বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। এটির দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার, যা কক্সবাজার শহর থেকে বদরমোকাম পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে কক্সবাজারের তিনটি বিচই পর্যটকরা বেশি পছন্দ করেন। সেগুলো হলো কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী। আমাদের দেশের ভ্রমণপ্রেমীদের প্রথম পছন্দ হলো কক্সবাজার। অনেকেই আছেন যাদের প্রতি বছরই কক্সবাজার না গেলে ভালোই লাগে না।
তারপরও এমন অনেকেই আছেন যারা কক্সবাজার যাওয়ার প্ল্যান করেও এখনো যেতে পারেননি। তাদের জন্য এই লেখাটি।
কক্সবাজার নাম কীভাবে হলো
কক্সবাজারের নামকরণের পেছনে ছোট্ট একটি ইতিহাস না বললেই নয়। এর প্রাচীন নাম ছিল পালংকী। একসময় এটি প্যানোয়া নামে পরিচিত ছিল। প্যানোয়া শব্দটির অর্থ হলুদ ফুল। অতীতে কক্সবাজারের আশপাশের এলাকাগুলো এই হলুদ ফুলে ঝকঝক করত। স্থানীয় বাসিন্দারা এই সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে একজন ইংরেজ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স অষ্টাদশ শতকে পালতোলা কাঠের জাহাজে করে এখানে এসে নামেন। ১৭৯৯ সালে তিনি এখানে একটি বাজার স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে হিরাম কক্সের নামানুসারেই এলাকাটির নামকরণ করা হয় কক্সবাজার।
কক্সবাজার নিয়ে কিছু কথা
কক্সবাজার বাংলাদেশের দক্ষিণে-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এবং চট্টগ্রাম প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। এর আয়তন প্রায় ২ হাজার ৪৯১ দশমিক ৮৬ বর্গকিলোমিটার। উত্তরে হারবাংয়ের সুউচ্চ পাহাড় থেকে দক্ষিণে ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে নাফ নদীর কোল ঘেঁষে সাবরংয়ের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত এর অবস্থান। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন।
চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজার ১৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। বঙ্গোপসাগরের পাশে অবস্থিত মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কক্সবাজারে রয়েছে দর্শনীয় বেশ কয়েকটি স্থান। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, মাতারবাড়ী, শাহপরী ও সেন্ট মার্টিন কক্সবাজারকে করেছে আরও আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে মাতা মুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কুহেলিয়া ও নাফ নদী।
পর্যটন, বনজসম্পদ, মাছ, শুঁটকি, শামুক, ঝিনুক ও সিলিকাসমৃদ্ধ বালুর জন্য কক্সবাজারের অবস্থান তাই ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের কাছে সবার শীর্ষে। সমুদ্রতটের অপার সম্ভাবনাময় এ দ্বীপখণ্ডটিতে তাই সমৃদ্ধির আশায় ছুটে এসেছে মগ, পর্তুগিজ, আরব, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজরা। কালের বিবর্তনে এখানে লেগেছে উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ছোঁয়া। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কক্সবাজারকে মহকুমায় উন্নীত করেন। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ কক্সবাজারকে পূর্ণাঙ্গ জেলায় রূপান্তর করা হয়। ২০০২ সালে আটটি উপজেলা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কক্সবাজার জেলা গঠিত হয়। এগুলো হলো কক্সবাজার সদর, রামু, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, উখিয়া ও টেকনাফ।
কীভাবে যাবেন
সড়ক, ট্রেন এবং বিমানপথে কক্সবাজার যাওয়া যায়। সড়কপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪১৪ কিলোমিটার। ঢাকার ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিলসহ বেশ কয়েকটি স্থানে সরাসরি কক্সবাজারের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়ার এসি, নন-এসি স্লিপার বাস পাওয়া যায়। ভাড়া পড়বে এক থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকেও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে যাওয়ার সরাসরি বাস সার্ভিস চালু আছে।
এ ছাড়া বর্তমানে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত দুটি ট্রেন পর্যটক এক্সপ্রেস ও কক্সবাজার এক্সপ্রেসে যাওয়া যায়। ট্রেনে ভাড়া পড়বে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নন-এসি চেয়ার ৬৯৫ টাকা ও এসি চেয়ার ১ হাজার ৩২৫ টাকা। শিশুদের ক্ষেত্রে ভাড়া কিছুটা ছাড় পাওয়া যায়। আর ট্রেনের টিকিট অনলাইনে কাটার ক্ষেত্রে ২০ টাকা সার্ভিস চার্জ যুক্ত হবে।
আর বিমানপথে যাওয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন বিমান বাংলাদেশ ছাড়াও নভো এয়ার, ইউএস বাংলা, এয়ার এস্ট্রা প্রভৃতি সরাসরি ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যাত্রী পরিবহন করছে। সেগুলোর ভাড়া ৪ হাজার ৫০০ থেকে শুরু হয়। তবে বিভিন্ন সিজনে নানা রকম অফারে অনেক সময় কমেও বিমানে কক্সবাজার যাওয়ার সুযোগ থাকে। তবে সব ক্ষেত্রেই আগে থেকে টিকিট কেটে রাখা ভালো। বিশেষত বাস ও বিমানে আগে থেকে টিকিট কাটলে সাশ্রয়ী ভাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার কিছু কিছু অনলাইনেও বিশেষ ছাড়ে টিকিট বিক্রি করা হয়।
কোথায় থাকবেন
কক্সবাজারে থাকার জন্য পাঁচ তারকা সমমানের অনেক হোটেল ও রিসোর্ট আছে। এ ছাড়া চার তারকা, তিন তারকাসহ বিভিন্ন মানের হোটেলও আছে। বিচের আশপাশের বেশির ভাগ হোটেলই ভালো মানের। বেশির ভাগ হোটেল ও রিসোর্ট কলাতলী বিচ ও লাবণী পয়েন্টের আশপাশে অবস্থিত। ইনানী বিচের আশপাশে থাকার জন্যও সম্প্রতি বেশ কিছু হোটেল গড়ে উঠেছে।
এ ছাড়া এর বাইরে আছে ইকো রিসোর্ট। এসব হোটেল ও রিসোর্টে পিক টাইম এবং অফ-পিক টাইম অনুযায়ী রুমের ভাড়া ভিন্ন হয়। সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পিক টাইম এবং মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অফ-পিক টাইম হিসেবে ধরা হয়।
অফ-পিক টাইমে রুম ভাড়া হোটেল ভেদে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। হোটেল ভাড়া দরদাম করে নিলে অনেক কমে পাওয়া যায়। তবে পিক সিজন বা ছুটির দিনে আগে থেকেই হোটেল রুম বুকিং করে যাওয়া ভালো। নইলে পরিবার নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বর্তমানে অনলাইনে অনেক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কোনো অ্যাডভান্স টাকা ছাড়াই হোটেল রুম বুকিং করা যায়।
কক্সবাজারের দর্শনীয় স্থান
হিমছড়ি, ইনানী বিচ, ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপ, মহেশখালী, সোনাদিয়া দ্বীপ, এয়ারপোর্ট এলাকা, বার্মিজ মার্কেট, শুঁটকি মার্কেট, হিলটপ সার্কিট হাউস ও এর পাশের রাডার স্টেশন, লাইট হাউস, আগ্গা মেধা বৌদ্ধ ক্যাং ও মাহাসিংদোগী বৌদ্ধ ক্যাং, মাথিনের কূপ, গোলাপ চাষ প্রকল্প, বদর মোকাম মসজিদ, চিংড়ি প্রসেসিং জোন, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, লবণ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা, রামকোট তীর্থধাম, কানা রাজার সুড়ঙ্গ, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, লামার পাড়া বৌদ্ধবিহার, কুতুবদিয়া দ্বীপের বাতিঘর, শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ বিচ ইত্যাদি।
সতর্কতা
একটু সতর্কতার অভাবে প্রতি বছর অনেক পর্যটক সমুদ্রের পানিতে গোসল করতে গিয়ে প্রাণহানির শিকার হচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী বিচ পর্যন্ত গুপ্ত খাল রয়েছে এবং বেশির ভাগ পর্যটক ভাটার সময় নেমে এই গুপ্ত খালে পড়ে প্রাণ হারান। তাই ভাটার সময় সৈকতে গোসল করা পরিহার করা উচিত। ভাটা ও জোয়ারের সময় অনুযায়ী সৈকতে লাল ও সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হয়। যখন সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হবে তখন গোসল করা নিরাপদ।
আর গোসলের সময় বিচের বেশি গভীরে না যাওয়াই ভালো। প্রয়োজনে লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখতে পারেন। আর যেকোনো সমস্যায় বিচের ট্যুরিস্ট পুলিশ বা লাইফ গার্ডের সদস্যদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তারা ট্যুরিস্টদের যেকোনো সমস্যার সমাধানে বেশ আন্তরিক।
কলি