আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া। প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিশাল এই দেশ সম্পর্কে খুব কম জানি আমরা। সম্প্রতি রাশিয়া ঘুরে এসেছেন সাবিতা বিনতে আজাদ। তার যাত্রাটা ছিল মূলত বিশ্ব যুব উৎসবে অংশগ্রহণ করা। রাশিয়ার বিখ্যাত বিশ্বকাপ করা হোস্টিং সিটি সোচিতে কনফারেন্সে যোগ দিতে। কনফারেন্সের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর ছয় মাস ধরে দফায় দফায় বিভিন্ন আপডেট আর আপলোড চালিয়ে কনফারেন্স কনফারমেশন মেইল পেয়েছিলেন। দু-তিন দফা রাশিয়ান অ্যাম্বেসিতে গিয়ে ভিসাও পেয়েছিলেন। তবে পর্যটক হিসেবে রাশিয়ার ভিসাপ্রাপ্তি আর ভ্রমণ তেমন জটিল কোনো কিছু নয়। নিয়মানুযায়ী আবেদন করলে সহজেই ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়া যায়। এসব নিয়ে লিখেছেন সাবিতা বিনতে আজাদ
সোচি শহর
কল্পনার মতো করে শহরটা সাজিয়েছে রুশ সরকার। মূলত শহরটা তৈরি হয়েছে ৫০ হাজারের ওপর অতিথির হোস্টিংয়ের জন্য। কৃষ্ণ সাগরের পাশে এই শহর, সবুজ আর শান্ত। সমুদ্রপ্রেমী ও ক্রীড়ামোদী পর্যটকদের কাছে এই শহর অনেক পছন্দের। রাশিয়ার জাররা এ শহরে অবসর সময় কাটাতে আসতেন। গ্রীষ্মে এ শহরে পর্যটকদের ঢল নামে। মূল শহর বেশ গোছানো। বাস, ট্রেন, ট্রাম সবকিছুই নাগালের মধ্যে। মোবাইল অ্যাপস ধরে, ক্যাশ কিংবা কার্ডে পেমেন্ট করে অনায়াসে আপনি ভ্রমণ করতে পারবেন। রুশ সরকার আমাদের ফ্রি সিম আর ব্যাংক কার্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তবে আপনি সহজেই পাসপোর্ট আর মাইগ্রেশন কার্ড দিয়ে সিম এবং ব্যাংক কার্ড করতে পারবেন। সোচি ভ্রমণ খুব আরামদায়ক ছিল, আরও ছিল
চমৎকার খাবার আর আয়েশি হোটেল। অফুরন্ত ইভেন্ট আর এডুকেশনাল সেশন চোখের পলকে শেষ হয়ে গিয়েছিল। সোচি থেকে বিমানযোগে মস্কো চলে গিয়েছিলাম। মস্কো থেকে একদম পৃথিবীর শেষের শহর মুরমাস্ক। সেখান থেকেই শুরু হয় আমার একক যাত্রা।
মুরমাস্ক শহর
পৃথিবীর শেষ গ্রাম আর নিয়ন আলোর নর্দার্ন লাইট হান্টিং- মস্কো শহর থেকে বিমানযোগে চলে গিয়েছিলাম মুরমাস্ক। এখানে পৃথিবীর শেষ গ্রাম টেরিবার্কা গিয়েছিলেন। অসাধারণ সে অনুভূতি। মূলত চারজন রুশ মেয়ের সঙ্গে মিলে গ্রামে গিয়েছিলাম। কী অপূর্ব সুন্দর এই গ্রাম! সেখানে গিয়ে দেখেছি সি গাল, গ্রিক মিথিওলজির রেইন্ডার, স্লেজ গাড়ি টানা হাস্কি কুকুরের ফার্ম। টেরিবারকা থেকে আর্কটিক সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়েছি বারবার। ঠাণ্ডা এত বেশি ছিল যে, ৫-৬টা লেয়ারের জামা কাপড় পরেও জমে গিয়েছিলাম।
নর্দার্ন লাইট
এই শহরেই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস দেখেছি। আমি প্রফেশনাল একজন গাইড বুক করেছিলাম, আমার পরিচিত এক ভাইয়ের রেফারেন্সে যারা খুব আগ্রহী, নর্দার্ন লাইট হান্টিং করে। আমার গাইড ইয়োরাস্লভের ডেডিকেশনের গল্প বললে কম হয়ে যাবে। সারা রাত ধরে আমাদের নর্দার্ন লাইট হান্টিং চলে। রাতের আকাশে নিওন লাইটের দেখা পাওয়া মার্চ মাসে এত সহজ নয়। আমরা ২০-২১ বার গাড়ি থেকে নেমেছি। মাইলের পর মাইল ছুটেছি। অবশেষে ধাপ করে নেমে এল বরফ রাজ্যে আকাশ থেকে সেই সবুজ নিয়ন আলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম বরফ সবুজ হয়ে গেছে, পাইন বনে নেমে এসেছে নর্দার্ন লাইট। মস্কো ফিরে সিদ্ধান্ত নিলাম, বিমানের টিকিট পরিবর্তন করে পেছাব। সেন্ট পিটার্সবাগ যাব।
সেন্ট পিটার্সবার্গ
মস্কো এসে চলে গেলাম সেন্ট পিটার্সবাগ। ইতালির ভেনিসের মতো সুন্দর এই শহর। এখানকার সবকিছু ৩০০ বছর আগের করা। এখনো অনেক আধুনিক। যা দেখি তাতেই অবাক হয়েছি। জারদের কী স্থাপত্যশৈলী! কী সেই রাজপ্রাসাদ। স্টেট হেরমিটেজ, কাজান ক্যাথেড্রাল, চার্চ অব দ্য সেভিয়ার অন ব্লাড, কি অবাস্তব স্থাপত্য তবু কত বাস্তব। নদীগুলোর বরফ ভাঙতে শুরু করেছে। আমার মনেও গ্রীষ্মের উষ্ণতা লেগেছে। নিজেকে বহমান নদী মনে হচ্ছে। আমি রাস্তায় ঘুরতাম, ঘুরতাম নদীর ধারে, বাসে, ট্রামে। আর মেট্রো! সে এক এলাহিকাণ্ড। পৃথিবীর গভীরতম মেট্রো বোধহয় এই সেন্ট পিটার্সবার্গে।
মস্কো
সব শেষে আসি মস্কো ভ্রমণে। আমি দফায় দফায় মস্কো এসেছি এই ভ্রমণে, মস্কো ছিল আমার বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। মস্কোর মেট্রো সিস্টেম আমার মাথা খারাপ করে ছেড়েছে। একবার এক ঘণ্টার জন্য হারিয়েও গিয়েছিলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে হোস্টেলে ফিরেছি। পুরো শহর যেন পাতালপুরী। মাটির ওপরে যত না কিছু মাটির নিচে তার কয়েকগুণ বেশি এলাহিকাণ্ড! কী নেই! শপিংমল থেকে শুরু করে সবকিছুই। পরে জানতে পারলাম মেট্রোগুলো এত গভীরে করেছে। যাতে যুদ্ধ লাগলে এগুলোকে বাংকার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। মস্কোর আকাশ খুব সুন্দর আর পরিষ্কার।
কোথায় থাকবেন
আমার মতো বাজেট ট্রাভেলার হলে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো হোস্টেল। বেশ সস্তা। সব সুযোগ-সুবিধা পাশাপাশি একটা রান্নাঘরও পেয়ে যাবেন। সবচেয়ে দারুণ কথা এখানে আপনি একা নন। দুনিয়াজুড়ে দেশ-বিদেশের বন্ধু বানানোর চমৎকার জায়গা এই হোস্টেলগুলো। আমি যেহেতু বেশির ভাগ একাই ভ্রমণ করেছি তাই আমি হোস্টেলগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছি। এগুলো নিরাপদ, সস্তা আর মূল শহরেই হয়।
কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবেন
যদি আপনার একটা ফোন থাকে আর তাতে ইন্টারনেট থাকে, সঙ্গে রাশিয়ান একটা কার্ড পান তাহলে এ দেশ আপনার! যেকোনো জায়গায় কার্ড দিয়েই পেমেন্ট করে বাসে, ট্রামে, মেট্রোতে প্লেনের টিকিট কেটে চলতে পারবেন। আর ফোনে অ্যাপস আছে ট্রান্সলেটর, ম্যাপ, ট্যাক্সির ম্যাপ। সব ব্যবহার করে আপনি আরামে থাকতে পারবেন।
সতর্কতা
রাশিয়ার ইমিগ্রেশন শেষে তারা একটা মাইগ্রেশন কার্ড দেয়। এটা হারিয়ে গেল পাসপোর্ট হারানোর মতোই কঠিন অবস্থা হবে। এটা একদম শেষ পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থাকা লাগবে। রাশিয়ার মানুষ দারুণ। ভাষা না বোঝা একটা সমস্যা, এক্ষেত্রে গুগল ট্রান্সলেটর আপনাকে সাহায্য করবে। ভ্রমণে আপনি মানেই বাংলাদেশ, এমন কিছু করবেন না যেটা আপনার দেশকে হেয় করে। রাশিয়ানরা বাংলাদেশিদের খুব ভালোবাসে।
কলি