সুন্দরবনে যাওয়ার কথা উঠলেই মনের গহিনে জাগে অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চ। পাঁচ বছর ধরে অনেকবার পরিকল্পনা করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই এবারের শীতে সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। পরিকল্পনামাফিক ‘সিলভার ক্রুজ’ আর একদল দক্ষ ক্রু স্টাফ নিয়ে মোংলা থেকে নভেম্বরের এক শুক্রবার ভোরে রওনা হলাম। দলের সবাইকে রুম বুঝিয়ে ছাদে বসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন দেখতে বসলাম৷ একদিন মাঝে অমাবস্যা পড়েছে বিধায় টেলিস্কোপ আর তারা দেখানোর জন্য সজীব বর্মণ এসেছে আমাদের ট্রিপে। জঙ্গলের অন্ধকার থেকে রাতে নৌকায় বসে তারা দেখব চিনব এমন প্ল্যান আগেই করে রেখেছিলাম।
সুন্দরবন ট্রিপে আপনার ওজন কেজিখানেক বাড়তে বাধ্য। এখানকার বাবুর্চিরা এত মুখরোচক সব খাবার বেলায় বেলায় রান্না করে, ডায়েট চার্ট সেখানে কুপোকাত। নদীর তাজা মাছ, ঝোলে-তেলে উদরপূর্তি৷
প্রথম দিন বিকেলে আন্ধারমানিক খালে ঘুরে বেড়ালাম ঘণ্টাখানেক৷ অদ্ভুত সুন্দর আর রহস্যময় খালগুলো৷ কেতাবি ভাষায় বলে ‘ক্যানাল ক্রুজিং’। চুপ করে সবাই নিসর্গ উপভোগ করে, ছবি তুলে, বিরক্তি শুধু একটাই- ইঞ্জিন বোটের গাক গাক শব্দ। সুন্দরবনকে নিবিড়ভাবে দেখা এবং উপভোগ করাই আমাদের উদ্দেশ্য। বাঘ মামার দেখা পাওয়া খুব খুব অনিশ্চিত৷ আমি দু-ডজনবার গিয়ে এখনো দেখিনি। কিন্তু ওই সুন্দরবনে নিশ্চিত আছে মামা আশপাশেই- এই রোমাঞ্চটা দারুণ উপভোগ্য৷
রাতে আকাশভর্তি তারার মেলা বসল যেন। ভরপেট ডিনার শেষে আমরা ছোট নৌকায় করে চলে গেলাম একটু দূরে সব জাহাজ ছাড়িয়ে। ইঞ্জিন অফ করে দিয়ে চলল আমাদের তারা চেনানোর ক্লাস৷ কী অবাক বিস্ময় আকাশজুড়ে! কত অজানা, কত ক্ষুদ্র আমাদের অস্তিত্ব!
জাহাজের কেবিনে ৫/৬ ঘণ্টা ঘুমিয়ে খুব ভোরে নেমে গেলাম আবার খালে, এক কাপ চা আর বিস্কুট খেয়ে। অনেক হরিণ, কয়েকটা কুমির আর অসংখ্য পাখির দেখা পেলাম৷ ফিরে এসে নাশতা করে চলে গেলাম অফিসপাড়া, যেখানে দেখা যায় পালে পালে হরিণ। এবার আমাদের লম্বা হাঁটা- প্রায় ১০ কিলো শুরু করব। দু-একজন জাহাজে রয়ে গেল। বাকি সবাই প্রস্তুত সৈকত ধরে কটকা থেকে কচিখালি পর্যন্ত এই সুন্দর বিচ ধরে হাঁটার জন্য। জাহাজ প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা পথ ঘুরে আমাদের তুলবে কচিখালী থেকে। তার আগে আমরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জাহাজ বা নেটওয়ার্ক থেকে৷ সচরাচর এই পথে কেউ হাঁটে না। এত টাকা দিয়ে ইভেন্টে এসে কেইবা এত হাঁটবে!
কিন্তু আমরা এই পাগলামিটাই করতে এসেছি। সুন্দরবনের শেষ আর বে অফ বেঙ্গলের শুরতে- সরু একটা সৈকত দিয়ে হেঁটে যাওয়া। বাম দিকে ঘন জঙ্গল আর ডানে অবারিত সমুদ্র৷ মামার ভয়ও আছে অনেক। সামনে-পেছনে সশস্ত্র সতর্ক বনরক্ষী, দুইজন। মাঝে আমরা ২৮ জনের মতন ট্যুরিস্ট। শুরু হলো হাঁটা মোটামুটি নিঃশব্দে। প্রাণিকুল আছে চারপাশে অনেক৷ তাদের বিরক্তির কারণ হতে চাই না। শুরুতেই একটা বিশাল কালো সাপ দেখতে পেলাম৷ আমাদের দেখে দ্রুত সরে গেল ঝোপের আড়ালে। বিচে নামার পর থেকেই একটু পরপর পেলাম বাঘের পায়ের ছাপ। ভোরে হয়তো জঙ্গল ছেড়ে সমুদ্রপাড়ে বাতাস খেতে এসেছিল বনের সবচেয়ে ম্যাজেস্টিক প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। চার ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা পৌঁছলাম কচিখালি পয়েন্টে৷ জাহাজ আসার আগেই আমরা চলে এসেছি। টিমের সবাই সুস্থ এবং হাসিখুশি। দুপুরে রোদ হয়েছে চড়া, ভোরের শীত শীত ভাব কেটে। খিদেও পেয়েছে বেশ, নৌকা এসে আমাদের তুলে ডাব খাইয়ে আবার নামিয়ে দিল আন্ডার চরে; সেখানে কেউ কেউ গোসল করল। আমরা আবার সেই দ্বীপটাও ঘুরে এলাম ৪ কিলোর মতন। জাহাজে ফিরে গোসল সেরে অনেক খাবার খেয়ে যখন রেস্ট নিচ্ছি- স্মার্টফোন জানান দিল সারা দিনে আমরা বনে বনে হেঁটেছি প্রায় ১৯ কিলোর মতন। পরদিন সকালে করমজল খানিকটা ঘুরে, কুমির প্রজননকেন্দ্র দেখে, বনের নতুন সিমেন্টের ট্রেইলে হাঁটার পর জাহাজ উঠে রওনা দিলাম খুলনার পথে। সেই সঙ্গে শেষ হলো আমাদের সুন্দরবনের অ্যাডভেঞ্চার।
জাহ্নবী