বইমেলা মানেই তরুণ পাঠকদের আনাগোনা, আধিপত্য। বইমেলাকে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে রাখেন তো তারাই। তিনজন তরুণ পাঠকের গল্প শোনাচ্ছেন জারিন সাইয়ারা
সাইকা লাবিবা সিফাত
পছন্দ করেন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের
ইতিহাস সম্পর্কিত বই
সিফাত বেড়ে উঠেছেন বগুড়া শহরে। সেখানেই শেষ করেছেন উচ্চমাধ্যমিক। এরপর ভর্তি হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। সেখানেই পড়ছেন স্নাতকোত্তরে। ছোটবেলায় কিশোর উপন্যাস পড়তে ভালো লাগত তার। তবে বড় হওয়ার পর আত্মজীবনী, ভ্রমণমূলক, মুক্তিযুদ্ধ ও গোয়েন্দা কাহিনি প্রিয় হয়ে ওঠে। আর অর্থনীতিতে পড়াশোনার কারণে অর্থনীতিবিষয়ক বইও পছন্দনীয়। এবার মেলা থেকে তিনি কিনেছেন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কিত বই। এর মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’, ‘মুজিবের রক্ত লাল’, জুলে ভার্নের ‘আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ’, মইনুল হোসেনের ‘গণতন্ত্রের সংগ্রামে বাংলাদেশ’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘নির্বাচিত গল্প’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার সাস্ট জীবন’, শওকত আলীর ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, আবুল মনসুর আহমদের ‘রচনাসমগ্র’, শাহরিয়ার কবির ‘একাত্তরের যীশু’, আনিসুল হকের ‘রক্তে আঁকা ভোর’, বুলবুল সারওয়ারের ‘ঝিলাম নদীর দেশ’।
সিফাতের প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তার লেখা সায়েন্স ফিকশন বেশ ভালো লাগে। ছোটবেলা থেকেই জাফর ইকবালের বই সংগ্রহ করে সিফাত। তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে জাফর ইকবালের বই পড়া বেশ ভালোভাবে জড়িত। বছরে কী পরিমাণ বই পড়েন? কোন সময়ে বেশি বই কেনেন? এ প্রশ্নের জবাবে সিফাত বলেন, সিফাতের বই কেনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় নেই। দু-তিন মাস পরপরই দশ-বারোটা করে বই কেনার চেষ্টা করেন। এবার মেলা থেকে প্রায় ৫০টা বই কিনে ফেলেছেন। সে হিসেবে বছরে ৭০ থেকে ৯০টার মতো বই কেনা পড়ে। বই পড়ার অভ্যাস কতটা উপকারী? এ বিষয়ে তিনি বলেন, বই পড়ার অভ্যাস মূলত কল্পনাশক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করতে, সেসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে, মানুষের মেধাকে আরও শানিত করতে কাজে লাগে। বই পড়ার অভ্যাস বাস্তব জীবনে সরাসরি কাজে লাগাতে পারে মানুষ। বই পড়া প্রাতিষ্ঠানিক কাজে কতটা সহায়তা করে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, বই পড়ার অভ্যাস প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় সরাসরি সাহায্য করে। আমরা যারা নিয়মিত বই পড়ি তাদের ভিতরে দীর্ঘ সময় ধরে পড়ালেখার একটা অভ্যাস থাকে, জটিল বিষয় সহজে বুঝে নেওয়ার একটা ক্ষমতা থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে পরীক্ষার আগে প্রায়ই স্টুডেন্টরা একটানা পড়তে পারে না, ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে, জটিল বিষয় এড়িয়ে যায়। বই পড়ার অভ্যাস থাকলে এমনটা আর হয় না।
উম্মে জান্নাত স্বর্ণা
পছন্দ করেন ইতিহাস, আত্মজীবনী ও
ভ্রমণমূলক বই
স্বর্ণার জন্ম কুমিল্লায় হলেও বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। শৈশব-কৈশোর, পড়াশোনা ওখানেই কেটেছে। বর্তমানে পড়ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তরে। ছোটবেলা থেকেই গল্পের বই পড়তে বেশ ভালো লাগে স্বর্ণার। তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাস, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনি, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস সম্পর্কিত বইগুলো ভালো লাগতে শুরু করে তার। বাংলা বিভাগে পড়ার কারণে নিজ গণ্ডির বাইরেও অনেক রকমের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন এবং বেড়েছে তার পছন্দের বইয়ের তালিকা। বইমেলা থেকে এবার কিনেছেন ইতিহাস, আত্মজীবনী ও ভ্রমণমূলক বই। বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলোর পাশাপাশি কিনেছেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘একাত্তরের দিনগুলি’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘রাশিয়ার চিঠি’ ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি কিনেছেন বিশ্বসাহিত্যের ‘ইলিয়ড-ওডিসি, শাহনামা ইত্যাদি। কারবালার ইতিহাস জানতে সংগ্রহ করেছেন মোস্তফা কামালের আলোচিত উপন্যাস ‘কারবালা উপাখ্যান’। তার প্রিয় লেখক সেলিনা হোসেন। সেলিনা হোসেনের কাকতাড়ুয়া উপন্যাসটি পড়ার পর তার মন ও মননে বেশ প্রভাব ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানি ও রাজাকারদের ভয়াবহতা উনি শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন, যা তার মনে দাগ কাটে। তারপর থেকে তাকে জানার আগ্রহ বাড়ে। আর ধীরে ধীরে তার উপন্যাস, কিশোর গল্প পড়ে ফেলে। সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে সারা বছরই বইয়ের সঙ্গে থাকতে হয় এবং প্রচুর বই কেনা হয়। বছরে গড়ে ৫০-৬০টি বই কেনা হয়ই। বাংলাবাজার, নীলক্ষেতের পাশ দিয়ে গেলে তালিকার বাইরেও বই কেনা হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। বই পড়ার অভ্যাস চিন্তা ও কল্পনাশক্তিকে বাড়িয়ে দেয় বলে সে মনে করে। তার মতে, ‘একটি বই যখন পড়া হয় তখন আপনার ভাবনার গণ্ডিটা বেড়ে যায়। আপনার পরিমিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে ভাবতে পারেন সমাজের নানাবিধ সমস্যা- কেন লেখক কবিরা তাদের বইয়ের পাতায় এসব লিখেছেন। বাস্তবতার সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন। বই পড়ে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কে মানুষ বাস্তবে কাজে লাগাতে পারে। এতে তার মন ও মেধার বিকাশ ঘটে। যার ফলে তার চিন্তাশক্তির পরিচয় অন্যরাও পেয়ে থাকে। বই পড়ার অভ্যাস প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় কতটা সহায়তা করে? তিনি বলেন, ‘বই পড়ার অভ্যাস প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, নিয়মিত বই পড়লে পড়াশোনার প্রতি একঘেয়েমি বা অনীহা আসে না, পড়ার আগ্রহ বাড়ে, জানার কৌতূহল বাড়ে, চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে। বিশেষ করে পরীক্ষার সময় টেবিলে দীর্ঘক্ষণ পড়ার স্ট্যামিনা পাওয়া যায়। নিয়মিত বই পড়ার ফলে জটিল ও সূক্ষ্মতর বিষয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় না। শিক্ষাজীবনের ধাপটা মসৃণ হয়ে যায় অনেকটা। তাই সবারই উচিত নিয়মিত বই পড়া।
জোবায়ের হোসাইন
পছন্দ করেন গোয়েন্দা গল্প এবং
রাজনৈতিক বই
জোবায়েরের বেড়ে ওঠা চুয়াডাঙ্গার এক অজপাড়াগাঁয়ে। যেখানে ফেসবুক না এলে হুমায়ূন আহমেদকে চিনতে মানুষকে শহরের কলেজে পড়তে হতো। এসএসসি পাস করার আগে যে হুমায়ুন আহমেদকেও চিনত না। শুধু জোবায়ের একা না, তার বন্ধুরাও চিনত না হুমায়ুন আহমেদকে। বর্তমানে ঢাকা কলেজে পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতক শেষবর্ষে লেখাপড়া করছেন জোবায়ের। জোবায়ের গোয়েন্দা গল্প এবং রাজনৈতিক বই পড়তে বেশি পছন্দ করেন।
মেলা থেকে জোবায়ের কিনেছেন সাদাত হোসাইনের উপন্যাস, ফারজানা মিতুর ‘তবু মন ভাবে তারে’, জাভেদ হুসেনের ‘মির্জা গালিবের সঙ্গে দেখা’, মহিউদ্দিন আহম্মদের ‘একদলীয় সরকার যেভাবে এলো’, মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার ‘স্পাই স্টোরিজ-২’। প্রিয় লেখক বলতে একেকজনের একেকটি বই তার ভালো লাগে। গোয়েন্দা গল্পের বিবেচনায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তার খুবই পছন্দ। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর রীতিমতো ভক্ত তিনি।
বছরে প্রায় ৮০-৮৫টি বই কেনা হয় তার। কারণটা তিনি নিজেই জানালেন, ‘পড়ার অভ্যাস আমাকে মূলত যুক্তিনির্ভর কথা বলতে, চিন্তাশক্তিকে বাড়াতে এবং মানবিক হতে যথেষ্ট সাহায্য করে। যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতেও উপকারে আসে।
জাহ্নবী