বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির উৎসব আনন্দে পুরো দেশ যেন ভাসছিল। আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে অন্য এলাকার মতোই বরিশাল শহরের কালীবাড়ি রোডের একঝাঁক কিশোর জড়ো হয়েছিলেন উদয়নী ক্লাবের সামনে। তারা সবাই উদয়নী ক্লাবের কিশোর সদস্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দের স্থায়ী রূপ দিতে একটি শহিদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা। পূর্বপরিকল্পনাহীন হঠাৎ সিদ্ধান্তে নির্মাণ করা হয়েছিল ছোট পরিসরের প্রথম স্থায়ী শহিদ মিনার।
১৯৭২ সালে তারা ওই শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সেই থেকে আইকনিক হিসেবে খ্যাত কালীবাড়ি রোডের উদয়নী ক্লাবের শহিদ মিনারটি। সেই কিশোরদের অনেকেই আজ আর নেই। পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। ১৯৭২ সালে নির্মিত শহিদ মিনারটি আজও আছে নগরীর কালীবাড়ি রোডে।
আইকনিক এই শহিদ মিনার নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কিশোরদের মধ্যে অন্যতম একজন এনামুল কবির পান্না। তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সাল। স্বাধীন দেশে বিজয়ের এক মাস পর হয়েছে কেবল। স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা ছিলাম আমরা। এক দিন উদয়নী ক্লাবের কিশোর সদস্যরা ক্লাবের সামনে একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভাষাশহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার স্থাপনের। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ে আনন্দকে স্থায়ী রূপ দিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে) অধ্যয়নরত উদয়নী ক্লাব সদস্য মানস কুমার মিত্র মণিদাকে শহিদ মিনারটির নকশা তৈরি করার অনুরোধ করা হয়। তিনি কয়েকটি নকশা তৈরি করেন। নকশাগুলো স্থানীয় মুরব্বিদের কাছে দেওয়া হয়। তারা আমাদের সঙ্গে নিয়ে একটি নকশা নির্বাচন করেন। পাশাপাশি শহিদ মিনারটি নির্মাণের পুরো দায়িত্ব মানস কুমার মিত্র মণিকে দেওয়া হয়। নকশা অনুযায়ী শহিদ মিনারটি বাস্তব রূপ লাভ করে।’
এই শহিদ মিনার নির্মাণে নেতৃত্ব ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহে সে সময় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত মো. মাহামুদ হোসেন বাদশা, প্রয়াত শুকলাল আচার্য, প্রয়াত শ্যামল আচার্য, প্রয়াত রতনলাল গুহ রিতন, প্রয়াত খোকন বসু, প্রয়াত পুলিন বিহারী মিত্র, আমান সেরনিয়াবাত, নিজামুল ইসলাম নিজাম, তপন লাল গুহ বংশ, নিতাই দত্ত, দুলাল ভট্টাচার্য, বাবুল নাগাসী, মোজাম্মেল হোসেন মানিক, বাবুল সেরনিয়াবাত, রিন্টু চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ বসু, অনুপম আচার্য, জামালউদ্দিন আহম্মেদ, মো. জাকির হোসেন, খোকন দাস কানাই, দীপক দত্ত, সমির দত্ত, কানাই দাম, স্বপন হালদার, মনোয়ার রহমান হারুন, কিরীটী মিত্র, মিহির ঘোষ বিষু, খোকন সিকদার, মো. আব্দুল হক, নন্দ চক্রবর্তী ও এনামুল কবির পান্নাসহ এলাকার আরও অনেক। সবার নাম মনে পড়ছে না।
তিনি আরও বলেন, ‘কিশোর বয়সে দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আনন্দ আমরা ধরে রাখতে পারছিলাম না। ওই সময়ে মনে হয়েছিল, দেশের জন্য, ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের জন্য শহিদ মিনার নির্মাণ করা যেতে পারে। তাই উদয়নী ক্লাবের কিশোর সদস্যরা আনন্দের বহিঃপ্রকাশের স্থায়ী নিদর্শনস্বরূপ এই মিনারটি প্রতিষ্ঠা করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সহযোগিতায় মানস কুমার মিত্র মণির করা নকশা অপরিবর্তিত রেখে ২০২৩ সালে শহিদ মিনারটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এই আইকনিক শহিদ মিনার দেশের একমাত্র অনন্য ব্যতিক্রমী স্থাপনা, যেটি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেবে আগামী প্রজন্মকে।’