
শীতকালে এ দেশের উপকূলে আসে গাঙচষা পাখি। ঘোলা পানির ওপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে ওরা ওড়ে। এ পাখির চঞ্চু যেন লম্বা লাল লাঙলের ফলা। চঞ্চুর নিচের পাটি পানিতে চুবিয়ে হা করে ওরা উড়ে চলে। ধাবমান লাল চঞ্চু দেখে বাটামাছ পানি ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেই খপ করে ধরে গাঙচষা পাখি।
মাছ ধরার জন্য এ এক আজব পদ্ধতি। পানির ওপর দিকে সাঁতার দিয়েই সারাটা জীবন কাটে অনেক মাছের। বল্লমের মতো চঞ্চুর ঘায়ে এদের ছানাপোনা শিকার করেই বেঁচে আছে বক আর মাছরাঙা। গাঙচিলও ওই সব মাছ পানি থেকে তুলে খায়। গাঙচষাদের কিন্তু পছন্দ নয় শিকারের এই সহজ কায়দাগুলো।
গাঙচষা পাখি মাছ ধরতে চায় বাতাস থেকে। লাল চঞ্চু পানিতে দিয়ে সে মাছকে ভয় দেখায়। ভীত মাছ লাফ দিয়ে শূন্যে উঠলেই তা শিকার করে। কোটি বছর আগে উদ্ভব হয়েছে মাছ শিকারের ব্যতিক্রমী এই পদ্ধতি। কিন্তু গাঙচষা ছাড়া আর কোনো পাখি আজও রপ্ত করতে পারেনি শিকারের এ কৌশলটি।
পৃথিবীতে মাত্র তিন প্রজাতির গাঙচষা আছে। বাংলাদেশে যে প্রজাতিটি আছে, আমরা তার নাম দিয়েছি ‘দেশি-গাঙচষা’। বাকি দুই প্রজাতির বাস দুটি ভিন্ন মহাদেশে। আমেরিকার বাসিন্দা ‘কালা-গাঙচষা’ দেখার ভাগ্য হয়েছিল ফ্লোরিডা সৈকতে গিয়ে। আর ‘আফ্রিকা-গাঙচষা’ দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম উগান্ডায়।
বাংলাদেশে প্রতি বছরই দেখতে পাই দেশি-গাঙচষা। এর ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়ান স্কিমার’। ভারতবর্ষের বাইরে খুব কমই দেখা মেলে এ পাখির। এককালে মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড হয়ে ভিয়েতনাম পর্যন্ত এ পাখির বিস্তৃত বসবাস ছিল। এই শতাব্দীতে এসে ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথাও নেই পাখিটি।
একমাত্র বাসস্থান এই ভারতবর্ষেও এখন দেশি-গাঙচষার দেখা পাওয়া কঠিন। পাখিটি এখন ‘বিপন্ন’ এবং এর সংখ্যা কমেই চলেছে। বাংলাদেশে এখনো নিঝুম দ্বীপের পাশে শীতকালে আমরা শতাধিক পাখির ঝাঁক দেখতে পাই। গত শীতে ভোলার পশ্চিমে ট্যাগরার চরে আমরা একটিমাত্র গাঙচষার দেখা পেয়েছিলাম।
মাছ শিকারের ব্যতিক্রমী এ পদ্ধতিই সম্ভবত গাঙচষার টিকে থাকার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানিতে যখন অনেক মাছ লাফালাফি করত, তখন বাতাস থেকেও মাছ ধরা কঠিন ছিল না। কিন্তু সেই দিন আর নেই। এখন মাছের চরম আকাল। পানিতেই মাছ নেই, তো বাতাসে আসবে কোথা থেকে!
বক ও মাছরাঙার তো তবু বিকল্প আহার্য কিছু আছে। মাছ না পেলে ওরা কাঁকড়া, কেঁচো, কিংবা ঝিঁঝি শিকার করে। শিকারের ব্যতিক্রমী পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে কোটি বছরের বিবর্তনে গাঙচষা চঞ্চুর যে আকৃতি, তা দিয়ে বিকল্প কিছু করা যায় না। গাঙচষাকে বাঁচতে হলে পানিতে ভাসমান মাছই চাই।
ডোবা-নালায় নেমে গামছা দিয়ে রঙিন মাছ ধরার চাঞ্চল্যে ভরপুর শৈশবের দিনগুলোর কথা আমার মনে আছে। সে কালে গাঙচষার জন্যও নিশ্চয়ই মাছ ধরাটা অতটাই সহজ ছিল। জলাশয়ে আজ সেই মাছ আর নেই। তবে আমরা মাছের অভাবে মরে যাইনি, মাছ চাষ করে আমাদের অভাব পূরণ করেছি।
পাখির জীবনে চাষবাসের তো সুযোগ নেই। নদীতে মাছের স্বল্পতার সঙ্গে সঙ্গে অনন্য এই গাঙচষার সংখ্যাও তাই কমতে শুরু করেছে। আমরা সেটা জানতেও পারিনি। সম্প্রতি আমরা শুরু করেছি এসব তথ্য সংগ্রহের কাজ। জানা গেছে, সারা ভারতবর্ষে গত ১০ বছরে এ পাখির সংখ্যা কমে গেছে এক-পঞ্চমাংশ।
আহার্যের সংকট ছাড়াও দেশি-গাঙচষার জীবনে আরও একটি বড় সমস্যা আছে। তা হলো প্রজননের স্থানের অভাব। নদীতীরে বালুচরে এরা দল বেঁধে বাসা করে। তিন মাস ধরে ডিমে তা দেওয়া আর ছানা পালার মতো নিরাপদ বালুচর এখন আর বাংলাদেশের কোথাও নেই। চম্বল নদী ছাড়া ভারতেও বেশি নেই।
বাংলাদেশে আমরা হয়তো বেশি দিন আর দেশি-গাঙচষা দেখতে পাব না। ‘বিপন্ন’ থেকে পাখিটি একসময় ‘মহাবিপন্ন’ হিসেবে আখ্যায়িত হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনন্য এই পাখির নামটি শুধু জানতে পারবে, আমরা যেমন জানি ‘ডোডো’ পাখির নাম।