রাজধানীর বেইলি রোডে এতিহ্যবাহী ইফতার বাজারের অভিজাত নানা পদের মুখরোচক খাবারের পসরা সাজিয়েছেন দোকানদাররা। কিন্তু সেই চিরচেনা রূপ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। বন্ধ রয়েছে একাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁ। ইফতার বাজারে অনেকটাই ক্রেতাশূন্য। তার পরও প্রতিবছরের মতো এবারও বেইলি রোডে ‘কাবাব’-এর প্রতি বেশি আকর্ষণ ক্রেতাদের। এ ছাড়া আরও অর্ধশতাধিক বাহারি ও অভিজাত ইফতারের খাবার রয়েছে।
‘বেইলি বারবি কিউ রেস্তোরা’য় ইফতার কিনতে এসেছেন বেইলি রোডের বাসিন্দা মিসেস দিলারা বেগম। তিনি একজন গৃহিণী, প্রতিবছরই এখান থেকে বাসার ইফতার কেনেন। দিলারা বেগম বলেন, বেইলি বোডের ‘কাবাবে’ বিশেষ স্বাদ রয়েছে। এ ছাড়া অভিজাত নানা পদের ইফতারের খাবারের জন্য সেরা। তিনি বলেন, এবার ইফতারের দাম অনেক বেশি। আগুন লাগার পর এই এলাকায় বাসিন্দা থেকে সবাই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
বুধবার (১৩ মার্চ) বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেইলি রোড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অন্যবারের তুলনায় এবার ইফতারে রমরমা আয়োজন নেই। সড়কের দুই পাশে বসেনি কোনো ইফতারের দোকান। ফখরুদ্দীন বিরিয়ানি, সুলতান’স ডাইনিস, চিলক্স, বার্গার এক্সপ্রেস, ক্যাফে জেলাটেরিয়া, সেশিয়েট, নবাবি ভোজ, ভূতের আড্ডাসহ অধিকাংশ রেস্তোরাঁ এখনো বন্ধ রয়েছে। অন্য যারা রেস্তোরাঁ খুলেছেন তারাও ভয়ে ভয়ে চালাচ্ছেন। হাত গ্লোভসসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করছেন। তবে হাঁকডাক দিয়ে ক্রেতাদের নজর কাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। রেস্তোরাঁগুলোতে দেখা যায়নি ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। কমেছে ইফতার খাবারের নানা পদও।
রমজানের দ্বিতীয় দিনে বেইলি রোডে ইফতারির বাজারে এসেছেন আরিফ হোসেন। তিনি মগবাজারের একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত। খিলগাঁও এলাকার এ বাসিন্দা বলেন, রমজানে প্রতিবছরই বেইলি রোড থেকে ইফতার কেনা তাদের পরিবারের রীতি। বাড়ির মুরুব্বি থেকে শুরু করে ছোট বাচ্চারা সবাই এখানকার ইফতারি পছন্দ করে। তবে গতবারের তুলনায় এবার লোকজন অনেক কম বলেও জানান।
ব্যবসায়ীরা জানান, বিগত দুই-তিন বছরের তুলনায় এবারই ইফতার বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। ক্রেতা নেই বললেই চলে। মঙ্গলবার প্রথম রমজানেও একই অবস্থা ছিল। তাদের ভাষ্যমতে, সম্প্রতি বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর অনেকেই আতঙ্কে এদিকে আসছেন না। এর পর থেকেই বেইলি রোডের ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু রেস্তোরাঁও বন্ধ রয়েছে। ক্রেতাদের মধ্যেও আতঙ্ক কাটেনি। যার প্রভাব পড়েছে ইফতার বাজারে। তবে দ্রুত বেইলি রোডের ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হওয়ার আশায় আছেন তারা।
বিগত বছরের মতো এবারও বেইলি রোডের ইফতার বাজার সেজেছে অভিজাত বাহারি ইফতারির সাজে। রেস্তোরাঁভেদে এসব ইফতারির খাবারের দামের পার্থক্য রয়েছে। চিকেন হাজারি ও হারিয়ানি ৩২০-৩৫০ টাকা, চিকেন আচারি ৩১০ টাকা, চিকেন টিকা ২৯০ টাকা, চিকেন কটি ২৯০ টাকা, চিকেন টেংরি ৯০ টাকা, চিকেন গুল কাবাব ৩৯০ টাকা, চিকেন কাটলেট ১২০ টাকা, আস্ত মুরগির রোস্ট ৫০০-৬০০ টাকা, খাসির লেগ পিসের রোস্ট ৬০০-৭০০ টাকা, বোম্বে জিলাপি ৪০০, রেশমি জিলাপি ৫০০-৬০০ টাকা, সুতিকাবাব ১ হাজার ৬০০ টাকা, বিফ মমো ৫০ টাকা, বিফ শর্মা ১৫০ টাকা, জালি কাবাব, চিকেন কাবাব, কাজলা ১০০ টাকা, ডাবের পুডিং ছোট ১০০ টাকা ও বড় ৩৫০ টাকা, গরুর চপ, কালা ভুনা, মোরগ পোলাও ২৮০ টাকা, তেহারি ২৯০ টাকা, ফালুদা, দইবড়া, হালিম, পনির সমুচা ৪০ টাকা, ফিশ ফিঙ্গার ৯০ টাকা, নার্গিস কাবাব ৪০ টাকা, চিকেন রোস্ট ৩০ টাকা, চিকেন কিমা পরোটা, চিকেন কোফতা, তুলাম্বা ৪০০ টাকা কেজি, ফিশ বল ৮০ টাকা, গাজর হালুয়া ৭০ টাকা, প্রোন ফ্রাই ৮০ টাকা, চিকেন ডামোস্টিক ৭০ টাকা, শরবতহ অর্ধশতাধিক পদের বাহারি ও অভিজাত খাবার।
বেইলি বারবি কিউ রেস্তোরাঁর ম্যানেজার সুরঞ্জিত জয়দার বলেন, আগুন লাগার পর থেকেই অনেক রেস্তোরাঁ বন্ধ আছে। আগুন লাগা ও রেস্তোরাঁ বন্ধের প্রভাব পড়েছে ব্যবসার ওপর। ইফতার বেচাবিক্রি খুবই কম। ক্রেতারা যারা আসছেন তারাও দ্রুত খাবার নিয়ে চলে যান। তিনি বলেন, বেইলি রোডে কাবাব, বারবি কিউ ও জিলাপির চাহিদা বেশি।
১৯৮০ সাল থেকে বেইলি রোডে ইফতার বিক্রি করে আসছে ক্যাপিটাল ইফতার বাজার। এর স্বত্বাধিকারী মো. এহেসান উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘এবার বিক্রি অনেক কম। সর্বশেষ কবে এমন দশা হয়েছে জানা নেই। লোকজন আতঙ্কে এদিকে আসছেন না। তবে প্রথম দুই দিন গেল, এখনো রমজানের অনেক সময় আছে। আশা করি লোকজন আসবেন। গতবারের মতো এবারও ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছি।’
এখনো বেইলি রোড দিয়ে যাওয়ার সময় পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের সামনে থামছেন সাধারণ পথচারীরা। ভবনের নিচেও পুলিশের অবস্থান দেখা গেছে। ব্যবসায়ীদের অস্বস্তি এখনো কাটেনি। বিপাকে পড়েছেন বন্ধ থাকা রেস্তোরাঁর মালিকরা।
বেকারি দোকান হলেও প্রতিবছরের মতো এবারও বাহারি ইফতারের খাবারের পসরা সাজিয়েছে এ ওয়ান। দোকানের মালিক মো. পারভেজ বলেন, এই এলাকার বাসিন্দারাও ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। তার পরও প্রথম দিন ও আজ (বুধবার) মোটামুটি বিক্রি হয়েছে। খাবারের তালিকাও এবার ছোট করা হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে এবারই কম বিক্রি হয়েছে বলেও জানান।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের আগুনে পুড়ে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এর পর থেকেই সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে রয়েছে।