১৯৫২ সালে ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের পর আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে খুলনায়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে খুলনা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুরে, ২৮ ফেব্রুয়ারি মিউনিসিপ্যাল পার্কে, ১ মার্চ নৈহাটী স্কুলে, ৪ মার্চ দৌলতপুর কলেজে ও ৫ মার্চ স্থানীয় পার্কে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি একই সঙ্গে বিএল কলেজ একাডেমিতে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। ১৯৫৩ সালে খুলনার দৌলতপুর মাঠে ভাষাশহিদদের স্মরণে প্রথম শহিদ মিনার তৈরি হয়। তবে সেই সব ইতিহাস আজ ভুলতে বসেছেন অনেকেই।
খুলনায় ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সেই সময়ের ছাত্রনেতাদের অনেকেই এরই মধ্যে মারা গেছেন। যারা এখনো বেঁচে আছেন, বয়সের ভারে তারাও স্মৃতি রক্ষায় আর কোনো উদ্যোগ নেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন। ফলে খুলনার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি অবহেলায় অযত্নে হারিয়ে যেতে বসেছে।
খুলনার বিএল কলেজ ছিল দৌলতপুর-খালিশপুর-রায়েরমহল এলাকার সব আন্দোলন-সংগ্রামের পীঠস্থান। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল দৌলতপুর হিন্দু একাডেমি। এ ছাড়া খুলনা জিলা স্কুল, সেন্ট জোসেফ স্কুল, বিকে স্কুল ও মডেল স্কুলকে কেন্দ্র করেই সে সময় সংগঠিত হয়েছিল খুলনার ভাষা আন্দোলনের সব আয়োজন।
খুলনা শহরের যশোর রোডে ও সারদা রোডের সংযোগস্থলে একতলা বাড়ির একটা কামরায় এ কে সামসুদ্দিন (সুনু মিয়া) সে সময় ‘আজাদ লাইব্রেরি’ নামের একটা গ্রন্থাগার পরিচালনা করতেন। ঢাকায় ছাত্রদের ওপর হামলার পর ১৮ ফেব্রুয়ারি সেখানে ছাত্রনেতারা একত্রিত হয়ে খুলনায় বাংলা ভাষার দাবিতে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেন। শিশিভর্তি আলতা কেনা হলো, দাঁতন জোগাড় করা হলো, কাগজও কেনা হলো। রাতেই প্রায় এক শর মতো পোস্টার লেখা হয়। পোস্টারগুলো আঠা দিয়ে স্কুলের দেয়ালে লাগিয়ে দেওয়া হলো। পরদিন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভাষার দাবিতে হরতালের সমর্থনে রাজপথে বিক্ষোভ করেন।
এরই মধ্যে পুলিশ হানা দেয় সুনু মিয়ার লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে তারা উদ্ধার করল ভাষার দাবিসংবলিত পোস্টার। এ ঘটনায় দেশদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়। গ্রেপ্তার হলেন আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস, এম এ বারী, নূরুল ইসলাম ও সুনু মিয়া।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ্জামান বলেন, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষায় খুলনায় কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। দৌলতপুরে ঠিক কোন স্থানে শহিদ মিনার তৈরি করা হয়েছিল, তারও সঠিক ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক আছে। ভাষাসৈনিকদের অনেকে মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন, তারাও এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ভাষা আন্দোলনের সেই সব স্মৃতি ইতিহাস সংরক্ষণ করা হলে সমৃদ্ধ হবে আগামী প্রজন্ম।