ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ছিলেন ১৯৫২ সালে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সূচনা, বিকাশ ও সফল পরিণতি অর্জনে যেসব ভাষাসৈনিকের নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
বরেণ্য এই ভাষাসৈনিক নিজ জন্মভূমিতেই অবহেলিত। তার স্মৃতিরক্ষায় নিজ জন্মভূমি বরিশালের গৌরনদীতে নির্মিত ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব তোরণ এবং গৌরনদী উপজেলা পরিষদ এলাকায় নির্মিত ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব চত্বরটি প্রায় নিশ্চিহ্ন। তোরণটি ভেঙে ফেলার পর আট বছরেও পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারটি।
ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও গণমাধ্যমকর্মী জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, নিজ এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ১৯৫২ সালে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় গৌরনদী উপজেলা চত্বরকে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব চত্বর করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিদ্ধান্তটি চিঠি দিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসককে অবগত করেন।
জহিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ২০১৫ সালে স্থানীয় একটি মহলের ষড়যন্ত্রে তোরণটি ভেঙে ফেলা হয়। ওই বছর স্থানীয় প্রশাসন কাজী গোলাম মাহবুব চত্বরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে এবং ওই চত্বরে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্মিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। শহিদ মিনারের পাশে থাকা ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের নাম ফলকটি লাল রং দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি খাদিজা বেগম জানান, তোরণটি ভেঙে ফেলা, চত্বর ও কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার পরিত্যক্ত ঘোষণা করার প্রতিবাদে স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের স্মৃতিরক্ষায় নির্মিত তোরণ অপসারণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তখন ১০ জন ভাষাসৈনিক তোরণটি পুনর্নির্মাণের দাবিও জানিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন উন্নয়নকাজের নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার সুবিধার্থে তোরণটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এটি পরে পুনর্নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। দুঃখজনক সত্য যে আট বছর পেরিয়ে গেলেও ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব তোরণটি পুনর্নির্মাণ করা হয়নি।
ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ১৯২৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশালের গৌরনদী উপজেলার লাখরোজ কসবা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি কাজী গোলাম মাহবুব ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতাল পালনকালে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ১৯৫২ সালে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই ভাষাসংগ্রামী আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য এবং ১৯৫৩ সালে বৃহত্তর বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। কাজী গোলাম মাহবুব ১৯৭৫ সালে বাকশালের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন। কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এবং বিএনপির রাজনৈতিক গবেষণা কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন। ২০০২ সালে একুশে পদক পান। মৃত্যুবরণ করেন ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ।