
গগনবেড় পাখি। এই পাখিকে এখন আমরা ‘পেলিক্যান’ নামে চিনি। চিড়িয়াখানা ছাড়া পাখিটি বাংলাদেশে খুব কমই চোখে পড়ে। বিশ শতকেই দেশত্যাগ করেছে এই পাখি। তাও গেছে কিছুদিন অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটানোর পর। দেশত্যাগী হওয়ার পর ‘গগনবেড়’ পাখির নামও বাংলাদেশ থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
অথচ কিছুদিন আগেও গগনবেড় ছিল এ দেশের পরিচিত একটি পাখি।
শুনেছি, আমার বাবার আমলে ঢাকার আকাশে একঝাঁক গগনবেড় দেখলে কেউ অবাক হতো না। ১৯১২ সালের পূর্ববাংলা ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার লিখেছে, ‘ফরিদপুর ও ঢাকায় গগনবেড় দেখা যায়, নদী ও জলাভূমিতে এরা দল বেঁধে থাকে।’
১০০ বছর আগেও ঢাকার নদী, বিল ও ঝিলে গগনবেড় পাখির ঝাঁক চোখে পড়ত। কিন্তু গগনবেড় তো দূরের কথা, সেই নদী, বিল ও ঝিলগুলোর অস্তিত্বই আজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোথায় হারিয়ে গেছে সেকালের ঢাকা জেলার বেগবত্তা বালুনদী, বিশালাকার বেলাই-বিল আর মনোহর মতিঝিল!
এখন বালুনদী ভরাট করে হয়েছে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্প, বেলাই-বিলের বুকে আছে পুবাইল রেলস্টেশন আর মতিঝিলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাজধানীর ভবন ও প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। সেকালের প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অতুলনীয় সেসব স্থানে পাখি বলতে এখন আছে শুধু বর্জ্যভুক কাক, চিল ও শালিক।
তবে এসব আধুনিক স্থাপনা গড়ে ওঠার আগেই ঢাকার তাবৎ জলাশয় থেকে বিদায় নিয়েছে গগনবেড়। এদের সে মহাপ্রস্থানের প্রধান কারণ খাদ্যাভাব। গগনবেড় পাখি বেঁচে থাকে মাছ খেয়ে। পানির ওপরে অনেক মাছ সাঁতরে বেড়ালেই ঠোঁটের বেলচা দিয়ে এরা তা উঠিয়ে নিয়ে উদরপূর্তি করতে পারে।
সেকালের জলাশয়ে পোনামাছের ও গগনবেড়-ছানার সংখ্যার মধ্যে একটা ভারসাম্য ছিল। মাছ বাড়লে গগনবেড় পাখির ছানা বেশি হতো। আবার ছানার সংখ্যা বাড়লে মাছ কমে যেত এবং মাছ কমে গেলে অবশেষে পাখির সংখ্যাও নামতে থাকত। এভাবে মাছ ও গগনবেড় পরস্পরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হতো।
জলাশয়ের তীরে মানুষের সংখ্যা বাড়ার ফলে ভেঙে গেছে সেই ভারসাম্য। পাখির মতো শুধু পানির ওপরের মাছই ধরে না মানুষ। তারা জাল দিয়ে জলার তলা থেকেও সব মাছ তুলে আনে। ভারসাম্যের তোয়াক্কা করে না অধিকাংশ মানুষ। তারা আহরণ করে নির্মূল করে। ভবিষ্যতের ভাবনা তাদের কাছে বিলাসিতার নামান্তর।
প্রথম দিকে গগনবেড় ও মানুষে কোনো সংঘাত ছিল না। তখন মানুষ ধরত রুই, কাতল, চিতল, বোয়াল, বাউশ, পাঙাশ ইত্যাদি। আর গগনবেড় ধরত শোল, টাকি, বাটা, দাড়কিনা ইত্যাদি ‘বাজে মাছ’ যার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল না। তাই জেলে ও গগনবেড়, দুই প্রতিবেশী পাশাপাশি মাছ শিকার করতে পারত।
কিন্তু নির্মূল করে আহরণে আগ্রহী মানুষের জন্য অচিরে মাছের আকাল হলো, প্রথমে ঢাকার জলাশয়ে, তারপর সারা দেশে। শোল-টাকির মতো ‘বাজে মাছ’ হয়ে গেল গ্রহণযোগ্য এবং কালক্রমে ‘ডেলিকেসি’। তাই একদিন আকাল পড়ল বাজে মাছেরও। আর তখনই বাংলার জলাশয় থেকে বিদায় নিল নিরুপায় গগনবেড়।
বিশ্বে সর্বসাকুল্যে আছে আট প্রজাতির গগনবেড়। এর দুটিমাত্র প্রজাতি ছিল বাংলাদেশে, নাম ‘বড় ধলা-গগনবেড়’ ও ‘চিতিঠুঁটি-গগনবেড়’। গত ২০ বছরে এ দেশে চোখে পড়েনি কোনো ধলা-গগনবেড়। এখন শীতকালে শুধু রাজশাহী নগরীর পাশে পদ্মা নদীতে কালেভদ্রে দেখা দেয় দুয়েকটি চিতিঠুঁটি-গগনবেড়।
বিশালদেহী পাখি গগনবেড়। পাঁচ কেজিরও বেশি তার ওজন। মাছরাঙার মতো দুয়েকটি চুনোপুঁটিতে তার দিন চলে না। পানিতে সহজে ভেসে থাকার মতো ‘বয়ান্ট’ দেহ নিয়ে সে পানির গভীরে গিয়ে পানকৌড়ির মতো মাছ শিকার করতেও পারে না। তাই মাছরাঙা আর পানকৌড়ির আগেই তাকে এ দেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।
গগনবেড় পাখিরা দেহে যেমন, মনেও তেমনই বয়ান্ট, অর্থাৎ প্রফুল্ল। যেখানেই রয়েছে ওরা, আছে দল বেঁধে। হুল্লোড়ে ও আমোদে কাটে ওদের দিন। শুধু দুঃখ আমাদের, এ দেশের একটি জলাশয়েও আমরা ওদের টিকে থাকার পরিবেশটুকু ধরে রাখতে পারিনি।