গত ২ মে বজ্রপাতে কুমিল্লা, রাঙামাটি, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৯ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে কুমিল্লার চান্দিনা, সদর দক্ষিণ, দেবীদ্বার ও বুড়িচং উপজেলায় ২ মে সন্ধ্যায় বজ্রপাতে দুই কৃষকসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে গড়ে ২৫০ জনের মৃত্যু হয়। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে প্রায়ই বজ্রপাতের কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটে। আর এ বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান। কারণ, দেশটির একদিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর; এরপর রয়েছে ভারত মহাসাগর, যেখান থেকে আসে গরম আর আর্দ্র বাতাস। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই রয়েছে হিমালয়, যেখান থেকে ঢোকে ঠাণ্ডা বাতাস। আর এই দুই বাতাসের সংমিশ্রণ দেশে তৈরি করছে বজ্রপাতের অনুকূল পরিবেশ।
বন্যা এবং সাইক্লোনের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি ভূমিকম্পের ন্যায় আকস্মিক। দেশে বছর ধরে যে পরিমাণে দুর্যোগ হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ হয় মে মাসে। পরিসংখ্যানমতে, দেশে বছরে ৮০-১২০ দিন বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে এপ্রিল-জুনে হয় ৭০ শতাংশ। অপর পরিসংখ্যানমতে, ২০১৩-২০২০ সালে দেশে ১ হাজার ৮৭৮ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে ৭২ শতাংশই কৃষক। যদি কেউ খালি মাঠে বা পানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে সমতল ভূমির তুলনায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির উচ্চতা বেশি হওয়ায় তিনি সরাসরি বজ্রপাতের শিকার হতে পারেন।
অন্যদিকে কেউ যদি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, যেমন- মুঠোফোনে কথা বলেন বা কম্পিউটারে কাজ করেন অথবা টিনের ঘরে টিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকেন, তবে বজ্রপাত থেকে নির্গত অতিরিক্ত ভোল্টেজের সংস্পর্শে তিনিও মৃত্যুবরণ করতে পারেন। শস্য রোপণ বা আহরণের কাজে কৃষকরা মূলত দুই পা আড়াআড়ি করে সারিবদ্ধ অবস্থায় জমিতে কাজ করেন। তারা স্টেপ ভোল্টেজের কারণে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বজ্রপাতে দেশে বার্ষিক প্রাণহানির হার প্রতি ১০ লাখে ১ দশমিক ৬ জন। কিন্তু এপ্রিল-মে মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুজন বজ্রঝড়ের কারণে মারা যান। কারণ মার্চ-জুন মাসে দেশের কৃষকরা কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকেন। ফলে তারা বজ্রপাতের আঘাতের প্রথম শিকার হন। বাড়ি ফেরার পথে বজ্রপাতে মারা যান ১৪.৫ শতাংশ। পুকুর-নদীতে গোসল করা এবং মাছ ধরা অবস্থায় মারা যান ১৩.৪ শতাংশ। অপরদিকে মোট প্রাণহানির ২১ শতাংশ ঘরের অভ্যন্তরে ঘটে থাকে।
কিন্তু একটু সচেতন হলেই বজ্রপাত থেকে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। যেমন- কেউ যদি ঘরের ভেতরে থাকেন, তবে তার জন্য নিম্নোক্ত সতর্কতা জরুরি- (ক) ফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকা। (খ) প্লাম্বিং যেমন বাথটাব, রান্নাঘরের ধাতব পদার্থ থেকে দূরে থাকা। (গ) বজ্রঝড়ের সময় ঘরের জানালা, দরজা বা যেকোনো প্রবেশদ্বার থেকে দূরে থাকা। (ঘ) বজ্রপাতের সময় কোনো অবস্থাতেই কংক্রিটের ওপর না শোয়া বা দেয়ালের সঙ্গে হেলান না দেওয়া।
বজ্রপাতের সময় যদি কেউ বাইরে থাকেন, তবে ঝুঁকি এড়াতে অবশ্যই যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে- (ক) উঁচু স্থান এড়িয়ে চলতে হবে বা নদী, পুকুর, খাল-বিলের আশপাশে থাকা যাবে না। (খ) কোনো অবস্থাতেই ভূমিতে শোয়া যাবে না বা বিচ্ছিন্ন কোনো বড় গাছের নিচে দাঁড়ানো যাবে না। (গ) বৈদ্যুতিক তারের বেড়া, ধাতব পদার্থ বা সংশ্লিষ্ট বস্তু (টাওয়ার) থেকে দূরে থাকা। (ঘ) বজ্রঝড়ের সময় পুকুর, নদী-নালা বা হ্রদে মাছ ধরা বা নৌকা ভ্রমণ পরিহার করা। (ঙ) অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকলে (যেমন খেলার মাঠে) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ বজ্রঝড়ের সময় মানুষ জড়ো অবস্থায় থাকলে একসঙ্গে অনেক জনের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে।
দেশে যেহেতু বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তাই বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ১৮টি উপায় বাতলে দিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। উপায়গুলো হচ্ছে- ১. এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয় এবং এ সময়সীমা সাধারণত ৩০-৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করা। ২. আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে না যাওয়া। ৩. বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় বা খোলা মাঠে অথবা উঁচু স্থানে না থাকা। ৪. বজ্রপাতের সময় ধানখেত বা খোলা মাঠে থাকলে দ্রুত পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা। ৫. যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় গ্রহণ করা এবং টিনের চালা এড়িয়ে চলা। ৬. উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইলের টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। ৭. আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর বা জলাশয় থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা। ৮. বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ না ঘটানো। ৯. বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় না থাকা; জানালা বন্ধ রাখা এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি থেকে দূরে থাকা। ১০. বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং এগুলো বন্ধ রাখা। ১১. বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার না করা। ১২. বজ্রপাতের সময় শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্কদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখা। ১৩. বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে না যাওয়া। তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করা। ১৪. বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ না করা। ১৫. প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করা। ১৬. খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালে বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকের ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যাওয়া। ১৭. কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে, তা হলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা কক্ষে থাকা। ১৮. বজ্রপাতে কেউ আহত হলে দ্রুত চিকিৎসক ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্র আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বর্তমানে দেশে বজ্রবৃষ্টির মৌসুম চলছে। এ অবস্থায় বজ্রপাত বিষয়ে গণসচেতনতা বাড়ানো অতি জরুরি। কারণ বায়ুমণ্ডলীয় এ দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করার পথ সামান্য। নতুবা ‘বিনা মেঘে বজ্রপাতের’ মতো ঝড় ও বজ্রপাত আমাদের জীবন-জীবিকাকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ- কখন ও কোথায় বজ্রঝড় হতে পারে, তা আবহাওয়ার সংবাদ থেকে জেনে নেওয়া এবং ঝড় ও বজ্রপাতকালীন নিয়মাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ করা। পাশাপাশি ঝড়, বজ্রপাত থেকে রক্ষায় হাওরের বুকে ‘কৃষক ছাউনি’, হাওরে বজ্রপাত থেকে কৃষক ও জেলেদের রক্ষায় ‘লাইটনিং শেড’ স্থাপন করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, উপরিউক্ত ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। যদিও বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য তালগাছ লাগানোর কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। তবে তালগাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে। বস্তুত বজ্রপাত ঠেকানোর কার্যকর উপায় এখন পর্যন্ত মানুষের অজানা। তবে মানুষ যদি সচেতন হয়ে উল্লিখিত কৌশলগুলো যথাযথভাবে অবলম্বন করে, তা হলে বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি বহুলাংশে কমানো সম্ভব।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
[email protected]