দ্বীপের নাম কেন ‘নিঝুম’ সেটা ঘুরতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি নামের মতোই নিঃশব্দ অথচ সমুদ্রের কোলে স্বর্গীয় এক আবেশ নিয়ে জেগে আছে এই দ্বীপ। নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান নিঝুম দ্বীপ। দ্বীপের গাছপালার মধ্যে আছে কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, বাইন ইত্যাদিসহ প্রায় ২১ প্রজাতির বৃক্ষ ও ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম। চিত্রা হরিণ, বন্য কুকুর, সাপ, বনবিড়াল ইত্যাদি প্রাণী ও সারস, মাছরাঙা, সোয়ালো, বুলবুলি, হট্টিটি, চিল, আবাবিলসহ প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখির সমন্বয়ে এই দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিবেচনায় অমূল্য সম্পদ। শীত মৌসুমে অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় দ্বীপটি।
ঝুম বৃষ্টিতে ভোগান্তি
কয়েক বন্ধু মিলে আমরা যখন এই দ্বীপে গিয়েছিলাম, তখন বর্ষা বিদায়ের ঘণ্টা বাজছিল। তবে প্রলয়ংকরী শক্তি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল ঘূর্ণিঝড় হামুন। আমরা সরাসরি ট্রলারে করে যাত্রা শুরু করলাম নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশে। নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে পৌঁছাতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ঘাট থেকে ভাড়ায় চালিত বাইক নিয়ে আমরা চলে গেলাম নামাবাজার পর্যন্ত। খাবারের খোঁজে বসে পড়লাম ছোট একটা খাবার হোটেলে। মাছ, মাংস, ডাল, ভর্তা, সবজি কিংবা শাক। খাবারের দাম মাঝামাঝি।
খাওয়া শেষে আমরা থাকার জন্য উঠলাম এখানকার সরকারি ডাকবাংলোতে। ডাকবাংলো ছাড়াও আশপাশে অনেকগুলো হোটেল ছিল। এখানে অবস্থানের ক্ষেত্রে হোটেলের খরচ নির্ভর করে আপনি কোন সময়ে ভ্রমণে এসেছেন সেটার ওপর। আমরা যেহেতু ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে গিয়েছিলাম, তাই হোটেলের খরচ মোটামুটি কম ছিল।
কোথায় কোথায় গেলাম?
সন্ধ্যার পর টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় আমরা গেলাম নামাবাজার সমুদ্রসৈকতে। বালিমাখা সমুদ্রসৈকত। খোলা প্রান্তরের বিস্তীর্ণ এই সমুদ্রসৈকত দেখে মন জুড়িয়ে গেল। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছিল তীরে। চারপাশ একেবারে নীরব-নিস্তব্ধ। এর মাঝে শোনা যায় কেবল সমুদ্রের গর্জনের শব্দ। সমুদ্রে সময় কাটিয়ে আমরা বাংলোতে ফিরে এসেছিলাম রাত ঘনিয়ে আসার আগেই।
ম্যানগ্রোভ বন ও হরিণের জন্য পর্যটকদের কাছে বিশেষ খ্যাতি আছে নিঝুম দ্বীপের। পরদিন সকালে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়লাম হরিণ ও বনের খোঁজে। আমাদের সঙ্গে ছিল স্থানীয় দুজন গাইড। কবিরাজের চরের কাছে চৌধুরী খালের কিছুটা অদূরে বিকেল থেকে সন্ধ্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণের দেখা মেলে। সেদিকটাই ছিল আমাদের গন্তব্য। যাওয়ার পথে বাংলোর একেবারে কাছেই রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। চাইলে সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠে পাখির চোখে একবারে দেখে নিতে পারেন পুরো নিঝুম দ্বীপ।
বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যখ্যাত এই দ্বীপে রয়েছে হাজার হাজার হরিণের বসবাস। ১৯৯৬ সালের হরিণশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী এখানে প্রায় ২২ হাজার হরিণের বসবাস ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে মানুষের আনাগোনা ও বাড়তি বসতি এবং প্রাকৃতিক সংকটের কারণে কমেছে হরিণের সংখ্যা।
ওয়াচ টাওয়ার পেরিয়ে যেতেই জেলেপল্লী। পাশে বয়ে গেছে খাল। খালের ওপারের ঘন জঙ্গল পেরিয়ে গেলেই হরিণের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। তাই নৌকা দিয়ে খাল পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলাম অনেক দূর। প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার পথ ট্রেকিং করে আমরা ম্যানগ্রোভ বন পেরিয়ে গিয়েছিলাম কমলার দীঘির পাড়ে।
নোনা পানির এ জগতে হরিণ টিকিয়ে রাখার জন্য হরিণের মিঠাপানির অভাব মেটাতে এখানে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে এই কমলার দীঘি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা ঘাপটি মেরে ঘণ্টা দুয়েক বসে থেকেও হরিণের দেখা পেলাম না। দেখা পেলাম মাটিতে পড়ে থাকা হরিণের মাথার খুলির। স্থানীয় গাইড জানালো এসব শিয়াল মামার কাণ্ড। ফিরে এলাম অন্য পথে।
কবিরাজের চরের পাড়ঘেঁষে ফিরতে ফিরতে দেখা পেলাম উড়ন্ত ঝাঁকবাঁধা পাখির। পাড়ে বয়ে গেল খাল, নদী ও সমুদ্রের মোহনা। দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করতেই চোখে পড়ল জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য।
পরের দিন সকালে বের হলাম দমার চরের দক্ষিণে থাকা ভার্জিন আইল্যান্ডখ্যাত সমুদ্রসৈকতে। নামাবাজার থেকে মোটরবাইকে করে সমুদ্রসৈকতের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছালাম। সমুদ্রের একেবারে কাছে যেতে যেতে চোখে পড়বে মাটিতে হরিণের ছাপ। দূরে ধু-ধু প্রান্তর আর মাঝে মধ্যে উঁকি দেওয়া দুয়েকটা গাছের সারি।
তিন দিনের যাত্রা শেষে পর দিনই আমাদের শহরে ফেরার তাড়া। পথিমধ্যে বাঁধ সাধল ঘূর্ণিঝড়ের ৭ নম্বর বিপৎসংকেত। আশপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ঘাট থেকে সকাল ৮টায় একটি ট্রলার ছাড়া হবে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছিল। তবুও রওনা হলাম বন্দরটিলা ঘাটের উদ্দেশে। ঘাটের দোকানে বসে কেটে গিয়েছিল ঘণ্টাখানেক। নির্দিষ্ট ট্রলারটি আর ছাড়ল না। ছাড়ল অন্য একটি ট্রলার। এ পাড়ের বন্দরটিলা ঘাট থেকে ওপাড়ের মোক্তারিয়া ঘাট। সমুদ্র তখন বেশ উত্তাল। সংকেতও বাড়ছিল। উত্তাল সমুদ্রের বড় বড় ঢেউয়ের তালে দোল খেতে খেতে কীভাবে যেন পৌঁছে গেলাম মোক্তারিয়া ঘাট।
সেখান থেকে নলচিরা ঘাট দুই থেকে তিন ঘণ্টার পথ তখনো। ঘাটে থাকা তিন থেকে চারটি বাইকও ভাড়ায় ঘাট ছেড়ে গেল। আর কোনো গাড়িও নেই যার মাধ্যমে এ পথ পাড়ি দেওয়া যেত। তাই হাঁটা শুরু করলাম। ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পর পৌঁছালাম একটা বাজারে। সেখান থেকে দর কষাকষি করে উঠে পড়লাম একটা অটোরিকশায়। আরও দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর আমরা আসলাম নলচিরা ঘাটে। ঘাটে পৌঁছানোর ঠিক মিনিট বিশেক আগে চেয়ারম্যান ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে গেল একটি ট্রলার। আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম পরের ট্রলারটির জন্য। ইতোমধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম।
বিকেল প্রায় গড়িয়ে এল। শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। সঙ্গে বাতাসের তোড়জোড়। সমুদ্রের ঢেউ অনেকদূর পর্যন্ত আছড়ে পড়া শুরু হলো।
মহাবিপৎসংকেত দেওয়া হলো। খবরে জানলাম রাতের মধ্যেই হামুন আঘাত হানবে। ট্রলার ঘাটে এসে পৌঁছাল। ঘাটে থাকা যাত্রীদের মধ্যে ভয় আর উৎকণ্ঠা। ভীষণ সাহস নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রলারে। ট্রলারের সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় মনে হলো মৃত্যুকূপে পা রাখছিলাম। ট্রলারে উঠতেই সমুদ্রের ঢেউয়ের ভয়াবহতা অনুভব করলাম। মনে হলো এ যাত্রায় বেঁচে গন্তব্যে পৌঁছানো অসম্ভব ব্যাপার। শেষমেশ নেমেই পড়লাম। সেদিন আর ফেরা হলো না। কিছুদূর পেছনে হাতিয়া পৌরসভার একটা হোটেলে উঠলাম।
সেদিন রাতেই হামুন আঘাত হানল। ভোর হতেই আকাশে আলোর ছটা, অশান্ত সাগর ধীরে ধীরে শান্ত হলো। সকালে যথারীতি ১০টার ট্রলার ধরেই আমরা চেয়ারম্যান ঘাট এসে শহরের বাস ধরলাম। শীতকাল অর্থাৎ অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। বছরের অন্য সময়গুলোয় মেঘনা নদী ও সাগর বেশ উত্তাল থাকে, তাই এই সময়গুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।
জেনে রাখুন যাওয়ার উপায়গুলো
ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে সোজা চলে যাবেন হাতিয়া। হাতিয়া থেকে বোট বা ট্রলারে যেতে পারেন নিঝুম দ্বীপ বন্দরটিলা। অথবা বাসে চড়ে নোয়াখালী, মাইজদী বা সোনাপুর যেতে পারেন। সেখান থেকে সিএনজিতে যেতে হবে ঘাটে। ঘাট থেকে নৌকা, স্পিডবোট বা ট্রলারে চড়ে হাতিয়া হয়ে বা সরাসরি যেতে পারেন নিঝুম দ্বীপ। তবে সকাল ৮টার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারলে যেতে পারবেন সি-ট্রাকে। সি-ট্রাকে উঠে হাতিয়া হয়ে নিঝুম দ্বীপ।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
প্রত্যন্ত অঞ্চল ও নানামুখী অসুবিধার কারণে এখানে এখনো সর্বোন্নত মানের কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠেনি। তবে সরকারি ডাকবাংলো কিংবা বিভিন্ন আবাসিক হোটেল আছে যাতে আপনি কম বাজেটে ভাড়ায় থাকতে পারবেন।
কলি