ভারতে ক্রেতারা বাজার থেকে শাকসবজি ও ফল কেনার জন্য যে অর্থ ব্যয় করেন, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই পকেটে ঢোকান পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা। এতে ভোক্তাপর্যায়ে ব্যয় বাড়লেও পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। খবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের।
শাকসবজি, ডাল ও ফলের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে আরবিআইয়ের পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, তিনটি প্রধান শাকসবজি- টমেটো, পেঁয়াজ ও আলুর (টিওপি) ক্ষেত্রে ক্রেতারা যেই দাম দিয়ে পণ্য কেনেন তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পান কৃষকরা। সমীক্ষা অনুযায়ী, টমেটোর ক্ষেত্রে কৃষকরা পান খুচরায় বিক্রি করা দামের প্রায় ৩৩ শতাংশ, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ এবং আলুর দামের ক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশ।
রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গবেষণাপত্র অনুযায়ী, দেশীয় মূল্য শৃঙ্খলে কলার জন্য কৃষকদের অংশ ৩১ শতাংশ, আঙুরের জন্য ৩৫ শতাংশ এবং আমের জন্য ৪৩ শতাংশ। রপ্তানি মূল্য শৃঙ্খলে আমের ক্ষেত্রে কৃষকদের অংশ বেশি হলেও আঙুরের ক্ষেত্রে কম, যদিও প্রাপ্ত মূল্য দেশীয় মূল্য শৃঙ্খলের চেয়েও বেশি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটির খবরে বলা হয়, দুগ্ধজাত পণ্যের মতো অন্য খাতে দেশটির কৃষকরা চূড়ান্ত দামের প্রায় ৭০ শতাংশ পেলেও, বাকি অংশ পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের মাঝে ভাগ হয়ে যায় বলে ওই গবেষণায় উঠে এসেছে।
ডাল জাতীয় পণ্যের মধ্যে ছোলার (চনা বুট) ক্ষেত্রে ভোক্তা যে অর্থ খরচ করেন, তার প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষকদের কাছে আসে। মুগডালের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ৭০ শতাংশ এবং তুরের (অন্য নাম অড়হর ডাল) জন্য ৬৫ শতাংশ।
আরবিআইয়ের গবেষণা অনুযায়ী, শস্য ও দুগ্ধজাত পণ্যের মতো যেখানে সংগ্রহ ও বিপণন ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে উন্নত, সেখানে টিওপি সবজির ক্ষেত্রে দক্ষ মূল্য শৃঙ্খল ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এই অবস্থার প্রধান কারণ হলো এই ফসলের নষ্ট হওয়ার প্রবণতা, আঞ্চলিক ও মৌসুমি ঘনত্ব, পর্যাপ্ত সঞ্চয় সুবিধার অভাব এবং বেশিসংখ্যক মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতি।
কোভিড-১৯ মহামারি এবং তার পরে দেশব্যাপী লকডাউন ২০২০ সালে দেশের টিওপি সবজির সরবরাহ শৃঙ্খল ও বিপণন অবকাঠামোতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো প্রকাশ করেছে। গবেষণা অনুযায়ী, ভরা মৌসুমেও যখন দাম উৎপাদন খরচের অনেক নিচে নেমে যায়, তখন কৃষকরা প্রায়ই তাদের ফসল ফেলে দিতে বা দুর্দশায় পড়ে খুবই কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।
অন্যদিকে মন্দা বা টান মৌসুমে ভোক্তারা উচ্চমূল্যের চাপের সম্মুখীন হন। এই বুম-অ্যান্ড-বাস্ট (উত্থান-পতন) চক্রটি অকার্যকর বিপণন ব্যবস্থা, কৃষকরা যেই অর্থ পান তা এবং পণ্যের বিপরীতের ভোক্তারা যে অর্থ ব্যয় করেন তার মধ্যে একটি বিস্তৃত ব্যবধানসহ সুসংহত মূল্য শৃঙ্খলের অভাবের কারণে।
এর আগে গুলাটি ও সাইনির (২০১৩) গবেষণায় উচ্চফলনশীল বীজ, সেচ, লজিস্টিকস, প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) ব্যাপক বিনিয়োগ বরাদ্দ করে সরবরাহ প্রতিক্রিয়া বাড়ানো এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে অসংগতিগুলো সংশোধন করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া গাঙ্গুলি ও গুলাটির (২০১৩) আরেকটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাড়তি চাহিদার ফলে উচ্চমূল্যের পণ্যের দাম বাড়ার চাপকে সরবরাহ শৃঙ্খলকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে সংশোধন করা যেতে পারে।
সবজির মধ্যে টমেটো, পেঁয়াজ ও আলু, উৎপাদন ও খরচের দিক থেকে ভারতের তিনটি প্রধান ফসল। গত কয়েক বছরে এই তিনটি ফসলের উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে।
গবেষণার পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, ২০২২-২৩ সালে টমেটো, পেঁয়াজ ও আলুর উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ২ কোটি ৪ লাখ টন, ৩ কোটি ২ লাখ টন এবং ৬ কোটি ১ লাখ টন।
এতে আরও বলা হয়, ভারত এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম টমেটো ও আলু উৎপাদক দেশ। এখানে দেশটির অবদান যথাক্রমে বিশ্ব উৎপাদনের ১১ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ। ২০২১ সালে ভারত চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদক দেশ হয়ে ওঠে এবং ২০২২ সালে বিশ্ব উৎপাদনে ২৮ দশমিক ৬০ শতাংশ অবদান ছিল ভারতের। ২০১৩-১৪ থেকে ২০২১-২২ মৌসুম পর্যন্ত ভারতের পেঁয়াজ উৎপাদনে সবচেয়ে তীব্র বৃদ্ধি দেখা গেছে, যা ছিল বিশ্ব উৎপাদনের প্রায় ৬৩ শতাংশ।