সারা বছর উপেক্ষিত থাকলেও ফেব্রুয়ারি মাস এলে ভাষাশহিদ আব্দুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের কথা মনে পড়ে। শুরু হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সাজসজ্জার কাজ। বছরের বাকি সময়ে প্রাণহীন থাকে এই গ্রন্থাগার। ভাষাশহিদ আব্দুস সালামের জন্মস্থান সালামনগরকে নতুন সাজে সাজিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হবে। এ লক্ষ্যে ফেনী-নোয়াখালী সড়কে তোরণ নির্মাণসহ একটি শিশুপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে ফেনী জেলা পরিষদ।
ভাষাশহিদ আব্দুস সালাম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর ফেনীর দাগনভূঁঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের লক্ষ্মণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে অংশ নেন তিনি। পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রায় দেড় মাস পর ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার নামানুসারে লক্ষ্মণপুর গ্রামের নাম রাখা হয় ‘সালামনগর’।
ফেনী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খায়রুল বশর মজুমদার তপন জানান, ভাষাশহিদ সালাম স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করে পর্যটন এলাকা প্রতিষ্ঠা করা গেলে সারা বছর প্রাণচঞ্চল থাকবে সালামনগর। পাঠক ও পর্যটকদের উপস্থিতি বাড়িয়ে সরব রাখতে ও ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কে তোরণ ও ম্যুরাল নির্মাণ করা হবে এবং গ্রন্থাগারে নতুন বই দেওয়া হবে।
২০০৮ সালের ২৬ মে শহিদের স্মৃতি রক্ষায় ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নে সালামনগরের প্রবেশমুখে ফেনী জেলা পরিষদের অর্থায়নে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। জাদুঘরে ভাষাশহিদের একটি ছবি ছাড়া অন্য কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। দর্শনার্থী ও স্থানীয়দের দাবি ফেনী-মাইজদী মহাসড়কের পাশে সালামনগরের প্রবেশ নির্দেশক তোরণ ও ম্যুরাল নির্মাণ। এলাকাবাসী চান, এখানে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশুপার্ক প্রতিষ্ঠা করা হোক।
ভাষাশহিদ সালাম স্মৃতি পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ সাহাদাত হোসেন বলেন, ভাষাশহিদদের নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য ভাষাশহিদ সালাম পরিষদ গঠন করা হয়েছে। প্রতিবছর শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, হাতের সুন্দর লেখার প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এসবের মাধ্যমে শিশুরা সব ভাষাশহিদ সম্পর্কে জানতে পারে।
ভাষাশহিদ আব্দুস সালামের পাশের বাড়ির বাসিন্দা ইফতেখার বলেন, স্থানীয় জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক বছরে এলাকার রাস্তাঘাট, কালভার্ট নির্মাণসহ অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রন্থাগারে নতুন বই দিয়ে আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে এক দিন গ্রন্থাগারটি পরিদর্শনে আনা গেলে গ্রন্থাগারের শতভাগ সফলতা পাওয়া যাবে, এমন আশা করা যায়।
সাহিদা সাম্য লীনা নামের এক দর্শনার্থী বলেন, গ্রন্থাগারের পাশে ফেনী ছোট নদীর পাড়ে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। সেখানে একটি শিশুপার্ক স্থাপন করা হলে সারা বছর সালামনগরে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধি পেত। শিশুপার্ককে কেন্দ্র করে মানুষ এলে গ্রন্থাগারটি মুখরিত থাকতে পারত।
ভাষাশহিদ আব্দুস সালামের ভাতিজা মিয়াদন বলেন, সালামনগরে অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। ভাষাশহিদ আবদুস সালামের নামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হলে এলাকার মানুষ উপকৃত হতেন। কারণ আশপাশে কোথাও কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। চিকিৎসাসেবা পেতে এলাকাবাসীকে দূরদূরান্তে যেতে হয়।
গ্রন্থাগারিক লুৎফুর রহমান বাবলু জানান, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই গ্রন্থাগারে তিন হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য, এই গ্রন্থাগারটিতে শুধু ভাষার মাস এলেই মানুষের আনাগোনা বাড়ে। বাকি ১১ মাস কেউ কোনো খবর রাখেন না এবং গ্রন্থাগারে আসেন না। এই গ্রন্থাগারটিকে জনসম্পৃক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে বই পড়ে নতুন প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষ ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারতেন এবং গ্রন্থাগার স্থাপনের সুফল পাওয়া যেত।
ভাষাশহিদ সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) প্রধান শিক্ষক আঁখি রানী দাস বলেন, ‘আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি ভাষাশহিদ সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ করা হলেও গেজেট হয়নি। ফলে কাগজে-কলমে নাম এখনো লক্ষ্মণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই রয়ে গেছে।’
দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন জানান, বছরের ১১ মাস ভাষাশহিদ আব্দুস সালাম গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটি নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে। এই গ্রন্থাগারটির জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাপ্তাহিক বা মাসিক পরিদর্শন করানো যায় কি না, সে বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তাহলেই এই গ্রন্থাগারটির জনসম্পৃক্ততা বাড়বে এবং গ্রন্থাগারে থাকা বিভিন্ন বই পড়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ভাষাশহিদদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, গ্রন্থাগারের পাশে ফেনী ছোট নদীর পাড়ে কিছু জায়গা রয়েছে। সেগুলো অধিগ্রহণ করে বিনোদন স্পট হিসেবে একটি শিশুপার্ক করা যায় কি না, সে বিষয়ে পৌরসভার সঙ্গে আলোচনা করা হবে। যদি বিনোদন স্পট হিসেবে শিশুপার্ক করা যায়, তাহলে সারা বছর উজ্জীবিত থাকবে। মানুষ আসবেন, সালামের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।
ভাষাশহিদ কোটা এবং সালামের কবর সংরক্ষণের দাবি পরিবারের
ভাষাশহিদ আব্দুস সালামের ভাতিজা নুরে আলম দৈনিক খবরের কাগজের মাধ্যমে ভাষাশহিদদের পরিবারের জন্য কোটা প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হলেও ভাষাশহিদদের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে কোটা থাকলেও ভাষাশহিদদের ক্ষেত্রে নেই। তিনি কোটা সংরক্ষণের দাবি জানান। যদি কোটা সংরক্ষণ করা হতো, তাহলে স্কুল, কলেজ, সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে এসব কোটা ব্যবহার করার সুযোগ পেত ভাষাশহিদদের পরিবার।
সালামের কবর সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, ছয় বছর আগে আজিমপুর গোরস্তানে সালামের কবর চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কবরটি সংরক্ষণ করা হয়নি।