উত্তর কোরিয়া হলো কঠিন রাষ্ট্রীয় শাসনে বাঁধা একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। এখানে স্বাধীনভাবে কিছুই করার উপায় নেই। মানুষের জীবনযাপনসহ প্রত্যেকটি কাজে রাষ্ট্র নাক গলায় এবং আদেশ-নির্দেশ দিয়ে থাকে। কোনো কিছুর ব্যতিক্রম হলে শাস্তির আওতায় আসতে হয়। উত্তর কোরিয়ায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো বিদেশির সঙ্গে কথা বলাও নিষিদ্ধ। কেউ যদি তা করে তবে ধরে নেওয়া হয় সে গুপ্তচরবৃত্তি করছে! তাই এ দেশে টিনএজারদের জীবনও নিয়মকানুনের বেড়াজালে কঠিনভাবে শৃঙ্খলিত। কোনো টিনএজার রাষ্ট্রের কোনো নিয়মকানুন না মানলে তাকে দৈহিক শাস্তি পেতে হয়। এমনকি তাকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ শ্রমশিবিরেও পাঠিয়ে দিতে পারে।
সবার জন্য দেশের সামরিক বাহিনীতে কাজ করা বাধ্যতামূলক। কেউ পড়ালেখায় খারাপ করলে তাকে সোজা সামরিক বাহিনীতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
উত্তর কোরিয়ার টিনএজারদের জীবনও রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা ইচ্ছা করলেই পছন্দের কিছু পড়তে পারে না বা অপছন্দের বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে পারে না। যদিও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় এক বছর। প্রাথমিক বিদ্যালয় পাঁচ বছর এর পর ছয় বছর মাধ্যমিক স্কুল।
উত্তর কোরিয়ায় শিক্ষা সর্বজনীন। ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে শিক্ষার হার ৯৯ শতাংশ। স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য রাষ্ট্রের আদর্শ, শাসকদের এবং তাদের চৌদ্দগুষ্টির পরিবারকে নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ বইগুলো পড়তে বাধ্য করা হয়। পাঠ্যক্রমের বিশাল একটা জায়গাজুড়ে রয়েছে এসব বিষয়। এসব বিষয়ে কোনো ছাত্রছাত্রী যদি পাস না করে বা মুখস্ত রাখতে না পারে তাহলে তাদের কঠিন দৈহিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। যেমন তাদের গ্রামাঞ্চলে সমবায় খামারে কাজ করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাদের ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। কখনো এটা ১৪ ঘণ্টাতেও পৌঁছায়। উত্তর কোরিয়ায় ছাত্রছাত্রীদের ফেল করাটা সহ্য করা হয় না। কেউ যদি তা করে তবে তাকে সামরিক বাহিনীতে ঢুকতে হবে বা চাকরিতে ঢুকতে হবে। তিন-চার বছর পর হয়তো সে আবার পড়ালেখায় ঢোকার সুযোগ পেতে পারে। তখন তাকে আবার ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষায় বসতে হয়। এজন্য তাদের কোটা আছে।
উনিশ শতকে খ্রিষ্টান মিশনারিদের দ্বারা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হলে মেয়েরাও স্কুলে যেতে শুরু করে। এখন মেয়েরা যেকোনো পর্যায়ের শিক্ষা লাভ করতে পারে। তবে তাদেরও সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক সার্ভিস দিয়ে আসতে হয়।
অল্প বয়স থেকেই ছেলেমেয়েদের শারীরিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়। তারা কাজ করে কৃষি খামারে প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের সাহায্যকারী হিসেবে, কোনো দ্রব্যসামগ্রীর সংগ্রাহক হিসেবে এমনকি নির্মাণক্ষেত্রে বা কোনো এতিমখানায়, প্রিজন ক্যাম্পে ও রিলিফ ক্যাম্পেও টিনএজারদের কাজ করতে পাঠানো হয়। টিনএজাররা ডেটিঙে গেলে কতটুকু তারা ঘনিষ্ঠ হতে পারবে সেটাও রাষ্ট্র ঠিক করে দেয়।
বিবাহপূর্ব যৌনতাকে উত্তর কোরিয়ায় খুবই ঘৃণার চোখে দেখা হয়। কোনো অবিবাহিত মেয়ে যদি সন্তান ধারণ করে ফেলে তাহলে তাকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হয় এমনকি তার পিতা-মাতাকেও হেনস্তার স্বীকার হতে হয়। উত্তর কোরিয়ায় বিয়ের বয়স ছেলেদের জন্য ১৮ এবং মেয়েদের জন্য ১৭। সব টিনএজারকে বাধ্যতামূলকভাবে ‘ইয়থ লিগ’-এ যোগদান করতে হয়। ইয়থ লিগের দাপ্তরিক নাম হলো, ‘কিম ইল সুং ইয়থ লিগ।’ এটা বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের বাবার নাম কিম ইল সুং-এর নামে নামকরণ করা হয়েছে। ১৪ বছর বয়সে ইয়থ লিগে নাম তালিকাভুক্তির পর শুরু হয় কিম জং উনের পরিবারের প্রশংসাগাথা মাথায় ঢোকানো। এ সময় স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েদের সর্বমোট ৩৮৮ ঘণ্টার কিম জং উন, তার বাবা কিম জং ইল এবং ঠাকুরদা কিম ইল সাংয়ের ওপর কোর্স শেষ করতে হয়। ১৭ বছর বয়সেই শুরু হয় তাদের বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীর সার্ভিস। এটা চলে পরের ১০ বছর পর্যন্ত। এর মধ্যেই পড়াশোনা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হতে হয় এ সময়ের মধ্যে। এই সার্ভিসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে, পড়তে যেতে দেওয়া হয়। স্নাতক শেষ করে বাকি বাধ্যতামূলক সার্ভিসের সময়টুকু শেষ করে দিয়ে আসতে হয়। যখনই সতেরো বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তখন তাকে আরেকটি কাজ বাধ্যমূলকভাবে করতে হয়। সেটি হলো ভোট দেওয়া। ভোটের নিয়মটাও অদ্ভুত। ভোটকেন্দ্রে টানানো প্রেসিডেন্ট এবং লম্বা করে টানানো তার বাবার ছবির সামনে গিয়ে একটা বো (মাথা নুইয়ে সম্মান জানানো) করে ব্যালট পেপার (যেখানে একজনেরই নাম লেখা আছে সেটা) নিতে হবে। তারপর ব্যালটে সিল মেরে ভোট দিয়ে সোজা চলে আসতে হবে। ১৯৫৮ সাল থেকে এই পদ্ধতি চলে আসছে। কারও ঘাড়ে দুটো মাথা নেই যে এর অন্যথা করে!
উত্তর কোরিয়ার টিনএজাররা বাইরেরর জগৎ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। কোনো কোরিয়ান যদি আমেরিকা বা দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা দেখে তাহলে তার জেল থেকে ফাঁসিও হতে পারে! এর মধ্যেও অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা বিয়ার খেয়ে, সারা রাত গান গেয়ে ফুর্তি করে থাকে। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে যতটুকু সময় এবং ব্যবস্থা করা আছে সে সময়টায় খেলাধুলা করতে পারে। কেউ যদি পর্নোগ্রাফি দেখে ধরা পড়ে তাহলে সোজা তাকে শ্রমশিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতকিছুর মধ্যেও টিনএজাররা কিম জং উনের নানা ব্যাপার নিয়ে জোকস বলে থাকে। যদিও জানে পুলিশের কেউ শুনলে জেলে যেতে হতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার টিনএজাররা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকে রোজগার করা পর্যন্ত। বাবা-মায়েরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন থাকে তাদের ছেলেমেয়েদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং নৈতিকতা শিক্ষা দিতে। বৃদ্ধ বয়সে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের দেখাশোনা করে। বেশির ভাগ সময়ে ছোট ছেলের কাছেই বাবা-মা থাকে। সব মিলিয়ে উত্তর কোরিয়ার টিনএজাররা পৃথিবীর অন্য যেকোনো টিনএজারদের চাইতে পরাধীন জীবনযাপন করে। বলতে গেলে তারা ‘আয়রন কার্টেল’-এর ভিতরে এক কঠিন নিয়মকানুনের বেড়াজালে দমবদ্ধ অবস্থায় বেড়ে ওঠে।
জাহ্নবী