বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বললে বলতে হয় বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ যে খুব অন্ধকার, তা কিন্তু নয়। কবিরা আছেন, সাহিত্যিকরা আছেন এবং বাংলা ভাষার নিত্যনতুন সৃষ্টি হয়ে চলেছে। আর এর প্রাচীন ইতিহাস ও বিস্তৃতি তো অনেক বিশাল। সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ হয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও সেলিনা হোসেন যে নামই বলি না কেন, ভাষার চর্চা চলছে। ফলে আমি বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব একটা চিন্তিত নই।
তবে আমি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত, সেটা হলো পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সাহিত্য মানুষের কাছে কতটা পৌঁছাচ্ছে? আমাদের ভাষা কতটা তার মর্যাদা বজায় রাখতে পারছে? অর্থাৎ ভারতে বা বাংলাদেশে আমরা যে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছি, তাতে বাংলা ভাষার প্রতি তাদের একটা অবহেলা দেখা যাচ্ছে। তাদের কাছে ইংরেজি ভাষার যতটা মর্যাদা আছে, বাংলা ভাষার মর্যাদা ততটা নেই। তাই এটা তারা পড়তে চায় না। এই বিষয়টা নিয়েই দুশ্চিন্তা বেশি হয়।
এই বিষয়টা থেকে উত্তরণ খুব জরুরি। একুশে ফেব্রুয়ারি একটা চর্চায় চলে এসেছে। কিন্তু এই এক দিনের জন্য আমরা বাঙালি হই। বছরের বাকি ৩৬৪ দিনই আমরা অতটা বাঙালি থাকি না।
কিন্তু আমাদের ভাষায়ও সবকিছু হতে পারে। এখানে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ দুটোর কথাই বলছি। তারা যদি মাতৃভাষায় সব শিক্ষাটা দিতে পারে এবং সেই সঙ্গে জীবিকার ভাষা বাংলা হয়, তাহলে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্য কারণেও বাংলা শেখার দরকার আছে; ধর্মের জন্য, সাহিত্যের জন্য। কিন্তু জীবিকার ভাষা, অর্থনীতির ভাষা, রাজনীতির ভাষা যতদিন বাংলা না হচ্ছে, ততদিন কিন্তু বাংলা ভাষার যথাযথ সম্মান হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ১৯৭৪ সালের রাষ্ট্রসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবছরই রাষ্ট্রসংঘে বাংলায় ভাষণ দিচ্ছেন, সেটা একটা মর্যাদা দেয় এবং সেটা মানুষ তাকিয়ে দেখে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বাংলা ভাষাকে একটা মর্যাদা দিয়েছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে অস্তিত্বের সংকটে থাকা পৃথিবীর সমগ্র ভাষার একটা যোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু শিক্ষায় ও জীবিকায় সেই মর্যাদাটা যদি আমরা দিতে না পারি, তাহলে মর্যাদাটা পরিপূর্ণ হবে না।
বিশ্বমণ্ডলীতে বাংলা ভাষাকে আমরা যতটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছি, সাহিত্যটা আমাদের সেভাবে পৌঁছাচ্ছে না। এ নিয়ে আমার একটু অভিমান রয়েছে। আমাদের মধ্যে যারা বিদেশি ভাষা শিখেছেন, ইংরেজি নবিশ কত তৈরি হয়েছে। ফরাসি জানেন আরবি জানেন স্প্যানিশ জানেন, এমন প্রচুর আছেন, তারা কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে বাংলা ভাষার অনুবাদটা করেননি। এই অনুবাদটি যদি তারা করতেন! এখন অনেকেই মন দিয়ে অনুবাদ করছেন, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশে অনুবাদকের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু অনেক আগ থেকেই ধারাবাহিকভাবে যদি অনুবাদটা করা হতো কিংবা এখনো যদি করা হয়, তাহলে বাংলা ভাষার সাহিত্য অনেকটা দূর গিয়ে পৌঁছাবে।
এ বিষয়ে আমি গত বছর শাপলা পত্রিকার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুবাদের জন্য আলাদা সেল থাকা প্রয়োজন। এবং এই অনুবাদের সেলে কোনো অপচয় হবে না। এটা বাইরের লোকের লেখাও অনুবাদ করতে পারবে, কিছু নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে। তখন কিন্তু অনেকেই অনুবাদ করাতে আসবেন। বাংলা ভাষার চর্চায় এবং বাংলা সাহিত্যের বিকাশে এই সেলগুলো বেশ কার্যকরী একটা অবদান রাখতে পারবে। আর এরই সঙ্গে বাংলা একাডেমির সেলটাকে যদি আরও শক্তিশালী করা হয় এবং সরকার নিজে স্বতন্ত্রভাবে যদি একটা অনুবাদ একাডেমি করে, তাহলে তো আরও ভালো হবে।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার চর্চার যে বিষয়টা একটু সংকুচিত হয়ে আসছে, সেটার জন্য আসলে আন্দোলন হচ্ছে। তবে আন্দোলনটা যতটা আবেগের জায়গা থেকে হচ্ছে, কার্যকরী ব্যবস্থার দিক থেকে আসলে ততটা হচ্ছে না। সেখানেও কিন্তু সরকার ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল করার জন্য এগোচ্ছে। সেটা ওই সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য। কিন্তু এটা আমি সব সময়ই বলি, আগেও বলেছি, বাংলাদেশেও বলেছি, মাতৃভাষাটা সর্বস্তরে শেখানোর পাশাপাশি ইংরেজি বা অন্য যেকোনো ভাষায় যেটাকে জরুরি বলে মনে করব, সমান গুরুত্ব দিয়ে শেখানো উচিত। এটাও আমি সব সময় বলি যে সাহিত্য দরকার নেই, বলার ভাষা লেখার ভাষাটা আগে শেখো, সাহিত্য নিজেরাই পড়ে নেবে।
সাহিত্যের জন্য আলাদা করে ইংরেজি ভাষায় শেক্সপিয়ারের লাইন তুলে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।
বরং স্বাধীনভাবে ভাষা শেখার জন্য যেমন আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট আছে, তেমন আরও কিছু ইনস্টিটিউট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে করা যেতে পারে। অর্থাৎ ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। যেখানে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সব ভাষাই শেখানো হবে।
অনেক কাল আগেই রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছিলেন মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা। কিন্তু এতকাল পরও আমরা তা করতে পারিনি। এর পেছনে অভিভাবকদেরও একটা দায় আছে। তারা মনে করেন ইংরেজি ভাষা শিখতে না পারলে জীবনটা বৃথা হয়ে গেল। ইংরেজি জানা থাকলে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলার প্রতি অভিভাবকরা সেই গুরুত্বটা দেন না। এই মানসিকতাটা বদলাতে হবে।