ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় পেতে নতুন করে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে সফররত আইএমএফ মিশন। আইএমএফ বলেছে, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ মজুত থাকতে হবে ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলার। এ ছাড়া একই সময়ে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সোমবার অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সার্বিকভবে পর্যালোচনামূলক বৈঠক করে মিশন। ওই বৈঠকে চতুর্থ কিস্তি ঋণ পেতে নতুন শর্ত দেয় আইএমএফের প্রতিনিধিদল।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে রাখার অনুরোধ জানান অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। কিন্তু আইএমএফ কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। আজ (মঙ্গলবার) এবং আগামীকাল (বুধবার) সরকারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আশা করছি, আমাদের অনুরোধে বিবেচনা করবে আইএমএফ।’ জানা যায়, এর আগেও বাংলাদেশ রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রায় দুই দফা ছাড় পেয়েছে।
গত ২৪ এপ্রিল ঢাকায় সফরে আসা আইএমএফের ডেভেলপমেন্ট মাইক্রোইকোমিক্স ডিভিশনের প্রধান ক্রিস পাপাগেওর্জিউর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ইস্যুতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্যের ভিত্তিতে আজ মঙ্গলবারও সরকারের সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল।
বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৃতীয় কিস্তি ছাড় চূড়ান্ত করবে। একেই সঙ্গে চতুর্থ কিস্তির জন্য নতুন শর্ত দেওয়া হবে। মিশনের সফর শেষ হবে ৮ মে। সফরে শেষ দিনে একটি সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, তৃতীয় কিস্তির টাকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ এর জন্য প্রায় সব শর্ত পূরণ করেছে সরকার। সব ঠিক থাকলে আশা করা যাচ্ছে, মে মাসের শেষে অথবা জুনে এই টাকা ছাড় হবে।
তবে চতুর্থ কিস্তি নিয়ে চিন্তিত সরকার। কারণ নতুন শর্ত বিশেষ করে ৩০ জুন পর্যন্ত রিজার্ভের নতুন যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তা অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুত ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত পর্যালোচনা করতে বর্তমান মিশন ঢাকায় অবস্থান করছে।
গত বছরের জানুয়ারিতে ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের পর এ পর্যন্ত দুই কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন তৃতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড়ের অপেক্ষা। এই কিস্তির জন্য গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন শর্তের বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করছে মিশন। আর চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের জন্য আগামী জুনভিত্তিক বেশ কিছু শর্ত পরিপালনের কথা রয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং রাজস্ব আদায় অন্যতম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর নাগাদ পরিপালনের জন্য মোটা দাগে সংশোধিত যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ছাড়া অন্য সব শর্ত পূরণ হয়েছে। তাই তৃতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে প্রতিনিধিদল খুব বেশি আপত্তি তোলেনি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার মনে করছে, আগামী জুনভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে রিজার্ভ ও রাজস্বে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই আবারও এ দুই ক্ষেত্রে ছাড় চায় বাংলাদেশ।
শর্ত অনুযায়ী চতুর্থ কিস্তির জন্য আগামী জুন শেষে নিট রিজার্ভ ২০ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। তবে বর্তমানে দেশে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ রয়েছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন বা দেড় হাজার কোটি ডলার। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কারণ হিসেবে মিশনকে জানানো হয়, বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে কাঙ্ক্ষিত হারে বাজেট সহায়তা পাওয়া যায়নি। আগামী জুনের আগে বিশ্বব্যাংক থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে, এর বাইরে খুব বেশি সহায়তার আশা করা যাচ্ছে না।
তা ছাড়া নির্বাচনের পর আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমে আসবে বলে আশা করা হলেও তা হয়নি। তাই জুন শেষে এ লক্ষ্যমাত্রা ১৭ থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে নামিয়ে আনার অনুরোধ জানায় সরকার। একই সঙ্গে বিনিময় হার আরও নমনীয় করতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উন্নতির জন্য শিগগির ক্রলিং পেগ সিস্টেম চালু করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে আজ এবং আগামীকালের বৈঠকে।
প্রাথমিকভাবে আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রিজার্ভ বড় ধরনের উন্নতি না হওয়ায় বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তা কমিয়ে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়। তারপরও বাংলাদেশ এ লক্ষ্য থেকে ৫৮ মিলিয়ন ডলার পিছিয়ে ছিল। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য গত জুন পর্যন্ত রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, বৈঠকে আইএমএফ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বেঁধে দেয় ৩ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তাই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা কমানোর জন্য অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা আইএমএফ মিশনকে অনুরোধ করেছে। যদিও এ বিষয়ে কিছুই বলেনি আইএমএফ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে কাছাকাছি অবস্থানে যাওয়া যাবে। কিন্তু রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে।