আর মাত্র ৩২ দিন পর ভারতবাসী তথা বিশ্ববাসী জানতে পারবে ভারতে গণতন্ত্র রক্ষা হলো কি না। বিজেপির মনোভাব হলো এখানে ইচ্ছেমতো ধর্মাচরণ করা যাবে না, এমনকি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাম জানিয়ে দিয়েছেন, তার রাজ্য উত্তরপ্রদেশে গো-মাংস খাওয়া চলবে না। বিজেপি নেতারা নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, এবার ৪০০ পার। তা হলে তারা সংবিধানের আমূল পরিবর্তন করে দেবেন। কিন্তু গত কয়েক দিন বিভিন্ন নির্বাচনি প্রচারে কোনো বিজেপি নেতার মুখে ‘৪০০ পার’ করার কথা শোনা যাচ্ছে না। মোহন ভাগবত, নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ- এই ত্রয়ী বিভিন্ন নির্বাচনি বক্তৃতায় সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি অমিত শাহ মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ থেকে জামায়াত ও বিএনপি এই রাজ্যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের বক্তব্য- আমরা তো দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট আকারে পাঠিয়ে দিয়েছি, তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?
কংগ্রেস নির্বাচনি ইশতেহারে সংবিধান বাঁচানোসহ ২৫টি বিষয় উল্লেখ করেছে। সেগুলো তারা ক্ষমতায় এলে রূপায়িত করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-বর্তমানে বিজেপি জামানার বিধায়ক বা সাংসদ দলবদল করলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে করবে, সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা, ইচ্ছেমতো খাদ্য, পোশাক, ধর্মীয় রীতি মেনে চলার অধিকার। নির্বাচনি বন্ড, রাফাল চুক্তি, স্পেগাসাইটসহ যাবতীয় আইনের সংশোধন, সংবিধানের যেসব ধারা পরিবর্তন- পুনরায় ক্ষমতায় এলে তা সংশোধন করা হবে। অপরদিকে বিজেপির ইশতেহারে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে তারা পুরোনো নীতি বজায় রাখবে, অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হবে না। এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশ থেকে জামায়াত, বিএনপির লোকদের পশ্চিমবঙ্গে এনে মমতা ভোটব্যাংক পুষ্ট করতে চাইছে। এই অভিযোগ স্বয়ং অমিত শাহের।
গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রচারের উত্তাপ। নির্বাচনে আর একটি হাতিয়ার হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে মমতার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। এই স্লোগান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন, যেটা বাংলাদেশের নিজস্ব স্লোগান। শুধু মমতা নন, সোমবার পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনি প্রচারে এসে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার মুখেও এই স্লোগান শোনা গেছে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সিটি করপোরেশনের ভোটে আওয়ামী লীগ নেতা শামিম আখতার যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন, তাও এখন বিজেপি এবং তৃণমূলের হাতিয়ার।
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি রামমন্দির উদ্বোধনে যাননি কেন? রাষ্ট্রপতি উত্তর দিয়েছিলেন- আমি দলিত ও আদিবাসী। এ জন্যই আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। স্বয়ং রাষ্ট্রপতির প্রতি যদি বিজেপির এই মনোভাব হয়, তবে সাধারণ দলিত-আদিবাসীদের কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
ধর্মীয় মেরূকরণকে নতুন পোশাকে আনলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেটা করতে গিয়ে তিনি মহারাজা বনাম নবাব, রাজা বনাম বাদশা এবং শিবাজি বনাম আওরঙ্গজেবের তুলনা করে বসলেন। লোকসভা নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটে ভোট কম পড়ায় দ্বিতীয় দফার ভোটের আগেই মেরূকরণকে সামনে এনেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায়ও ভোটের হার কম পড়ায় মোদি তথা এনডিএ নেতাদের কপালের ভাঁজ চওড়া হয়। সেই জন্যই মোদির এই নতুন চাল!
রবিবার কর্ণাটকের ভোট প্রচারে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনকে নতুন করে সামনে এনে রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেসকে নিশানা করলেন তিনি। মোদি কর্ণাটকের প্রতিটি জনসভায় আহ্বান জানালেন- গরম যতই পড়ুক, আগে ভোটদান পরে জলপান।
রাহুলকে ‘শাহজাদা’ আখ্যায়িত করে মোদির বক্তব্য, ‘স্বাধীনতা লড়াইয়ের সময় থেকে কংগ্রেস ভোটব্যাংক তোষণের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কংগ্রেসের শাহজাদা সেই পাপকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সেটা এবারে কংগ্রেসের নির্বাচনি ইশতেহারেও প্রমাণ মিলেছে। শাহজাদার তাজা বক্তব্য- ভারতের রাজা-মহারাজারা অত্যাচারী ছিলেন। তারা মর্জিমাফিক গরিবদের জমি ছিনিয়ে নিতেন।
শাহজাদার এই বয়ান তোষণের বয়ান। তিনি মহারাজাদের খারাপ বলছেন। অথচ নিজাম, নবাব, বাদশাহের বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। যে আওরঙ্গজেব ভারতের মন্দির ধ্বংস করেছেন, অপবিত্র করেছেন তার বিরুদ্ধে শাহজাদার মুখে কুলুপ। যারা ভারতে এসে লুট করেছেন, গো-হত্যা করেছেন, ভারতের বিভাজনে বড় ভূমিকা নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নীরব। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন- কেউ ভাবতে পারেনি বারানসির হিন্দু রাজার সহায়তা ছাড়া বেনারসে এই ইউনিভার্সিটি হতো? এসব কথা কংগ্রেসের কোনো নেতার মুখে শুনতে পাবেন না।
রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, আগে রাজা-মহারাজারা যা চাইতেন তাই করতেন। জমি-জায়গার দরকার পড়লে হরণ করতেন। কংগ্রেস দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে। সংবিধান দিয়েছে, গণতন্ত্র এনেছে।
এআইসিসির নেতা মানিকম টোগা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট করেছেন। তা দেখে সংসদে দাঁড়িয়ে মোদি বলছেন- আজ ইংরেজদের কথা বলা হচ্ছে, রাজা-মহারাজদের সঙ্গে একসময় ইংরেজদের দারুণ ঘনিষ্ঠতা ছিল। মানিকম বলেন, একসময় যে মোদি রাজা-মহারাজাদের সমালোচনা করেছেন, এখন তাদেরই প্রশংসা করছেন। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাটের মতো রাজ্যগুলোতে রাজপুত্রদের বিজেপিবিরোধী ক্ষোভের দিকটি নিয়েও মানিকমের দাবি- অবিলম্বে মোদিকে রাজপুতদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি জঘন্যতম স্তরে পৌঁছেছেন। রাহুল গান্ধীর প্রতিটি বক্তব্যকে বিকৃত করে তিনি সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আসলে প্রস্থান অবশ্যম্ভাবী বুঝেই এই খেলায় মেতেছেন।
বিভিন্ন জনসভায় মোদি এক্স-রে এবং উত্তরাধিকার করের প্রসঙ্গ তুলছেন। তিনি বলেছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষের জমানো সম্পদ, গাড়ি, স্কুটার, স্ত্রীধন, মঙ্গলসূত্র সবই এক্স-রে হবে। ঘরে ঘরে এক্স-রে করে তারা সম্পদ লুট করতে চায়। সেই সম্পদ বণ্টন করবে পছন্দের ভোটব্যাংককে। আপনারা কি কংগ্রেসকে সেই সম্পদ লুট করতে দেবেন? আমি যতদিন বেঁচে আছি কংগ্রেসকে এই লুট করতে দেব না।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক