দ্বীপান্তর শব্দটি শুনলেই মনের মধ্যে কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। চারদিকে অথই জল, মানবশূন্য, শ্বাপদসংকুল। আধুনিক এই যুগে কাউকে অবশ্য দ্বীপান্তরিত করা হয় না আর দ্বীপগুলোও আগের মতো নেই। তবুও দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে কেউ যদি দ্বীপান্তরিত হওয়ার স্বাদ পেতে চান, কয়েকদিনের জন্য চলে আসুন বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত দ্বীপজনপদ সন্দ্বীপে। বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটা দ্বীপ। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সন্দ্বীপের বুকে মানুষের বসবাস।
স্থানীয়দের কাছে ‘সবুজ চর’ নামে পরিচিত এ চরের বিস্তৃতি সন্দ্বীপের উত্তরে বামনী নদী ও পশ্চিমে মেঘনা নদীর মোহনাঘেঁষে আমানউল্লা, সন্তোষপুর ও দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নজুড়ে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধের বাইরে বিশাল এ চর যেন দিগন্তে মিশেছে। ছয়টি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিলেও মূলত শীত ও বর্ষায় সব সৌন্দর্য নিয়ে ভ্রমণপিপাসুদের সামনে হাজির হয় ‘সবুজ চর’।
বর্ষায় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে থাকা রাজাশাইল ধানের সবুজ কচি পাতায় ঢেউ খেলে ফুরফুরে বাতাস। খেতের আল কেটে বসানো হয় মাছ ধরার শত শত চাঁই। জোয়ারের পানির সঙ্গে নদী থেকে উঠে আসে টেংরা, চিংড়ি, কোরাল, কাকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায় বড় বড় জলাশয়। ফুটে থাকে রাশি রাশি শাপলা।
শরতের শুরুতে আকাশে ভেসে বেড়ায় বাউণ্ডুলে মেঘ। সূর্য ডোবার পর আকাশের খোলা ক্যানভাসে নানান রঙে ছবি আঁকে প্রকৃতি। আকাশ পরিষ্কার থাকায় সন্দ্বীপের উত্তরে চরের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে পূর্ব দিকে দেখা যায় চট্টগ্রামের সুউচ্চ পাহাড়। বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়ালে চরের মাঝখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছাড়া কতগুলো বাড়ি চোখে পড়ে। সন্ধ্যা নামলে ওসব বাড়ির ভেতর মিট মিট আলো জ্বলে। একবার মনে হয় তারা, আবার মনে হয় জোনাকি।
হেমন্তে ধান কাটার শেষে বিপুল বিরহ নিয়ে শূন্য পড়ে থাকে মাইলের পর মাইল। বিস্তীর্ণ চরজুড়ে কোনো ফসল না থাকায় ছেড়ে দেওয়া হয় ভেড়ার পাল। সারা দিন ঘাস খেয়ে রাখালসহ ওদের ঘরে ফেরার দৃশ্য বলে দেয় কাকে বলে গোধূলীসন্ধ্যা, কাকে বলে গড্ডালিকাপ্রবাহ। ভেড়া পালন স্থানীয় লোকজনের অন্যতম আয়ের উৎস। চরের কোথাও কোথাও দেখা যায় মহিষের পালও। নানারকম পাখির আনাগোনা বেড়ে যায় এ সময়। গুলতি হাতে নিয়ে বের হয় গ্রামের দস্যি ছেলেরা। চরের কিছু কিছু অংশে বেড়িবাঁধের ঢালে চাষ হয় মৌসুমি সবজি। বেড়িবাঁধের সারি সারি খেজুর গাছে হাঁড়ি বসায় গাছিরা।
শৌখিন ভ্রমণপিপাসুরা সন্দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে ঘুরতে আসেন এখানে। অল্প দামে কিনতে পাওয়া যায় রাজহাঁস। স্কুল-কলেজ থেকে মাইক বাজিয়ে আসে পিকনিক বাস। বালক-বালিকাদের কলকাকলীতে মুখর হয়ে ওঠে চরের ধূলিকণা, ঘাস।
সূর্য লাল আবীর ছড়িয়ে ডুব দেয় পশ্চিমের বঙ্গোপসাগরে। শীত জেঁকে বসলে রসের ঘ্রাণে ম ম করে চরাচর। কোথাও কোথাও রান্না হয় রসের পায়েস।
সন্দ্বীপের চারপাশেই এখন জেগে উঠেছে নতুন নতুন চর। উত্তর-পশ্চিমের সবুজ চর ছাড়াও সন্দ্বীপের দক্ষিণে আছে বড় দুটি মাছের ঘাট- বাংলাবাজার ও গাছতলী ঘাট। সন্ধ্যায় গভীর সমুদ্র থেকে জলপরীর গল্প ও গন্ধ নিয়ে ফিরে আসা শত শত নৌকার ঝিকিমিকি আলোয় তৈরি হয় মায়াময় পরিবেশ। জেলেদের জীবনধারা, তরতাজা মাছ, হইহুল্লোড় সন্ধান দেবে নতুন পৃথিবীর। প্রকৃতিপ্রেমীদের বুক ভরিয়ে দেওয়ার জন্য আছে সন্দ্বীপের চারপাশের বেড়িবাঁধের মাইলের পর মাইল ঝাউবন। সন্দ্বীপের পূর্ব অংশের বেড়িবাঁধের পাথর-সিমেন্টে বাঁধানো ব্লকে বসলে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা শত শত জাহাজের ঝিকিমিকি আলো আনমনা করে দেবে যে কাউকে। ঘুরে আসতে পারেন সন্দ্বীপের স্বাধীন রাজা দেলোয়ার খাঁর (দিলাল রাজা) কন্যার স্মৃতিবিজরিত মুছাবিবির দিঘি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদের স্মৃতিবিজরিত পৈতৃক ভিটা ও মুন্সী গোলাম মজিদ পাঠাগার, ইসলাম সাহেবের খামারবাড়ি, হরিশপুর ইউনিয়নের সাগরপাড়ের নারিকেল বাগান। সাগরপাড়ে তাঁবু খাটিয়ে আকাশের তারা গুনতে গুনতে কাটিয়ে দিতে পারেন নির্ঘুম দু-একটি রাত।
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সন্দ্বীপের পশ্চিম ও পূর্ব সাগরপাড়ে গড়ে উঠেছে দুটি রেস্তোরাঁ। সন্ধ্যায় কিংবা রাতে সাগরের গর্জনে সৃষ্টি হওয়া সংগীতের মূর্ছনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। সম্প্রতি ব্যক্তি উদ্যোগে সন্তোষপুর ইউনিয়নে পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ট্রাভেলি ইকো ভিলেজ।
সাধারণত, নভেম্বর থেকে মার্চ- এই সময়টি বেড়ানোর জন্য বেশি উপযোগী। বছরের অন্যান্য সময় সন্দ্বীপ চ্যানেল উত্তাল থাকায় সমুদ্রপথে যাতায়াতে একটু সাবধান থাকাই ভালো।
যেভাবে যাবেন: বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে সন্দ্বীপ উপজেলায় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের জন্য রয়েছে বিআইডব্লিউটিসির একটি স্টিমার। দেশের যেকোনো জায়গা থেকে চট্টগ্রামের একে খান মোড়ে নামবেন। এখান থেকে প্রাইভেট গাড়ি বা লোকাল বাসে আসতে হবে সীতাকুণ্ডের কুমিরাঘাটে। লোকাল বাসে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩০ টাকা, প্রাইভেট গাড়িতে এলে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে দ্বীপে পৌঁছানোর সহজ রাস্তা ‘কুমিরা টু গুপ্তছড়া ঘাট’। জাহাজ, স্পিডবোটে যেতে পারলে ভালো। চাইলে ট্রলারেও যেতে পারেন। জাহাজে সদ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দিতে সময় লাগবে এক থেকে দেড় ঘণ্টা, স্পিডবোটে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। জাহাজে শ্রেণিভেদে বিভিন্ন দামের টিকিট পাবেন। চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ ছাড়ে প্রতিদিন সকাল ১০টায়, সন্দ্বীপ থেকে সকাল ৭টায়। স্পিডবোটের টিকিট পাবেন জনপ্রতি ২৮০ টাকা। শিশুদের জন্য হাফ টিকিট নিলে চলবে।
থাকবেন যেখানে: সন্দ্বীপে এখন থাকার জন্য বেশ ভালো কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। খুব স্বল্প খরচে থাকতে পারেন এসব হোটেলে। গুপ্তছড়া ঘাট থেকে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল বা সিএনজি করে সন্দ্বীপ কমপ্লেক্সে গেলে পেয়ে যাবেন আবাসিক হোটেল। হোটেল গ্রিন ভিউ, জামান গেস্ট হাউস, রয়েল ইন, ফয়সাল গেস্ট হাউস, মোল্লা আবাসিক হোটেলগুলো ভালোমানের। হোটেলগুলোয় তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া বাজারের ভেতর যে খাবারের হোটেলগুলো আছে, ওখানেও আপনার পছন্দ অনুযায়ী খাবার পাবেন।
খাবেন যেখানে: দ্বীপ দেখতে গিয়ে তাজা মাছ না খেয়েই ফিরে আসবেন, তা কি হয়! এখানে আপনি পাবেন সামুদ্রিক মাছসহ সব ধরনের মাছ। দ্বীপে ঘুরতে এলে সন্দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী বিনয়সাহার ছানার মিষ্টি, সন্দ্বীপের মহিষের দই, ডাব অবশ্যই একবার হলেও খেয়ে দেখবেন।
জাহ্নবী