বগুড়ায় পুণ্ড্রনগর ও মহাস্থান জাদুঘর পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হলেও অর্থাভাবসহ নানা সমস্যার কারণে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে পারছে না প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্ভাব্য তালিকায় থাকা এ সাইটটিতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ দর্শক ও পর্যটক আসেন। কিন্তু তাদের থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই।
জাদুঘরসংলগ্ন এলাকায় একটি ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণ করা হলেও সেটি চালু হচ্ছে না। হাইকোর্টের নির্দেশে নিরাপত্তার জন্য ২০১১ সালে পুলিশ মোতায়েন করা হলেও তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল। এ অবস্থায় নিরাপত্তার অভাবে এ সাইটের অনেক স্থানেই দর্শক-পর্যটকরা যেতে তেমন একটা উৎসাহবোধ করেন না।
দক্ষিণ এশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন এ দুর্গনগরী ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট হিসেবে গেজেটভুক্ত করার পর ১৯৬৭ সালে জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। ৪৪টি শোকেসে ৮২৮টি প্রত্নবস্তু বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রাখা হলেও গুদামে পড়ে আছে অন্তত ৩ হাজার প্রত্নবস্তু। জাদুঘরে রাখার স্থান না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সব নিদর্শন পড়ে আছে গুদামে। দর্শকদের একই প্রত্নবস্তু দেখতে হচ্ছে বারবার।
‘মহাস্থান জাদুঘর’এর কাস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতানা জানান, দুর্গনগরীর খুব কাছে আন্ততবালা এলাকায় গেস্ট হাউস, ডরমিটরি, পার্কিং, নতুন জাদুঘর নির্মাণসহ ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে ৬ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যেই ৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আরও আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দর্শক পর্যটকদের থাকা খাওয়ার সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে। সাইট এলাকায় নিরাপত্তাও বাড়বে। আগে একটি প্রকল্পের আওতায় ক্যাফেটেরিয়াসহ আরও যেসব অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোও দুর্গনগরীসংলগ্ন এবং দর্শকদের সুবিধার জন্য অনেক আগেই খুলে দেওয়া হয়েছে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, পর্যটন করপোরেশন ক্যাফেটেরিয়া চালু করে লোকসান গুনে প্রায় এক বছর আগে বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় ওই সাইটে এখন খাবার পাবার কোনো সুযোগ আপাতত নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন কয়েক মাস আগে দুর্গনগরীতে বেড়ানোর সময় তার পরিবারের সদস্যরা ইভটিজিংয়ের শিকার হন। জাদুঘরসংশ্লিষ্টরাও জানান, বখাটেদের দৌরাত্ম্যের কারণে অনেকেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আবদুল খালেক জানান, বিভিন্ন সময় খননে পাওয়া গেছে মৌর্যপূর্ব, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম আমলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বেশ কয়েক বছর আগে দুর্গনগরীর দক্ষিণ দিকে ফ্রান্স ও বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকরা খনন করে পান একটি মন্দির, ইটবিছানো রাস্তাসহ আরও অবকাঠামো। এর আগেও দুর্গনগরীর ভেতরে খননের সময় ফ্রান্স ও বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকরা একটি মাটির প্রাচীন চুলা পান। পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মাটির এ চুলাটির বয়স অন্তত ২ হাজার ৪০০ বছর অর্থাৎ যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ৪০০ বছর আগে নির্মিত।
তিনি আরও জানান, খননে পাওয়া গেছে পঞ্চমার্ক কয়েন, পোড়ামাটির ফলক, প্রাচীন ইটের দেয়ালসহ অনেক অবকাঠামোর পাশাপাশি নানা ধরনের নিদর্শন। আবদুল খালেক খবরের কাগজকে বলেন, বিভিন্ন সময় দুর্গনগরী ও তার আশেপাশের এলাকায় খননে পাওয়া নিদর্শন থেকে প্রমাণ হয়েছে এখনে মৌর্যপূর্ব, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম আমলের ধারাবাহিকতা আছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সাইট উন্নয়নে কয়েক বছর আগে এক হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যার মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণসহ পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই করা সম্ভব হয়নি অর্থের অভাবে। দেশি-বিদেশ পর্যটকরা মনে করেন প্রায় ৩৪ লাখ ৫৯ হাজার ২৫৫ বর্গমিটার মিটার আয়তনের এ সাইটের ভেতর ও বাইরে খননে যা পাওয়া গেছে, সেসব নিদর্শন জাদুঘরে রাখা সম্ভব হলে পর্যটক ও দর্শকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়বে।
তাদের দাবি, প্রত্নবস্তুর সঙ্গে একটি করে সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকা প্রয়োজন, যাতে দর্শক ও পর্যটকরা সহজেই বুঝতে পারেন নিদর্শনটি কী এবং কোথায় ছিল, কীভাবে পাওয়া গেছে এবং তার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব কতখানি। এখন জাদুঘরে রাখা নিদর্শনগুলোর পাশে শুধু লেখা আছে শতাব্দী ও নাম, যা থেকে ওই নিদর্শন সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। দুর্গনগরীর ভেতর ৩৯৩ একর জমির মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের জমি আছে মাত্র ৮৬ একর। বাকি সব জমিই ব্যক্তিগত।
এ কারণে যার যখন যেমন প্রয়োজন, তিনি সেভাবেই নির্মাণ করছেন তার বাড়িঘর আর অবকাঠামো। অথচ হাইকোর্টের নির্দেশ আছে প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া কোনো খনন বা অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না।
স্থানীয় জনসাধারণের অনেকেই এ আদেশ লঙ্ঘন করে নির্মাণ করেছেন অনেক বাড়িঘর। ফলে সাইটটি হারিয়েছে স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য। ফসল আবাদ বা অন্যান্য কারণে খনন করা হচ্ছে সাইটের ভেতরে থাকা জমি।