শিক্ষা কারিকুলাম পাথরে খোদাই করা কোনো বস্তু নয়। উন্নত দেশগুলোতে ক্রমাগত কারিকুলাম সংস্কার করা হয়। জনগোষ্ঠীর চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্রমাগত তা পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়। সেখানে একটি বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়, যেমন- শিক্ষার্থীদের বয়স যদি ১০ বছর হয়, তাহলে তাকে ১৫ বছরের শিক্ষা উপাদান দেওয়া যাবে না। আমাদের বর্তমান শিক্ষাক্রমের আওতায় যে পাঠ্যপুস্তকগুলো আছে, সেগুলো অনেক সময় শিক্ষার্থীদের কেবল ভারাক্রান্তই করে না; তাদের জন্য রীতিমতো বোঝা হয়ে যায় এবং বহন করা কষ্টকর হয়ে ওঠে।
কারিকুলাম অভিন্ন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। কিন্তু তার জন্য আমাদের শিক্ষকরা প্রস্তুত হচ্ছেন কি না, তার প্রশিক্ষণটা যথাযথ কি না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনমাফিক বিজ্ঞানাগার আছে কি না, পাঠাগার আছে কি না, এগুলো দেখতে হবে। একই সঙ্গে বারবার এটাও বলা হচ্ছে, এক্সট্রা কারিকুলার বা কো-কারিকুলার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। তার জন্য খেলার মাঠ আছে কি না, প্রশিক্ষিত শিক্ষক আছেন কি না, চারু ও কারুকলার জন্য শিক্ষক আছেন কি না ইত্যাদি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা।
আর শিক্ষা ব্যবস্থাপনা যেটি আছে সেটি যদি অসম্ভব রকমের কেন্দ্রীভূত হয়, বিকেন্দ্রীকরণ না থাকে, সেখানে শিক্ষকদের দক্ষতা বা কর্মনিষ্ঠার অভাব না থাকলেও তার জবাবদিহির ব্যাপারে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনের তেমন কিছু করার থাকে না। মূলধারা ছাড়াও সরকারি সাহায্যপুষ্ট মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যে ব্যবস্থাপনা চালু আছে, সেখানে সরকার নানা সময়ে নানা ধরনের নির্দেশনা দিয়ে, প্রজ্ঞাপন জারি করে কিছুটা লাগামের মধ্যে আনার চেষ্টা করে থাকে। যেমন- সম্প্রতি বলা হয়েছে, তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতে হবে; সেখানেও আমরা প্রায়ই স্বচ্ছতার অভাব দেখি। মাঝেমধ্যে মহামান্য আদালতকেও এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে বলতে হয়েছে- শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জবরদস্তি করে বাড়তি ভর্তি ফি নেওয়া যাবে না, শিক্ষকরা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কোচিং করতে পারবেন না।
কাজেই এখানে শিক্ষার্থী-অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রশাসন এসব অংশীজনের মধ্যে সমন্বয় খুবই প্রয়োজন। যারা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত তাদের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করাও জরুরি। সবচেয়ে বড় প্রতিফলন যেখানে আসতে হবে সেটা হচ্ছে, একটি অগ্রসরমুখী শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তকেও যথাযথভাবে আসতে হবে। এমনভাবে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে একেবারে প্রাক-প্রাথমিক থেকে ধারাবাহিকতাটা বজায় রাখা যায়। প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থী যখন ক্লাস ওয়ানে পড়বে, তখন তাকে যেন হোঁচট খেতে না হয়।
এখন পঞ্চম শ্রেণির পরে যারা যষ্ঠ শ্রেণিতে যায় তাদের একটা বিশাল লং জাম্প দিতে হয়। এর কারণ এখানে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। তবে এর একটি প্রয়াস নতুন শিক্ষাক্রমে রয়েছে। বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বয়স উপযোগী, মেধা ও মননের উপযোগী বই-পুস্তক তৈরি করতে হবে। এখানে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার একটি প্রয়াস আমরা লক্ষ করছি। এর জন্য মহামান্য আদালতকে পর্যন্ত নির্দেশনা দিতে হয় যে, একজন শিক্ষার্থীর ওজনের ১০ পার্সেন্টের বেশি বই-পুস্তক দেওয়া যাবে না। এখানে আমরা মনে করি বয়স উপযোগী, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকের বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে; তবে সেটা কোন বয়সে করতে হবে, কতটুকু করতে হবে- সুনির্দিষ্ট করে যদি প্রতিফলিত না হয়, তাহলে যে বিভাজনটা ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য চিন্তা করা হচ্ছে, সেটা অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে পারে।
কারিকুলাম হলো সতত পরিবর্তনশীল, পরিবর্ধনশীল একটি বিষয়। ১০-১৫ বছর আগে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির কথা তেমনভাবে ভাবিনি; এখন অনেক গুরুত্বসহকারে ভাবতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে অনলাইনে মূলধারার যেসব শিক্ষার্থী যুক্ত হচ্ছে, তাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রস্তুতিটা আগে থেকেই থাকার জন্য কারিকুলামটাও সে রকমই হওয়া উচিত ছিল। সব মানুষই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। কোনো ধর্মেই কোনো মানুষকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সংবিধানেও লিঙ্গ-বর্ণ ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার বা থার্ড জেন্ডার যেটাই হোক না কেন এখানে সমস্যা কিছু নেই।
নতুন শিক্ষাক্রমে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ অধ্যায়ে শরীফ থেকে শরীফা হওয়ার গল্পের বিষয়ে বলা যায়, একটি প্রগতিশীল চিন্তা থেকে পাঠ্যবইয়ে শরীফ থেকে শরীফা গল্পটি যুক্ত করা হয়েছে।
সেখানে থার্ড জেন্ডার হোক বা ট্রান্সজেন্ডার এতে কোনো সমস্যা দেখি না। অথচ দেখছি, একটি উগ্র গোষ্ঠী ধর্মকে ব্যবহার করে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে ভুলপথে পরিচালিত করছে। ঘৃণা ছড়ানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখলেও এখানে তা দেখা যাচ্ছে না। যা নিয়ে নানা রকম হতাশাও রয়েছে।
বাকস্বাধীনতা একটি বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্মকে ব্যবহার করে ঘৃণা ছড়ানোর সংস্কৃতি চলছে। অথচ পৃথিবীর বহু দেশে হেট স্পিচ (ঘৃণা) ছড়ানোর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কারিকুলামের কোনো গল্পে আপত্তি থাকলে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করতে পারেন। চাইলে উচ্চ আদালতে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
এশিয়ার মধ্যে মডেল দক্ষিণ কোরিয়া। তারা সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ শিক্ষায় করেছে। আমাদের দেশের শিক্ষকের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আমাদের দেশের সব স্কুলে লাইব্রেরিয়ান আছে, কিন্তু লাইব্রেরির সংস্কৃতি আগের মতো নেই। এসব কারণে এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষক চাহিদা দিলে এনটিআরসিএ থেকে দুই বছর লাগে। স্কুলের নিয়োগেও স্বজনপ্রীতি হয়। এসব থেকে আমাদের বের হতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। প্রাথমিকের শিক্ষকরা অনেক মেধাবী। সেখানে যে শিক্ষা ক্যাডার নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি বলতে চাই, সবাই পাশে থাকেন, পেছনে নয়। পরিবর্তন প্রয়োজন, তবে বারবার এই পরিবর্তনের কারণে নানা জটিলতা দেখা দেয়। আমাদের প্রধান সমস্যা বাস্তবায়ন। সঠিক পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করতে না পারলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। নীতি-নৈতিকতা না থাকলে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব হবে না।
সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখন খুবই প্রতিযোগিতামূলক। শ্রমবাজার থেকে শুরু করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংকিংব্যবস্থা সবকিছুই প্রতিযোগিতামূলক। আমরা যদি মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই, তাহলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং বিশ্ব নাগরিক হওয়ার যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হওয়ার জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। এসব বিবেচনায় নিয়ে আমি বলব একটি অগ্রসরমুখী চিন্তাভাবনাসহ আরও অনেক কিছু করা দরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমরা যদি স্বপ্ন দেখি উন্নত বিশ্বের দিকে যাওয়ার, তাহলে শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। মান নির্ধারণের বড় একটি জায়গা হলো মূল্যায়ন পদ্ধতি। আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে, সেটি হলো লেখাপড়া নোটবইভিত্তিক অথবা শিক্ষকরা নোট দেবেন; শিক্ষার্থীরা সেগুলো পড়ে সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। শ্রেণিভিত্তিক ধারাবাহিক যে মূল্যায়নগুলো নিয়মিত হওয়ার কথা, সেটা পেছনে পড়ে যাচ্ছে বা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে আমরা যদি জাতীয়ভাবে নির্ধারিত বড় বড় পরীক্ষাগুলোর সংখ্যা না কমাই, নিয়মিত ধারাবাহিক মূল্যায়ন না করি; তাহলে জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়ব। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা