ঢাকার খুব কাছেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁ। এখানে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল চত্বরে রয়েছে একাধিক পিকনিক স্পট। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী সেখানে ভ্রমণে যান। সোনারগাঁ বেড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ তুলে ধরেছেন সৈয়দ শিশির
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ে রয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহাসিক নানা নিদর্শন। এগুলো হলো লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, ঐতিহাসিক পানাম নগরসহ আরও অনেক কিছু।
লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর
সোনারগাঁয়ে গেলে প্রথমেই আপনি যা দেখবেন তা হলো- আবহমান গ্রামবাংলার লোক সংস্কৃতির ধারাকে পুনরুজ্জীবন, সংরক্ষণ ও বিপণনের জন্য গড়ে ওঠা বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন যা, সোনারগাঁ জাদুঘর নামে পরিচিত। এটি একটি জাতীয় জাদুঘর। বাংলাদেশের লোকশিল্পের সংরক্ষণ, বিকাশ ও সর্বসাধারণের মধ্যে লোকশিল্পের গৌরবময় দিক তুলে ধরার জন্য ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার বিশাল এলাকা নিয়ে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। এতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, যেমন- পাঞ্জাবি, শাড়ি, ধুতি, শার্ট, প্যান্ট ইত্যাদি। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী, যেমন বাদ্যযন্ত্র, খেলনা, আসবাবপত্র ইত্যাদি। এখানকার জয়নুল আবেদীন স্মৃতি জাদুঘরটি বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীনের স্মরণে নির্মিত। এ জাদুঘরে জয়নুল আবেদীনের বিভিন্ন চিত্রকর্ম ও অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় এ জাদুঘরের টিকিট কাটার নিয়মে অনেক ক্যাটাগরি রয়েছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে ছাত্রছাত্রী। তাদের জন্য প্রবেশমূল্য মাত্র ৩০ টাকা। জাদুঘরটির ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্সের টিকিট বা প্রবেশমূল্য সর্বসাধারণের জন্য ৫০ টাকা। তবে বিদেশি দর্শকদের জন্য ১০০ টাকা। এ ছাড়া এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য প্রতিটি বাস ৩০০ টাকা, কোস্টার ২০০ টাকা, কার/জিপ বা মাইক্রোবাস ১০০ টাকা। সিএনজি ও মোটরসাইকেল ২৫ টাকা এবং বাইসাইকেলের জন্য ১০ টাকা দিতে হয়।
নির্ধারিত ফিয়ের বিনিময়ে লেক এবং নৌ বিহার ভ্রমণের জন্য জনপ্রতি ৩০ মিনিট ২০ টাকা এবং শুটিং স্পটের জন্য সারা দিন ৩ হাজার ৪৫০ টাকা দিতে হয়। একই সঙ্গে বড়শিতে মাছ ধরতে ১ হাজার ৭৫০ টাকা ফি দিতে হয়। এখানকার সরদার বাড়িতে প্রবেশমূল্য ১০০ টাকা বাংলাদেশি দর্শনার্থীদের জন্য এবং বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ২০০ টাকা। এখানে শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন- এ দুই সিজনে দুই ধরনের সময়সূচি রয়েছে।
সোনারগাঁ জাদুঘরের সময়সূচি ২০২৩ অনুসারে, শীতকালীন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর গ্রীষ্মকালীন অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ ডিসেম্বর সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা। জাদুঘরটি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে।
পানাম নগর
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে ঠিক উত্তর দিকে গেলেই আপনি দেখতে পাবেন ঐতিহাসিক পানাম নগর। পানামের অট্টালিকা আপনাকে স্বাগত জানাবে। চারদিকে পরিখা বেষ্টিত দুই দিকে ফটকসমৃদ্ধ ইমারতরাজী শোভিত নাচঘর, নহবতখানা, দরবার কক্ষ। এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খীরাজ খাল।
একটু উত্তর দিকে দেখা যাবে পঙ্খীরাজ সেতু (পানাম সেতু) ও নীলকুঠি। ঈশা খাঁর সময়কালে এ নগর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। সোনারগাঁয়ে রাজদণ্ড বা রাজকার্য পরিচালিত হতো এই পানাম নগর থেকেই। এ নগরই যে প্রাচীন বাংলার রাজা-বাদশাহদের বাসস্থান ছিল তার প্রমাণ এ অঞ্চলের স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যেই পাওয়া যায়। পানাম গড়ে উঠেছিল বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে। যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের স্বাক্ষর হয়ে আছে।
এ নগরীতে আরও রয়েছে খাজাঞ্চিখানা, ঠাকুর ঘর, গুপ্তপথ, মঠ, মন্দির, পোদ্দার বাড়ি, ৪০০ বছরের প্রাচীন টাকশাল বাড়ি, বিনোদন পিকনিক স্পট, ট্যুরিস্ট হোম এবং প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সোনারগাঁ জি আর ইনস্টিটিউশন।
কারুশিল্প গ্রাম
এখানকার কারুশিল্প গ্রামে বৈচিত্র্যময় লোকজ স্থাপত্য গঠনে বিভিন্ন ঘরে কারুশিল্প উৎপাদন, প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। দোচালা, চৌচালা ও উপজাতীয় মোটিফে তৈরি এ ঘরগুলোয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অজানা, অচেনা, আর্থিকভাবে অবহেলিত অথচ দক্ষ কারুশিল্পীরা বাঁশ-বেত, কাঠ খোদাই, মাটি, জামদানি, নকশিকাঁথা, একতারা, পাট, শঙ্খ, মৃৎশিল্প ও ঝিনুকের সামগ্রী ইত্যাদি কারুশিল্প উৎপাদন, প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে কিংবা প্রাইভেটকারে সোনারগাঁয়ে যাওয়া যায়। সময় লাগে বাসে এক থেকে দেড় ঘণ্টা এবং প্রাইভেটকারে এক ঘণ্টা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা হয়ে উত্তরদিকে গেলেই দেখতে পাবেন পর্যটন নগরী সোনারগাঁ। গুলিস্তান হকি স্টেডিয়ামের পাশে বাস কাউন্টার রয়েছে। এখান থেকে ঢাকা-মেঘনা সড়কের দোয়েল সার্ভিস, স্বদেশ পরিবহন, মেঘালয়, বোরাক বাসে চড়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে। বাস ভাড়া ৪৫-৫৫ টাকা। যদি বাসে যান তাহলে চৌরাস্তা বাসস্ট্যান্ড নেমে রিকশা করে উত্তর দিকে পর্যটক নগরী সোনারগাঁ লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁ জাদুঘরে) যেতে হবে। রিকশা ভাড়া নেবে ৩০-৪০ টাকা।
যেখানে থাকবেন
সোনারগাঁয়ে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সাধারণত থাকার পরিকল্পনা করেন না বেশির ভাগ পর্যটক। ঢাকার খুব কাছাকাছি বলে এক দিনে ঘোরাঘুরি শেষে আবার বাসায় ফিরে যান। কিন্তু যারা দূর থেকে বেড়াতে আসেন তারা অনেক সময় থেকে যেতে চান। তাদের জন্য এখানে থ্রি স্টার মানের ‘সোনারগাঁ রয়্যাল রিসোর্ট’ রয়েছে। এটি লোকশিল্প জাদুঘরের পাশেই খাসনগর দিঘীরপাড় এলাকায় অবস্থিত। রাত যাপনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। তবে থাকতে হলে আগেই বুকিং দিতে হবে।
এ ছাড়া একটি রেস্ট হাউস আছে। সেটি এমএ সাত্তার কেন্দ্রীয় গণবিদ্যালয় (বেইস)। এখানে অনেকগুলো মনোরম কক্ষ রয়েছে। জাদুঘর সংলগ্ন খাসনগর দীঘিরপাড় ইছাপাড়া গ্রামে এর অবস্থান। এ ছাড়া সরকারি অতিথিদের জন্য জাদুঘর ও উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব গেস্ট হাউস বাংলো রয়েছে।
কলি