মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নীল জলরাশি ও রোমাঞ্চকর সমুদ্র তলদেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইলে ঘুরে আসুন মালদ্বীপ। ১২০০টি দ্বীপ এবং ২৬টি প্রবালদ্বীপের এই অপরূপ দ্বীপদেশটি অপার্থিব সব বিলাসিতার কেন্দ্রবিন্দু।
মালদ্বীপের রাজধানী মালে। মালদ্বীপের সবচেয়ে জনবহুল শহর এটি। ছোট শহর হলেও দ্বীপ হিসেবে মালদ্বীপের সবচেয়ে বড় দ্বীপ কিন্তু এটি। দ্বীপটি মালদ্বীপের অন্য দ্বীপ থেকে আলাদা। এখানে নগর জীবনের চাকচিক্যের সঙ্গে কোলাহলও যুক্ত হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে মালদ্বীপের নির্জনতা এখানে অনুপস্থিত। তবে নারিকেল, সুপারি গাছসহ অন্যান্য নানা গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ ছোট দ্বীপটি। এই আইল্যান্ডে পাওয়া যায় সাগরের মাঝে নগরায়নের ছোঁয়া। মালে শহরের চারদিকে চক্রাকারে পথ। সংকীর্ণ রাস্তা, গাড়ি, বাইক, স্কুটি, এলোমেলো পথচারী সব মিলিয়ে হযবরল অবস্থা হয়েছিল আমার। পুরাতন প্রেসিডেন্ট প্যালেস, পার্লামেন্ট হাউস, হুকুরু মস্ক, মালে মাছ বাজার, ইসলামিক সেন্টার, মালে জাতীয় যাদুঘর, শিশুপার্ক, গ্র্যান্ড ফ্রাইডে মসজিদ সুনামি স্মৃতিস্তম্ভসহ হাতে গোনা কয়েকটি জনপ্রিয় স্থান। তবে প্রবাল পাথর দিয়ে নির্মিত ‘ওল্ড ফ্রাইডে মসজিদ’ বা হুকুরু মস্ক আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপত্য ভবন মনে হয়েছে। এখানে অনেক বাংলাদেশির দোকান আছে, কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে।
মালদ্বীপের দ্বীপগুলোকে দুই নামে ডাকা হয়, লোকাল আইল্যান্ড আর রিসোর্ট আইল্যান্ড। লোকাল আইল্যান্ডে স্থানীয় জনগণ থাকে আর রিসোর্ট আইল্যান্ডে শুধুই রিসোর্ট। আমাদেরটা লোকাল আইল্যান্ড। আগে এ ধরনের দ্বীপে হোটেল-রিসোর্ট করার অনুমতি দেওয়া হতো না, এখন দেওয়া হচ্ছে, তবে কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। এই দ্বীপে চারটি ছোট রিসোর্ট আছে, আছে একটি ক্যাফে ও দুটি ছোট রেস্তোরাঁ। ঘুরতে ঘুরতে কোনো একটিতে গিয়ে বসতাম দুপুরের খাবার খেতাম। লোকাল আইল্যান্ডে মজা হচ্ছে, সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশতে পারা, তাদের সঙ্গে কথা বলা; রিসোর্ট আইল্যান্ডে যে সুযোগ মিলবে না।
আমাদের ভ্রমণের দুই দিনের অবস্থান ছিল হুলহুমালে দ্বীপে। রাজধানী মালের সঙ্গে লম্বা একটা ব্রিজের সঙ্গে যুক্ত এই হুলহুমালে শহর। ভ্যালেনা আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট এখানেই। এটা মূলত একটা কৃত্রিম দ্বীপ। আধুনিক পরিকল্পিত শহরের সবকিছুই এখানে। শহরের মাঝে সবুজ ঘাসে বসলে বোঝার উপায় নেই নিজের অবস্থান। মালদ্বীপের সবচেয়ে বড় স্থলঅংশ এটাই। হুলহুমালে পৌঁছিয়ে আমরা আমাদের আগেই বুকিং করা হোটেলে পৌঁছে যাই। বেশ বড় বড় রুম, জানালার পর্দা সরালেই সমুদ্র! ফ্রেশ হয়ে রাত ১১টায় হোটেলের পাশেই সি বিচে গিয়েছিলাম ঘুরতে। পূর্ণ চাঁদের আলো নীল পানিতে পড়ে সে এক স্বর্গীয় রূপ ধারণ করেছিল। দৃষ্টিসীমানার বাইরে যত দূর চোখ যায় সাগরের পানির ওপর চাঁদের আলো এ এক অপরূপ দৃশ্য। হুলহুমালের রাস্তা পরিকল্পিত পরিচ্ছন্ন, নারিকেল বাগান, ঝাউগাছ দিয়ে গোছানো দ্বীপটা।
মালদ্বীপে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হলো সাবমেরিনে করে সমুদ্রের তলদেশ উপভোগ করা। সাবমেরিনটি দেখতে অনেকটা তিমির মতো, তাই এর নাম হোয়েল সাবমেরিন। হোয়েল সাবমেরিনে করে সমুদ্রের তলদেশে গেলে আপনি মালদ্বীপের বিচিত্র ও রঙিন জলজ প্রাণীদের সাক্ষাৎ পাবেন। হলুদ বক্সফিশ, নীল স্ন্যাপার, লায়নফিশ, কচ্ছপ এবং হাঙরও দেখতে পারবেন। মালদ্বীপে অনেকে ডাইভ করেন। আপনি যদি ডাইভ করতে না চান, তাহলে সমুদ্রের নিচের জীবন দেখতে হোয়েল সাবমেরিনই সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
মালের পর মাফুসি দ্বীপে কিছুটা গমগমে ভাব মেলে। পুরো দেশের দ্বীপগুলো পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। মাফুসি দ্বীপের রোমাঞ্চের স্বাদ মিলেছিল উইন্ড সার্ফিং, কায়াকিং, স্কুবা ডাইভিং ও প্যাডেল নৌকার মাধ্যমে। এই দ্বীপে তীরের অদূরে মাঝে মধ্যে চলে আসে তিমি ও হাঙ্গর। এই দ্বীপে চাইলে পানিতে নেমে স্নরকেলিং করতে পারবেন। ডুব দিলেই দেখতে পারবেন কত রঙের মাছ আপনার চারপাশে। এর অভিজ্ঞতা ছিল না, স্নরকেলিং নেশা ধরিয়ে দিল, পানি থেকে আর উঠতে ইচ্ছে করেনি। মাফুশি দ্বীপের অপরূপ রূপে হারিয়ে গিয়েছি কত বার। এয়ারপোর্ট থেকে দুইটা শহরেই যাতায়াত করতে হয় ট্যাক্সি দিয়ে। মাফুশি সবচেয়ে কমন একটা দ্বীপ তাই এখানে খরচটা তুলনামূলক কম। প্রতিজনের পার ট্রিপ ২০ ডলার বা ১৮০০ টাকা।
মালদ্বীপের আরেকটি আকর্ষণীয় অংশ হলো অসংখ্য প্রাইভেট দ্বীপগুলোতে রাত্রিযাপন। তবে এই দ্বীপগুলোর বিলাসবহুল ওভারওয়াটার বাংলোতে এক রাত থাকতে চাইলে আপনাকে গুনতে হবে প্রায় ১ লাখ টাকা। বাংলোগুলো সরাসরি সমুদ্রের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায় বাংলোগুলো থেকে। আর সেই সঙ্গে মালদ্বীপের সমুদ্রের পানির অপরূপ সৌন্দর্য তো আছেই।
নভেম্বর থেকে মার্চ মালদ্বীপের পিক সিজন থাকে। কারণ মালদ্বীপে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস গ্রীষ্মকাল চলে। এই সময়ে মালদ্বীপের আকাশ পরিষ্কার থাকে ও সমুদ্রের পানি অদ্ভুত সুন্দর গাড় নীল রঙ ধারণ করে। তাই বিশ্বের নানা দেশ থেকে এখানে পর্যটকরা ভিড় করে। খরচও বেশি হয়। তাই খরচ কম করতে চাইলে মালদ্বীপ ভ্রমণের জন্য মার্চ ও এপ্রিল মাস বেছে নেওয়া যেতে পারে, কারণ এই সময়গুলোতে সবকিছুর দাম তুলনামূলক কম থাকে।
জাহ্নবী