‘খাজা নিবেন খাজা, কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা, মজার রাজা কুষ্টিয়ার তিলের খাজা’ দেশের প্রায় সব বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন এমনকি বিভিন্ন হাটে-ঘাটে, বাজারে হকারদের এমন আওয়াজ সবার কাছেই কমবেশি পরিচিত।
চিনি ও তিলের মিশ্রণে সম্পূর্ণ হাতে তৈরি, খেতে দারুণ সুস্বাদু কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে নানা রকম হাঁকডাকের মাধ্যমে রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায় কুষ্টিয়ার তিলের খাজা।
ছোট-বড় সব মানুষের কাছে মুখরোচক এই খাবার বেশ প্রিয়। শীত মৌসুমে তিলের খাজার চাহিদা থাকে বেশি। সঠিক তথ্য না থাকলেও স্থানীয়দের দাবি, প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই তিলের খাজা।
সম্প্রতি খাবারটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় আধ্যাত্মিক ফকির বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই বলেছিলেন, হায় রে মজার তিলের খাজা,/ খেয়ে দেখলি না মন কেমন মজা,/ লালন কয়, বেজাতের রাজা হয়ে রইলাম এ ভুবনে...।’
স্থানীয় বাউল সাধুদের দাবি, প্রায় ১৫০ বছর আগে ফকির লালন সাঁই তিলের খাজা নিয়ে এই গানটি রচনা করেছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও জনশ্রুতি থেকেই তিলের খাজা নিয়ে এমন গান চলে আসছে বছরকে বছর।
এলাকাবাসী এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের সময়কালে তিলের খাজার প্রচলন ঘটে কুষ্টিয়ায়। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আগে শহরের মিলপাড়ায় ও দেশওয়ালীপাড়ার পাল সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি পরিবার তিলের খাজা তৈরি শুরু করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে মিলপাড়ার আবদুল মজিদ, চাঁদ আলী, সাইদুল ইসলাম, ইদিয়ামিন, সরওয়ারসহ আরও কয়েকজন কারখানায় তিলের খাজা তৈরির ব্যবসা শুরু করে এই শিল্পের দেড় শ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনটন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে এই শিল্প। এরপর আবার নতুন করে মহামারির প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি এই ব্যবসায়ীরা । সব মিলিয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই পেশার মানুষ।
এখন মিলপাড়ায় বিখ্যাত ‘ভাই ভাই তিলের খাজা’ নামের একটি এবং ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ির পেছনে দুলাল হোসেনের একটি- এই দুটি মাত্র তিলের খাজার কারখানা টিকে আছে। এই কারখানা দুটির বয়সই প্রায় ৫০ বছর। তবে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখানকার কারিগররা গিয়ে নতুন করে কারখানা তৈরি করেছেন।
সব মৌসুমে রাতের বেলা তৈরি হয় তিলের খাজা, আর দিনে বিক্রি হয়। তবে শীত মৌসুমের ৩ মাস প্রায় ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে কারখানাগুলো।
চিনি ও দুধ জ্বাল দিয়ে নির্দিষ্ট ঘনত্ব তৈরি হলে হালকা ঠাণ্ডায় জমাট বেঁধে চিনির মণ্ড তৈরি করা হয়। সেই মণ্ড গাছ বা বাঁশের সঙ্গে বিশেষভাবে টাঙিয়ে হাতে টানা হয়। মণ্ডটি হালকা বাদামি থেকে সাদা রঙে পরিণত হলেই কারিগর তার নিপুণ হাতের টানে ভেতরের অংশ ফাঁপা করেন। পরে বিছিয়ে রেখে তা নির্দিষ্ট মাপে কাটা হয়। ওই কাটা অংশের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় খোসা ছাড়ানো তিল।
এরপর করা হয় প্যাকেট। এভাবেই তৈরি হয় তিলের খাজা। কুষ্টিয়ার কারখানা দুটিতে প্রতি রাতে প্রায় আড়াই শ কেজি করে তিলের খাজা তৈরি হয়। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুচরা এবং পাইকারি বিক্রেতাদের মাধ্যমে এই খাদ্যপণ্যটি চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
দেশের অনেক কিছু বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের। চিনি ও তিলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় লোকসানের আশঙ্কায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন তিলের খাজা তৈরির কাজ।
সম্প্রতি খাবারটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র শিল্পের তালিকায় থাকা পণ্যটি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখনো ধুঁকছে।
শতাধিক বছর আগে পণ্যটি কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী উপজেলায় তেলি সম্প্রদায়ের হাতে তৈরি হয় বলে জানা যায়। ঠিক কবে উৎপাদন শুরু হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ইতিহাস অনুসারে তিল থেকে তেল তৈরি করতে তেলিদের কুষ্টিয়ায় এনেছিল ব্রিটিশরা। তেলি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে এই খাবার প্রথম কুষ্টিয়ায় তৈরি হয়।
জেলা প্রশাসক মো. এহতেশাম রেজা বলেন, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা শিল্পের বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। ক্ষুদ্র এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঋণের ব্যবস্থাও করবে জেলা প্রশাসন।
দরদাম
তিলের খাজা আকারভেদে কেজি ২৩০ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৩০০ টাকা কেজি পর্যন্ত পাইকারিভাবে বিক্রি হয়। আবার প্যাকেট হিসেবে খুচরা ২০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়।