![বইকে বানাও বন্ধু](uploads/2024/02/09/1707461155.a5.jpg)
বইয়ের মতো বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই (There is no friend as loyal as a book)- কথাটি বলেছিলেন নোবেলবিজয়ী মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। মানুষ মানুষের ক্ষতি করতে পারে, কিন্তু বই কখনো কারও ক্ষতি করে না। বই কেবল মানুষের উপকারই করে। জ্ঞানে-বিদ্যায়-বুদ্ধিতে তাকে উন্নত করে। তার সম্মান বৃদ্ধি করে এবং তাকে অন্যের কাছে আদরণীয় ও অনুসরণীয় করে তোলে। তাকে ভালো মানুষে পরিণত করে এবং সমাজের কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করে। এক কথায়, বই মানুষের সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও হিতকারী বন্ধু।
তোমরা যারা কিশোর-তরুণ, যাদের শরীর-মন এখনো বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, তাদের উচিত বইকেই আঁকড়ে ধরা। এই সময়ে অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা আজীবন তোমার কাজে লাগবে। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জনে সহায়তা করবে। বই তোমাকে আলোকিত করবে এবং জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়াবে। জীবনকে সঠিক পথ দেখাবে এবং জীবনকে সুন্দর করবে। তুমি মানবিক গুণ অর্জন করবে এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার পথে অনবরত এগিয়ে যাবে। জীবনকে অর্থময় করার জন্য বইয়ের বিশাল ভূমিকা আছে।
আমি বলি, মোবাইলটি দূরে সরিয়ে রাখো এবং হাতে তুলে নাও বই। মোবাইলের নেশা নয়, চাই বইয়ের নেশা। বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকো, তোমার যা কিছু ভালো লাগে তা-ই পড়ো। তোমার পাঠ্যসূচিভুক্ত বই তো পড়বেই, বাইরের বইও পড়বে। জানার পরিধি যত বাড়বে, তোমার নিজের ওপর তত আস্থা বাড়বে, যা জীবনে উচ্চতম স্থানে যাওয়ার জন্য সহায়ক হবে। আর যদি মোবাইলে ডুবে থাকো, তা তোমাকে পিছিয়ে দেবে। তোমার শরীর-মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। প্রযুক্তি দরকারি, কিন্তু তা যেন তোমাকে খেয়ে না ফেলে।
তবে মোবাইল-ল্যাপটপ-ডেস্কটপকে পাঠের কাজে লাগাতে পারো। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারো এবং নিজের চিন্তাকে আরও সংহত করতে পারো। ফেসবুক-ইউটিউব নিয়ে দিন-রাত মেতে থেকো না। চ্যাটিংয়ে সময় নষ্ট করো না। গেম খেলতে খেলতে খাবার খাওয়ার কথা ভুলে যেও না, রাতের ঘুমকে হারাম করো না। মোবাইল ব্যবহারে যদি পরিমিতিবোধ হারিয়ে ফেলো, তা হলে জীবনে ভীষণ ঠকা ঠকবে। আমার এই কথাটা শুধু তোমাদের জন্য নয়, ছোট বড় সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নাও, নিয়মিত খাবার খাও, ব্যায়াম করো, আর বই পড়া থেকে আনন্দ খুঁজে নাও। ডিজিটাল পড়াশোনা করতে পারো, তবে মাত্রাতিরিক্ত নয়। পিডিএফ বা ইপাব ফর্মেটের বই খারাপ নয়। তবে চেষ্টা করবে কাগজে ছাপানো বই পড়তে। আমাদের চোখ ডিজিটাল স্ক্রিনে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, অসুস্থ হয়ে পড়ে। কাগজের বইয়ে সেই সমস্যা নেই। ডিজিটাল স্পর্শের চেয়ে কাগজের স্পর্শই অধিক স্বাস্থ্যকর।
ঠিক করো তুমি কী হতে চাও, নিজের ভবিষ্যৎকে কল্পনা করো। আর সেই লক্ষ্যে বই নির্বাচন করে পড়তে থাকো। পড়া কখনোই বৃথা যায় না, কোনো না কোনোভাবে তা কাজে আসবেই। পড়াতে সময় দেওয়াই জীবনের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। এর রিটার্ন অপরিমেয়, অমূল্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মেলে এর ফল। জীবন যত এগিয়ে যাবে, দেখবে পাঠই তোমার সর্বোচ্চ সঞ্চয় ও অবলম্বন। এর ওপর ভর করেই তুমি বেঁচে থাকবে, বিকশিত হবে। বিকশিত হবে ফুলের মতো, ছড়াবে সুগন্ধ। তোমার সাফল্যে পরিবার-পরিজন তো বটেই, তুমি নিজেও গর্ববোধ করবে।
বই পড়ার একটি মস্তবড় লাভ আছে। তা হলো লেখার ক্ষমতা তৈরি হওয়া। বই পড়লে লেখার ক্ষমতা আসে এবং তুমি ভালো লিখতে পারবে। কেবল পরীক্ষার খাতায় নয়, বাস্তব জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে। এই লেখার ক্ষমতায় তুমি অন্যদের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত হবে এবং বিশেষ মর্যাদা লাভ করবে। আমি সৃজনশীল-অসৃজনশীল সব ধরনের লেখার কথা বলছি। গল্প-উপন্যাস-কবিতায় তোমার রুচি থাকতে হবে- এমন কোনো কথা নেই। তুমি যেতে পারো কঠিনের পথে, গবেষণা ও গদ্যে। তুমি যেকোনো ধারাতেই যাও, তার জন্য প্রয়োজন বিপুল নিবিষ্ট পাঠ। তোমার কলমটিকে সচল ও শক্তিশালী করার জন্য বই পড়ার চেয়ে ভালো জিনিস আর নেই।
বই নিয়ে ওয়াল্ট ডিজনি একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, জলদস্যুরা ট্রেজার আইল্যান্ড থেকে যত সম্পদ লুট করতে পারে, তার চেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে বইয়ে। সত্যিকার অর্থে, বইয়ের পাতায় মুদ্রিত জ্ঞানের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আজীবন পড়লেও বইয়ের জ্ঞান কোনোদিন শেষ হবে না। এই কথার একটি মাহাত্ম্য আছে। তা হলো, পাঠ করতে হবে নির্বাচন করে। বিশৃঙ্খল পাঠ নয়, পাঠ হতে হবে সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত। তাতেই মিলবে সর্বোচ্চ লাভ। হতাশ হবে না। ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’- হীরক রাজার দেশের এ জাতীয় উক্তিতে বিভ্রান্ত হবে না। সেই নির্দিষ্ট বইগুলো বেছে নাও, যা তোমার স্বপ্নপূরণে সহায়ক হবে। সুনির্বাচনের মাধ্যমে একটি একটি করে বই পড়ো, আর অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে একটি একটি করে তীর ছুড়তে থাকো। এক সময় তীরটি কেন্দ্রবিন্দুতে গাঁথবেই।
লেখক: ড. বিনয় বর্মন, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
জাহ্নবী