ভ্রমণের কথা শুনলে ছেলেরা যতটা উৎসাহ দেখায়, মেয়েরা ততটা দেখায় না। এর অর্থ এই নয় যে, তাদের ভ্রমণে যেতে ভালো লাগে না। এর কারণ হলো, তারা পারিবারিক বা সামাজিক নানা প্রেক্ষাপটের কারণে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করে। তবে এই দ্বিধাকে জয় করে ভ্রমণ জগতে নারীর পদচারণার গল্পও নেহায়েত-ই কম নয়।
শুনেছি সমুদ্রের বিশালতা মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। অথচ সমুদ্রের খুব কাছে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও আমার স্বপ্ন দেখার কারিগর হলেন বাবা আর মা; যারা সবসময় আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। ভ্রমণের শুরুটা হয় ২০১৮ সালে, যখন মা নিজে হাতে টাকা তুলে দেন ভ্রমণের জন্য। কখনো কল্পনাও করতে পারিনি, চকরিয়ার মতো ছোট্ট একটা জায়গা থেকে নিজেকে বরফের চাদরে মোড়ানো এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে নিয়ে যেতে পারব।
এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, নেপাল
২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর। অবশেষে সুযোগটা পেয়ে গেলাম, এক বছর তিন মাস ধরে পরিকল্পনা করা ভ্রমণের গল্প সফল করার। মাউন্ট এভারেস্টের নাম শুনলেও কখনো ভাবিনি, এর বেস ক্যাম্প জয় করব। মাউন্ট এভারেস্ট প্রায় ৮ হাজার ৮৫০ মিটার উঁচু। এর চূড়ায় উঠতে হলে চারটি ক্যাম্প পার হতে হয়। ক্যাম্প হচ্ছে রাতে থাকার জন্য আর বেস ক্যাম্প ট্রেকিং করার জন্য। ৫ হাজার ৪০০ মিটার যাওয়ার পরে আবার ফিরে আসতে হয়। যারা সামিট করে, তাদের উপরে যেতে হয়।
অক্টোবর ১৮ তারিখ কাঠমান্ডু পৌঁছেই গাইডের সঙ্গে আলোচনা করি। তারপর শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে পড়ি। রেন্টাল দোকান থেকে ভাড়া করি স্লিপিং ব্যাগ। ১৯ তারিখ সকালের নাশতা করেই সোজা বেরিয়ে পড়ি এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। সেখান থেকে ১০ জন যাত্রীসহ ছোট্ট একটি প্লেনে করে ৩০ মিনিটের যাত্রায় পৌঁছালাম লুকলা এয়ারপোর্ট। মাত্র তিন হাজার মিটার আয়তনের এই ছোট্ট এয়ারপোর্টটি এভারেস্টের সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্ট, যেটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক এয়ারপোর্টও বলা হয়ে থাকে। লুকলা নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক গল্প আছে। ১৯৫৩ সালে স্যার এডমন্ড হিনরি যখন এভারেস্ট জয় করেন, তখন তার লুকলা পৌঁছাতে সময় লেগেছিল প্রায় এক মাস আর আমরা পৌঁছে গেলাম মাত্র ৩০ মিনিটে।
লুকলা পৌঁছানোর পরপরই শুরু হলো কাঙ্ক্ষিত পথচলা। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় লোকজন মাঝে মাঝে হাত নাড়িয়ে শুভ কামনা ও নমস্তে বলতে লাগল। প্রথম দিন দুপুরের খাবার সারলাম একটি টি হাউসে। দীর্ঘ ১৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার পথ চলার পর অন্য টি হাউসে পৌঁছালাম। রুমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এত ঠাণ্ডা ছিল যে কোনোভাবেই শরীর গরম করতে পারছিলাম না। কোনো উপায় না থাকায় এভাবেই রাত কাটাতে হলো।
পরবর্তী গন্তব্য নামচি বাজার। প্রাণবন্ত একটি শহর। ট্র্যাকারস, ট্রাভেলার্সদের জন্য এটিই মূল শহর। এই শহরে দুদিন থাকতে হলো এমন উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে অভ্যস্ত করার জন্য। আর পরের দিনগুলো কাটল এভারেস্টকে সামনে রেখে। যতই সামনে এগোচ্ছি, ততই এভারেস্টকে দেখার আগ্রহ যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে মনের ভেতরে।
প্রতিদিনই ১৩-১৪ কিলোমিটার ট্র্যাক করে ওপরে উঠছি। কিন্তু চারদিকের এত প্রশান্তিকর জায়গা দেখে সারাদিনের কষ্ট কিছুই আর মনে আসে না। বারবার শুধু এটাই ভাবছি যে, আমি কি সত্যি সত্যিই এভারেস্ট দেখতে যাচ্ছি! মজার বিষয় হলো, যত সামনে যাবেন, দেখে মনে হবে এটি এভারেস্টের চেয়েও উঁচু।
পৃথিবীর ১৪টি সবচেয়ে বড় পর্বতের ১০টি হিমালয়ান রেঞ্জের ভেতরে আমা দাবলামকে অনেক উঁচু মনে হলেও মূলত এভারেস্ট সবার চেয়ে উঁচু। lobuche- ৫০০০ মিটার- ঐতিহাসিক একটি জায়গা। এখানে রয়েছে শেরপাদের কবর; যারা হিমালয় এক্সপ্লোরেশনে জীবন হারিয়েছে। এখানে সবাই বিশ্রাম নেয়। Altitude Sickness এর শুরুও সবার এখান থেকে। রাতের খাবার শেষ করে খেয়াল করলাম, সারা শরীরে অনেক গরম অনুভব করছি, সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা। কিন্তু চিন্তার কারণ নেই। ওষুধ নেওয়ার ২০-৩০ মিনিট পর ভালো অনুভব করবেন।
পরের দিন মনে হলো, আজকে আর আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু গাইড বলল, মানিয়ে নিতে হবে, শক্ত হতে হবে, নাহলে সবকিছুই শেষ। সব পার করে অবশেষে বেস ক্যাম্পের দেখা মিলল অনেক দূরে। দেখা যাচ্ছে, সামনে অনেক বড় লাইন। একটি বড় পাথরের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই ছবি তুললাম। এভারেস্টের খুব কাছে গিয়েও চূড়া দেখা একটু কষ্টকর। তবু এখান থেকে আপনি ক্যাম্প-১-এর শুরু (Khumbu Glacier) দেখতে পারবেন।
বেস ক্যাম্প দেখার পর খুবই বিশ্রামের দরকার। কারণ এরপর যেতে হবে কালা পাথার (৫ হাজার ৬০০ মিটার) ক্লাইম্বিংয়ের জন্য, যেখান থেকে পুরো হিমালয় রেঞ্জের ওপরে পরিষ্কার সূর্যাস্ত দেখা যায়। এতটা উঁচু থেকে জীবনের প্রথম চকচকে সূর্য দেখা। দেখে মনে হবে, এভারেস্টের ওপর আগুন জ্বলছে আর এদিকে আমার শরীর ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে যাচ্ছে।
যেই এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে আপনি উঠবেন সাত দিনে, সেই একই পথ নামতে সময় লাগবে মাত্র তিন থেকে চার দিন। কিন্তু নতুন অভিজ্ঞতার জন্য আমি হেলিকপ্টার রাইড নিলাম। মনে হলো, আজকে আমার জীবন হাতে নিয়ে ফিরতে পারলে আর কখনো হেলিকপ্টার রাইড নেব না। এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্র্যাক করার পর আমার মনে হলো,
‘The harder you work for something,
The greater you'll feel when you achieve it.’
কলি