চায়ের রাজধানী নামে বিখ্যাত শ্রীমঙ্গল জেলা বিগত কয়েকবছর ধরে সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা গরমে কিংবা শ্রাবণে বৃষ্টিস্নাত লেবুপাতা, চা বাগানভর্তি সবুজ দেখে চোখের শান্তি যেমন মিলবে আবার শীতে কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকে ছোট্ট শহরটাও সমান উপভোগ্য হবে।
ঢাকা থেকে মাত্র ৪ ঘণ্টার দূরত্বে মৌলভীবাজারের কোলঘেঁষে এই জেলাটি। অজস্র চা বাগানের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়, বিল, হাওর দিয়ে ঘেরা সবুজ মায়ার জায়গা।
আকাশ বেয়ে নেমে আসা এমনি এক ধূসর কুয়াশা দিনে ঢাকায় শীতের আভাস না পেয়ে শীতযাপনের জন্য গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গল।
করোনা মহামারির পরপরই এক দুপুরে ট্রেনে চেপে বসেছিলাম কমলাপুর স্টেশন থেকে। অনলাইনে টিকিট পেতে যে ঝক্কি হয়েছিল, তা ভোলা কঠিন হবে।
অবশ্য সে কষ্ট নিমেষেই মিইয়ে গেছিল ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ বাদে। মাইলের পর মাইল হলুদখেত, সর্ষেফুলের পাতা ঝরে বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে।
কেটে নেয়া ধান খেতের ওপারে মলিন সূর্যটাও ট্রেনের সঙ্গে ঝিকঝিক করে আগাচ্ছিল। একরাশ ভালোলাগায় মন উদ্বেলিত হয়ে ভুলে গেলাম শহরের যান্ত্রিক জীবন। ট্রেনভর্তি মানুষ, পাশে পরিবারের প্রিয়জনরা এর মাঝেও কোথা থেকে শীতের দুষ্টু বাতাসের মতো একফালি বিষণ্ণতা ঢুকে পড়ে মনে।
চোখের আরাম দেয়া সন্ধ্যার লালিমা ধরা আকাশের ওইপার থেকে কে যেন ডাকে নাম ধরে! যাপিত এই জীবনে নিজেকে বড় বেমানান লাগে।
আমার যেন অন্য কোথাও থাকার কথা ছিল। কথা ছিল এই প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে বাঁচার। উদাস হওয়ার বিলাসিতাটুকু ঝেড়ে ফেলে আবার পার্থিব জগতে ফিরতেই হয়। বোধহয় একেই বলে নিয়তি!
এশার আজানের কিছুক্ষণ পরে ট্রেন থামে আমাদের গন্তব্য শ্রীমঙ্গল স্টেশনে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সাজিদ ভাই। শ্রীমঙ্গলের স্থানীয় অটোচালক ভাইটি এই অঞ্চলে আমাদের একমাত্র ভরসার জায়গা।
তাই এখানে এলেই ওনাকে ফোন দেওয়া হয়। লাগেজ টানাটানি থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং, প্রতিবার নতুন জায়গায় ঘোরাঘুরি, কার কী লাগবে সব দায়িত্ব হাসিমুখে নিজ কাঁধে তুলে নেন সাজিদ ভাই।
বরাবরের মতো উনার হাতে সব ছেড়ে দিয়ে অটোতে চড়ে বসি হোটেলের উদ্দেশে। চিরচেনা চা বাগানের ঘ্রাণসমেত বাতাস নিতে ফুসফুস ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ঠাণ্ডা বাতাসের এই মিঠেকড়া অনুভূতি ঝিরঝিরি বৃষ্টির মতো মনে হয়। এখানে সন্ধ্যাটাও ভোরের কুয়াশার মতো বাতাস মিষ্টি লাগছে।
চা বাগান আর বাঁশ বনের জোছনা গায়ে মাখতে পৌঁছে যাই হিমাচল রিসোর্টে। এখানে আমাদের জন্য রুম বুকিং দেওয়া ছিল আগে থেকেই।
রাতের খাবারের পর বেশ আয়েশ করে এক কাপ চা পান করলাম। যাত্রার ক্লান্তি কাটিয়ে অরণ্য গহিনে ভোর দেখার আশায় একুট আগেই ঘুমিয়ে গেলাম।
ভোরে ঠিকঠাক সময়েই ঘুম ভাঙল। জ্বলজ্বলে মুক্তার মতো কুয়াশার চাদর বিছিয়ে আছে বাইরে। হোটেলটার ঠিক সামনেই একটা চা বাগানের টিলা।
গায়ে একটা শাল পেঁচিয়ে উঠে গেলাম ওপরে। দেবদারু গাছের ফাঁকে প্রথম সূর্যের লাল আভা উঁকি দিয়ে যেন আমাকেই ডাকছে। শহরের কাঠিন্যে ক্লান্ত চোখ শান্ত হলো।
হঠাৎ একটা বনমোরগ ঝাঁপ দিল বুনো ঝোপের আড়ালে। অদ্ভুত নির্জন বাতাসের সঙ্গে পৌষের সকালটা শুরু হলো আমার। কোথাও কেউ নেই।
দূরে ঝাপসা সবুজ মাঠ ঝিলমিল করে আড়মোড়া ভাঙছে। বেশ কিছুক্ষণ নির্জনতায় নিজেকে খুঁজে ফিরে এলাম খাবারের টানে। হোটেলে নাশতা সেরে সাজিদ ভাই আসতেই প্রথম দিনের যাত্রা শুরু হলো।
উদ্দেশ্য পদ্মছড়া নামের এক ছোট পাহাড়। সে পাহাড় নাকি পুরোটাই লালমাটি আর তার নিচের নদী নীল সিলেটের লালাখালের মতো। ফিনলে চা বাগানের ভেতর দিয়ে, দুধারে গাছের সুড়ঙ্গ চিরে এগিয়ে যাচ্ছে অটোরিকশা।
চা বাগানের শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম পদ্মছড়া। সত্যিই রুক্ষ এক লাল পাহাড় সেটি। পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠছি আর লালমাটির ধোঁয়া উড়ছে।
পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে একটা দুইটা গাছ, তাও তার পাতা ধুলায় ময়লা হয়ে রয়েছে। জায়গায় জায়গায় চা চাষের অবশিষ্টাংশ অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে উঠছে। হাঁটতে হাঁটতে উঠে গেলাম টিলার চূড়ায়।
একজোড়া বটগাছ ঠায় দাঁড়িয়ে ডালপালা মেলে আকাশের সঙ্গে গম্ভীর বাতচিতে ব্যস্ত যেন। পাহাড়ের ওপরে পৃথিবী অন্যরকম। নিচে ছোটছোট লোকজন দেখা যাচ্ছে, ছোট ঘরবাড়ি, অদূরে ফিনফিনা এক নদী আঁকাবাঁকা।
ততক্ষণে রোদ উঠে গিয়েছে। চিকচিক করে কই জানি একটা হরিয়াল ডাকে। বটের ছায়ায় বসে কিছুক্ষণ আকাশ দেখলাম।
এলোমেলো ভাবনায় আসল, এই সময়টুকু বন্দি করে রাখা যায় না? এই ঝলমলে আদুরে রোদ, গায়ে না লাগা পাতার বাতাস, টিয়াপাখি টিংবা নতুন দূর্বাঘাসের মতো সবুজের ছড়াছড়ি চারদিকে, ঘাসফড়িং…
সব ফেলে চলে যেতে হবে! কেন হাতের মুঠোয় ঝরেপড়া বালির মতো সময়গুলো চলে যায়? সাজিদ ভাই তাড়া দিতেই ঘোর ভাঙল।
পরের গন্তব্য লাউয়াছড়া উদ্যান। লাউয়াছড়া যাওয়ার পথটি আরেক আশ্চর্য সুন্দর। পাহাড়ি পথের দুপাশে বড় গাছ আর জঙ্গলে ঘেরা উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছিল।
বারবার এসেও এই চমৎকার রাস্তাটি প্রথম পরিচয়ের মতো মুগ্ধ করে। পথের শেষে সংরক্ষিত উদ্যানে প্রবেশ করলাম টিকিট কেটে। বড় বড় গাছ।
নানা প্রজাতির গাছের মাঝে বাঁধানো পায়ে হাঁটার পথ। বিরল সব প্রজাতির গাছের দেখা মিলবে এখানে। একটু সামনে গেলেই দেখতে পাবেন রেললাইন।
এখানেই হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র ‘আমার আছে জল’এর শুটিং হয়েছিল। রেললাইনের বাম পাশ দিয় সামনে গেলেই দেখা মিলবে গবেষণা কেন্দ্র।
রেললাইন ছাড়ালে ধীরে ধীরে জনকোলাহল কমতে থাকে। যত ভেতরে যাবেন, ততই প্রকৃতি আর নির্জনতার রাজত্ব। নাম না জানা সব বুনোপাখি আর জন্তুর হাঁকডাক চলতেই থাকবে।
জঙ্গলে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে ফেরার পথ ধরলাম। এবারের মতো বেড়ানো শেষ। ফিরতে হবে শহুরে জীবনে। আবার সেই ছুটে চলা। পথ চলতে চলতে ভাবলাম, মানব জীবন এমনই।
এই সুখী ঘরকন্না আর সবসময় চাওয়া সুখের সখ্য কোনোদিনও চলমান হবে না। দিনমান বয়ে চলা অক্লান্ত নদীর মতো, শত বছর ধরে গম্ভীর সময়ের সাক্ষী সমান্তরাল রেললাইনের মতোই থাকবে।
পাহাড়ি ঝরনা যেমন দুরন্ত, নেমে এলে ছুটে যায় তার মতো করে, তেমনি উদাসীনতা আর রোজকার জীবনযাপন দুয়ের মিলন অসম্ভব। জীবিকার তাগিদে ফিরতেই হয়।
পরতে হয় একেকদিন একেক চরিত্রের মুখোশ। আপনারা যদি একদিনের অবকাশে বেড়াতে চান সেক্ষেত্রে শ্রীমঙ্গলের চেয়ে ভালো গন্তব্য আর নেই।
রাতের গাড়িতে এসে অটো ভাড়া করে একদিনেই ঘোরা যাবে ছিমছাম এই শহরটি। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) থেকে যাত্রা শুরু করে একে একে দেখবেন ফিনলের চা-বাগান, ভানুগাছ সড়কের টি-রিসোর্ট, জেরিন টি-এস্টেট।
এরপর লাউয়াছড়ার আগে হাতের ডানে জঙ্গলঘেরা পথটি চলে গেছে নূরজাহান টি-এস্টেটের দিকে। এ পথে দেখা মিলবে আরও বেশ কিছু বাগান।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান দেখা শেষ করে কমলগঞ্জের পথ ধরে আরও পাঁচ কিলোমিটার গেলে পাহাড়ঘেরা চা-বাগানের মধ্যে বিশাল মাধবপুর লেক। পড়ন্ত বিকেলটা লেকে কাটিয়ে ফেরার পথ ধরুন।
কলি