ঢাকা শহরের অদূরেই মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামটি আমাদের ভাষা শহিদ রফিক উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি। এখানেই তার জন্ম। আমরা এক সকালে বন্ধুরা মিলে এই ভাষার মাসে গিয়েছিলাম ভাষা শহিদ রফিক উদ্দিনের স্মৃতিকে উৎসর্গীকৃত ভাষা শহিদ রফিক উদ্দিন জাদুঘরে।
আমাদের প্রধান উদ্যোক্তা ছিল বন্ধু জিলাল আহমেদ, একজন নিবেদিতপ্রাণ কলেজ শিক্ষক এবং দারুণভাবে শিক্ষানুরাগী। তার বাসায় আছে একটি বেশ বড়সড় ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। আর সে এমন একজন শিক্ষক যে নাকি নিজের গাটের পয়সা খরচ করে ক্লাসের ছাত্রদের দর্শনীয় স্থান দেখাতে নিয়ে যায়। আরেক বন্ধু বজলুল করিম চৌধুরী ওরফে বাবর হলো মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক; যে নাকি বিনা পয়সায় রোগী দেখার জন্য বিখ্যাত।
সেই প্রথম প্রস্তাব করে রফিকউদ্দিনের মেমোরিয়াল জাদুঘর দেখতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ খুব ভালোভাবে চেনে না। কিন্তু আমাদের সঙ্গে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তারেক ভাই যোগ দেওয়ার পর বলল, আগে তো বের হই। আর সঙ্গে আছে সব বিষয়ের ব্যবস্থাপক অনুজপ্রতিম তেজেন রায়। কিন্তু রাস্তা কে চেনে? কুছ পরোয়া নেহি।
সঙ্গে আছে জ্যান্ত এটলাস শাহজাহান। অ অঞ্চলের এমন কোনো স্থান নেই যার আদ্যোপান্ত সে জানে না। আর আমি মূর্খ তো আছিই। জিলাল আর বাবরের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল সকাল ১০টা নাগাদ। সঙ্গে কিছু হালকা খাবার। কিন্তু জ্যান্ত এটলাস শাহজাহানের এটলাসগিরিতে তেমন কোনো কাজ হলো না। দুই তিনবার রাস্তা ভুলভাল করে শেষে পৌঁছে গেলাম পারিল তথা রফিকনগর গ্রামে। চমৎকার রাস্তা। কোথাও কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই। ঢাকা থেকে আসতে হলে ঢাকা-আরিচা হাইওয়ে ধরে হেমায়েতপুরে নেমে বাম দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে সহজেই ব্যাটারিচালিত রিকশা বা গাড়িতে করে অনায়াসে রফিকনগর পৌঁছে যাওয়া যায়। তবে অটোতে যেতে হলে অটোরিকশাওলাকে এখনো পারিল গ্রামই বলতে হবে।
পারিল গ্রামে শহিদ রফিকউদ্দিন জাদুঘরটি একটি সুরম্য এবং অত্যন্ত সুন্দর ভবন, খোলামেলা জায়গায় রাস্তার পাশেই নির্মিত হয়েছে। এর একপাশে এবং সামনে বিস্তৃর্ণ আবাদি জমি। আমরা যখন গেছি তখন সরিষা মৌসুম চলছে। চারদিকে হলুদ সরিয়া ফুলের রং ভবনটির আরও সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। পারিল গ্রামেই রফিকউদ্দিনের সব ভাইবোন বসবাস করতেন। তারা ছিলেন পাঁচ ভাই দুই বোন। রফিকউদ্দিন ছিলেন সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়।
এর মধ্যে এখনো সর্বকনিষ্ঠ ভাইটি বেঁচে আছেন। তিনি একজন সমাজসেবক। তাদের ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই এই গ্রামেই বসবাস করেন। তারা গর্ববোধ করেন তাদের পরিবারের নিকট পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত। শহিদ রফিকের নামানুসারে পারিল গ্রামটি এখন ‘রফিকনগর’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার জন্য তাকে ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ভাষা শহিদ রফিকউদ্দিন ১৯২৬ সালে ৩০ অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুল লতিফ এবং মায়ের নাম রাফিজা খাতুন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। স্কুলজীবন শেষ করে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে পড়াশোনা না করে ঢাকায় এসে বাবার প্রেসের ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন এবং জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে ব্যবসা এবং পড়ালেখা দুটোই চালাতে থাকেন।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রতিবাদ মিছিল চলাকালে ঢাকা মেডিকেলের সামনে যখন পাকিস্তানি পুলিশ মিছিলের ওপর সরাসরি গুলিবর্ষণ করে তখন শহিদ রফিক মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনিই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ। তাকে পুলিশ পাহারায় আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তার কবরটি আর চিহ্নিত করা যায়নি। ২০১০ সালে রফিকের গ্রামের বাড়িতে জেলা পরিষদ শহিদ রফিকউদ্দিন স্মরণে এই গ্রন্থাগার-জাদুঘর নির্মাণ করে। তবে জাদুঘরটিতে রফিকের স্মৃতি স্মারক বলতে তেমন কিছুই নেই।
তার ব্যবহার করা পাঞ্জাবি আর টেবিল চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। বাইরে এবং ভিতরে শহিদ রফিকের দুটো ম্যূরাল তৈরি করা হয়েছে। এমনকি ৯ হাজার সংগৃহীত বইয়ের মধ্যে মাত্র দুটো বই শহিদ রফিককে নিয়ে লেখা। তবে সাধারণ পাঠকের জন্য পর্যাপ্ত বই আছে। যেখানে পাঠকরা ইচ্ছামতো তাদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো একজন পাঠকও সারা দিনে এখানে আসে না। এ তথ্যটি জানালেন ভাষা শহিদ রফিকের ভাইয়ের ছেলে ফরহাদ হোসেন খান।
আরেকটি বিষয় একজন গ্রন্থাগারিক নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও গ্রন্থাগারের বইগুলো একেবারে এলামেলো অবস্থায় আলমারিতে সাজানো, অনেক ক্ষেত্রে যেভাবে খুশি সেভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে। লেখকের নাম অনুযায়ী বা বিষয়ভিত্তিকভাবে বইগুলো সাজিয়ে রাখলে পাঠকদের সুবিধা হতো। তবে পাঠক কিন্তু কদাচিৎ দু-একজন আসে। এদের কেউ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বা কলেজে পড়ে। দেশের বাড়িতে বন্ধের সময় এলে গ্রামের এসব ছাত্ররা এই গ্রন্থাগারের বই বাসায় নিয়ে পড়ে। আমরা ওখানে থাকতেই এ ধরনের একজন ছাত্র দেখলাম বেশ কিছু বই নিয়ে এসেছে ফেরত দেওয়ার জন্য।
ছাত্রটি জানাল, সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র। ছুটিতে এসেছে বাড়িতে। তাই বই নিয়ে গিয়েছিল এই গ্রন্থাগার থেকে। তাকে জিলাল বলল, তোমরা শিক্ষিত হয়েছ, তোমরা তো গ্রামের অন্যদের প্রভাবিত করতে পার, বলতে পার বই পড়ার জন্য। ছেলেটা জানাল, সে বলে। বন্ধু শাহজাহান প্রস্তাব করল, একদিন আমরা বইগুলো সাজিয়ে দিয়ে যাই। সবাই রাজি হলো। তবে সেটি আর হয়ে ওঠে কি না তা অনিশ্চিত। ভাষা শহিদ রফিকের ভাতিজা জানাল, মেমোরিয়ালের প্রাঙ্গণে ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে পাঁচ দিনব্যাপী মেলা হয়, রফিক মেলা। মেলাটি ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত চলে।
সে মেলায় নৃত্য, সংগীত, আঁকা, বইপড়া, আবৃত্তিসহ নানা সাংস্কৃতিক বিষয়ের ওপর কর্মসূচি পালন করা হয়। ওই সময় বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং রক্তদান কর্মসূচি পালিত হয়ে থাকে। সে মেলায় সরকারি কর্মকর্তারা আসেন। শহিদ রফিকের বাড়িতে সরকার কর্তৃক নির্মিত শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। তখন একটু লোকজনের ভিড় হয়। এ ছাড়া এ সুরম্য ভবন এবং বিপুল গ্রন্থরাজি সারা বছর অবহেলায়ই পড়ে থাকে। তবে আমাদের বিশ্বাস সরকারি উদ্যোগে এই জাদুঘর কাম গ্রন্থাগারের প্রচার প্রচার চালালে এখানে অবশ্যই বিপুল পরিমাণ ভ্রমণপিপাসু মানুষের আগমন ঘটবে।
এতে মানুষ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানবে এবং নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। ফেরার সময় হয়ে গিয়েছিল। চারপাশের সরিষা ফুলগুলোর রং আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল শেষ সূর্যের রৌদ্রের আভায়। ফিরে আসার সময় আমাদের সবাইকেই একটু বিষণ্নতায় গ্রাস করেছিল।
বায়ান্নর আগুনরাঙা বিকালটা কী এমনই ছিল, রফিকের মাথায় গুলিবিদ্ধ লাশটি যেদিন এমনই এক বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হোস্টেলের পাঁচ নম্বর কক্ষের সামনে নিথর হয়ে পড়েছিল?
কলি