ঐতিহাসিক স্মৃতিজড়ানো প্রাচীন এক জনপদের নাম সোনারগাঁ। এই অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনা আর স্মৃতি-বিস্মৃতির আনন্দ-বেদনার উপাখ্যান। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সোনারগাঁ ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের রাজধানী।
বছরভর দেশি-বিদেশি অতিথি পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে সোনারগাঁয়ে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার গড়ে আট থেকে দশ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। অনেকে আসেন সবান্ধব, সপরিবারে। সপ্তাহের অন্যান্য দিনে গড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ এখানে আসেন ঐতিহ্যের আলোয় স্নাত হতে।
মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যাসহ বিভিন্ন নদ-নদী বিধৌত এই অঞ্চল যুগ যুগ ধরেই ছিল অজেয়। প্রকৃতিগত কারণেই বহির্শক্তির আক্রমণ থেকে সোনারগাঁ ছিল নিরাপদ এবং সুরক্ষিত। তাই স্বাধীন সুলতানগণ বাংলার রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁকে বেছে নিয়েছিলেন। মোগল সেনাপতিরা বারবার সোনারগাঁ আক্রমণ করতে এসে পরাজিত এবং পর্যুদস্ত হয়েছিলেন।
ষোল শতকের শেষার্ধে বাংলার বার ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর আমলে সোনারগাঁ গৌরব এবং সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে। ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে এখন আর রাজপাট বা রাজত্ব কিছুই নেই। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় কিছু পুরোনো অট্টালিকা, জরাজীর্ণ প্রাসাদ, মসজিদ, মিনার, সমাধি সৌধ ইত্যাদি। অথচ এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘিরেই সুদূর অতীতে ঘটেছিল নানা জমজমাট ঘটনা, রচিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীন শাসকদের শৌর্য-বীর্য আর প্রাচুর্যের উপাখ্যান। এক সময়কার ঐশ্বর্যমণ্ডিত আজকের জীর্ণ-পরিত্যক্ত পানাম নগরী তার অন্যতম স্মৃতি স্মারক। সোনারগাঁয়ে আকাশে-বাতাসে, জরাজীর্ণ প্রতিটি অট্টালিকার ইটের পরতে পরতে আজও যেন ধ্বনিত স্পন্দিত হয় বাংলার গৌরবময় রোমাঞ্চকর ইতিহাসের চাপা দীর্ঘশ্বাস।
সুবর্ণগ্রাম বা সোনারগাঁও নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। নারায়ণগঞ্জ থেকে আট মাইল উত্তর-পুবে পুরাতন মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আজকের সোনারগাঁ বা সুবর্ণ গ্রাম। সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া একসময় আন্তর্জাতিক নদীবন্দর হিসাবে পরিগণিত ছিল। এই কারণে মুসলিম শাসকদের আমলে সোনারগাঁ অত্যধিক বাণিজ্যিক গুরুত্ব লাভ করে। সে সময় এখানে সমুদ্রগামী জাহাজও ভিড় জমাত। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনেবতুতা, ফা হিয়েন এবং হিউয়েন সাং বঙ্গদেশ সফরে এসে এই মোগড়াপাড়া ঘাটেই অবতরণ করেছিলেন।
রানি প্রথম এলিজাবেথের দূত রালফ ফিস পনেরো শতকের শেষ দিকে সোনারগাঁয়ে এসেছিলেন। তিনি সোনারগাঁয়ের মসলিন বস্ত্রকে জগতের সর্বাপেক্ষা মিহি বলে অভিহিত করেন। পাল বংশ এবং সেন বংশের হিন্দু নৃপতিগণসহ সোনারগাঁ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুসলিম শাসক এবং সুলতান কর্তৃক শাসিত হয়। তবে সোনারগাঁয়ের সাফল্য সমৃদ্ধি পরিচিতি এবং সুখ্যাতির শেষ নায়ক ছিলেন বীর ঈশা খাঁ। তাই সোনারগাঁয়ের সঙ্গে ঈশা খাঁর নামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
বাংলার বার ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিলেন ঈশা খাঁ। তার পিতা রাজপুত বংশোদ্ভূত কালিদাস গজদানী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সোলায়মান নাম ধারণপূর্বক সোনারগাঁয়ের জমিদারি লাভ করেন। তার মৃত্যুর পর লোকশিল্প জাদুঘরে (সর্দারবাড়ী) সুযোগ্য পুত্র ঈশা খাঁ উত্তরাধিকার সূত্রে সোনারগাঁয়ের শাসনভার হাতে নেন। বর্তমানের ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ এবং পাবনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার শাসনাধীনে ছিল। পূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলের বিখ্যাত জমিদার ঈশা খাঁ দীর্ঘকাল ধরে দের আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেন। তার বিরুদ্ধে প্রেরিত বহু সুদক্ষ সেনাপতি তাকে দমন করতে ব্যর্থ হন। রাজা মানসিংহ তার সঙ্গে যুদ্ধে পর্যুদস্ত হন। মানসিংহের পুত্র দুর্জন সিংহ বিক্রমপুরের অনতিদূরে সংঘটিত এক যুদ্ধে ঈশা খাঁর হাতে পরাজিত ও বন্দি হয়ে পরে মৃত্যুবরণ করেন। শেষ জীবনে ঈশা খাঁ সম্রাট আকবরের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন।
১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈশা খাঁর মৃত্যু হলে তার পুত্র মুসা খাঁ পিতার আসনে সমাসীন হন। তিনিও দের অনেক আক্রমণ বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেন। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে সুবেদার ইসলাম খাঁর কাছে তিনি পরাস্ত হন। ইসলাম খাঁর সময় ঢাকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকলে ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক নগরী সোনারগাঁয়ের পতন ঘটে। ইসলাম খাঁ পতনোন্মুখ সোনারগাঁয়ের বদলে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করেন।
ভুবনমোহিনী মসলিন- অত্যন্ত মিহি সুতোর তৈরি মসলিন বস্ত্রের জন্য একসময় সারা বিশ্বের নজর ছিল সোনারগাঁয়ের দিকে। প্রচণ্ড কদর ছিল মসলিনের। এখান থেকে বিভিন্ন পণ্যাদি সে সময় বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানি হত। পানাম নগরের অতি কাছে খাসনগর দিঘী আজও যেন হারিয়ে যাওয়া মসলিনের বিস্মৃতি ও অনুশোচনার তাপে দগ্ধ। এই দিঘীর চারপাশে কারিগররা টানা দিতেন দীর্ঘ মসলিন সুতার। এই সুতা কখনো কখনো ১৭৫ হাত পর্যন্ত লম্বা হতো। বহিরাগত বণিক, লেখক এবং পরিব্রাজকরা মসলিন সম্পর্কে অনেক প্রশংসনীয় মন্তব্য করেছেন।
সে আমলে বাংলার সুবেদারগণ বাদশাহদের কাছে উপঢৌকন হিসেবে মসলিন বস্ত্র পাঠাতেন। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান মসলিনের একজন মুগ্ধ অনুরাগী ছিলেন। পানাম নগর ছিল মসলিন শিল্পের প্রসিদ্ধ বাজার। এখান থেকে এশিয়া, ইউরোপ এমনকি সুদূর আফ্রিকাতেও মসলিন রপ্তানি করা হতো। অতীতের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী মসলিনও। যেখানে মসলিন শিল্প আন্তর্জাতিক বাজার পেয়েছিল; সে শিল্পের অপমৃত্যুর কথা ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। ইংরেজ আমলের শেষ দিকেই মসলিন শিল্প নিঃশেষিত হয়। জনশ্রুতি আছে, মসলিন শিল্পের ক্রমবিকাশে ঈর্ষান্বিত হয়ে ইংরেজ সরকার তাদের পতনের আগে মসলিন কারিগরদের আঙুলের অগ্রভাগ কেটে দিয়েছিল, যাতে তারা আর মসলিন বুনতে না পারেন।
প্রাচ্যের ব্যাবিলনখ্যাত পানাম নগরী-পানাম ছিল সোনারগাঁয়ের অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগরী। বাংলার ঐতিহ্য মসলিন শিল্পকে ঘিরে এই নগরী গড়ে উঠেছিল। ঐতিহ্যবাহী পানাম নগরের কারুকার্যমণ্ডিত ইমারতগুলোর অধিকাংশ অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। কালের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে যে কয়েকটি ইমারত এখনো অবশিষ্ট আছে, সেগুলো থেকে ক্রমেই খসে পড়ছে ইট, চুন, সুরকি ও পলেস্তরা। প্রায়ই ধসে পড়ছে কোনো না কোনো প্রাসাদ, মুখ থুবড়ে পড়ছে ভবনের ছাদ। চুরি হয়ে যাচ্ছে প্রাচীন স্থাপত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। পুরাকীর্তি গুঁড়িয়ে ফেলে গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। পাচার হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান পাথর, সমাধিস্থলের দুর্লভ স্মৃতিফলক।
ঐতিহ্যমণ্ডিত এবং ঐতিহাসিক এই স্থাপনাগুলো অনতিবিলম্বে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে সচেতন সুধীমহল মনে করেন। সেই সঙ্গে এই পুরাকীর্তিগুলো তার পুরোনো কাঠামো এবং আদলেই সংস্কার ও সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন, নয়তো যে কয়েকটি স্থাপনা এখনো অবশিষ্ট আছে, একসময় তার শেষ চিহ্নটুকুও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাবে এক ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ নগরীর গর্বিত ইতিহাস।
লোকশিল্প জাদুঘর: শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং সরকারি সাহায্য ও সহযোগিতায় সোনারগাঁয়ের পানাম নগরী এলাকায় একটি লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের শিল্পকলা হচ্ছে লোক ও কারুশিল্প, যা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরাট উপাদান। অথচ আমাদের গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য প্রায় বিলুপ্তির পথে ছিল। এককালের পল্লীগীতি, জারি-সারি, ভাটিয়ালী গান, মুর্শিদী গান, পুঁথিপাঠের আসর, মরমী গানের সুর, আউল-বাউলের পদচারণায় মুখর গ্রাম বাংলা, মেলা উৎসবে দক্ষ কারিগরের হাতে গড়া, মাটিরপাত্র, চিত্রিত হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, খেলনা, পাতার বাঁশি, বাঁশের বাঁশি, পল্লীবালার হাতে বোনা নকশিকাঁথা, শীতল পাটি, হাতপাখা, নানা ধরনের সুচিকর্মসহ নানা লোকজ উপাদান যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। শিল্পাচার্যের স্বপ্ন ছিল এগুলো ধরে রেখে আমাদের আবহমান ঐতিহ্যের মর্যাদা দিতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ এক সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিপণন ও পুনরুজ্জীবনই হলো এই ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য। ১৯৭৬ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে পানাম নগরের একটি সরকারি রিকুইজিশন করা পুরোনো ভবন সংস্কার করে ওই ভবনেই লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের কাজ শুরু হয়।
গত ৪৮ বছরে ১৫০ বিঘা জমির ওপর লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে দুটি কারুশিল্প জাদুঘর রয়েছে। (১) লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর (সর্দারবাড়ী)। (২) শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। সর্দারবাড়ীতে স্থাপিত জাদুঘর ভবনে মোট ১০টি গ্যালারি রয়েছে। ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে স্থাপিত শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে মোট ২টি গ্যালারি রয়েছে। দ্বিতল এই আধুনিক ভবনটিতে জাদুঘর ছাড়াও রয়েছে ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক ভবন। জাদুঘরে মোট সংগৃহীত নিদর্শনের সংখ্যা ৪০১২, গ্যালারিতে প্রদর্শিত নিদর্শন ৯১২টি। স্টোরে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে ৩১০০টি।
লোক ও কারুশিল্পের ওপর গবেষণার প্রয়োজনে এখানে একটি আধুনিক লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টারও গড়ে তোলা হয়েছে। স্থাপত্য নকশা অনুযায়ী এখানে রয়েছে একটি কৃত্রিম আঁকাবাঁকা জলাশয়, যা গ্রামবাংলার খালের বৈশিষ্ট্যের আলোকে নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য সংবলিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও সৃষ্টি করা হয়েছে। নানা তরুলতা, পুষ্পপল্লব শোভিত এবং গাছগাছালি বেষ্টিত এই ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্সের সর্বত্রই গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিকল্পিত স্বাক্ষর চোখে পড়ে। বর্তমানে এই ফাউন্ডেশনে ৬০/৭০ কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। বিশাল আয়তনের এই কমপ্লেক্সের শাশ্বত লোকজ পরিবেশে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর লোক ও কারুশিল্প মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই মেলাকে প্রতি বছরই নানারূপে নতুন আঙ্গিকে শৈল্পিক সাজসজ্জায় উপস্থাপন করা হয়।