
বর্তমানে দেশের ব্যবসায়ীরা প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন। উত্তরণের জন্য যে সময় নির্ধারিত রয়েছে তার জন্য আমরা প্রস্তুত না। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের সময় কমপক্ষে ২-৩ বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
গতকাল রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় ব্যবসায়ীরা এ দাবি জানান। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর সাপোর্ট টু সাসটেইন্যাবল গ্র্যাজুয়েশন প্রজেক্ট (এসএসজিপি) যৌথভাবে ‘এলডিসি উত্তরণে ‘মসৃণ রূপান্তর কৌশল (এসটিএস) বাস্তবায়ন’ শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আলোচনায় সভায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এবং বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান যথাক্রমে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা চেম্বার সভাপতি তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এলডিসি হতে উত্তরণের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্থিরতা, শিল্প খাতে জ্বালানিসংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, উচ্চ সুদহার ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের স্বল্পতা প্রভৃতি কারণে বেসরকারি খাত প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।’
এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ কমপক্ষে ২-৩ বছর পিছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তিনি জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ১.৮ শতাংশ, যেখানে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১.৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণে ৫টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ‘মসৃণ রূপান্তর কৌশল (এসটিএস)’ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ফ্রেমওয়ার্কের বাস্তবায়ন, শক্তিশালী নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার, পার্টনারশিপ ও সহমর্মিতা, নীতির সমন্বয়, অর্থায়ন নিশ্চিতকরণে কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন একান্ত অপরিহার্য।
তৈরি পোশাক খাতের বাইরে রপ্তানির সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাত যেমন: ঔষধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, সেমিকন্ডাক্টর, হালকা-প্রকৌশল এবং তথ্য-প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের আহ্বান জানান ঢাকা চেম্বার সভাপতি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইআরডির সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, ‘এলডিসি-পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য সুবিধা চলে যাওয়ার প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের সকল স্তরে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের প্রয়োজন নির্ধারণ ও সমাধানের লক্ষ্যে বাণিজ্য সংগঠনগুলোর প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি প্রণয়ন করা হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তবে চলতি হিসাব এবং আর্থিক হিসাবের বর্তমান অবস্থা বেশ উন্নত হওয়ায় এ ক্ষেত্রে আশার সঞ্চার হচ্ছে। তথ্যগত বিভ্রান্তি ও ব্যবধান দূর করতে সরকারকে ইউএন-এসক্যাপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কারিগরি সহায়তা দেবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুরু থেকেই যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ঘাটতি ছিল। তবে বেসরকারি খাতের মতামতের ভিত্তিতে কতটুকু টেকসই উপায়ে এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে অগ্রসর করা যাবে, তার দিকে বেশি আলোকপাত করতে হবে। তিনি তৈরি পোশাক খাতের পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি প্যাকেজিং খাতের উন্নয়নের ওপর মনোযোগী হওয়ার জন্য বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের আহ্বান জানান।
স্বাগত বক্তব্যে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও এসএসজিপির প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম জাহাঙ্গীর বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বেসরকারি খাত। বেসরকারি খাতের সহায়তার পাশাপাশি এলডিসি উত্তরণ সার্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণীত এসটিএস বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সমন্বিত কার্যক্রম একান্ত অপরিহার্য।
এলডিসির স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি বিষয়ে এসএসজিপির কম্পোনেন্ট ম্যানেজার ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘আমাদের মোট রপ্তানির প্রায় ৭৩ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে, যা এলডিসি পরবর্তী সময়ে আমরা গ্রহণ করতে পারব না।’ তা ছাড়া বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাপ্রাপ্তি হতেও আমরা বঞ্চিত হব। সেই সঙ্গে রপ্তানির পণ্যের বহুমুখিতার স্বল্পতাও আমাদের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্প্রসারণের পাশাপাশি মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় এসএসজিপির কম্পোনেন্ট ম্যানেজার ড. মো. রেজাউল বাসার সিদ্দিকী, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও ইটিবিএল হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিজওয়ান রাহমান, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ডিসিসিআইর সাবেক পরিচালক মনোয়ার হোসেন, বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক আসিফ আশরাফ এবং সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী অংশগ্রহণ করেন।
ড. মো. রেজাউল বাসার সিদ্দিকী বলেন, ‘এসটিএস বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনয়ন করা সম্ভব। এলডিসি উত্তোরণের সব সূচকে আমরা এখনো বেশ ভালো অবস্থানে।’
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত সিএমএসএমই হতে ‘মধ্যম’কে আলাদা করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রকৃত নীতি-সহায়তার সুবিধা হতে বঞ্চিত হবে। এসএমই ডাটা বেইজ প্রণয়নে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। দেশের ব্যবসায়ীরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। তাই সরকারকের এ ব্যাপারে বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তাব করেন।
আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অবকাঠামো খাতে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি।’ এ ছাড়া ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পকারখানায় প্রয়োজনীয় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে সমগ্র অর্থনীতিতে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের আমদানির চাইতে রপ্তানি বেশি না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এর জন্য প্রস্তুত নই।’
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘২০২২ সাল হতে আমরা অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করছি, এর সঙ্গে রয়েছে রপ্তানি আয়ের তথ্য বিভ্রান্তি।’ তিনি বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু নীতি আমাদের রপ্তানি খাতের বিরুদ্ধে গেছে। সেই সঙ্গে ইডিএফ ফান্ডসহ আরও কিছু তহবিল সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে এবং ঋণের উচ্চ সুদহার এ অবস্থাকে আরও অসহনীয় করে তুলছে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত নই।’ তিনি জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে এখন থেকেই উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, পাট খাতে বহুমুখীকরণের জন্য সরকারের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা একান্ত প্রয়োজন।