ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত দেওয়া শহিদদের স্মরণে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে দেশের প্রথম শহিদ মিনার তৈরি করা হয়েছিল। পাকিস্তানি জান্তার চাপ ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলে ইট-সুরকি ও কাদা-মাটি দিয়ে রাতের আঁধারে তৈরি হয় শহিদ মিনারটি। শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ নামে এই শহিদ মিনারের স্থায়িত্ব হয়েছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
রাতভর নির্মাণের পরদিন সকালেই শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ সেই শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু দেশের প্রথম শহিদ মিনার হিসেবে এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি আজও।
ভাষাসৈনিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীতে নির্মিত প্রথম শহিদ মিনারের স্থানে ছয় বছর আগে নতুন একটি শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও শুধু ভিত্তিপ্রস্তরেই আটকে আছে ওই শহিদ মিনারের কাজ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ভাষাশহিদদের স্মরণে রাজশাহীতে নির্মিত ‘প্রথম’ শহিদ মিনারটি নতুনভাবে নির্মাণের জন্য সাত বছর আগে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করা হয়। ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যেই রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা স্মারকটির পুনর্নির্মাণের কথা ছিল।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, নির্মিতব্য শহিদ মিনারটির নকশায় তিনটি পিলারের মধ্যে বড়টির উচ্চতা রাখা হয় ৫৫ ফুট। এটি হবে সিলভার রঙের। মধ্যম ও ছোট পিলারের উচ্চতা হবে যথাক্রমে ৪০ ও ৩০ ফুট। মধ্যম ও ছোট পিলার দুটি পোড়ামাটির রঙে করার সিদ্ধান্ত হয়। শহিদ মিনারের বেদিতে এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য লিপিবদ্ধ থাকবে বলে জানানো হয়। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়নাধীন শহিদ মিনারটির প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০ লাখ টাকা। বছর চারেক আগে পাইলিংয়ের কাজ হলেও আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি। অজ্ঞাত কারণে শ্রদ্ধা স্মারক নির্মাণ কার্যক্রম থেমে আছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
ভাষাসৈনিকরা জানান, রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলে ইট-সুরকি ও কাদা-মাটি দিয়ে শহিদ মিনারটি দেশের প্রথম। কিন্তু রাতভর নির্মাণের পরদিন সকালেই শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ সেই শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু শহিদ মিনার গড়ে উঠলেও প্রথম এই শহিদ মিনারটি বরাবরই ইতিহাসে উপেক্ষিত রয়েছে। রাজশাহীর ভাষাসৈনিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই শহিদ মিনারটিকে দেশের প্রথম শহিদ মিনার হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানালেও আজ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন ঘটেনি। বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি উঠলেও তা মেলেনি।
ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীতে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়েছেন ভাষাসৈনিক সাঈদউদ্দিন আহমদ। ৮৪ বছর বয়সে ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি। পরের বছরের ১৯ জুলাই ৭৭ বছর বয়সে ভাষাসৈনিক আবদুর রাজ্জাকও শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তাদের অন্যতম আরও একজন রাজশাহীর ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি। এখন বয়সের ভারে তিনিও ন্যুব্জ ও অসুস্থ। প্রবীণ এই ভাষাসৈনিক বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জানতে পারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করেছে। খবর শুনেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাৎক্ষণিককভাবে রাজশাহী কলেজ থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সন্ধ্যায় কলেজে ছাত্ররা জরুরি সভায় মিলিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকায় মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতি রক্ষার জন্য রাজশাহী কলেজে একটি শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাতেই আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা বিভিন্ন স্থান থেকে ইট সংগ্রহ করে। রাতে সিমেন্ট সংগ্রহ করতে না পারায় ইট ও কাদা-মাটি দিয়ে তারা শহিদ মিনার নির্মাণ করে নাম দেয় ‘শহিদ ম্মৃতিস্তম্ভ’। স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লিখে দেওয়া হয় ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ এই কাজে কলেজের কয়েকজন কর্মচারীও সহায়তা করেন। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শেষে ছাত্ররা তার ছবি তুলে রাখেন। রাজশাহী কলেজের শহিদ মিনারটিই বাংলাদেশের প্রথম শহিদ মিনার।
মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি বলেন, ‘আমরা শহিদ স্মৃতিস্তম্ভটি সারা রাত জেগে পাহারা দিই। কিন্তু পরদিন সকালে যখন আমরা সেখান থেকে চলে যাই, সেই সুযোগে ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে শহিদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।’
এই শহিদ মিনারটি বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে আসায় কয়েক বছর ধরেই ভাষাসৈনিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছেন।
ভাষাসৈনিক ও রাজশাহীর মানুষের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এবং সাবেক এমপি ফজলে হোসেন বাদশার সহায়তায় মুসলিম হোস্টেলের গেটের কাছে ২০০৯ সালে শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সেই স্থানটিতে একটি ফলক নির্মাণ করা হয়। ওই স্থানে একটি শহিদ মিনার স্থাপনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও তৎকালীন এমপি ফজলে হোসেন বাদশা সেই শহিদ মিনারের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, সাবেরা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শহিদ মিনার নির্মাণের কাজটি পায়। ওই কাজের জন্য তখন ৫০ লাখ টাকাও বরাদ্দ করা হয়। ২০২০ সালের ৩০ জুন নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই শহিদ মিনারের পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র। ওই কাজ মাটির নিচেই হয়েছে। এখন কাজ বন্ধ রয়েছে।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল খালেক বলেন, শহিদ মিনারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর কিছুদিন কাজ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু কাজটি সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে, তাই সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবে।
রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. হবিবুর রহমান বলেন, ‘নতুন এই শহিদ মিনারের জন্য আমি জায়গা ছেড়ে হোস্টেলের রাস্তা করেছিলাম। শহিদ মিনারের দৃশ্যটা যেন সুন্দর হয়, একনজরে সবার চোখে পড়ে, এ জন্য পাশের ডাইনিংটাও অন্যত্র সরিয়ে নিলাম। কিন্তু কাজ যতটুকু হয়েছে, তা মাটির নিচেই।’
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি আমাদের রাজশাহীবাসীর ব্যর্থতা। এই শহিদ মিনারটি কেন্দ্রের (ঢাকা) বাইরে হওয়ায় স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। শহিদ মিনারটি ঢাকায় হলে দেখা যেত যে বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটি গঠন হতো। এটির সঠিকতা যাচাই করা হতো। আমরা অযৌক্তিক দাবি করছি না। এটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক, এটিই আমরা চাই।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, পাইলিংয়েই শহিদ মিনার নির্মাণের টাকা শেষে হয়ে গেছে। এ কারণে এটি আর নির্মাণ করা হয়নি। এটি এখন রিভাইজড ডিপিপিতে দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন হলেই এটির নির্মাণকাজ আবারও শুরু হবে।