কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবি, সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। ২৪ মে ১৮৯৯ সালে তিনি ভারতের চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কবি ছিলেন অনেকটাই মজার মানুষ। তার জীবদ্দশায় তিনি অনেক মজার ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন। সেগুলোর কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
একবার কবি নজরুল গেছেন সিরাজগঞ্জে সাহিত্যিক আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর বাসায়। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে দই দেওয়া হলো। কিন্তু সে দই খানিকটা নষ্ট হয়ে টক হয়ে গিয়েছিল। হয়তো দই একটু আগেভাগেই নিয়ে আসাতে এরকম হয়েছিল। তো সেই দই খেয়ে নজরুল আসাদউদ্দৌলার দিকে তাকিয়ে চোখে-মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, ‘তুমি কি এই দই তেঁতুল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি?’ কবির এমন কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসেই খুন!
নজরুলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল কিছু হিউমার ছিল। তিনি Aristocrate-এর বাংলা করেছিলেন, ‘আড়ষ্টকাক!’ যারা বক্তৃতা দিতে ভালোবাসতেন তাদের বলতেন, ‘বখতিয়ার খিলজী’, কোনো কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে তিনি বলতেন, ‘জানে দেও কন্ডাক্টর’। কবি নজরুল fun এবং পান-এ সমান অভ্যস্ত ছিলেন। তার একটি বিখ্যাত পানপাত্র ছিল (যেটাকে তিনি নিজেই ‘পানের সিন্দুক’ আখ্যা দিয়েছিলেন)। এই পানপাত্রে এক শ পান থাকত। লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে একসঙ্গে তিন-চারটা পান মুখে পুরতেন আর পিকদানিতে পানের পিক ফেলতেন। এই পান নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। একবার এক ভদ্রমহিলা নজরুলের পান খাওয়া দেখে তাকে খুব স্মার্টলি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা আপনি কি পানাসক্ত?’ নজরুল বললেন, ‘জি না, আমি বেশ্যাসক্ত!’ নজরুলের এমন উত্তর শুনে ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। পরে নজরুল ব্যাখ্যা করলেন, ‘পান একটু বেশি খাই তাই বেশ্যাসক্ত, অর্থাৎ বেশি+আসক্ত=বেশ্যাসক্ত!’
একবার গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডে গান দিতে এলেন এক লোক। লোকটিকে নজরুলের কাছে পাঠানো হলো তার গানের দৌড় পরীক্ষা করার জন্য। লোকটি হারমোনিয়াম নিয়ে কবির সামনে বসলেন এবং গান শুরু না করে কথা শুরু করলেন। কার কাছে গান শিখেছেন, কবে তার গান শুনে কে প্রশংসা করেছে, তিনি কতখানি পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইত্যাদি। মাঝে একবার কবিকে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন, ‘আপনি কি ধানশ্রী ভৈরবী রাগের গান শুনেছেন? শোনেননি বোধহয়। খুব রেয়ার। কেবল আমার কাছেই আছে।’ এভাবে লোকটি গান না গেয়ে বকবক করেই যাচ্ছিল। নজরুল তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি তো দেখছি একটি জানোয়ার লোক।’ ‘কী বললেন?’ ভদ্রলোকটি নজরুলের কথায় বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। নজরুল বললেন, “না না অন্য কিছু মনে করবেন না, দেখলাম আপনি অনেক কিছু জানেন, তাই আপনার সম্বন্ধে ‘জানোয়ার’ শব্দটি প্রয়োগ করেছি!” লোকটি হাঁ করে বসে রইল।
প্রতিবেশীর মেয়ের আকিকা। বিশাল আয়োজন। বাড়িভর্তি লোকজনের আনাগোনা, আনন্দ-ফুর্তি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি দেখে তিনি অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। প্রতিবেশীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন রোগা-পটকা এক ঘোড়ার পিঠে বিদঘুটে চেহারার এক লোককে বসিয়ে। লোকটি দেখতেই শুধু বিদঘুটে নয়, তার পোশাকও অদ্ভুত— শতেক ছেঁড়া, ধুলাবালু মাখা। মুখভর্তি গোঁফদাড়ির জঙ্গল।
নজরুল বাড়ির গিন্নিকে ডেকে বললেন, ‘মাইজি, তোমার মেয়ের জন্য বর এনেছি। পছন্দ হয়নি?’
বাড়ির গিন্নি নজরুলের এমন রসিকতার কারণ বুঝতে পেরে বললেন, ‘আমি তো বাপু ভেবে রেখেছি তোমার সঙ্গেই আমার মেয়ের বিয়ে দেব।’
বাড়িভর্তি মানুষের সামনে হঠাৎ উল্টো প্রস্তাব পেয়ে কিশোর নজরুলের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ঘোড়াসহ ওই বিদঘুটে লোকটিকে রেখেই দ্রুত চম্পট দিলেন সেখান থেকে।
অসামান্য প্রতিভাবান কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ইসলামি হামদ, নাত, গজল রচনা শুরু করলেন, তখনকার একটি ঘটনা। শিল্পী আব্বাসউদ্দিন এক দিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে নজরুলকে না পেয়ে সকালে তার বাসায় চলে গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখলেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছেন। নজরুল ইশারায় আব্বাসউদ্দিনকে বসতে বললেন। আব্বাসউদ্দিন অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি উসখুস করতে লাগলেন।
নজরুল বললেন, ‘কী, তাড়া আছে, যেতে হবে?’ আব্বাসউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক তাড়া নেই, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেবার জন্য। গজল না নিয়ে আজ যাওয়া হচ্ছে না।’ (নজরুলকে যেহেতু বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে পাওয়া যেত না, তাই সবাই এইভাবে লেখা আদায় করত!)
নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিষ্কার চাদর তার ঘরের আলমারি থেকে বের করে বিছিয়ে দিলেন। এরপর আব্বাসউদ্দিন যথারীতি জোহরের নামাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল তার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার গজল।’ এই গজলটিই হলো—‘হে নামাজি আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ/ দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ...’
সুফিয়া কামাল কাজী নজরুল ইসলামকে ডাকতেন দাদু বলে। কবি আবার প্রায়ই সুফিয়া কামালের বাড়ি যেতেন। সেখানে গানের আসর বসত। সে আসরে সাহিত্য অনুরাগী অনেকেই থাকতেন। এ সময় নজরুলের পেছনে গোয়েন্দা লাগে। সাহিত্য অনুরাগীদের সঙ্গে মিশে কয়েকজন গোয়েন্দাও আসতেন। এক দিন এক ভদ্রলোকের মুখের ওপর নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি জানি ঠিকঠিকই।’ কবিতার ধরন শুনে লোকটি মুখ লাল করে উঠে যেতেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বললেন, ‘দাদু। তুমি একে চিনলে কী করে?’‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’ নজরুলের উত্তর।
কাজী নজরুল ইসলাম একবার ট্রেনে যাচ্ছিলেন। পাশে সমবয়সী এক ভদ্রলোক হঠাৎ তার উদ্দেশে বললেন, ‘এই শালা, তোর কাছে দিয়াশলাই আছে?’অপরিচিত এক লোকের এমন সম্ভাষণে কবি প্রথমে চমকে উঠলেন, তারপর বিরক্ত। কিন্তু পরক্ষণেই পরিস্থিতি সামলে নিয়ে হেসে পকেট থেকে দিয়াশলাইয়ের বাক্সটা তার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘লে বে শালা।’
ইটের বদলে পাটকেল খেয়ে অপরিচিত ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘পরিচয়ের একটু পরেই আমরা এই সম্ভাষণেই পৌঁছাতাম। তাই অনেক ভেবে ওখান থেকেই শুরু করেছি। কী, ঠিক করিনি?’
কবি নজরুল তখন থাকেন কৃষ্ণ নগরে। তার বন্ধু মঈনুদ্দীন থাকেন বেচু ঠাকুরের গলিতে কারমাইকেল কলেজের হোস্টেলের পেছনে। তিনি এক দিন দাওয়াত করলেন কবি নজরুলকে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কবিবন্ধু মইনুদ্দীনের বাসায় আয়োজন। খুব আহামরি কিছু নয়, তবে অন্যদিনের চেয়ে ভালো। নজরুল এলেন। সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলেন মঈনুদ্দীনের ঘর।
কবি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিরে?
বন্ধুর উত্তর, রান্নাঘর।
-আর ওটা?
-ওটা হলো পায়খানা।
কবি বলে উঠলেন, ধুর শয়তান! পায়খানা কিরে? বল ‘যায়খানা’। খানা তো ওখান দিয়েই যায় রে!!’ এটুকু বলেই হাসি। সে কী বিরাট প্রাণখোলা হাসি কবির। তার হাসির আওয়াজে জানালার কার্নিশের আড়ালে বসে থাকা কবুতর পাখা মেলে ঝটপট করে উড়ে গেল।
অনেকের হয়তো জানা নেই যে, আমাদের প্রিয় কবি নজরুল কিন্তু নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন। অবাক হলেও কিছু করার নেই, কারণ তিনি ওই নির্বাচনে জয়লাভ করেননি।
১৯২৬ সাল। মাসের নাম নভেম্বর। পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে কবি নজরুল কেন্দ্রীয় আইনসভার সভ্যপদপ্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন। শুধু কি তাই, এ নির্বাচনি প্রচারের জন্য তিনি এসেছিলেন ঢাকা, ফরিদপুরসহ কয়েক জায়গায়।
সূত্র: ইন্টারনেট অবলম্বনে
কলি