ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বরিশাল কালীবাড়ি রোডে আইকনিক শহিদ মিনার

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:০০ এএম
বরিশাল কালীবাড়ি রোডে আইকনিক শহিদ মিনার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির উৎসব আনন্দে পুরো দেশ যেন ভাসছিল। আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে অন্য এলাকার মতোই বরিশাল শহরের কালীবাড়ি রোডের একঝাঁক কিশোর জড়ো হয়েছিলেন উদয়নী ক্লাবের সামনে। তারা সবাই উদয়নী ক্লাবের কিশোর সদস্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দের স্থায়ী রূপ দিতে একটি শহিদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা। পূর্বপরিকল্পনাহীন হঠাৎ সিদ্ধান্তে নির্মাণ করা হয়েছিল ছোট পরিসরের প্রথম স্থায়ী শহিদ মিনার। 

১৯৭২ সালে তারা ওই শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সেই থেকে আইকনিক হিসেবে খ্যাত কালীবাড়ি রোডের উদয়নী ক্লাবের শহিদ মিনারটি। সেই কিশোরদের অনেকেই আজ আর নেই। পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। ১৯৭২ সালে নির্মিত শহিদ মিনারটি আজও আছে নগরীর কালীবাড়ি রোডে। 

আইকনিক এই শহিদ মিনার নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কিশোরদের মধ্যে অন্যতম একজন এনামুল কবির পান্না। তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সাল। স্বাধীন দেশে বিজয়ের এক মাস পর হয়েছে কেবল। স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা ছিলাম আমরা। এক দিন উদয়নী ক্লাবের কিশোর সদস্যরা ক্লাবের সামনে একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভাষাশহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার স্থাপনের। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ে আনন্দকে স্থায়ী রূপ দিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে) অধ্যয়নরত উদয়নী ক্লাব সদস্য মানস কুমার মিত্র মণিদাকে শহিদ মিনারটির নকশা তৈরি করার অনুরোধ করা হয়। তিনি কয়েকটি নকশা তৈরি করেন। নকশাগুলো স্থানীয় মুরব্বিদের কাছে দেওয়া হয়। তারা আমাদের সঙ্গে নিয়ে একটি নকশা নির্বাচন করেন। পাশাপাশি শহিদ মিনারটি নির্মাণের পুরো দায়িত্ব মানস কুমার মিত্র মণিকে দেওয়া হয়। নকশা অনুযায়ী শহিদ মিনারটি বাস্তব রূপ লাভ করে।’ 

এই শহিদ মিনার নির্মাণে নেতৃত্ব ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহে সে সময় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত মো. মাহামুদ হোসেন বাদশা, প্রয়াত শুকলাল আচার্য, প্রয়াত শ্যামল আচার্য, প্রয়াত রতনলাল গুহ রিতন, প্রয়াত খোকন বসু, প্রয়াত পুলিন বিহারী মিত্র, আমান সেরনিয়াবাত, নিজামুল ইসলাম নিজাম, তপন লাল গুহ বংশ, নিতাই দত্ত, দুলাল ভট্টাচার্য, বাবুল নাগাসী, মোজাম্মেল হোসেন মানিক, বাবুল সেরনিয়াবাত, রিন্টু চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ বসু, অনুপম আচার্য, জামালউদ্দিন আহম্মেদ, মো. জাকির হোসেন, খোকন দাস কানাই, দীপক দত্ত, সমির দত্ত, কানাই দাম, স্বপন হালদার, মনোয়ার রহমান হারুন, কিরীটী মিত্র, মিহির ঘোষ বিষু, খোকন সিকদার, মো. আব্দুল হক, নন্দ চক্রবর্তী ও এনামুল কবির পান্নাসহ এলাকার আরও অনেক। সবার নাম মনে পড়ছে না।

তিনি আরও বলেন, ‘কিশোর বয়সে দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আনন্দ আমরা ধরে রাখতে পারছিলাম না। ওই সময়ে মনে হয়েছিল, দেশের জন্য, ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের জন্য শহিদ মিনার নির্মাণ করা যেতে পারে। তাই উদয়নী ক্লাবের কিশোর সদস্যরা আনন্দের বহিঃপ্রকাশের স্থায়ী নিদর্শনস্বরূপ এই মিনারটি প্রতিষ্ঠা করেছিল।’ 

তিনি বলেন, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সহযোগিতায় মানস কুমার মিত্র মণির করা নকশা অপরিবর্তিত রেখে ২০২৩ সালে শহিদ মিনারটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এই আইকনিক শহিদ মিনার দেশের একমাত্র অনন্য ব্যতিক্রমী স্থাপনা, যেটি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেবে আগামী প্রজন্মকে।’

চুইঝালের কদর চাহিদা বাড়ছে

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩৪ এএম
চুইঝালের কদর চাহিদা বাড়ছে
বাগেরহাটের চুইঝালের কদর বাড়ছে ভোজনরসিকদের কাছে। ছবি: খবরের কাগজ

বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চুইঝাল ব্যাপক জনপ্রিয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দিনদিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা এলাকায় জনপ্রিয় একটি মসলার নামও ‘চুইঝাল’। কয়েক টুকরো চুইঝাল মাংসের স্বাদ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংসের স্বাদ বাড়াতে এর জুড়ি নেই।

খাবারে স্বাদ বাড়ানোই শুধু নয়। ভেষজ গুণ থাকার কারণে অনেক রোগব্যাধি প্রতিরোধের কাজ করে চুইঝাল। বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে চুইঝালের।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. বিল্লাল হোসেন চুইঝালের নানা উপকারী দিক নিয়ে লিখেছেন। 

চুই লতাজাতীয় গাছ। এর কাণ্ড ধূসর এবং পাতা পান পাতার মতো, দেখতে সবুজ। চুইঝাল খেতে ঝাল হলেও এর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ। শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুলফল সবই ভেষজ গুণসম্পন্ন। মসলা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হাঁস ও গরুর মাংস রান্নায়। রান্নায় চুইঝালের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়।

চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল থাকে। এ ছাড়া রয়েছে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল ইত্যাদি। চুই এর শিকড়ে রয়েছে ১৩.১৫ শতাংশ পিপারিন।

খাবারের রুচি বাড়ানো ও ক্ষুধামান্দ্য দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে এটি। প্রচুর পরিমাণ আইসোফ্লাভোন ও অ্যালকালয়েড নামক ফাইটোক্যামিকাল রয়েছে যা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং ক্যানসার প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এটি হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। দূর করে পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ। তাছাড়া গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

চুইঝাল স্নায়বিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে। মানবশরীরের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা দূর করে শরীর সতেজ রাখতে সহায়তা করে। এটি ঘুমের ওষুধও বটে! শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে। প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা কমাতে চুইঝাল কাজ করে ম্যাজিকের মতো। চুইঝাল বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

বাগেরহাট সদরসহ জেলার বিভিন্ন বড় হাটে চুইঝালের ছোট-বড় স্থায়ী-অস্থায়ী দোকান রয়েছে। চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। সেই সঙ্গে বাড়ছে দামও। ভোজনরসিক মানুষের কাছে চুইঝালের কদর আগের তুলনায় বাড়ছে।

চুইঝাল বিক্রেতা কুদ্দুস শেখ বলেন, চাহিদা দিন-দিন বাড়ছে। ঈদসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনে চাহিদা বাড়ে সবচেয়ে বেশি। আগে যে চুই ৬০০ টাকা কেজিতে বাড়ি থেকে পাইকারি দরে কিনতাম, এখন সেই চুই কিনতে হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। তবে মূল চুইঝালের দাম আরও বেশি।

আরেক বিক্রেতা আব্দুস সোবাহান বলেন, হঠাৎ চুইঝালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় জাতের যে চুইঝাল আগে প্রতি মণ ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। মোটা ও মূল চুইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি। আমার কাছে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজির চুইঝাল রয়েছে।

চুইঝাল কিনতে আসা মারুফ হাওলাদার বলেন, চুইঝাল ছাড়া মাংসের তেমন স্বাদই পাই না। মাংস কিনলেই চুইঝাল কিনে নিই। ঢাকায় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও পাঠাতে হয়। আগের চেয়ে দামও বেড়েছে।

বাগেরহাট শহরের সবজি বাজারে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে শুধু চুইঝাল বিক্রি করছেন জামান শেখ। প্রতিদিন সকালে দোকান নিয়ে বসেন তিনি, থাকেন বাজার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তিনি বলেন, আগে চুইঝালের চাহিদা তেমন ছিল না। বেচা-বিক্রিও কম ছিল না। তবে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে, প্রতিদিন বিক্রিও ভালো হচ্ছে। চুইঝাল বিক্রি করে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়াসহ সংসারের সব খরচ চালান বলে জানান তিনি।

বাগেরহাট শহরের বাইরে ও জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে অনেক দোকান ঘুরে দেখা যায়, চুইঝালের চিকন ডাল কেজি ৪৫০-৫০০ টাকা, একটু মোটা ডাল ৬০০-৬৫০ টাকা, বড় ডাল ১১০০-১২০০ টাকা, গাছ-কাণ্ড ১২০০-১৪০০ টাকা।

সিলেটের ‘আসাম বাড়ি’

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১০:০৮ এএম
সিলেটের ‘আসাম বাড়ি’
শত বছরের পুরোনো আসাম প্যাটার্নের চুন-সুরকির তৈরি দোতলা বাড়িতে এখনো বসবাস করছেন রফিকুল হক ও তার পরিবার। সিলেট নগরীর তাঁতিপাড়া এলাকা থেকে তোলা। ছবি: মামুন হোসেন

‘চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ি/ আলী আমজদের ঘড়ি/ বঙ্কু বাবুর দাড়ি/ জিতু মিয়ার বাড়ি’। সিলেটের বহুল প্রচলিত প্রবাদ। ‘জিতু মিয়ার বাড়ি’ হিসেবে যেটির উল্লেখ করা হয়েছে, সেই বাড়িটি চুন-সুরকি দিয়ে আসাম প্যাটার্নে নির্মিত। প্রাচীনকাল থেকেই সিলেটিদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির যেমন স্বতন্ত্র ঐতিহ্য আছে, তেমনি বাড়ি নির্মাণেও ছিল নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী। নিজস্ব এই নির্মাণশৈলী আসাম প্যাটার্ন বা ‘আসাম ঐতিহ্য’ নামে পরিচিত। এমন স্থাপত্যশৈলীর কারণে সিলেটের আদি ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে আছে জিতু মিয়ার বাড়িও। 

স্থানীয় ইতিহাস বলে, সিলেটের স্বনামধন্য জমিদার ছিলেন খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া। ১৮৮৬ সালে মূল বাড়িটি নির্মাণ করেন জিতু মিয়ার বাবা মাওলানা আবু মোহাম্মদ আবদুল কাদির। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সিলেট ও আসামের অধিকাংশ স্থাপনার মতো এটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ১৯১১ সালে জিতু মিয়ার বাড়িটির সামনের অংশে একটি নতুন দালান নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এটিই জিতু মিয়ার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। 

সেই কালে ১ দশমিক ৩৬৫ একর ভূমিজুড়ে ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল মুঘল আমলের মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন আসাম প্যাটার্নে। সেই স্থাপত্যশৈলীর বাড়িগুলোতে কাঠের নল-বর্গার সঙ্গে চুন-সুরকির প্রলেপ দেওয়া হতো। ঘরগুলোর দেয়াল, দরজা-জানালা থেকে শুরু করে চালাতেও ছিল নান্দনিকতার ছোঁয়া। টালি বা ঢেউটিন দিয়ে ২ থেকে ১৩টি পর্যন্ত হতো ঘরের চালা। তখন সেই নির্মাণশৈলীতে সিলেটের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বাড়ি তৈরি করাতেন। ধীরে ধীরে এই নির্মাণশৈলী জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। 

এখনকার সিলেট মহানগরী তখন ছিল শহর। গ্রাম ও শহরের ব‍্যবধান ছিল বাড়ির চাকচিক‍্য বিচারে। বিভিন্ন উপজেলায় এখনো কিছু বাড়ি রয়েছে আসাম প্যাটার্নের। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবনও রয়েছে। অনেকেই ঐতিহ্যের নিদর্শনস্বরূপ বাড়িগুলো রেখে দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবনগুলো এখন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। 

সেমিপাকা আসাম প‍্যাটার্নের বাড়ির নির্মাণশৈলী এখনো আকর্ষণীয় বলে মনে করেন স্থপতি রাজন দাশ। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, যদিও সিলেট একসময় আসাম প্রদেশের সঙ্গে ছিল, এ জন্যই আমরা এই ধরনের বাড়িকে আসাম প্যাটার্ন বাড়ি বলি। কিন্তু সিলেট অঞ্চলের বাড়িগুলো আসাম থেকেও কিছুটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলেই আমরা একে সিলেট প্যাটার্ন বা সিলেটি বাড়ি বলতে পারি। তৎকালীন আসামের উঁচু অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের বাড়ি তৈরি করা হতো। কোনো কোনো বাড়ি টিলার ওপরে মাচা করেও বানানো হতো, যাতে পাহাড় বেয়ে নেমে-আসা পানি ঘরের নিচ দিয়ে চলে যায়। ইংল্যান্ডে প্রথম করোগেটেড আয়রন শিট বা সিআই শিট তৈরি হয়, যা ব্রিটিশ উপনিবেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতীয় অঞ্চলে আসে, মূলত মাইনিং এরিয়াগুলোর পাশে ওয়্যার হাউসের জন্য এই সিআই শিট ব্যবহৃত হতো। ক্রমশ তা এ অঞ্চলের কুঁড়েঘরের ছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ভিত্তি হিসাবে লোহার খুঁটি আর দেয়ালগুলোতে কাঠের ফ্রেম (যাকে আমরা ব্যাটন বলি) ও তার ভেতরে মাটি-লেপা ‘ইকরা’র বেড়ার ব্যবহার শুরু হয়। স্থাপত্যকলায় একে বাংলা ব্যাটন বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

১৮৯৭ সালের ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পর আসাম ও সিলেট অঞ্চলে ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত দালান বাড়িগুলোর প্রায় সব কটি ভেঙে পড়েছিল। এ তথ্য উল্লেখ করে স্থপতি রাজন দাশ আরও বলেন, কোনোটিরই ছাদ অক্ষত ছিল না। বলা হয় তৎকালে প্রায় ৫০০ বাড়ি ধসে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখে ছাদ হিসেবে চুন-সুরকির বদলে টিনের বাড়ির প্রচলন হয়। এগুলো বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। যেমন, ইংরেজি বর্ণ ই, এইচ, ইউ, সি কিংবা এল আকৃতির টিনের ছাদবিশিষ্ট বাড়ি। 

কালের পরিক্রমায় নির্মাণ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সিলেট অঞ্চলে যেসব বাড়ি অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও ভগ্নদশাগ্রস্ত। যেসব আসাম প্যাটার্ন বা সিলেট প্যাটার্ন বাড়ি স্থাপত্যকলার দৃষ্টিতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল, তার অনেকই ধ্বংস হয়ে গেছে। সিলেটে এ রকম একটি স্থাপত্য ছিল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাস। সেটি ভেঙে বহুতল ভবন করা হয়েছে।

এ ছাড়াও ‌ শহিদ ডা. শামসুদ্দিন ছাত্রাবাস, এমসি কলেজের সুকান্ত ছাত্রাবাস ও বাংলা বিভাগের ভবনগুলো সেই সময়ের স্থাপত্যের সৌন্দর্যের স্মৃতি এখনো বহন করছে। 

স্থপতি রাজন দাশ বলেন, আমার জানামতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্রিটিশ পিরিয়ডের স্থাপত্য-আঙ্গিক নিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ওই সময়ের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা এবং ড্রইংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা। যাতে পরবর্তী প্রজন্মের স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে জানানো যায়। আমি মনে করি, এই ধরনের বাড়িগুলো আমাদের এই অঞ্চলের স্থাপত্য-ঐতিহ্যের তথা ইতিহাসের অংশ। যেগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোকে ঐতিহ্য ঘোষণা করে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা অতি জরুরি।

কালের সাক্ষী ৪১৫ বছরের আতিয়া মসজিদ

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
কালের সাক্ষী ৪১৫ বছরের আতিয়া মসজিদ
৪১৫ বছর আগের মুসলিম স্থাপত্যকর্ম টাঙ্গাইলের আতিয়া মসজিদ ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথম ঠাঁই পেয়েছিল। ছবি: খবরের কাগজ

বাংলাদেশে সুলতানি এবং মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত যেসব স্থাপত্য রয়েছে, তার মধ্যে টাঙ্গাইলে অবস্থিত আতিয়া মসজিদ অন্যতম। এই মুসলিম স্থাপত্যকর্মটি প্রায় ৪১৫ বছর আগেকার। মসজিদটির নান্দনিক কারুকাজ এখনো কৌতূহলী দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগ্রহী দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন। সব মিলিয়ে আতিয়া মসজিদ যুগসন্ধিলগ্নের স্থাপত্য ও নিদর্শনরূপে পরিচিত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পকর্মগুলো। এর সঠিক সংরক্ষণ ও যথাযথ পরিচর্যার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক আতিয়া মসজিদটির অবস্থান। ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে আতিয়া মসজিদটি প্রথম ঠাঁই পেয়েছিল। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও আবার স্থান পায়। এতে দেশবাসীর কাছে সহজেই মসজিদটি পরিচিতি লাভ করে। তবে আজকাল দশ টাকার পুরোনো নোটটি তেমন দেখা যায় না।

পঞ্চদশ শতকে এই অঞ্চলে আদম শাহ বাবা কাশ্মীরি নামের এক সুফি ধর্মপ্রচারক এসেছিলেন। ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। এই পুণ্যবান ব্যক্তির কবরও এখানেই অবস্থিত। শাহ কাশ্মীরির অনুরোধে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগনার শাসক নিয়োগ করেন। সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তার উদ্যোগে ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ‘আতিয়া’ শব্দটি আরবি ‘আতা’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো ‘দান’। ওই সময় ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে বিশাল একটি এলাকা তিনি ‘ওয়াক্ফ’ হিসেবে পান।

সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি মসজিদটি সংস্কার করেন বলে জানা যায়।

মূল্যবান প্রত্নসম্পদ এই মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ১৮.২৯ মিটার, প্রস্থে ১২.১৯ মিটার। মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার ও উচ্চতা ৪৪ ফুট। চারকোনা অষ্টকোনাকৃতি মিনার রয়েছে। মসজিদটি টেরাকোটার তৈরি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদ ইট দিয়ে নির্মিত।

আতিয়া মসজিদটির প্রধান কক্ষ ও বারান্দা দুই ভাগে বিভক্ত। মসজিদের পূর্ব ও মাঝের দেয়ালে রয়েছে একটি করে দরজা। বারান্দাসহ উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে দুটো করে দরজা। ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি সুন্দর মেহরাব। প্রধান কক্ষের প্রত্যেক দেয়ালের সঙ্গে দুটি করে পাথরের তৈরি স্তম্ভ আছে। প্রধান কক্ষের ওপরে শোভা পাচ্ছে বিশাল একটি মনোমুগ্ধকর গম্বুজ। বারান্দার পূর্ব দিকে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ।

মাঝখানের প্রবেশপথের ওপরের অংশের নিম্নভাগে একটি শিলালিপি রয়েছে। বর্তমানে যে শিলালিপিটি রয়েছে, আগে সেখানে অন্য একটি শিলালিপি ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এই শিলালিপিটি ফার্সিতে লেখা। কোনো কারণে আদি শিলালিপিটি বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তীকালে মসজিদ মেরামতের সময় বর্তমান শিলালিপিটি বসানো হয়। চুন, সুরকি গাঁথুনি দিয়ে মসজিদটি নির্মিত। সুলতানি আমলে প্লাস্টার পদ্ধতির চল ছিল না। চুন-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা হতো। আতিয়া মসজিদের নাম একবার হলেও শোনেনি বাংলাদেশে এমন ব্যক্তি হয়তো খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। শতবছরের প্রাচীন মসজিদটি চালুর পর থেকে এখানে রোজ নামাজ আদায় চলছে।

মসজিদের ভারপ্রাপ্ত ইমাম মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের এই প্রাচীন মসজিদের চওড়া দেয়ালে শোভাময় পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা) ইতোমধ্যেই ক্ষয়ে গেছে। মোটা দেয়ালও বিবর্ণ হয়ে গেছে। ইটগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। ভারী বৃষ্টি হলে ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। তাই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করা হোক মসজিদটির। 

হাবিবুর রহমান নামে এক দর্শনার্থী জানালেন, আমাদের এলাকা বেশ পরিচিত হয়েছে এই অনিন্দ্যসুন্দর মসজিদটির কল্যাণে। আগে সরকারের ১০ টাকার নোটে এই মসজিদের ছবি ছিল। সেখান থেকেই পুরো দেশের মানুষ জায়গাটি এবং মসজিদকে চেনে। কিন্তু এখন আর ছবিটি ১০ টাকার নোটে নেই। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, আবারও টাকার মধ্যে ঐতিহাসিক এই মসজিদটির ছবি যেন স্থান পায়।

মালেক মিয়া নামে অপর এক দর্শনার্থী বলেন, আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে এই মসজিদটি দেখতে সেই বগুড়া থেকে এসেছি। আসার মূল কারণ হলো, পুরোনো ১০ টাকার নোটে এই মসজিদটির ছবি দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে কখনো দেখি নাই। তাই দেখতে আসলাম। তবে পর্যটন স্থান ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ অনুযায়ী এই এলাকার সেরকম কোনো উন্নয়ন চোখে পড়ল না।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়সারুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় থাকার পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৭৮ সালে মসজিদটির দেখভাল করার দায়িত্ব নেয়। আমি মসজিদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়েছি। কয়েক দিনের মধ্যে এই মসজিদটির প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করা হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সর্বদা পাশে থাকব। মসজিদটি যেন আরও শত শত বছর টিকে থাকতে পারে, সেভাবেই কাজ করা হবে।’