![নজর কাড়ছেন তরুণ লেখকরা](uploads/2024/02/13/1707804832.book-fair.jpg)
গল্প-সাহিত্য-প্রবন্ধসহ বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীল নানা শাখায় দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততার পরে তরুণরা নতুন কথাশৈলীতে নতুন বইয়ে নজর কাড়ছেন বইমেলার পাঠকদের। স্বীয় রচনাশৈলীতে নিজস্ব ভাবনা বা দর্শনে সমাজ বাস্তবতা, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে বিজ্ঞানের সাযুজ্য খুঁজে চলেছেন তারা। গল্প-কবিতা-উপন্যাসের বাইরে এসে মননশীল রচনাতেও বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে ঠাঁই করে নিতে মুখিয়ে আছেন এই তরুণরা।
এবার অমর একুশে বইমেলায় ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কর্মকার অনুপ কুমারের গল্পগ্রন্থ ‘আশ্বিনের বৈঠক’। গল্পগ্রন্থে লেখকের নতুন দশটি গল্প সংকলিত হয়েছে। ভিন্ন ধাঁচের স্বতন্ত্র ও মৌলিক দশ রকমের দশটি ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখক তার গল্পগুলো সৃষ্টি করেছেন। কর্মকার অনুপ বলেন, ‘মানুষের জীবনের সব ঘটনাই মূলত একজন লেখকের কলমের মাধ্যমে গল্প হয়ে ওঠে। সে গল্প হতে পারে লেখকের স্বচক্ষে দেখা কোনো ঘটনা নিয়ে বা কারও মুখে শোনা কোনো জীবন-আখ্যান নিয়ে। আশ্বিনের বৈঠক-বইয়ের গল্পে পাঠক যেমন রহস্য ও রোমাঞ্চ খুঁজে পাবেন তেমনি প্রতিটা গল্পেই পাঠক মানবিকতা বোধের একটা স্পর্শ খুঁজে পাবেন।’
বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে মনীষা চিন্ময়ের ছোটগল্পের সংকলন ‘শৃঙ্খলের কূটসুখ’। বইটি নিয়ে মনীষা চিন্ময় বলেন, ‘সমাজে যেমন রয়েছে শ্রেণিবৈষম্য তেমনি রয়েছে শ্রেণি-সংঘাত; রয়েছে অবদমনের সংস্কৃতির মতো মানসিক বৈকল্য। এই সমাজ কখনো সমাজবদ্ধ মানবের জন্য খুলে দেয় নতুন দ্বার। আবার কখনো তাকে জটিল করে তোলে পক্ষপাতের শিকলে। এই আবর্তেই হতাশা আর না পারার আড়ালে মানুষ খোঁজে বেঁচে থাকার সান্ত্বনা। এমনি ভিন্নতায় চরিত্রায়ণ করা হয়েছে ‘শৃঙ্খলের কূটসুখ’ বইয়ের দশটি গল্প; যেখানে কোথাও কোনো চরিত্র জাদুবাস্তবতা বা পরাবাস্তবতার ছায়ায় বলে ফেলে অবচেতনের অতলে হারানো কথাগুলো।’
আজব প্রকাশ থেকে এসেছে তরুণ লেখক হক ফারুকের কবিতার বই ‘সবুজ সন্ন্যাস কাল’। কবিতার পঙ্ক্তিতে এই বইয়ে উঠে এসেছে এক আংশিক জীবন ভ্রমণ; যেখানে আছে দ্রোহ, প্রেম, প্রকৃতি, পরিবর্তনের বয়ান। তিনি বলেন, ‘আমি একাধারে সংগীত এবং কবিতা অন্তঃপ্রাণ মানুষ। চার বছর পর নতুন কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। বইতে এই শহরে বেড়ে ওঠা একজন মানুষের আংশিক জীবন তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে প্রেম, দ্রোহ, প্রকৃতি, পরিবর্তন, ধ্যান, বোহেমিয়ানসহ আরও অনেক বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটেছে।’
তরুণ লেখক সুশীল মালাকার যুক্ত রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে। প্রভাতফেরি নামে একটি সাহিত্য সংগঠনের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি নিয়মিত লিখছেন প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে। এবার প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স থেকে এসেছে তরুণ লেখক সুশীল মালাকারের গল্পগ্রন্থ ‘হারানো শহর’। ইতালির দক্ষিণ-পশ্চিমে উপকূলীয় শহর পম্পেই অগ্ন্যুৎপাতে কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল গল্পচ্ছলে সে মর্মন্তুদ কাহিনি তুলে ধরেছেন তিনি। এ ছাড়াও এ প্রকাশনী থেকে এসেছে তার আরেকটি ছোটগল্পের বই ‘চেকপোস্ট’। নাগরিক জীবনের নিঃসঙ্গতা, বিষাদময় জীবনের নানা আখ্যান রচিত হয়েছে এই বইটিতে।
২০০৬ সাল থেকে সাহিত্যে নিয়মিত হওয়া রুমানা বৈশাখী ভালোবাসেন সম্পর্কের গল্প বলতে। এবার ‘যে মেয়েটি ভাত বেশি খেতো’ শিরোনামের একটি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন তিনি। গ্রামীণ পটভূমিতে নারী জীবনের আখ্যান রচিত হয়েছে এই বইটিতে। এ বইটি বইমেলায় এনেছে দিব্যপ্রকাশ। এ ছাড়াও এই প্রকাশনী থেকে এসেছে মাহবুব সিদ্দিকীর গবেষণাগ্রন্থ ‘সুন্দরবন ও গাঙ্গেয় বদ্বীপের মোহনা’ও প্রকাশ করেছে দিব্যপ্রকাশ। অন্বেষা প্রকাশনী থেকে এসেছে ইসমত আরা প্রিয়ার ‘আমার শুধু মানুষ হারায়’, রুশদী শামসের ‘অদ্ভুত যন্ত্রেরা সব’। বিশ্বসাহিত্য ভবন এনেছে অলীন বাসারের ‘বল্টুদের দেয়াল ঘড়ি’। সময় প্রকাশন এনেছে অধরা জাহানের উপন্যাস ‘মুহূর্তরা জানে’। অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে এসেছে ইকবাল খন্দকারের সাইকো থ্রিলার ‘ঘাতকের নিশানা’, খান মুহাম্মদ রুমেলের গল্পগ্রন্থ ‘আমাদের চোখে মাকড়সা জাল বোনে।
সামাজিক প্রেক্ষাপটকে উপজীব্য করে তরুণ লেখক আলম সিদ্দিকী লিখেছেন থ্রিলারধর্মী উপন্যাস ‘স্বীকারোক্তি’। তার এ বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। এ ছাড়া তরুণ লেখক আসিফ মেহদীর কিশোর উপন্যাস ‘অদ্রির অভিযান’ও প্রকাশ করেছে এই প্রকাশনী। তরুণ লেখক মাহাথির মাহমুদ অন্তিকের থ্রিলারধর্মী বই ‘নোমান’ তাম্রলিপি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাকে ঘিরে তাম্রলিপির স্টলে দেখা গেল বেশ উন্মাদনা। তাম্রলিপি প্রকাশক এ কে তারিকুল ইসলাম রনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে অন্তিকের লেখা তরুণরা গ্রোগ্রাসে পড়ছেন। লেখক হিসেবে অন্তিকের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।’
বইমেলার তরুণ লেখকদের নিয়ে অনিন্দ্য প্রকাশের প্রকাশক আফজাল হোসেন বলেন, ‘বইমেলায় অনেক তরুণ বই লিখছেন সাহিত্যের নানা শাখায়। কেউ গল্প, কবিতা কেউবা আবার নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখছেন। এখন তাদের বইয়ের মান বিচারের প্রশ্ন উঠছে। আমরা যারা প্রকাশক তাদের আসলে আর্থিক সক্ষমতা নেই যে একটি সম্পাদনা পরিষদ গঠন করব, যেখানে আমরা নতুন বইগুলো সুসম্পাদিত করে বইমেলায় আনব।’
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক বিক্রেতা সমিতির উপদেষ্টা ওসমান গণি তরুণ লেখকদের বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রকাশনীগুলো ফি বছর তরুণদের অনেক বই প্রকাশ করছে। কিন্তু সব বই কি ভালো মানের? আমরা নিজেরা এমন কিছু বই প্রকাশ করছি, যা আমাদের প্রকাশ করার কথা না। কিন্তু অনেক কিছুর পরে আমরা সেসব বই প্রকাশ করতে বাধ্য হই। তবে কিছু তরুণ আছেন যারা সমসাময়িক সাহিত্যকে ধারণ করতে পেরেছেন। তাদের বইগুলো আরও যত্ন নিয়ে প্রকাশ করা গেলে তারা সাহিত্যাঙ্গনে নতুন ধারা রচনা করবেন।’
মেলার নানা আয়োজন
গতকাল বিকেলে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: হেনা দাস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জোবাইদা নাসরীন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঝর্না রহমান এবং ফওজিয়া মোসলেম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীন আখতার।
প্রাবন্ধিক বলেন, ‘হেনা দাস আজন্ম এক প্রতিবাদী সত্তা। নির্লোভ শুভ্রতার প্রদীপ হয়েই তিনি আলো ছড়িয়েছেন এবং সব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে মানুষের জন্য পথ উন্মোচন করেছেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং শোষণমুক্তির লক্ষ্যে একজন সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। এ জন্য ঔপনিবেশিক শাসন, শ্রেণি ও লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।’
গতকাল ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী, কবি ফারহানা রহমান, গবেষক মিলটন কুমার দেব এবং কথাসাহিত্যিক ইকবাল খন্দকার।
আজও বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন হরিশংকর জলদাস এবং ফারজানা সিদ্দিকা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
নতুন বই
গতকাল বইমেলার তথ্যকেন্দ্রে নতুন বই জমা পড়েছে ১১৫টি। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হালিমা খাতুনের আত্মজীবনী ‘মেঘের ওপারে আকাশ’ (বাংলা একাডেমি), শ্রীশচন্দ্র দাসের প্রবন্ধ ‘সাহিত্য সন্দর্শন’ (ভাষাপ্রকাশ); বিপাশা চক্রবর্তীর প্রবন্ধ ‘নক্ষত্রবিথী’ (অনন্যা); দীপু মাহমুদের উপন্যাস ‘সুনসান সুন্দরবন’ (পাঞ্জেরী)।