ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ, নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন । খবরের কাগজ
ঢাকা ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ, নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ০২:২৭ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ, নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন
কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি (বাঁয়ে), সলিমুল্লাহ হলে রবীন্দ্র স্মারক। ছবি: খবরের কাগজ

নোবেল বিজয়ের ১৩ বছর পর ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বিশ্বকবি খ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এসেছিলেন। থেকেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের (আর সি মজুমদার) বাংলোতে। টানা ৯ দিনের ঢাকা সফরে ঘুরেছেন পুরান ঢাকা ও নব্য গড়ে ওঠা রমনায়। অবস্থান করেছিলেন বুড়িগঙ্গায় নবাব সলিমুল্লাহর ছেলে খাজা হাবিবুল্লাহর বিলাসবহুল জলযানে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) আয়োজনে কার্জন হলে দুটো বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তৎকালীন মুসলিম হলে (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) গাঁদা ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল রবি ঠাকুরকে, জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের অনুরোধে বাসন্তিকা পত্রিকার জন্য লিখে দিয়েছিলেন ‘বাসন্তিকা’ কবিতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক স্মৃতিই রয়েছে, যেগুলো শুধু বইয়ের পাতায় বদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রমণের কোনো স্মারকচিহ্নের দেখা না মিললেও আর সি মজুমদারের সঙ্গে তোলা রবি ঠাকুরের একটি স্থিরচিত্র মেলে।

হলটির শহিদ অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য স্মৃতি গ্রন্থাগারের রক্ষিত ছেঁড়া-জীর্ণ-শীর্ণ ৪৩ বছরের আগের একটি বাসন্তিকা পত্রিকায় মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ছবিটি। জগন্নাথ হলের বাসন্তিকা পত্রিকায় রজতজয়ন্তী সংখ্যায় আর সি মজুমদারের লিখা ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এর মধ্যে ছোট আকারের রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ৯ দিন ভ্রমণের অনেক স্মৃতিই উঠে আসে। ১৯০৫ সালে রমেশ চন্দ্র মজুমদার কলকাতা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বন্ধুদের আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ চলে আসতো, যদিও তখন রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাননি। বন্ধুমহলের সবচেয়ে বড় কুলদাপ্রসাদ মল্লিকসহ কয়েকজনের অংশগ্রহণে ‘রবীন্দ্র চক্র’- এর বৈঠক বসত। সেই থেকে রবীন্দ্রভক্ত হয়ে পড়েন আর সি মজুমদার।

আর সি মজুমদার জগন্নাথ হলের বাসন্তিকার রজতজয়ন্তীর সংখ্যায় ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এর প্রথমাংশে এভাবে লিখেছেন, ‘সন্ধ্যায় ইনস্টিটিউটে, কখনো বা শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমাদের এই ছোট্ট রবীন্দ্রচক্রের বৈঠক বসত এবং আমরা কয়েকজন রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত হয়ে উঠলাম। তারপরে ৬৭ বছর কেটেছে- সে ভক্তি কখনো কমেনি, শতগুণ বেড়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ যখন আসেন, তখন তাকে অনেকটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন আর সি মজুমদার। বাসন্তিকায় লিখা শুধু ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এ নয়, ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ বইয়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র’ অংশে ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাকে ঘিরে বিস্তর বর্ণনা করেছেন আর সি মজুমদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে যখন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ঘটনাক্রমে কবিগুরুর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আর সি মজুমদারের বাসায়।

১৯২৬ সালে কবিগুরু যখন ঢাকা আসবেন বেশ শোরগোল পড়েছিল। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জর্জ হ্যারি ল্যাংলির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয় রবীন্দ্রনাথ আর সি মজুমদারের বাড়িতে থাকবেন। আর রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ এবং রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান স্বরলিপিকার দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র সহযোগী কালীমোহন ঘোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়িতে থাকবেন। এবং কবির সঙ্গী ইতালির খ্যাতনামা অধ্যাপক জিয়োসেপ্নে তুচ্চিসহ দুজন বিদেশি সঙ্গী থাকবেন উপাচার্যের বাসভবনে। যদিও বাকিদের থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার লোকজনের মাথাব্যথা না থাকলেও কবি ভক্তদের মাঝে বেশ শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছিল ঢাকাজুড়ে।

আর সি মজুমদার ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এ উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকায় দু-চারজন লোক বেশ শোরগোল পাকিয়ে তুলল। তারা রবীন্দ্রনাথকে জানাল যে, ঢাকার জনসাধারণের এ ইচ্ছা নয় যে তিনি আমার বাড়িতে থাকেন। এই নিয়ে অনেক অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটে ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার অনেক চিঠি লেখালেখি হয়। ফলে রবীন্দ্রনাথ তার বিশ্বভারতীর অধ্যাপক শ্রী নেপালচন্দ্র রায়কে সরেজমিনে তদন্ত করবার জন্য ঢাকায় পাঠালেন। নেপালবাবু ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানালেন যে, দু-একটি লোক ছাড়া আমার বাড়িতে থাকায় সকলেরই সম্মতি আছে। তখন স্থির হলো রবীন্দ্রনাথ আমার বাড়িতেই থাকবেন।’

অন্যদিকে ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ বইয়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র’ অংশে মজুমদার লিখেছেন তার পাঠানো এক চিঠির প্রেক্ষিতে একটি চিঠিতে- ‘রবীন্দ্রনাথ লিখলেন যে, তিনি আমার বাড়িতেই থাকবেন।’

রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জ হয়ে। তিনি ১৯২৬ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছান।
আর সি মজুমদার ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ বইয়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র’ অংশে লিখেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জ স্টিমার স্টেশন থেকে গাড়ি করে রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় আমার বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। সেখানকার বড় বড় জমিদার, বিশেষতঃ ভাওয়ালের রাজকুমার এবং ঢাকার নবাব, আমায় বলে পাঠালেন যে রবীন্দ্রনাথের জন্য কোনো গাড়ি দরকার হলে আমি যেন তাদের জানাতে দ্বিধা না করি। রবীন্দ্রনাথের আগমন উপললক্ষে ঢাকায় বিপুল উদ্দীপনা; রাস্তায় বহু লোক তাকে সংবর্ধনা জানালেন।’

যখন আর সি মজুমদারের বাড়িতে কবি গুরু প্রবেশ করেন ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনায় তাকে সাদরে গ্রহণ করা হলো। ঢাকা শহরের ভদ্র সমাজের মানুষজনের উপস্থিতিও ছিল বেশ।

‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ আর সি মজুমদার অনেকটা এভাবেই বর্ণনা করেছেন, ‘তার আসার দিন আমার গৃহদ্বারে, সিঁড়িতে, ওপরের বারান্দায় এবং ঘরে নানারকম আলপনা আঁকা হয়, দরজার সামনে মঙ্গলকলস এবং আম্রপল্লব। ...কবি এসে পৌঁছানমাত্রই তার ওপর ফুলবর্ষণ শুরু হলো। মেয়েরা শঙ্খধ্বনিতে তাকে স্বাগত জানালেন। মঙ্গল-কলসের মাঝে পথ দিয়ে আমরা বাড়িতে প্রবেশ করলাম।’

আর সি মজুমদারের এই বর্ণনা তাই প্রমাণ করে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে এক পলক দেখতে এবং তার যেন সম্মান আর কদরের ঘাটতি না হয় বেশ সচেতনই ছিলেন তারা। ১৯০৯-১০ সালের দিকে কলকাতায় হায়দরাবাদ থেকে একজন বড় সংগীতজ্ঞ ও বাদকের আসরে রবি ঠাকুরের গলায় প্রথম গান শোনেন। পঞ্চাশ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে শুনলেন ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী।’

আর সি মজুমদার ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এর মধ্যে লিখেছেন, ‘পঞ্চাশ বছর বয়সে তার গলায় যে সুর ধ্বনিত হলো সারা সভাকক্ষ তার মূর্ছনায় ভরে গেল। গানের প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছিল-যা আজকালের রবীন্দ্রসংগীতে দুর্লভ।’

১৯২৬ সালে কবিগুরুর ঢাকা ভ্রমণ প্রসঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র-রচনা’ শীর্ষক এক লিখাতে লিখেছেন, ‘১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল নর্থব্রুক হলে সংবর্ধনা গ্রহণ দিয়ে ঢাকা কর্মসূচি শুরু করলেও ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের (এখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) কর্মসূচি দিয়েই মূলত তার বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কর্মসূচির সূচনা।’

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে যখন রবীন্দ্রনাথকে ফুলেল সংবর্ধনা দেওয়া হয় তখন বৈদ্যুতিক পাখায় গাঁদা ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেই না পাখা চালিয়ে দেওয়া হলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ফুলের পাপড়ি, চারপাশ করতালিতে ধ্বনিত হলো।

এদিকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক এক লেখায় ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ওই ফুলেল সংবর্ধনা প্রসঙ্গে লেখেন, ‘‘সংবর্ধনা সভায় হলের ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন। মুসলিম হলের শিক্ষার্থীদের আন্তরিক সংবর্ধনায় রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে অভিভূত হয়ে পড়েন। সংবর্ধনার উত্তরে তাই তিনি প্রথমেই বলেন, ‘এই সভাগৃহে প্রবেশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমার ওপর পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। প্রাচীন শাস্ত্রে পড়েছি কৃতী ব্যক্তির ওপর পুষ্পবৃষ্টি হয়। এ পুষ্পবৃষ্টি যদি তারই প্রমাণ করে তবে আমি আজ আনন্দিত।’ অভিভাষণের শেষে কবি বলেন, ‘ঈশ্বর এক, তার মধ্যে কোনো ভেদ নাই। যিনি সকল বর্ণের, সকল জাতির জন্য নিত্য, তার গভীর প্রয়োজন প্রকাশ করছেন।’’

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের ওই লেখার সূত্রে জানা যায়, ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ডাকসুর আয়োজনে কার্জন হলে তিনি উপস্থাপন করেন প্রথম বক্তৃতা: ‘দ্য বিগ অ্যান্ড দ্য কমপ্লেক্স’।

বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক ওই লেখাতে উল্লেখ করেন, “সভার প্রারম্ভে সমবেত সুধীদের কাছে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর জি এইচ ল্যাংলি বলেন: ‘এটা আমাদের পক্ষে আজ একটা পরম সুযোগ যে, এই সন্ধ্যায় পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী আমাদের কাছে কিছু বলবেন।’

ওই সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ ভাষণ উপস্থাপন করেন। তার ভাষণের মূল কথা ছিল: শিল্প-সৃষ্টি বিষয় ও ভাবের আবেগময় বিবরণ বা নিবেদন। তাই এটা কখনোই ক্যামেরায় তোলা ফটোর মতো নয়। শিল্পী খুবই ভাবপ্রবণ এবং তার এই প্রবণতা বিষয় নির্বাচনের রুচি-বাগীশতাতেই নয়, তার শিল্পের প্রত্যেকটি বিস্তৃত ব্যাপারেও। ...আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ঈশ্বর তার সৃষ্টির মধ্যে বাস করেন। শিল্পীও তেমনি নিজেকে মেলে ধরেন তার শিল্পের মাঝে। শিল্পীর শিল্পাদর্শ নিছক বিলাস বা কল্পনা-উদ্ভূত নয়, তা পরম বাস্তব।”

পরবর্তীতে অসুস্থতার কারণে ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী কর্মসূচিগুলো বাতিল করা হয়। অধ্যাপক ঘোষ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ’ ১৯২৬ সালের বাসন্তিকা (জগন্নাথ হল বার্ষিকী) পত্রিকার সূত্র টেনে ওই পত্রিকায় লেখা হয়- “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার জন্য, হল ইউনিয়ন বিপুল আয়োজন করিয়াছিলেন। কবি হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়ায় সংবর্ধনা হইতে পারে নাই। কার্জন হলে আমাদের হলের পক্ষ হইতে কবিকে একটি অভিনন্দনপত্র দেওয়া হয়। অভিনন্দনপত্র মূল্যবান বস্ত্রে মুদ্রিত ও রৌপ্যখচিত হয়ে ভেলভেট নির্মিত একটি সুদৃশ্য আধারে কবিকে উপহূত করা হয়। কবি ইহার কারুকার্যে অতীব প্রীত হইয়াছিলেন।”

অসুস্থ হলে সিভিল সার্জন ও ঢাকার অন্যান্য বড় বড় ডাক্তাররা শরীর পরীক্ষা করতে হাজির হন আর সি মজুমদারের বাড়িতে। আর সি মজুমদার তার ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ লিখেছেন, “ডাক্তারেরা দেখে বললেন যে অসুখের কোন লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ শুনে বললেন যে অসুখ তেমন কিছু নয়। তবে বহুদিন পরে পূর্ব বাংলায় এসেছি; মনে হয় জলে একটু থাকতে পারলে ভাল হতো।”

পরবর্তীতে বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটে নবাব সলিমুল্লাহর ছেলে খাজা হাবিবুল্লাহর বিলাসবহুল জলযান তুরাগ হাউস বোটে কবির থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্র নাট্যকার শ্রীমন্মথ রায়ের দায়িত্বে ২০-২৫ জন উৎসুক ছাত্র তার পরিচর্যার দায়িত্ব নিলেন। জানা যায়, তুরাগ হাউস বোটে অবস্থানকালীন সময়ে প্রতিদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকার নবাবদের মোটরচালিত বোটে বুড়িগঙ্গায় ভ্রমণে বের হতেন। প্রায় ছয় থেকে সাত মাইল ভ্রমণ করতো মোটরচালিত বোট।

বুড়িগঙ্গায় জলযান বিলাসের পুরো সময় জুড়ে দেখভালে পাশে ছিলেন তৎকালীন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট আর সি মজুমদার ও তার স্ত্রী। এই সময় জুড়ে অনেক মানুষ সাক্ষাৎ করতে আসতেন। আর সি মজুমদার কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ এ লিখেন, “এক দিন বিকালে প্রায় ৪০-৫০ জন উপস্থিত। রবীন্দ্রনাথ আমার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, এদের একটু জলযোগের ব্যবস্থা কর। আমার বাড়ি সেখান থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। কিন্তু মন্মথ তার ছাত্রদলকে নানা দিকে পাঠিয়ে আধ-ঘণ্টার মধ্যেই শহর থেকে প্রচুর মিঠাই ও চায়ের ব্যবস্থা করল।”

পয়ষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বেশ ভোজনরসিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে যখন তিনি এলেন প্রতিদিন তার খাবারে বড় কই মাছ খাবারে দেওয়া হতো এর পাশাপাশি অন্যান্য তরকারিও থাকত। মাছ খেয়ে বেশ খুশিও হতেন তিনি। আর সি মজুমদার তার ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ বইতে লিখেছেন, “অন্যান্য তরকারির সঙ্গে তিনি পুরো মাছটিও খেতেন। খেয়ে তিনি খুব খুশী হতেন- বলতেন, ‘পূর্ব বাংলার মতো মাছ রান্না আমাদের ওদিকে করতে পারে না।”

মেয়ের নামে কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের নাম চুরি:

আর সি মজুমদারের একমাত্র পুত্রসন্তানের নাম ছিল অশোক, ডাক নাম রবি। রবির বয়স তখন নয় দশ বছর হবে। সকলকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিলাম যতদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন যেন তাকে রবি বলে ডাকা না হয়। কিন্তু একদিন ঘটে বিপত্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সি মজুমদারের ছেলের নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘রবি।’

এ নিয়ে আর সি মজুমদার ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ আমার ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কি?’ সে, বলে বসল ‘রবি।’ তখন তিনি গম্ভীরভাবে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা তো লোক ভালো নও।’ আমরা তো কিছু বুঝতে না পেরে ভয়ানক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। ‘কি ব্যাপার?’ তিনি বললেন, ‘আমি আসার আগেই আমার নামটা তোমরা চুরি করেছ। সুতরাং এরপর আরও অন্য জিনিস চুরি করতে পার।’ আমরা হেসে উঠলাম।”

ওই বইতে মেয়ে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরে তিনি আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমার বড় মেয়ের বয়স তখন বারো তেরো বছর। এক দিন হঠাৎ সে রবীন্দ্রনাথের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি নাকি খুব বড় কবি? আপনি নাকি অনেক কবিতা লিখেছেন।’ রবীন্দ্রনাথ একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই দুর্নাম আমার আছে।’ অমনি একটি ছোট খাতা বার করে সে বলল, ‘আমায় নামে একটি কবিতা লিখে দিন না।’ রবীন্দ্রনাথ তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন- ভালো নাম ও ডাক নাম। এবং তৎক্ষণাৎ তার সেই ছোট খাতায় তারই কলমে একটি কবিতা লিখে দিলেন- তার মধ্যে তার দুটি নামই আছে। আমার এই মেয়ের বিবাহের সময় এই কবিতাটি প্রতিলিপিসহ ছাপিয়েছিলাম। পরে রবীন্দ্রনাথের ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামক ছোট একখানি পুস্তিকায় ও রচনাবলিতে এটি ছাপা হয়েছে। তবে তাতে ঘটনাটির কোনো উল্লেখ নেই।

বইটির একটি জায়গায় আর সি মজুমদার লিখেছেন, “৯দিন রবীন্দ্রনাথ আমার অতিথি ছিলেন।”

সরেজমিনে গিয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের আসা প্রসঙ্গে কোনো তথ্য কিংবা স্মারকচিহ্নের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হল প্রভোস্টের কক্ষে দেখা মেলে হলটির আজীবন সদস্যের নাম যেখানে কবিগুরুর অবস্থান দ্বিতীয়।

এদিকে জগন্নাথ হলের শহিদ অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য স্মৃতি গ্রন্থাগারে দেখা মিলে রজতজয়ন্তী বাসন্তিকা পত্রিকার একটি সংখ্যা। যার মারফতে তৎকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবি, বাসন্তিকা পত্রিকা এবং ওই পত্রিকায় লিখা তৎকালীন হল প্রভোস্ট অধ্যাপক রমেশচন্দ্রের ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ পাওয়া যায়।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের গ্রন্থাগারিক আলম সরকার এবং জগন্নাথ হলের সহকারী গ্রন্থাগারিক বিমল চন্দ্র সরকারের ধারণা, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সেইসব কাগজ পুড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। তাদের মতো একই ধারণা পোষণ করেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ।

সার্বিক বিষয়ে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারের ১৩ বছর পর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলে, বক্তৃতা রেখেছিলেন, এটি নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে কারণেই হোক শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না, রেকর্ড সংরক্ষণের প্রতি গোটা জাতির ইতিহাসে মনোযোগের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে তথ্য ছবিসহ রেকর্ড সংরক্ষিত অবস্থায় নেই। মাত্র একটি মাত্র ছবি পাওয়া যায়, তৎকালীন জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের সঙ্গে।’

এর পেছনে তিনটি কারণে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত, তখন হয়তো ক্যামেরার ব্যবহার এতটা ব্যাপক ছিল না। দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালে যেভাবে জগন্নাথ হল তছনছ হয়েছে; আমার ধারণা এ ধরনের কোনো রেকর্ড যদি থাকতো হয়তো সেটা তখন নষ্ট হয়ে গেছে। তৃতীয়ত আমরা জাতিগতভাবেই রেকর্ড সংরক্ষণের প্রতি ততটা মনোযোগী না। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডি.লিট উপাধি দেয়। সেই তথ্যও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ডে নেই, বিশ্বভারতীর ফাইলে পেয়েছি। তেমনি অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ডি.লিট উপাধি গ্রহণের জন্য আসতে পারবেন না- এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চিঠি দিয়েছিলেন সেটিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত নেই। পরবর্তীতে সেটি আমি জাদুঘরে দেখেছিলাম।’

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আজীবন সদস্য করার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ দশটা বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের এই অঞ্চলে ছিলেন। বাঙালি এবং একজন বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী। কেউ কেউ বিখ্যাত মানুষকে সম্মান দেখালে নিজেই অনেকটা সম্মানিত হয়। হয়ত এই বোধ থেকেই আজীবন সদস্য করা হয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে কাজ করতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারে, তবে খুব যে বেশি তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তারপরে বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুলকে নিয়ে একসঙ্গে একটি কাজ করলেও করতে পারে। আমি অনেক খুঁজেছি, কলকাতায় খুঁজেছি; তেমন একটা পাইনি। ফলে এটি একটি কঠিন কাজ। এটা আমাদের জাতিগত সংকট, আমরা পুরোনো জিনিস ওভাবে রাখি না ধ্বংস করে ফেলি।’  

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি ১০ বছরেও

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি ১০ বছরেও
হাইকোর্ট

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করার জন্য ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে মোট তিন দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিগত ১০ বছরেও এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। মাঝেমধ্যে কিছু পুলিশি তৎপরতা দেখা গেলেও তদারকির অভাবে ক্রমান্বয়ে সড়ক-মহাসড়ক চলে গেছে তাদের দখলে। 

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে এ ধরনের সব রিকশা বন্ধ করতে ২০১৪ সালে প্রথমবার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০১৭ সালে এসব পরিবহন বন্ধে আরেক দফা নির্দেশনা দেওয়া হয় হাইকোর্ট থেকে। এরপর ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ থ্রি-হুইলার ও ইজিবাইক বন্ধ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে অটোরিকশার আমদানিও নিষিদ্ধ করা হয়। এ আদেশের সংশোধন চেয়ে বাংলাদেশ ইলেকট্রিক থ্রি-হুইলার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন আপিল বিভাগে আবেদন করে। আবেদনের শুনানি শেষে মহাসড়কে সব ধরনের থ্রি-হুইলার ও ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। 

আদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা সর্বত্র বন্ধের আদেশ বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। আদেশের ফলে ইজিবাইক ও থ্রি-হুইলার গ্রামাঞ্চলের সাধারণ রাস্তায় চলাচলের সুযোগ পায়। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে সারা দেশে সব মহাসড়কে তিন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক, নছিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কয়েক দফা বিজ্ঞপ্তি জারি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। 

বিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবে সড়কে আজও কোনো শৃঙ্খলা ফেরেনি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন আইনজীবীরা। এ ব্যাপারে রিটের শুনানিতে অংশগ্রহণকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত খবরের কাগজকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা কমানো, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো, বিদ্যুতের অপচয় রোধসহ বিভিন্ন কারণে ওই রিট দায়ের করা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। শুনেছি নির্দেশনার আলোকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তবে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে তদারকির প্রয়োজন, যা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়।’

রিটকারীর আইনজীবী আতিক তৌহিদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী ব্যাটারিচালিত রিকশা কোনো অবস্থাতেই দেশের কোথাও চলাচল করতে পারবে না। এ ছাড়া থ্রি-হুইলার, ইজিবাইকসহ এ ধরনের কোনো যানবাহন দেশের কোনো মহাসড়কে উঠতে পারবে না। কিন্তু অদ্যাবধি এ রায় বাস্তবায়ন করা হয়নি। কর্তৃপক্ষ রায় বাস্তবায়ন না করায় মূলত সর্বোচ্চ আদালতকে অবজ্ঞা করা হয়েছে।’

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইকসহ এ ধরনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ চেয়ে ২০২১ সালে ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট করেছিলেন বাঘ ইকো মোটরস লিমিটেডের সভাপতি কাজী জসিমুল ইসলাম। এতে শিল্পসচিব, সড়ক পরিবহনসচিব, পরিবেশসচিবসহ সাতজনকে বিবাদী করা হয়েছিল। রিটে বলা হয়, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক এবং এ ধরনের যানবাহনে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয়। এ জন্য বিদ্যুৎ খাত থেকে সরকার প্রয়োজনীয় রাজস্ব হারাচ্ছে। এগুলো পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। রুট পারমিট ছাড়াই রাস্তায় বেপরোয়া চলাচল করে। এতে দুর্ঘটনা বেড়েছে। মানুষের প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। তাই এ ধরনের যানবাহন বন্ধ করা জরুরি। 

রিটের শুনানি শেষে ১৫ ডিসেম্বর এক আদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইকসহ এ ধরনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন হাইকোর্টের বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের বেঞ্চ। একই সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইকসহ এ ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, মর্মে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। শুনানিতে রিটের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট আতিক তৌহিদুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত।

এর আগে ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ দেশের সব মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক, নছিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এসব নির্দেশনার আলোকে প্রথম দিকে পুলিশি তৎপরতায় মহাসড়কে এসব যান চলাচল কমে গিয়েছিল। এ সময় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমতে থাকে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই মহাসড়ক আবার তিন চাকার গাড়ির দখলে চলে যায়। এর ফলে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার আবার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন গলার কাঁটা

ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন গলার কাঁটা
ব্যাটারিচালিত রিকশা

ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রথম ঢাকা শহরে চালু হয় অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) আমলে, ২০০৯ সালের শেষের দিকে। তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এগুলোকে বৈধতা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সেই সময় ডিসিসি ও বিআরটিএর মধ্যে বিরোধ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। তখন পিছু হটে ডিসিসি। 

তারপর থেকে অবৈধভাবেই বিকশিত হতে থাকে এই রিকশা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ যেটাকে ‘বাংলার টেসলা’ বলছেন সেটাকেই এখন অবৈধ তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করতে চাইছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনরা না চাইলে তো এটি বিকশিত হতে পারত না। শুরুতেই যদি সরকার কঠোর হতো তাহলে আজ এই পরিস্থিতি দেখতে হতো না। এখন লাখ লাখ পরিবারের জীবিকা এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর কঠোর সিদ্ধান্তে আসতে হবে। 

তখন অভিবক্ত ডিসিসি বৈধতা দিতে চাইলেও এখন বিভক্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি) চায় না এই রিকশা চলাচল করুক। কারণ হিসেবে সংস্থা দুটি নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলছে। 

ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলছেন, সিদ্ধান্তে আসা দরকার যে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক চলবে না। এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

অন্যদিকে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলছেন, ভয়াবহ ব্যাপার, যখন ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা দুই পা ওপরে উঠিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালান। অনেক প্রতিবন্ধী চালক আছেন, যারা চোখে কিছুটা কম দেখেন, তারাও এই রিকশা নিয়ে নেমে পড়েন।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথম থেকেই এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হতো, তা যখন করা যায়নি তাহলে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তারপর কঠোর হওয়া দরকার।’

‘বাংলার টেসলা’ নিয়ে শুরুর মতবিরোধ চলছে এখনো
অবিভক্ত ডিসিসি ও বিআরটিএর সেই পুরোনো মতবিরোধ এখনো বিদ্যমান। সরকারের একটি অংশ মনে করছে এটি বিপজ্জনক। তাই চলতে দেওয়া যাবে না। আরেকটি অংশ বলছে, এটি কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রয়েছে ব্যাপক উপযোগিতা। 

টেসলা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি। ব্যাটারিচালিত রিকশাকে তাই বাংলার টেসলা বলে অভিহিত করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা হলো ‘বাংলার টেসলা’। এসব যান যতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, তার চেয়ে রিটার্ন অনেক বেশি। অথচ যেসব কথা বলে এখন এসব রিকশা নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো এসব রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে বিপুল বিদ্যুৎ খরচ হয়। 

রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান রিপন খবরের কাগজকে বলেন, সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশাকে বাংলার টেসলা বলেছেন। তিনি দ্রুত এসব রিকশার গতিসীমা ঠিক করে ও নীতিমালা প্রণয়ন করে লাইসেন্স দিতে বিআরটিএকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিদ্যুৎ অপচয় করছে। একটি বাসায় ৬ ঘণ্টা এসি চালাতে ১৬ ইউনিট বিদ্যুৎ লাগে; আর একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে সাড়ে ৩ থেকে ৪ ইউনিট বিদ্যুৎ লাগে। এ ছাড়া আবাসিকের চেয়ে বহুলাংশে বিল দিচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশামালিকরা। আমাদের দাবি হলো, মোটরযান গতিসীমা নীতিমালা সংশোধন করে দ্রুত লাইসেন্স দেওয়া হোক। ব্যাটারিচালিত রিকশা কিন্তু মূল সড়কে চলে না, চলে অলিগলিতে। হুট করে এসব রিকশা বন্ধ হয়ে গেলে নগরবাসী যে বিপাকে পড়বেন, তার দায় নিতে হবে বিআরটিএ ও সড়ক মন্ত্রণালয়কে। 

সম্ভাব্য রাজস্ব যাচ্ছে চাঁদাবাজদের পেটে
নিবন্ধন দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে সরকারের ভেতরে মতবিরোধের মধ্যেই বেড়ে ওঠা এই খাত থেকে বিপুল রাজস্ব পেতে পারত সরকার। নিবন্ধন দিলে বছরে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ পুরোটা চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজদের পকেটে। 

বাংলাদেশ ইলেকট্রিক ব্যাটারি অ্যান্ড মোটরচালিত অটোরিকশা অটোবাইক সার্ভিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল কালাম বলেন, আমদানিকারকরা বিভিন্নভাবে ইজিবাইক আমদানি করে রাস্তায় নামিয়েছেন। এর মাধ্যমে লাখ লাখ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে অনেক শিক্ষিত বেকার রয়েছে। ২০১৬ সালে সারা দেশে ইজিবাইক ও অটোরিকশার সংখ্যা ছিল দুই থেকে আড়াই লাখ। বর্তমানে সেটি ৫০ লাখে উন্নীত হয়েছে। বিশাল সেক্টরের আয়ের সিংহভাগ চাঁদাবাজরা বিভিন্নভাবে আদায় করে নিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অটোরিকশার চাঁদার ভাগ পায় ট্রাফিক পুলিশ, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলররা। এ ছাড়া স্থানীয় অসাধু রাজনৈতিক নেতা ও পাড়ামহল্লার মাস্তানরাও চাঁদাবাজি করছে। বিনিময়ে এসব রিকশা চলতে দিচ্ছে তাদের এলাকায়। চাঁদা না দিলে অটোরিকশা চালকদের ধরে এনে নির্যাতন করে পুলিশ। এক হিসাবে রাজধানী ঢাকাতে টোকেনের নামে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দিতে হয় অটোরিকশা চালকদের। 

সূত্র জানায়, রিকশাপ্রতি রেকার বিল গুনতে হয় ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা। আবার কোনো রিকশা ডাম্পিং স্টেশনে নেওয়া হলে দিতে হয় ২ হাজার থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত। মাসিক চাঁদার টাকা পরিশোধ করে রাস্তায় নামাতে হয় রিকশা। রাজধানী ঢাকায় অন্তত ৩ থেকে ৪ লাখের মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে। মাসে গড়ে রিকশাপ্রতি প্রায় ২ হাজার টাকা টোকেন নিতে হয়। এই হিসাবে মাসে অবৈধভাবে আদায় করা হয় ৬০ কোটি টাকা।

সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটি। কমিটির সভাপতি জামসেদ আনোয়ার তপন ও সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এই দাবি জানিয়ে বলা হয়, অবিলম্বে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে লাইসেন্স দিতে হবে বিআরটিএকে। বিবৃতিতে বলা হয়, ব্যাটারিচালিত রিকশাকে নিরাপদ ও উন্নত করার একাধিক মডেলের প্রস্তাব দেশের অন্তত দুটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। এই লোকায়ত প্রযুক্তিটি বিপুলসংখ্যক মানুষের কষ্ট লাঘব ও কর্মের সংস্থান করেছে। একটি টেকসই ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে কর্তৃত্ববাদী ও আমলাতান্ত্রিক নির্দেশে বারবার এসব শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।

তারা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের মদদে ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের যৌথ অংশগ্রহণে ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে যারা এত দিন অবৈধ রুট পারমিট প্রদানের মাধ্যমে চাঁদাবাজি চক্র পরিচালনা করেছে তারাই গত দুই দিন ধরে গ্যারেজে গ্যারেজে হামলা চালিয়ে ব্যাটারিসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ আটকের নামে লুটতরাজ পরিচালনা করছে। কয়েকটি স্থানে সড়কে রিকশাচালকদের পিটিয়ে গুরুতর আহত করার ঘটনা ঘটেছে।

অনড় অবস্থানে সরকার
গত বুধবার রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ ভবনে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভায় রাজধানীতে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত কোনো রিকশা চলতে না দেওয়ার নির্দেশ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই সভায় মন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকায় কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো যাবে না। এটা আগে কার্যকর করুন। এ ছাড়া ২২ মহাসড়কে রিকশা ও ইজিবাইক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন করুন। আর ঢাকা সিটিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা যাতে না চলে, সেই বিষয়ে শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ নয়, এগুলো চলতে যাতে না পারে, সেটার ব্যবস্থা করুন।’

এর পরপরই এসব রিকশা নিষিদ্ধে তোড়জোড় শুরু করে প্রশাসন। বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট বিভাগসংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব মহানগরীর সড়ক থেকে ও ২২টি মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে গতকাল থেকে তৎপরতা শুরু হয়েছে। মহানগর, জেলা ও হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। 

বিকল্প কর্মসংস্থান করে নিষিদ্ধের দাবি
যদি এসব রিকশা নিষিদ্ধই করতে হয় তাহলে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তারপর নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। না হলে লাখ লাখ মানুষের পথে বসার উপক্রম হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। 

রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার অর্থ সম্পাদক রোকশানা আফরোজ আশা খবরের কাগজকে বলেন, ‘হাইকোর্ট যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা নেওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিল, এসব মানুষ যাবে কোথায়? বিকল্প ব্যবস্থা না করে গরিব মানুষের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থা না হলে এই রিকশাচালকদের কিছুই করা যাবে না।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো যখন সড়কে নামানো হয়েছিল, তখনই কিন্তু ওদের চলাচলের এলাকা আর গতিসীমা নির্ধারিত করে দেওয়ার দরকার ছিল। শুধু নিরাপত্তার ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দিলে সড়কের সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে অনেক শ্রমিকের রুটিরুজির ব্যাপার আছে। আর্থিক নিরাপত্তার দিক চিন্তা করে তাদের আগে পুনর্বাসন করা দরকার। ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়ক থেকে তুলে দিলে সেখানে বিকল্প পরিবহন কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। 

দুবাইতে অর্থ পাচারকারীদের তালিকা করেছে এনবিআর

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১২:১০ পিএম
দুবাইতে অর্থ পাচারকারীদের তালিকা করেছে এনবিআর
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে এবং হুন্ডিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) রাজধানী আবুধাবি, বাণিজ্যিক শহর দুবাই, শারজাহ এবং আজমানে অর্থ পাচার করেছেন বাংলাদেশের শতাধিক ব্যবসায়ী। প্রাথমিক তদন্ত শেষে এসব ব্যবসায়ীর নামের তালিকা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) টাস্কফোর্স কমিটি। এ তালিকায় আরও আছেন শিল্পী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাবেক ও বর্তমান সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকে। এনবিআর সূত্রে এসব জানা যায়।

চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে আইনের আওতায় আনতে আরও বিস্তারিত তদন্তে নামছে এনবিআরের টাস্কফোর্স কমিটি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, বিশেষভাবে এসব এলাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল শহরে বাংলাদেশ থেকে কে বা কারা অর্থ পাচার করে অবৈধভাবে সম্পদ করেছে বা ব্যবসা করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে অর্থ পাচার এবং পাচারকৃত অর্থ থেকে রাজস্ব আদায়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স কমিটি। এ কমিটির সুপারিশে এনবিআর থেকে এই টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে তদন্তে নেমেছে। এ কমিটিতে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, ট্রান্সফার প্রাইজিং সেলের একাধিক কর্মকর্তা আছেন। তদন্তের প্রয়োজনে এনবিআরের এ কমিটির সদস্যরা মধ্যপ্রাচ্যের ওই সব শহরেও যাবেন। তদন্তের কাজে যদি প্রয়োজন হয় তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পররাষ্ট্র, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং ওই দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা নেওয়া হবে। ইউএইর রাজস্ব প্রশাসন এবং ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তাও নেওয়া হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহায়তা নেওয়া হবে।

দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম, তদন্ত প্রতিবেদন ও রিপোর্ট এবং এনবিআর টাস্কফোর্সের কর্মকর্তাদের সংগৃহীত তথ্যের সমন্বয়ে এ বিষয়ে এনবিআর প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থ পাচার করে বাংলাদেশিরা নিজস্ব ভিলা, ফ্ল্যাট, ছোট হোটেল, তারকা হোটেল, জমি, বাণিজ্যিক স্থাপনা, দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন। অনেকে ইউএইর কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ ‘পাম জুমেইরা’, জুমেইরা, সিলিকন ওয়েসিস, এমিরেটস হিল, দুবাই মেরিনা ও বিজনেস বের মতো অভিজাত এলাকাগুলোতেও নিজস্ব বাড়ি ও তারকা হোটেল গড়ে তুলেছেন। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী নিজেদের আড়ালে রেখেছেন।

এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসব ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্যরা বছরে একাধিকবার বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ বা আজমানে গিয়েছেন। অনেকে আবার অন্য দেশ হয়েও সেখানে গিয়েছেন। ওই সব শহরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠিয়ে বিনিয়োগের জন্য এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে কোন পথে অর্থ পাঠিয়ে এসব করা হয়েছে, তদন্তে তা খতিয়ে দেখা হবে। এসব ব্যক্তির বেশির ভাগ বাংলাদেশের পরিবর্তে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আলবেনিয়া, সাইপ্রাস, মিসর, ব্রাজিল, সিয়েরা লিওনসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব বা পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন। 

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউএইর আবুধাবি, বাণিজ্যিক শহর দুবাই ও শারজাহতে বাংলাদেশিদের বসবাস বেশি। এনবিআরের এ তালিকায় অনেক আবাসন ব্যবসায়ী আছেন। বাংলাদেশের অনেক আবাসন ব্যবসায়ী এসব শহরে আবাসন ব্যবসা করছেন। বাংলাদেশে বসেই ওই সব শহরে ফ্ল্যাট, বাড়ি বা জমি কেনা যায়। উচ্চমূল্যের এসব সম্পদ বাংলাদেশের অনেকেই কিনেছেন। এ ক্ষেত্রে ওই আবাসন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ক্রেতার সব তথ্য গোপন রেখেছে। বাংলাদেশ থেকে হন্ডিতে পাঠিয়ে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। দুবাইয়ে তিন-চার কক্ষের ফ্ল্যাট কিনতে খরচ হয় ৩ থেকে ৪ লাখ দিরহাম। টাকার বিনিময় মূল্য হিসেবে ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোর চেয়ে দুবাইয়ে ফ্ল্যাটের মূল্য কিছুটা কম হয়। চাকরির জন্য দুবাইয়ে আসা অনেক বাংলাদেশি ফ্ল্যাট কিনেছেন। অন্য দেশে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশিও দুবাইয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এ ছাড়া ফ্ল্যাট কিনে কিছু লাভ রেখে আবারও বিক্রি করছেন, এমন অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তারাও আছেন। তবে নথিপত্রে তারা অন্য নাম ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ আরব আমিরাতে অবস্থান করলেও বেশির ভাগই দেশে থাকেন। তারা মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে থাকছেন। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী আমদানি-রপ্তানির আড়ালেও অর্থ পাচার করেছেন। অনেকে ওই সব শহরে সন্তান পড়িয়ে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন এবং খাওয়া ও থাকার খরচ প্রকৃত হিসাবের চেয়ে বেশি পাঠিয়েও অর্থ পাচার করছেন। বাংলাদেশিদের নিজেদের হোটেলগুলোতে হুন্ডিতে দেশ থেকে টাকা আনার ব্যবস্থা করা আছে। এখানে এসব বাংলাদেশির দোকান আছে। দোকান কেনার অর্থ দেশ থেকে নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ দোকানে সোনা বেচাকেনা হয়। এ ছাড়া পোশাক, প্রসাধনী, জুয়েলারি, প্রসাধনী, জুতা, স্যান্ডেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্রেরও দোকান আছে। এসব দোকানের কর্মচারীরা অধিকাংশই বাংলাদেশের। এসব কর্মচারী বাংলাদেশ থেকে দোকানের মালিকদের বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে কাজ করতে গিয়েছেন। এদের বেতনের অর্থও দেশে হুন্ডিতে পাঠানো হয়। বাংলাদেশিদের বিলাসবহুল হোটেলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ধনী ব্যক্তিরা থাকেন। এখান থেকে আয় ভালো, যা এসব শহরেই ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। 

এনবিআর থেকে টাস্কফোর্স কমিটি চূড়ান্ত তদন্তকালে এসব পাচারকারীর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে। পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ নিশ্চিত হলে তা দেশে ফেরত আনতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে পাচারকৃত অর্থ থেকে হিসাব কষে রাজস্ব আদায় করা হবে। 

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনবিআর কঠোর থেকে তদন্ত করলে পাচারকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। পাচারকারীদের রিটার্নে বিদেশে পাঠানো অর্থের বিষয়ে কিছু জানিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখারও সহায়তা নিতে হবে।’

বাংলাদেশের অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর একটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি। এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান খবরের কাগজকে বলছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে অর্থ বেশি পাচার হয়েছে তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের শহরগুলো আছে। এসব জায়গায় বিনিয়োগ করা হলে অর্থের উৎস নিয়ে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয় না। তাই বাংলাদেশ থেকে এখানে অর্থ পাচার বাড়ছে। এদের আইনের আওতায় নিয়ে গেলে পাচার কমবে।’

সড়ক যেন ‘ধান মাড়াইয়ের উঠান’

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ০৯:৩৭ এএম
সড়ক যেন ‘ধান মাড়াইয়ের উঠান’
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া-শিবগঞ্জ সড়কের ওপর ধানের খড় শুকানো হচ্ছে। খবরের কাগজ

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন সড়ক দখল করে চাষিরা বোরো ধান মাড়াই ও খড় শুকানোর কাজ করছেন। এতে যানবাহনের চালক ও পথচারীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। ওই সড়কে চলাচলকারীরা বলছেন, রাস্তার ওপর ধান শুকানোর কারণে গাড়ি ধীরে চালাতে হয়।

এতে তাদের ট্রিপের সংখ্যা কমায় আগের তুলনায় আয় কমেছে। পাশাপাশি রয়েছে ছোট-বড় দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা। তারা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। অধিকারকর্মীর ভাষ্য অনুযায়ী, বাড়িতে উঠান ছোট থাকার মতো ঠুনকো কারণকে সামনে এনে অনেকে রাস্তার ওপর ধান শুকাচ্ছেন। এগুলো বন্ধ করা প্রয়োজন। 

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের পাশেই শ্যালোচালিত ইঞ্জিন দিয়ে ধান মাড়াই করা হচ্ছে। মাড়াই শেষে সড়কের ওপরেই সেগুলো শুকানো হচ্ছে। অনেকে ধান বাড়ি নিয়ে গেলেও খড় শুকানোর জন্য সড়কের ওপরই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছেন। শুকানো শেষ হলে সড়কের পাশেই সেগুলো স্তূপ করে রাখা হয়েছে।

ফুলবাড়িয়া-শিবগঞ্জ সড়কে অটোরিকশা চালান আকরাম হোসেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘সড়কে ধান মাড়াইয়ের আগে প্রতিদিন গড়ে ১৩০০ টাকার ভাড়া উঠত। ৮০০ টাকা অটোরিকশার মালিককে দেওয়ার পরও ৫০০ টাকা থাকত। কিন্তু বর্তমানে সড়ক দখল করে ধান মাড়াইয়ের কারণে গাড়ি ধীর গতিতে চালাতে হয়। এতে ট্রিপের পরিমাণ কমে আসছে। এ জন্য প্রতিদিন ৭ থেকে ৮শ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে না। ফলে মালিককে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়ার পর নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

সিএনজিচালিত অটোরকিশার চালক সেলিম মিয়া বলেন, ‘কিছুদিন আগে যাত্রী নিয়ে শিবগঞ্জ বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। পথে ধান-খড়ে চাকা পিছলে সিএনজি উল্টে যায়। এতে তিন যাত্রী আহত হন। সড়কে ধান মাড়াই করার কারণে সবসময় ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়েও গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

ফুলবাড়িয়া পৌর এলাকার বাসিন্দা খোকন মিয়া বলেন, ‘উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি সড়ক দখল করে ধান মাড়াই ও খড় শুকানো হচ্ছে। দেখে মনে হবে বাড়ির উঠান। বৃষ্টি হলে ওই খড় সড়কে কর্দমাক্ত অবস্থা ধারণ করে। পরে সেগুলো আর সরানো হয় না। ধীরে ধীরে এগুলো পচে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে থাকে। এতে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।’

উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের পানজানা গ্রামের কৃষক চান মিয়া বলেন, আমি ৯ একর জমিতে ধান আবাদ করেছি। অনেক ধানসহ খড় বাড়ির উঠানে শুকানো সম্ভব হয় না। এ জন্য সড়কে এসেছি।

এভাবে সড়কে ধান মাড়াই করলে যানবাহনের যাত্রী, চালকসহ পথচারীদের সমস্যা হচ্ছে জানালে তিনি বলেন, ‘জানি সড়ক দিয়ে চলাচলকারী সবারই কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। খুব দ্রুতই ধান-খড় সড়ক থেকে সরিয়ে বাড়িতে নেওয়া হবে।’

একই গ্রামের গৃহিণী আছমা খাতুন বলেন, আশপাশে ধান-খড় শুকানোর মতো কোনো মাঠ নেই। কয়েক বছর আগে বাড়ির উঠান বড় থাকলেও ভাগাভাগির কারণে উঠান ছোট হয়ে গেছে। তাই জমি থেকে ধান কেটে আনার পর মাড়াই ও শুকানোর যাবতীয় কাজ সড়কেই করা হচ্ছে।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের (নিসচা) ময়মনসিংহের সভাপতি আব্দুল কাদের চৌধুরী মুন্না বলেন, সবারই যে উঠান নেই, বিষয়টি এমন নয়। অনেকের উঠান থাকা সত্ত্বেও ভালোভাবে সহজে রৌদ্রে মাড়াই করতে সড়কে নিয়ে আসেন। সড়কে চলাচলকারীদের ঝুঁকি এড়াতে ধান মাড়াই কিংবা খড় শুকানো একেবারেই উচিত নয়।

এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী জালাল বলেন, সড়ক দখল করে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেআইনি। জনস্বার্থে সড়কে ধান মাড়াই বন্ধ করা হবে।

‘মোরা না খাইয়া কষ্টে দিন কাডাব, ভারতীয়রা তো ঠিকই মাছ ধইরা নেবে’

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ০৯:২৩ এএম
‘মোরা না খাইয়া কষ্টে দিন কাডাব, ভারতীয়রা তো ঠিকই মাছ ধইরা নেবে’
ছবি : খবরের কাগজ

‘৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় মোরা সাগরে মাছ ধরতে না গেলেও ভারতীয়রা তো ঠিকই মাছ ধইরা নেবে। এই সময় মোরা না খাইয়া কষ্টে দিন কাডাইলেও ভারতের ট্রলারগুলা ঠিকই মাছ ধরবে। এই ৬৫ দিনে আমাগো হাজার হাজার জেলে কর্মহীন হইয়া পড়বে। এ চিন্তায় জাইল্লা পল্লিগুলা আন্ধার ইইয়া যাইতাছে।’

রবিবার (২০ মে) বিকেলে কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার গোরাপদ্মমা এলাকার জেলে মো. দুলাল হাওলাদার।
 
দেশের মৎস্য সম্পদ সুরক্ষা ও মাছের বংশবিস্তারে সাগরে মাছ ধরার ওপর রবিবার মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারি আইন মেনে উপকূলীয় বরগুনার বেশির ভাগ জেলে ট্রলার ঘাটে ফিরলেও নিষেধাজ্ঞার এই সুযোগে পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা দেশের জলসীমানায় ঢুকে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যায় বলে দাবি মো. দুলাল হাওলাদারসহ স্থানীয় জেলেদের। এ ছাড়া এ সময়ে সরকারের দেওয়া খাদ্যসহায়তাও অপ্রতুল বলে দাবি জেলেদের।

জানা যায়, বরগুনায় ২৭ হাজার ২৫০ জন সমুদ্রগামী জেলে রয়েছে। এসব জেলের জন্য প্রথম ধাপে সহায়তার চাল বিতরণ করতে গত ২৯ এপ্রিল ১ হাজার ৫শ ২৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। 

জেলার বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, জেলে পল্লিতে জেলে পরিবারগুলোতে কর্মহীন হয়ে যাওয়ার চিন্তা বিরাজ করছে। অভাব অনটনে কাটবে এই ৬৫ দিন।

বরগুনার ঢলুয়া এলাকার নাসির নামের এক জেলে বলেন, ‘৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমরা ৪০ কেজি চাল পাই। এ ছাড়াও যারা জেলে না, তারাও চাল পায়। কিন্তু আমাদের জন্য বরাদ্দ ৮৬ কেজি চাল আমরা পাই না। এই দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞায় ৪০ কেজি চালে আমাদের পরিবার চালানো কষ্ট হয়।’ 

পাথরঘাটার জেলে মো. সালাম বলেন, ‘এ সময়ে নদীতে ও সাগরে তেমন মাছও নেই। থাকলে পুঁজি করে কিছু টাকা রাখতে পারতাম। ধারদেনা করে জীবন চলে। আর অন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা নেই যে সামনের ৬৫ দিন কাজ করে খাব।’

বরগুনা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের অনেকটাই কষ্টে কাটবে। এই ৬৫ দিনের জন্য জেলেদের বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেওয়ার দাবি জানাই সরকারের কাছে। পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ একই সময়ে সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সমুদ্রগামী জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত এসব চাল আমরা পেয়েছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলেদের কাছে বরাদ্দকৃত চাল পৌঁছে দিতে সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, ‘নিবন্ধনের বাইরে থাকা জেলেদের তালিকা করার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তালিকার কাজ চলছে। এ ছাড়া সরকারিভাবে অন্য কোনো সহায়তা বৃদ্ধি করলে তা জেলেদের কাছে পৌঁছে দেব।’