ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের দিনগুলো

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৪, ০৩:৫১ পিএম
আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৪, ০৩:৫১ পিএম
মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের দিনগুলো

ভ্রমণের কথা শুনলে ছেলেরা যতটা উৎসাহ দেখায়, মেয়েরা ততটা দেখায় না। এর অর্থ এই নয় যে, তাদের ভ্রমণে যেতে ভালো লাগে না। এর কারণ হলো, তারা পারিবারিক বা সামাজিক নানা প্রেক্ষাপটের কারণে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করে। তবে এই দ্বিধাকে জয় করে ভ্রমণ জগতে নারীর পদচারণার গল্পও নেহায়েত-ই কম নয়।

শুনেছি সমুদ্রের বিশালতা মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। অথচ সমুদ্রের খুব কাছে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও আমার স্বপ্ন দেখার কারিগর হলেন বাবা আর মা; যারা সবসময় আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। ভ্রমণের শুরুটা হয় ২০১৮ সালে, যখন মা নিজে হাতে টাকা তুলে দেন ভ্রমণের জন্য। কখনো কল্পনাও করতে পারিনি, চকরিয়ার মতো ছোট্ট একটা জায়গা থেকে নিজেকে বরফের চাদরে মোড়ানো এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে নিয়ে যেতে পারব।

এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, নেপাল

২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর। অবশেষে সুযোগটা পেয়ে গেলাম, এক বছর তিন মাস ধরে পরিকল্পনা করা ভ্রমণের গল্প সফল করার। মাউন্ট এভারেস্টের নাম শুনলেও কখনো ভাবিনি, এর বেস ক্যাম্প জয় করব। মাউন্ট এভারেস্ট প্রায় ৮ হাজার ৮৫০ মিটার উঁচু। এর চূড়ায় উঠতে হলে চারটি ক্যাম্প পার হতে হয়। ক্যাম্প হচ্ছে রাতে থাকার জন্য আর বেস ক্যাম্প ট্রেকিং করার জন্য। ৫ হাজার ৪০০ মিটার যাওয়ার পরে আবার ফিরে আসতে হয়। যারা সামিট করে, তাদের উপরে যেতে হয়।

অক্টোবর ১৮ তারিখ কাঠমান্ডু পৌঁছেই গাইডের সঙ্গে আলোচনা করি। তারপর শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে পড়ি। রেন্টাল দোকান থেকে ভাড়া করি স্লিপিং ব্যাগ। ১৯ তারিখ সকালের নাশতা করেই সোজা বেরিয়ে পড়ি এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। সেখান থেকে ১০ জন যাত্রীসহ ছোট্ট একটি প্লেনে করে ৩০ মিনিটের যাত্রায় পৌঁছালাম লুকলা এয়ারপোর্ট। মাত্র তিন হাজার মিটার আয়তনের এই ছোট্ট এয়ারপোর্টটি এভারেস্টের সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্ট, যেটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক এয়ারপোর্টও বলা হয়ে থাকে। লুকলা নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক গল্প আছে। ১৯৫৩ সালে স্যার এডমন্ড হিনরি যখন এভারেস্ট জয় করেন, তখন তার লুকলা পৌঁছাতে সময় লেগেছিল প্রায় এক মাস আর আমরা পৌঁছে গেলাম মাত্র ৩০ মিনিটে।

লুকলা পৌঁছানোর পরপরই শুরু হলো কাঙ্ক্ষিত পথচলা। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় লোকজন মাঝে মাঝে হাত নাড়িয়ে শুভ কামনা ও নমস্তে বলতে লাগল। প্রথম দিন দুপুরের খাবার সারলাম একটি টি হাউসে। দীর্ঘ ১৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার পথ চলার পর অন্য টি হাউসে পৌঁছালাম। রুমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এত ঠাণ্ডা ছিল যে কোনোভাবেই শরীর গরম করতে পারছিলাম না। কোনো উপায় না থাকায় এভাবেই রাত কাটাতে হলো।

পরবর্তী গন্তব্য নামচি বাজার। প্রাণবন্ত একটি শহর। ট্র্যাকারস, ট্রাভেলার্সদের জন্য এটিই মূল শহর। এই শহরে দুদিন থাকতে হলো এমন উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে অভ্যস্ত করার জন্য। আর পরের দিনগুলো কাটল এভারেস্টকে সামনে রেখে। যতই সামনে এগোচ্ছি, ততই এভারেস্টকে দেখার আগ্রহ যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে মনের ভেতরে।

প্রতিদিনই ১৩-১৪ কিলোমিটার ট্র্যাক করে ওপরে উঠছি। কিন্তু চারদিকের এত প্রশান্তিকর জায়গা দেখে সারাদিনের কষ্ট কিছুই আর মনে আসে না। বারবার শুধু এটাই ভাবছি যে, আমি কি সত্যি সত্যিই এভারেস্ট দেখতে যাচ্ছি! মজার বিষয় হলো, যত সামনে যাবেন, দেখে মনে হবে এটি এভারেস্টের চেয়েও উঁচু।

পৃথিবীর ১৪টি সবচেয়ে বড় পর্বতের ১০টি হিমালয়ান রেঞ্জের ভেতরে আমা দাবলামকে অনেক উঁচু মনে হলেও মূলত এভারেস্ট সবার চেয়ে উঁচু। lobuche- ৫০০০ মিটার- ঐতিহাসিক একটি জায়গা। এখানে রয়েছে শেরপাদের কবর; যারা হিমালয় এক্সপ্লোরেশনে জীবন হারিয়েছে। এখানে সবাই বিশ্রাম নেয়। Altitude Sickness এর শুরুও সবার এখান থেকে। রাতের খাবার শেষ করে খেয়াল করলাম, সারা শরীরে অনেক গরম অনুভব করছি, সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা। কিন্তু চিন্তার কারণ নেই। ওষুধ নেওয়ার ২০-৩০ মিনিট পর ভালো অনুভব করবেন।

পরের দিন মনে হলো, আজকে আর আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু গাইড বলল, মানিয়ে নিতে হবে, শক্ত হতে হবে, নাহলে সবকিছুই শেষ। সব পার করে অবশেষে বেস ক্যাম্পের দেখা মিলল অনেক দূরে। দেখা যাচ্ছে, সামনে অনেক বড় লাইন। একটি বড় পাথরের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই ছবি তুললাম। এভারেস্টের খুব কাছে গিয়েও চূড়া দেখা একটু কষ্টকর। তবু এখান থেকে আপনি ক্যাম্প-১-এর শুরু (Khumbu Glacier) দেখতে পারবেন।

বেস ক্যাম্প দেখার পর খুবই বিশ্রামের দরকার। কারণ এরপর যেতে হবে কালা পাথার (৫ হাজার ৬০০ মিটার) ক্লাইম্বিংয়ের জন্য, যেখান থেকে পুরো হিমালয় রেঞ্জের ওপরে পরিষ্কার সূর্যাস্ত দেখা যায়। এতটা উঁচু থেকে জীবনের প্রথম চকচকে সূর্য দেখা। দেখে মনে হবে, এভারেস্টের ওপর আগুন জ্বলছে আর এদিকে আমার শরীর ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে যাচ্ছে।

যেই এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে আপনি উঠবেন সাত দিনে, সেই একই পথ নামতে সময় লাগবে মাত্র তিন থেকে চার দিন। কিন্তু নতুন অভিজ্ঞতার জন্য আমি হেলিকপ্টার রাইড নিলাম। মনে হলো, আজকে আমার জীবন হাতে নিয়ে ফিরতে পারলে আর কখনো হেলিকপ্টার রাইড নেব না। এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্র্যাক করার পর আমার মনে হলো,

‘The harder you work for something, 
The greater you'll feel when you achieve it.’

কলি 

 

নুহাশপল্লীতে একদিন

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৪ পিএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৪:০০ পিএম
নুহাশপল্লীতে একদিন
নুহাশপল্লীর এই বাংলোতে থাকতেন হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: আশিক সাইফুল্লাহ

সাহিত্য ও শিল্পমনা মানুষের জন্য হুমায়ূন আহমেদ এক তীব্র আবেগের নাম। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান কখনোই ম্লান হবে না। প্রকৃতিপ্রেমী এই কথাসাহিত্যিক গত শতকের  নব্বইর দশকে গাজীপুরে ‘নুহাশপল্লী’ নামে এক গ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হুমায়ূনপ্রেমী দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন নুহাশপল্লীতে। হুমায়ূন আহমেদের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে নুহাশপল্লী ভ্রমণ নিয়ে লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী

একজন সাহিত্য ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ হিসেবে সবসময়ই ইচ্ছে ছিল নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাগানবাড়ি ‘নুহাশপল্লী’তে ঘুরতে যাব। অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণের দিন ঘনিয়ে এল। ঢাকায় বসবাসরতদের একদিনের ভ্রমণের জন্য নুহাশপল্লী বেশ উপযুক্ত একটি স্থান। ৭ সিটবিশিষ্ট একটি হাই এইস গাড়ি ভাড়া করে সকাল ৭টায় আমরা রওনা হলাম রাজধানীর গ্রিনরোড থেকে। উত্তরা-টঙ্গীর জ্যামে কিছুক্ষণ বাড়তি সময় লাগল।

সকাল ৯টা নাগাদ আমরা নুহাশপল্লীর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। সকালের নাশতা সেরে আবার গাড়িতে বসলাম। গ্রাম আর বনজঙ্গল পেরিয়ে ২০ মিনিট পর আমাদের গাড়ি নুহাশপল্লীতে গিয়ে থামল। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মন নেচে উঠল।

গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে নুহাশপল্লীর প্রধান ফটক। ফটকের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে নিলাম। ভেতরে প্রবেশ করার পরই চোখে পড়ে সামনে হুমায়ূন আহমেদের একটি ফ্রেস্কো। তার পেছনে একটি বাংলো। নুহাশপল্লীতে এলে হুমায়ূন আহমেদ সেই বাংলোতে থাকতেন। বাংলোর সামনে ছোট্ট একটি সুইমিংপুল এবং মা ও শিশুর ভাস্কর্য।

 

যত

হুমায়ূন আহমেদের শখের দাবার কোর্ট

দূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, বিভিন্ন ধরনের ফলজ, বনজ আর ঔষধি গাছের সমাহার। দেখে চোখ আর মন উভয়ই শীতল হয়ে যায়। সবুজ মাঠের ওপর ছয়টি চেয়ার আর দুটি টেবিল পাতা। হুমায়ূন আহমেদ এসব চেয়ারে বসে গাছের ছায়ায় অসংখ্য দুপুর কাটিয়েছেন। টিনের ছাউনি দেওয়া চারপাশ খোলা এক জায়গায় দাবার কোর্ট বসানো। তিনি দাবা খেলতে পছন্দ করতেন। সেই ভাবনা থেকেই কিংবা স্মৃতি ধরে রাখতে তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মাঠের বিভিন্ন গাছের সঙ্গে হ্যামোক টাঙিয়ে রাখা। দর্শনার্থীরা হ্যামোকে শুয়ে শুয়ে মনের আনন্দে দোল খায়।

চোখে পড়ল বেশ কয়েকটি কাঁঠাল গাছ। তাতে প্রচুর কাঁঠাল ধরে আছে। লিচু গাছে লিচু পেকে লাল রং ধারণ করে আছে। খেজুর গাছগুলোয় খেজুর পেকেছে। জামরুল গাছে ধরেছে মজাদার জামরুল ফল। আম গাছে ধরেছে আম। নুহাশপল্লীতে আগত দর্শনার্থীরা সেসব ফল পেড়ে খাচ্ছে। এসবে যেন তাদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

লিচু গাছের বৃক্ষ বাড়ি

‘বৃষ্টিবিলাস’ নামে রয়েছে আরেকটি বাংলো। সেখানে কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। একসময় সেখানে শিল্পীদের নিয়ে শিল্পচর্চা করতেন হুমায়ূন আহমেদ। এখন নুহাশপল্লীর তত্ত্বাবধায়করা থাকেন এবং বৃষ্টিবিলাসের বারান্দায় দর্শনার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করে থাকেন। প্রতিটি কক্ষে রয়েছে ওয়াশরুম। দর্শনার্থীরা চাইলে সেই ওয়াশরুম ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া বাইরেও পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা আলাদা কয়েকটি ওয়াশরুম রয়েছে। বৃষ্টিবিলাসের পাশে রয়েছে কয়েকটি দোলনা। হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে গেলে দর্শনার্থীরা সেখানে বসতে কিংবা দোল খেয়ে নিতে পারেন।

গাছপালা দেখতে দেখতে আরেকটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে মৎস্যকন্যা ও রাক্ষসের ভাস্কর্য। তার কাছেই রয়েছে আরও একটা ছোট্ট শিশুর ভাস্কর্য; যেন শিশুটি মন খারাপ করে আছে। একটু সামনেই দিঘি লীলাবতী। নামফলকে চোখ আটকে গেল। সেখানে দিঘির নামের সঙ্গে লেখা ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে’। হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াত মেয়ে লীলাবতী যে আমৃত্যু তার নয়নে, মনে বেঁচে ছিলেন, এ যেন তারই সাক্ষ্য বহন করে। দিঘির দুই প্রান্তে সান বাঁধানো ঘাট, বটের ছায়া, কাঠগোলাপ ফুলের সমাহার। হেঁটে হেঁটে অন্য পাড়ে গেলাম।

সেখানে দুটি দোলনা রাখা। দোলনায় বসে দোল খেলাম। দোলনা থেকে সামনে দৃষ্টি মেললেই চোখে পড়ে ‘ভূত বিলাস’। দুই কক্ষবিশিষ্ট ওই বাংলোর বারান্দা দিঘির অভিমুখে। সেখানে বসে চা খেতে খেতে নিশ্চয়ই কখনো বৃষ্টি দেখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এপার ওপার হওয়ার জন্য সেই বাংলোর পাশ ঘেঁষে আগে বাঁশের সাঁকো ছিল। এখন আর নেই। 

ক্ষুধার তাড়নায় দিঘির পাড় থেকে চলে এলাম বৃষ্টিবিলাসে। গল্প জুড়ে দিলাম নুহাশপল্লীর তত্ত্বাবধানে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে। একজন জানালেন, তিনি ২৫ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন। কথায় কথায় হুমায়ূন আহমেদের অনেক স্মৃতিচারণা করলেন। তিনি জানালেন এক মজার তথ্য, হুমায়ূন আহমেদ নুহাশপল্লীতে এলেই নাকি বৃষ্টি হতো। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বৃষ্টির এমনই নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তারা যখন জানতেন, তিনি নুহাশপল্লীতে আসবেন, ধরেই নিতেন যে বৃষ্টি হবে।

মজাদার দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো আমাদের সামনে। দুই রকমের ভর্তা, টমেটোর চাটনি, সালাদ, মুরগির মাংস, ডাল আর সাদা ভাত। একদম তাদের হাতের রান্না করা সতেজ খাবার। খেতে খেতে আরও গল্প হলো। তারা জানালেন, যখন হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে ছিলেন, অনেক মজা হতো। তিনি সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন।

সময়ঘড়িতে বিকেল নেমে এল। আমরা মাঠের লিচুগাছের ওপর ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে বসলাম, ছবি তুললাম। আবারও পুরো মাঠ ঘুরে বেড়ালাম, গাছপালা দেখলাম। আমাদের দলের কয়েকজন খেজুর বাগানে ক্রিকেট খেলল। নুহাশপল্লীতে ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো, এখানে একটা লাইব্রেরি থাকা উচিত ছিল; যেখানে হুমায়ূন আহমেদের সব বই থাকবে। এও মনে হলো, নুহাশপল্লীর আরও একটু যত্ন আর সংস্কার করা জরুরি।

সন্ধ্যা নামার মুখে মন কেমন করা বিষণ্নতা নিয়ে মাঠের এক কোণে হুমায়ূন আহমেদের সমাধিতে গেলাম। সেখানে গাছের ছায়ায় গাঢ় অন্ধকার নামছে। আলো জ্বেলে দেওয়া হলো। আমরা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর সন্ধ্যা ৭টায় নুহাশপল্লী থেকে বের হয়ে এলাম। বনজঙ্গল পেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠতেই শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। গাজীপুর চৌরাস্তায় সন্ধ্যার নাশতা সেরে নিলাম। ঢাকায় পৌঁছাতে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেল। এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করার দরুন তবু সময় অনেকটা বেঁচে গেল। একটা সুন্দর দিনের স্মৃতি নিয়ে আমরা ফিরে গেলাম যে যার গন্তব্যে।

যেভাবে যাবেন: রাজধানীর মহাখালী বা গুলিস্তান থেকে ওই রুটে বিভিন্ন বাস চলাচল করে। যেমন- ঢাকা পরিবহন, সম্রাট লাইন, রাজদূত পরিবহন ইত্যাদি। সেসব বাসে গাজীপুরের হোতাপাড়া নেমে সিএনজি বা অটোরিকশায় নুহাশপল্লী যেতে পারবেন। এ ছাড়া গণপরিবহন ব্যবহার করতে না চাইলে ব্যক্তিগতভাবে মাইক্রোবাস বা হাইএইস ভাড়া করেও যেতে পারেন।

টিকিট মূল্য এবং সময়সূচি: নুহাশপল্লী সারা বছরই খোলা থাকে। কোনো সাপ্তাহিক বন্ধ নেই। প্রতিদিন সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বিশেষ অনুরোধে আরও কিছুক্ষণ থাকা যেতে পারে। টিকিট মূল্য ১২ বছরের ঊর্ধ্বে জনপ্রতি ২০০ টাকা। তবে বছরে দুদিন ১৩ নভেম্বর ও ১৯ জুলাই অর্থাৎ হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে সবার জন্য প্রবেশ মূল্য ও খাবার ফ্রি।

যেখানে থাকবেন: নুহাশপল্লীতে থাকার ব্যবস্থা নেই। তবে গাজীপুরে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। চাইলে সেখানে থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে নুহাশপল্লী ছাড়াও আশপাশে আরও কিছু জায়গা ভ্রমণ করে নিতে পারেন।

যা খাবেন: সকাল ও সন্ধ্যার নাশতা নুহাশপল্লীতে পৌঁছানোর একটু আগেই মেইন রোডের পাশের কোনো হোটেল থেকে খেয়ে নিতে পারেন। নিরিবিলি হোটেলের খাবারের মান বেশ ভালো। দুপুরের খাবার নুহাশপল্লীর ভেতরেই খেয়ে নিতে পারেন।

সতর্কতা: ঘুরতে গিয়ে কোনো প্লাস্টিক বা ময়লা-আবর্জনা বাইরে কিংবা পর্যটন স্পটে ফেলবেন না। এমন কোনো আচরণ করবেন না যাতে অন্য দর্শনার্থীদের কোনো সমস্যা হয়।

কলি

চলো হারাই হাওরে

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৫৬ পিএম
আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৫৬ পিএম
চলো  হারাই হাওরে
ছবি: লেখক

সন্ধ্যায় নৌকা ভেড়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টেকেরঘাট। এর আগে সকালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে নৌকায় উঠি। এরপর সারা দিন হাওরের পানি ভেঙে আসি এ ঘাটে। রাত যখন বাড়ল তখন দেখি ভরা পূর্ণিমা। আর সে পূর্ণিমায় নৌকার ছইয়ের ওপর চলে আড্ডা। আর সারা দিনের হাওরের ফিরিস্তিও অপূর্ব।

শুরুটা করি মোহনগঞ্জ বাজার থেকে। এখানকার শাহজালাল হোটেলে নাশতা সেরে উঠি নৌকায়। বাজারের ঘাটেই নৌকা ছিল। ইঞ্জিনচালিত ছইওয়ালা নৌকা। হাওরের মানুষ বর্ষা মৌসুমে এ নৌকায় যাতায়াত করেন। নৌকাগুলো কিছুটা লম্বাটে। হাওরের নৌকা নামেই বেশি পরিচিত।

কংশ নদী হয়ে নৌকা চলতে শুরু করে। ভ্রমণসঙ্গী ৩৮ জন। নৌকা চলার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও শুরু হয়। বৃষ্টির মধ্যে কেউ কেউ ছইয়ের ওপর ছাতা মাথায় বসি। বাকিরা ছইয়ের তলে। খুব বেশি চওড়া নয় কংশ নদী। নদীর দুই পাশে কোথায়ও বাড়ি, কোথায়ও মাঠ। আছে গাছগাছালি। টানা জালে মাছ ধরাও দেখি। এসব দেখি আর টিপটিপ বৃষ্টির ছন্দে চলছি। কিছুদূর আসার পর দেখি নদীর পাড়ে রঙিন কাগজে সাজানো একটি নৌকা। আমাদের মাঝি জানালেন এটা বরযাত্রীর নৌকা। হাওরে বর্ষা মৌসুমে বিয়ে হলে নৌকায় বরযাত্রী আসেন।

ঘণ্টা দু-এক চলার পর নৌকা ভেড়ে বাদশাগঞ্জ বাজারে। বাজারের পাশের মাঠে আমাদের কেউ কেউ ফুটবল খেলেন। এ বল তারা সঙ্গে করেই এনেছেন। আরেক দল পানিতে ভাসিয়েছে প্লাস্টিকের নৌকা। এ নৌকা ভাঁজ করে রাখা যায়। এটাও তারা সঙ্গে করে এনেছেন। কিছুক্ষণ এখানে তাদের খেলাধুলার পর নৌকা আবার চলতে শুরু করে। নদী ছেড়ে নৌকা এবার প্রবেশ করে মূল হাওরে।

বৃষ্টি আর বাতাস হওয়ায় হাওরে বেশ ঢেউ আছে। সেই ঢেউয়ের তালেই নৌকা চলছে। বিশাল হাওরের কোথাও কোথাও বাড়িঘর আছে। আর বহুদূরে দেখি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়। এসব দেখি আর পানি কেটে চলি।

নৌকা চলছে। সেই চলার মধেই হাতে এসে পৌঁছে গরম ভাতের প্লেট, সঙ্গে হাওরের মাছ ভাজা, সবজি আর ডাল। আহা কী স্বাদ! বাড়ির খাবারের সঙ্গে সত্যি এর তুলনা হয় না। খাবার শেষ করতেই নৌকা ভেড়ে তাহিরপুরের জয়পুর গ্রামে। হাওর পাড়ের এ গ্রাম দেখে সত্যি বিস্মিত। ছোট ছোট কাঁচা ঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা যেন লাগানো। এখানে কেউ অসুস্থ হলে তাকে নৌকায় নিয়ে যেতে হয় তাহিরপুর উপজেলা সদরে। এ গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও আছে।

কিছুক্ষণ জয়পুর থেকে নৌকা আবার চলতে শুরু করে। এবার নৌকা চলে টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে। শীত মৌসুমে এ হাওরজুড়ে থাকে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বসবাস। আর এখন কেবলই পানি।

বিকেল হয়ে এসেছে। নৌকার ছইয়ের ওপর সবাই বসেছি। শীতল একটা বাতাস বইছে, যেন একেবারে বুকের ভেতর গিয়ে ঠেকছে তার পরশ। এর মধ্যে সবার সামনে হাজির ঝালমুড়ির বোল। শীতল পরশে একটু ঝালের আবির্ভাব আরকি। ঠিক সন্ধ্যার দিকে নৌকা ভেড়ে টেকেরঘাট। অনেকেই ঘাটে নামেন।

রাত যাপনের জন্য কারও ঠিকানা হয়েছে তাহিরপুরের গেস্ট হাউসে। বাকিরা নৌকাতেই। রাতে খাবার খেয়ে গেস্ট হাউসের যারা তারা চলে গেছেন। আর নৌকার যারা তাদের কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেবল আমরা কয়েকজন ছইয়ের ওপর বসে আড্ডায় মাতি। এমন আড্ডা  ভরা পূর্ণিমায় আরও পূর্ণতা পায়। আর এ পূর্ণতা জীবনের অনেক অপূর্ণতাকেও ভুলিয়ে দেয়।

খুব সকালে ঘাটে নেমে আশপাশটা ঘুরে দেখি। টেকেরঘাটে বিসিআইসির চুনা পাথর খনি প্রকল্প আছে। অবশ্য এখন এর কার্যক্রম নেই। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে এখানে একটি ভাস্কর্যও আছে। দিনের অনেকটা সময় এখানে থেকে আবার ফিরতে শুরু করি।

কলি

ঐতিহ্যের টানে দিনাজপুরে একদিন

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৪, ০৬:২০ পিএম
আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪, ০৬:২০ পিএম
ঐতিহ্যের টানে দিনাজপুরে একদিন
নয়াবাদ মসজিদ

ঐতিহ্যের গন্ধ যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে না গিয়ে থাকা কঠিন। আর সেটি যদি হয় টেরাকোটা দ্বারা নির্মিত, তবে তো কথাই নেই! এমনই এক টেরাকোটার ঐতিহ্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির। আর কান্তজীর মন্দিরের নাম এলেই তার সঙ্গে যে আরেকটি নাম জড়িয়ে থাকে তা হলো নয়াবাদ মসজিদ। দুটো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানই একই দিনে ভ্রমণ করা যায়। তাই একদিন পরিকল্পনা করে বেরিয়ে পড়লাম এই ঐতিহ্যবাহী দুটি নিদর্শন দেখতে।

কান্তজীর মন্দির
কান্তজীর মন্দির দিনাজপুর জেলার অনেক পুরোনো একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। অনেকে এটিকে কান্তনগর, আবার কেউ কেউ এই মন্দিরকে কান্তজিউ মন্দিরও বলে থাকেন। তবে মন্দিরের 'নবরত্ন' নামটি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। এটি নবরত্ন মন্দির নামে পরিচিত ছিল। কারণ, তিন তলাবিশিষ্ট এই মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিল। কান্তজীর মন্দির ১৮ শতকে নির্মিত একটি চমৎকার ধর্মীয় স্থাপনা। এটি দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন।

১৭২২ সালে তার মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ সালে মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরটির চূড়াগুলো ভেঙে যায়। মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে পোড়ামাটির ফলকে লেখা রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫ হাজারের মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে। ওপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি। মন্দিরের চারদিকের সবগুলো খিলান দিয়েই ভেতরের দেবমূর্তি দেখা যায়।

মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির ওপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। দুটো ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে, স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে। এ মন্দিরের অনিন্দ্য স্থাপনাশৈলী সব দর্শনার্থীর মতো আমাকেও খুব মুগ্ধ করেছে।

কান্তজীর মন্দির

নয়াবাদ মসজিদ
নয়াবাদ মসজিদ কান্তজীর মন্দিরের কাছেই অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। এ মসজিদ দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কাহারোল উপজেলার নয়াবাদ গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঢেঁপা নদী। এই মসজিদটি ১.১৫ বিঘা জমির ওপর নির্মিত। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। জনমুখে কথিত আছে যে, কান্তজীর মন্দির যে শ্রমিকরা নির্মাণ করেছিলেন, তারা মুসলিম ধর্মের অনুসারী ছিলেন।

তখন তারা রাজার কাছে নামাজ কায়েমের জন্য একটি স্থান চান। রাজা রামনাথ রায় তাদের ১.১৫ বিঘা জমি দিয়ে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে বলেন। শ্রমিকরা কান্তজীর মন্দিরের পাশাপাশি নয়াবাদ মসজিদও নির্মাণ করতে থাকেন। যদিও এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। লোকমুখে এসব কথা প্রচলিত হয়ে আসছে। তবে মসজিদে প্রবেশের প্রধান দরজার ওপর স্থাপিত ফলক হতে জানা যায়, নয়াবাদ মসজিদ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বকালে ২ জ্যৈষ্ঠ, ১২০০ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৭৯৩ সালে) নির্মাণ করা হয়। সে সময় জমিদার ছিলেন রাজা বৈদ্যনাথ। যিনি ছিলেন দিনাজপুর রাজপরিবারের সর্বশেষ বংশধর। এলাকার অধিবাসীদের থেকে জানা যায় যে, ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে কান্তজীর মন্দির তৈরির কাজে আগত মুসলিম স্থপতি ও কর্মীরা এই মসজিদটি তৈরি করেন। তারা পশ্চিমের কোনো দেশ থেকে এসে নয়াবাদে বসবাস শুরু করেন এবং নামাজ আদায়ের জন্য এই মসজিদটি তৈরি করেন।

এটি একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। এর চার কোণে ১২.৪৫ মিটার x ৫.৫ মিটার আকারের চারটি অষ্টভুজ মিনার রয়েছে। দেয়ালগুলোর পুরুত্ব ১.১০ মিটার। উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে একটি করে জানালা রয়েছে। পশ্চিম পাশের দেয়ালে মোট তিনটি মিম্বার রয়েছে, যেগুলো মসজিদের তিনটি প্রবেশ দরজা বরাবর তৈরি করা হয়েছে। মাঝের মিম্বারটি আকারে বড় (উচ্চতা ২৩০ মিটার এবং প্রস্থ ১.০৮ মিটার) এবং অপর দুটি মিম্বার একই আকারের। মসজিদটি তৈরির সময় যেসব টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কারুকার্য ব্যবহার করা হয়েছিল, তার অধিকাশংই এখন আর নেই এবং যেগুলো রয়েছে সেগুলোও সম্পূর্ণ অক্ষত নেই। এখানে বর্তমানে মোট ১০৪টি টেরাকোটা অবশিষ্ট রয়েছে। 
এগুলো আয়তক্ষেত্রাকার এবং আকার ০.৪০ মিটার x ০.৩০ মিটার।

কীভাবে যাবেন
কান্তজীর মন্দির এবং নয়াবাদ মসজিদ দুটি যেহেতু দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় পাশাপাশি অবস্থিত, তাই এক ভ্রমণেই এই দুটো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঘুরে আসা যায়। ঢাকা থেকে আসতে হলে বাস কিংবা ট্রেন দুভাবেই আসা যায়। ঢাকা থেকে ৩০ মিনিট (ক্ষেত্রভেদে এক ঘণ্টা) পরপর বাস দিনাজপুরের উদ্দেশে ছাড়ে। নাবিল, হানিফ, শ্যামলী, এসআর পরিবহনসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস ঢাকা-দিনাজপুর রুটে যাতায়াত করে।

কোম্পানিভেদে বাস টিকিটের মূল্য ৭৫০-১৩০০ টাকা পর্যন্ত। বাসে যেতে সাধারণত ৮-৯ ঘণ্টা লাগে। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বর্তমানে তিনটি ট্রেন যাতায়াত করে। একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস এবং পঞ্চগড় এক্সপ্রেস। একতা এক্সপ্রেস সকাল ১০ : ১৫, দ্রুতযান এক্সপ্রেস রাত ৮ : ০০ এবং পঞ্চগড় এক্সপ্রেস রাত ১১ : ৩০-এ ঢাকা হতে দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। শ্রেণিভেদে ট্রেনের টিকিটের মূল্য ৫৭৫-১৯৭৮ টাকা পর্যন্ত। দিনাজপুর শহরে নেমে সেখান থেকে ইজিবাইক ভাড়া করে কান্তজীর মন্দির এবং নয়াবাদ মসজিদ দুটোই এক সঙ্গে ভ্রমণ করা যায়। শহর থেকে ৪০/৪৫ মিনিট সময় লাগবে যেতে। 

কোথায় থাকবেন
ভালো মানের হোটেলে থাকতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে দিনাজপুরের পর্যটন মোটেলে। সেখানে প্রতি রাতের জন্য খরচ হবে ১৫০০-২২০০ টাকা। এ ছাড়াও দিনাজপুর শহরে অনেকগুলো আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হোটেল ডায়মন্ড, নিউ হোটেল, হোটেল আল রশিদ ইত্যাদি। এসবে থাকতে হলে আপনার খরচ হবে এক রাতের জন্য মাত্র ৫০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত।

কোথায় খাবেন
দিনাজপুরে অনেকগুলো ভালো মানের খাবারের হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে রুস্তম হোটেল বেশ বিখ্যাত। এখানকার গরুর মাংসের কালাভুনা আর ভাত যেন অমৃত। এ ছাড়াও ভালো মানের আরও কয়েকটি হোটেল রয়েছে। দিনাজপুরের পাবনা সুইটসের কালোজাম, দিলশাদের পাটিসাপটা, এক টাকার সিঙাড়া এসব বেশ জনপ্রিয়। দিনাজপুরে গেলে এসব খাবার খেয়ে দেখতে পারেন।

কী কী দেখবেন
দিনাজপুরে গেলে কান্তজীর মন্দির এবং নয়াবাদ মসজিদ তো দেখবেনই! এ ছাড়াও ঘুরে দেখতে পারেন রামসাগর, সুখসাগর, রাজবাড়ি, দীপশিখা মেটি স্কুল, নবাবগঞ্জের আশুরার বিল, বিখ্যাত লিচুবাগান কিংবা দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড় ময়দান (দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ঈদগাহ মাঠ)।

সতর্কতা
যেহেতু কান্তজীর মন্দির এবং নয়াবাদ মসজিদ দুটোই ধর্মীয় স্থান, তাই এসব জায়গায় গিয়ে এমন কিছু করা যাবে না যাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। প্রতিটি ধর্মের মানুষের কাছে তাদের উপাসনালয় একটি পবিত্র এবং সর্বোচ্চ স্থান। তাই এসব জায়গায় সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে ভ্রমণ করতে হবে যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে।

 কলি

পর্বতের জাদুঘরে একদিন

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৪, ০৪:৩০ পিএম
আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ০৪:৩০ পিএম
পর্বতের জাদুঘরে একদিন

পর্বতের জাদুঘরে ঢুকেই একটু অন্যরকম অনুভূতি হলো। মনে হচ্ছে জাদুঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা বরফমাখা পর্বতের ছবিগুলো থেকে শীতল ঠাণ্ডা এসে গায়ে লাগছে। অবশ্য পর্বতের দেশে পর্বতের শীতলতা গায়ে লাগাটাই স্বাভাবিক; তা ঘরের ভেতরে হোক বা বাইরে। নেপালের পোখারায় অবস্থিত পর্বতের এ জাদুঘরের পোশাকি নাম ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেইন মিউজিয়াম। সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদসহ এ জাদুঘরে যখন ঢুকি তখন দুপুর ছুঁইছুঁই। ঢোকার ফি জনপ্রতি নেপালি ২০০ রুপি।

ঢুকতেই হাতের বাঁ পাশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রার্থনাকক্ষ। এখানে বৌদ্ধমূর্তিসহ বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন স্মারক আছে। কক্ষটির পাটাতন কাঠের। এ ছাড়া কক্ষটির সামনের দেয়াল ও জানালাগুলো কাঠের। কাঠের এ দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নানা রঙে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম। এ কক্ষের পাশের কক্ষটি লাইব্রেরি। এ লাইব্রেরিতে আছে পর্বতের তথ্যসমৃদ্ধ নানা বইপত্র।

টিনের ছাদের এ জাদুঘর ভবনটি ডুপ্লেক্স এবং খোলামেলা। দেখতে কিছুটা লম্বাটে। এর প্রথম গ্যালারি সাজানো পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবন যাপনের উপকরণ নিয়ে। এখানে আদিবাসীসহ পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের কৃষি, পোশাক, খাদ্য, বাসস্থান, রান্নাবান্না, কাঁসা-পিতলের বিভিন্ন পাত্রসহ জীবনযাপনের নানা নমুনা আছে। কাঁসা-পিতলের পাত্রগুলোর অধিকাংশই নান্দনিক কারুকাজ খচিত। এসব কারুকাজ দেখে বোঝা যায় এ অঞ্চলের মানুষের শিল্পমনা ভাবের।

দ্বিতীয় গ্যালারি সাজানো হয়েছে নেপাল ও অন্যান্য দেশের বিভিন্ন পর্বতের তথ্য ও ছবি দিয়ে। এর মধ্যে এভারেস্টসহ ৮ হাজার মিটার উচ্চতার ১৪টি পর্বতের ছবি ও তথ্যও আছে। পর্বতের তথ্য ও ছবি ছাড়াও এ গ্যালারিতে আরও আছে পর্বতসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যসহ নানা নমুনা।

তৃতীয় গ্যালারি সাজানো পর্বতবিষয়ক কার্যক্রম নিয়ে। এখানে আছে নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্বতারোহীদের বিভিন্ন পর্বত অভিযানের জানা-অজানা ইতিহাস, পর্বতারোহীদের পোশাক, পর্বতারোহণের সরঞ্জামের অসংখ্য নমুনা ও ছবি। 

মূলত এ গ্যালারিগুলোই এ জাদুঘরের প্রধান গ্যালারি। এ ছাড়া নিচের গ্যালারিগুলোর বিষয়ের সঙ্গে উপরের গ্যালারিগুলোর বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রাখা হয়েছে। নিচ থেকে উপরের গ্যালারিতে ওঠার সিঁড়ি আছে। এ ছাড়া উপরের গ্যালারিতে একপাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়ার জন্য আছে সেতু।

মূল গ্যালারি ছাড়াও জাদুঘরের চারপাশে পর্বতবিষয়ক আলাদা আলাদা আরও কিছু কর্নার বা প্রদর্শনী স্থান আছে। অবশ্য এগুলোও মূল গ্যালারির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব প্রদর্শনী কর্নারের মধ্যে নিচতলার একটি কর্নার বা স্থান হলো পাহাড়ি জন্তু ইয়েতি ও ইয়াক নিয়ে। ইয়েতি ও ইয়াকের নমুনা রাখা আছে এখানে। ইয়াক অনেকটা আমাদের গরু বা মহিষের মতো। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ এ জন্তুকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে মালামাল আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করেন। পর্বতারোহীরা পর্বতে উঠার সময় তাদের মালামাল বহনের জন্যও ইয়াক ব্যবহার করেন। আর ইয়েতি দেখতে অনেকটা গরিলার মতো। ইয়েতি নিয়ে অনেক লোককাহিনিও আছে। পায়ের ছাপসহ নানা তথ্য যাচাই করে গবেষকরা ধারণা করেন একসময় নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলে ইয়েতির বিচরণ ছিল।

নেপালের শেরপা পর্বতারোহী তেনজিং নোরগে ও নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী স্যার এডমন্ড পার্সিভাল হিলারি ১৯৫৩ সালের ২৯ মে যৌথভাবে বিশ্বে প্রথম পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন। তাদের ছবি ও তাদের অভিযানের ইতিহাসও সংরক্ষিত আছে এ জাদঘুরে। এ ছাড়া এভারেস্টসহ বিভিন্ন পর্বত অভিযানে সফল বা ব্যর্থ হয়েছেন, এমন অনেক পর্বতারোহীর কথা, ছবি ও তাদের পর্বত অভিযানের অসংখ্য সরঞ্জামও সংরক্ষিত আছে এ জাদুঘরে। 

মাউন্ট এভারেস্টের একটি মডেলও আছে এ জাদুঘরে। এ ছাড়া আছে এভারেস্টসহ বিভিন্ন পর্বতের বড় আকৃতির ছবি। ৫০ বা ৬০ বা তারও আগে পোখারাসহ নেপালের জনজীবন কেমন ছিল তারও নমুনা ছবির দেখা মিলেছে এখানে। বেশ সময় নিয়ে এসব দেখি।

জাদুঘরের দেওয়া স্যুভেনিরের তথ্যানুযায়ী ১ নভেম্বর ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নেপাল মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এ জাদুঘরের দ্বার উন্মোচিত হয়।

জাদুঘরের ঠিক সামনেই আছে পিতলের তৈরি একটি ইয়াকের ভাস্কর্য। তার একটু পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মনাসলু পর্বতের মডেল। মূল মনাসলুর উচ্চতা ৮ হাজার ১৬৩ মিটার। তবে এ মডেল মনাসলুর উচ্চতা মাত্র কয়েক মিটার। আমরা এর চূড়ায় উঠি। ছবি তুলি। তারপর আসি লিভিং মিউজিয়ামে। এ জাদুঘর মূলত স্থানীয় জনগোষ্ঠী বা উপজাতিদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করার স্থান বা কক্ষ। এখান থেকে আসি ক্লাইম্বিং ওয়ালের কাছে।

জাদুঘরের আঙিনাটি বেশ বড়। মূল জাদুঘর, মনাসলুর মডেল, লিভিং জাদুঘর, ক্লাম্বিং ওয়াল ছাড়াও পুরো আঙিনায় আছে ফুলসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালি। এককোণে আছে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন এমন তিন ব্যক্তির আবক্ষ মূর্তি। মজার বিষয় হলো আঙিনার এককোণ থেকে জাদুঘরের ছাদের দিকে তাকালে মনে হবে ঢেউ খেলানো পর্বতের চূড়া। অর্থাৎ ছাদটি পর্বতের চূড়ার আকৃতিতে করা। এ ছাড়া এ জাদুঘরের আঙিনা থেকে অন্নপূর্ণা, মনাসুল, ধুলাগিরিসহ কয়েকটি পর্বতের চূড়াও দেখা যায়। আমরাও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এ চূড়ায় চোখ রাখি। 

ছবি লেখক

 কলি 

 

চুরুলিয়া গ্রামে একদিন

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪, ০৩:৫১ পিএম
আপডেট: ২৫ মে ২০২৪, ০৩:৫২ পিএম
চুরুলিয়া গ্রামে একদিন
চুরুলিয়ায় কবির বসতবাড়ি

কাঁটাতারের বেড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে রাষ্ট্রের সীমানা। কিন্তু ভাষাকে ভাগ করতে পারেনি। যেমন ভাগ করতে পারেনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধি দানকারী দুই অমর সাহিত্যিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামকে। আমার এ চুরুলিয়া যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল। কবি কাজী নজরুল ইসলামের অজানা অধ্যায়ের সন্ধান। আমাদের নতুন গন্তব্য পথের দ্বিতীয় দিন আজকে আমার সঙ্গে ছিলেন গৌতম মামা। কলকাতা থেকে আসানসোলগামী বাসে চড়ে বসলাম আমরা।

চুরুলিয়ায় কবির ভাস্কর্য

ঘণ্টা পাঁচেকের পথ। নাগরিক জীবনের ছবি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলছি। কলকাতা থেকে প্রায় ২১৫ কিলোমিটার দূরে অজয় নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত গ্রাম চুরুলিয়া। গাড়ির হাঁকডাকে বুঝলাম আমি লোকাল বাসে উঠেছি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লাগবে আসানসোল যেতে। আমি মনে মনে হতাশ, এরপরও নতুন এক গন্তব্য পথে যাচ্ছি এই আনন্দে হতাশাটুকু দমিয়ে রাখলাম। বাস জিটি রোড হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছে। বিহার বর্ডার পানাঘর, দুর্গাপুর, মুন্সিপাড়া, দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীমোড় ভিডিঙ্গী পেড়িয়ে ছুটে চলছি আমরা। বেলা সাড়ে ১১টায় আসানসোল পৌঁছালাম। আসানসোল নেমে চুরুলিয়া যাওয়ার বাহন খুঁজতে লাগলাম আমরা। মামা বললেন, আসানসোল থেকে চুরুলিয়া ১৯ কিলোমিটার। আমরা আবারও বাসে চেপে বসলাম লোকাল বাস, ভাড়া ১০ টাকা। ‘টেটো চই’ হেলেদুলে বাস চলছে গন্তব্য পথে।

তখন স্কুল ছুটি হয়েছে দেখলাম। ছাত্রছাত্রীদের কিচিরমিচির শব্দের মাঝ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলছে। রাস্তার বায়ে চোখে পড়ল কাজী নজরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়। বাস চুরুলিয়া গ্রামের মোড়ে নামিয়ে দিল। হেঁটে হেঁটে ঢুকে পড়লাম চুরুলিয়া গ্রামে। চুরুলিয়া গ্রামে ঢুকতেই কবির ম্যুরাল দেখতে পেলাম। অজয় ঘাটের একটু আগেই চুরুলিয়ার ছোট্ট একটি বাজার। চৌরাস্তার ডান দিকের সরু ও ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। দুই পাশেই মাটির ঘর। বেশির ভাগই শন বা বিচালির চাল বা ছাদ। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রাস্তায় খেলা করছে মনের আনন্দে। যানবাহনের ব্যস্ততা নেই।

আমরা পৌঁছে গেলাম ‘কবিতীর্থে’। সেই যে ছোট বেলায় যেমন পড়েছিলাম কবি নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনী। আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামের এক নিদারুণ দুস্থ পরিবারের নজরুলের জন্ম। ঠিক তেমনিই যেন ইতিহাস তার কালের সাক্ষী এখনো বহন করে চলেছে সেই ১৮০০ শতাব্দীর মতো করেই। ভাঙাচোরা প্রতিটি বাড়ির দেয়াল, খসে পরা পলেস্তারা, অর্ধনগ্ন লোহার গেট, ভেজা দেয়ালের গায়ে গায়ে গজিয়ে ওঠা আগাছা, ভাঙা কার্নিশে ঝুলে থাকা নোংরা কাপড়, পুষ্টির অভাবে বেরিয়ে থাকা পুরোনো বাড়ির কঙ্কাল, যে বাড়িগুলোয় জন্মের পরে আর কোনো কিছুর প্রলেপ পরেনি, কোনো সংস্কার করা হয়নি, অতি দরিদ্রদের ভাতের অভাবে বেরিয়ে থাকা কণ্ঠার হাড়ের চিত্র প্রতিটি বাড়ির গেটে, দেয়ালে, কার্নিশে, সব জায়গায়। যেন সেই ১৮ শতকের সবকিছু ঠিক তেমনই আছে। কবিতীর্থ বা নজরুলের বাড়ি এখন ‘নজরুল একাডেমি’। 

প্রমীলা মঞ্চ

কবির জীবনের বাঁক নেওয়া বিভিন্ন ঘটনার ইতিহাস সংবলিত বই, ম্যাগাজিন ও পেপার কাটিং মিউজিয়ামে স্থান পেয়েছে। আমরা পদব্রজে চলছি এগিয়ে ছোট্ট বাড়িটির নিচতলায় নজরুল একাডেমি ও সংগ্রহশালা। এখানে নজরুল ও তার সন্তানদের ব্যবহৃত পোশাক, সংগীত যন্ত্র, পুরোনো ম্যাগাজিন, পেপার কাটিং, কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র, প্রমীলা দেবীর ব্যবহৃত খাট ও বিভিন্ন ছবি আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। নজরুল একাডেমিতে গবেষণার জন্য কবির বিভিন্ন বই, সম্পাদিত ম্যাগাজিন রয়েছে দেখতে পেলাম। সাদা-কালো নানা আলোকচিত্র, পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র সযত্নে রাখা আছে। আছে বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত কবির বিভিন্ন পুরস্কার, পদকের সম্ভারের মধ্যে জগত্তারিণী পদক ও মানপত্র, পদ্মভূষণ পদক ও মানপত্র।

চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমির প্রবেশ পথ 

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবির মৃত্যু ও পরবর্তী শবযাত্রার আলোকচিত্র। রয়েছে নানা ধরনের বস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, ব্যবহারিক জিনিসপত্র, গ্রামোফোন, তানপুরা ইত্যাদি। ব্যবহৃত জিনিসগুলোর অধিকাংশ দিয়েছেন কবির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী। সংগ্রহশালার কয়েকটি শোকেস দিয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ। বলছিলেন স্থানীয় একজন। নজরুল একাডেমি প্রতিদিন খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা, দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। প্রবেশ ফি ৫ রুপি। প্রবেশ ফিকে অনুদান হিসেবেই বিবেচনা করছে কর্তৃপক্ষ।

প্রমিলা দেবীর সমাধি 

কবিতীর্থের স্মৃতি: কাছেই নজরুলের শৈশবের মসজিদ, পুকুর ও পাঠশালা। এ ছাড়া সমাধিস্থল। এখানে রয়েছে কবির পাথরের পূর্ণাবয়ব মূর্তি। কবি ও কবিপত্নী প্রমিলা দেবীর সমাধি রয়েছে পাশাপাশি। কবির কবরের মাটি নেওয়া হয়েছে ঢাকা থেকে। সমাধি উদ্যানের পাথরের স্মৃতিফলকটি স্থাপিত হয় ১৯৯৮ সালে। স্মৃতিসৌধের ফলকটিতে রয়েছে অগ্নিবীণার ছবি। এ ছাড়া কাজী পরিবারের অন্যদের কবর ও স্মৃতিফলক রয়েছে। নজরুল একাডেমির দুই কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যেই স্থাপনাগুলো দেখা যাবে। ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কবির মক্তব এখন ‘নজরুল বিদ্যাপীঠ’। আরও আছে নজরুল কলেজ।

কোথায় থাকবেন: এখানে থাকা-খাওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। অনলাইনে বুকিং দিয়ে চুরুলিয়া ‘নজরুল যুব ভবনে’ থাকা যেতে পারে। কবির জন্মদিন উপলক্ষে মেলায় আগত অতিথিদের একটি অংশ এখানে থাকেন। তবে আসানসোলে ইচ্ছামতো দাম ও মানে থাকতে পারবেন।

কীভবে যাবেন: কলকাতা-হাওড়া থেকে উত্তরপ্রদেশ-দিল্লিগামী যেকোনো ট্রেনে আসানসোল যাওয়া যাবে। অথবা লোকাল বা গৌহাটি-নিউ জলপাইগুড়িগামী ট্রেনে বর্ধমানে নেমে লোকাল ট্রেনে আসানসোল যাওয়া যাবে। অথবা বোলপুরের শান্তিনিকেতনে আগে প্রোগ্রাম থাকলে, শান্তিনিকেতন থেকে বাসে রানীগঞ্জ হয়ে আসানসোল যাওয়া যাবে। তার আগে আপনাকে যেতে হবে কলকাতায়। এক্ষেত্রে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা বা যশোরের বেনাপোল পোর্ট ব্যবহার করলে সুবিধা হবে। গেদে বা বনগাঁ থেকে শিয়ালদহগামী অনেক ট্রেন পাবেন। অথবা বিমানেও কলকাতা যেতে পারেন।

 কলি