বর্তমানে অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে অব্যাহতভাবে আমরা অর্থনীতিতে শ্লথ গতির প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হতে দেখেছি। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এক ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। সেটি উৎপাদন, বিনিয়োগ, রপ্তানি, আমদানির ক্ষেত্রে যেমন দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে উচ্চমূল্য, দুর্বল বিনিময় হার, ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত মূল্য হ্রাস, এমনকি সুদের হারের ক্ষেত্রেও এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে। তাছাড়া রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও এর একটি প্রতিফলন আমরা দেখেছি। ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারি উৎসগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও এক ধরনের ধীরগতি পরিলক্ষিত হতে দেখা গেছে। ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সরকার ব্যাংকগুলো থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেন সেখানেও নাজুক অবস্থা বিদ্যমান। মোট কথা, অর্থনীতির সব পরিস্থিতিতেই নানা ধরনের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
দেশে বৈদেশিক ঋণের যে ঘাটতি সেটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে রিজার্ভের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি না হওয়ার কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। ফলে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর বিপরীতে যেমন টাকা অবমূল্যায়িত হয়েছে, অন্যদিকে টাকার বিপরীতে আমদানিতে ঘাটতি হওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক দিক থেকে টাকার এই অবমূল্যায়ন ঘটেছে। বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প দ্রুত শেষ করা, মুদ্রাস্ফীতিজনিত মুদ্রা সরবরাহ, কোনো কোনো সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে আমদানি-নির্ভর কাঁচাপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে অধিক হারে। শীতকালের এই মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজারমূল্য আরেকটু কম থাকার কথা ছিল। কিছুদিন আগ পর্যন্তও চালের ঊর্ধ্বগতির পেছনে একটা যৌক্তিকতা ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের উচ্চমূল্যের কারণে বাংলাদেশের চালের বাজারে তার প্রভাব পড়েছিল। ফলে মূল্যস্ফীতিতে এর একটি প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। মূল্যস্ফীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাজারব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা। সরকারি তদারকিতে দুর্বলতা, বেসরকারি খাতে অব্যাহতভাবে অতি নির্ভরশীলতা এবং দেশের ভিতরে যারা বড় ব্যবসায়ী তাদের বাজারব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব বিস্তার। পণ্য সরবরাহে তাদের এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, এটিও মূল্যস্ফীতির বড় কারণ। অব্যাহত মূল্যস্ফীতির প্রকৃত আয় যেমন কমেছে একই সঙ্গে তার খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে, পুষ্টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক ছাড় দিতে হয়েছে। বিশেষত, সীমিত অথবা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বছর আমরা সেই অস্থিরতা দেখছি। নির্বাচন পরবর্তীকালীন এ ধরনের অস্থিরতা সহজেই কেটে যাবে, তা মনে হয় না।
সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মানোন্নয়ন দরকার। যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক জড়িত তাদের সঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক অবস্থানের কারণে যদি সম্পর্কগুলোয় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে আমাদের সামনের সময়গুলো অর্থনীতির জন্য খুব একটা মসৃণ হবে না। অর্থাৎ আগামীর সময়গুলো আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে পার করতে হবে। ছয় মাস পর্যন্ত অর্থনীতিতে যথেষ্ট ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। সংকট মোকাবিলার জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক লেনদেনে এখন যে চাপ রয়েছে, সেটিকে কতটা কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন পড়বে। যেহেতু দেশে রিজার্ভ সংকট রয়েছে, অন্যদিকে টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, সে ক্ষেত্রে এটিকে কমিয়ে আনা দরকার। রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করার জন্য বাজারভিত্তিক রেমিট্যান্স মূল্য থাকা দরকার। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে শর্তাবলি রয়েছে সেগুলো যদি সহজ করা যায় অর্থাৎ সময় যদি বাড়িয়ে নেওয়া যায় সেটি কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক হবে।
দেশের প্রান্তিক মানুষকে ১ কোটি কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণের যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে, সেটিরও ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। তারা যেন কোনোভাবেই রাজনৈতিক মহলের প্রভাব বিস্তারের বলিদান না হয়, সেদিকটা আমাদের লক্ষ্য করতে হবে। বিভাগীয় পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে ব্যাপারটি খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে বাজারব্যবস্থাপনায় সুশাসন জরুরি। আমি মনে করি, অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জগুলো দূর করা সম্ভব না হলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দেবে। বিদেশি অনুদান অথবা বিদেশি ঋণের ওপর ভিত্তি না করে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা দরকার। যারা কর এড়িয়ে যাচ্ছেন, তাদের কীভাবে করজালের ভিতরে নিয়ে আসা যায় সেটিও দেখতে হবে। ডিজিটালাইজড সিস্টেম করে আধুনিকায়ন ব্যবস্থার দিকে জোর দিতে হবে। আগামী সময়গুলোতে খুব দ্রুত অর্থনীতিকে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নিয়ে আসা কঠিন হবে। সেজন্য চেষ্টা থাকতে হবে যেন, চ্যালেঞ্জগুলো দীর্ঘায়িত না হয়। নির্বাচন-পরবর্তী অর্থনীতিতে যে গতি সঞ্চার হওয়ার কথা, সেই গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে আমাদের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মিত মনিটরিং ও সঠিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করা যায়, তাহলে সেটা ধীরে ধীরে সুস্থির অবস্থানে ফিরে আসবে।
লেখক: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)