সুশাসনের অর্থনীতি রূপান্তরের বাংলাদেশ । খবরের কাগজ
ঢাকা ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪

সুশাসনের অর্থনীতি রূপান্তরের বাংলাদেশ

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৫৬ এএম
সুশাসনের অর্থনীতি রূপান্তরের বাংলাদেশ
ড. মোস্তাফিজুর রহমান

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাজেট ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। জানা কথা, বাংলাদেশে কর ও রাজস্ব আহরণ থেকে আয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম (১২৩টি দেশের মধ্যে ১১৯তম স্থান)। রাজস্ব আয়ের প্রায় পুরোটাই চলে যায় আবর্তক (রাজস্ব/পরিচালন) ব্যয়ের পেছনে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাজস্ব বাজেটে উদ্বৃত্ত মোটামুটি শূন্যের কাছেই থাকে। তাই এডিপির বাস্তবায়ন মূলত সম্পূর্ণই বহন করতে হয় ঋণের টাকায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ক্ষেত্রেও এ ধারাবাহিক প্রবণতার ব্যত্যয় হবে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়ন হতে হয় অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে, যেমন- সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক খাত থেকে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের মাধ্যমে অথবা বৈদেশিক (দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয়) বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত ঋণের টাকায়। অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে আসবে এডিপির প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৬৪.৩ শতাংশ আর বাকি ৩৫.৭ শতাংশ আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে। 

মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কারণে বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ কাঠামোতে রেয়াতি ঋণের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে আর সুদের হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে; ঋণের শর্তও কঠিনতর হচ্ছে (যেমন, ঋণ পরিশোধের সময়- গ্রেস পিরিয়ড ও ম্যাচুরিটি পিরিয়ড- হ্রাস পাচ্ছে)। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার পরিমাণ টাকার অঙ্কে, টাকার বিনিময় হারের অবমূল্যায়নের কারণে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অভিঘাত বেশি অনুভূত হবে বৈদেশিক অর্থায়নে- প্রসূত যেসব  প্রকল্প থেকে আয় হয় প্রধানত স্থানীয় মুদ্রায়, সেসব বিনিয়োগে। বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার জন্য রাজস্ব বাজেটের ব্যয়ের পরিমাণও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে৷ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের দায় পরিশোধের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১২৩৭৬.০ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের বরাদ্দের তুলনায় ৩২.৮ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনীতির বহুমাত্রিক চাহিদার নিরিখে বড় অঙ্কের উন্নয়ন ব্যয় অস্বাভাবিক নয়। এবং এ কথাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় জিডিপির শতাংশ হিসেবে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম (মাত্র ১৫ শতাংশের কাছাকাছি)। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি, বিভিন্নমুখী সরকারি সেবার প্রাপ্তি, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি, ব্যক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সরকারি বিনিয়োগের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে বড় ধরনের সরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে৷ স্কুল-হাসপাতাল নির্মাণ,  বিদ্যুৎ উৎপাদন,  গ্যাস সরবরাহ,  যোগাযোগ-পরিবহনের উন্নয়ন,  মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রযুক্তির সম্প্রসারণ– এসবের অর্জন মূলত নির্ভর করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির গুণসম্পন্ন বাস্তবায়নের ওপর। কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, আয় ও সম্পদবৈষম্য হ্রাস করে সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মানসম্পন্ন বাস্তবায়নের বড় ভূমিকা রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের ১৭টি অভীষ্ট ও ১৬৯টি লক্ষ্য অর্জনের যে অঙ্গীকার বাংলাদেশের আছে, সে প্রেক্ষিত থেকেও এডিপির সুশাসনভিত্তিক বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। 

তবে প্রশ্ন থেকে যায়, বার্ষিক  উন্নয়ন কর্মসূচি সরকার প্রণীত মধ্যমেয়াদি বাজেটারি কাঠামোর সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, চলমান অর্থনৈতিক চাহিদার নিরিখে খাতভিত্তিক বণ্টনের যে অগ্রাধিকার নির্ধারিত হয়েছে তার যৌক্তিকতা কতটুকু সঠিক এবং সর্বোপরি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থ সঠিকভাবে ব্যয়িত হচ্ছে কি না, সময়মতো ব্যয় হচ্ছে কি না এবং সুশাসনের সঙ্গে ব্যয় হচ্ছে কি না, সেসব প্রশ্ন। স্বীকৃত সত্য যে, উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রণীত হলে এবং মানসম্পন্নভাবে বাস্তবায়িত হলে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসে। এটা নিশ্চিত করা গেলে প্রাক্কলিত আর্থিক রিটার্নের নিশ্চয়তা এং উচ্চ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে না এবং ঋণ পরিশোধের দায়ভার অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলেই অর্থনীতি বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে- নাগরিক সুবিধার প্রাপ্যতা কমে যায়, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ অনুৎসাহিত হয়, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা স্তিমিত হয়ে পড়েন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায় এবং এর ফলে অভ্যন্তরীণ রিটার্নের হার, ইকোনমিক রিটার্নের হার এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিটার্নের হার প্রাথমিক প্রাক্কলনের চেয়ে হ্রাস পায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতেই ঋণের টাকা পরিশোধ অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে ওঠে। বৈশ্বিক উন্নয়ন অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এসব কারণে একটা পর্যায়ে কোনো কোনো দেশ ঋণের ফাঁদে (ডেট ট্র্যাপ) পড়ে এবং ফলে একটা সময়ে সেসব দেশ মধ্য আয়ের ফাঁদে (মিডল ইনকাম ট্র্যাপ) আটকে যায়। উন্নয়নের একটা পর্যায়ে উন্নিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে এসব অর্থনীতি দশকের পর দশক এক জায়গায় স্থবির হয়ে থাকে। বাংলাদেশকে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে, যাতে এ ধরনের একটি ভবিষ্যৎ পরিহার করে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা যায়। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতে মোট প্রকল্পের সংখ্যা ১২৫০টি; তার মধ্যে ১১৬৭টি বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ প্রকল্প। যোগাযোগ, শক্তি ও এনার্জি, শিক্ষা, বাসস্থান ও কমিউনিটি  সার্ভিসেস  এবং স্থানীয় সরকার ও গ্রামীণ উন্নয়ন- এই পাঁচ খাতে গেছে মোট এডিপির তিন-চতুর্থাংশ। রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ আছে মোট এডিপির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (১৮.৪  শতাংশ)। অগ্রাধিকারের বিবেচনায় যেসব খাতকে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন তার নিরিখে এডিপিতে খাতভিত্তিক বরাদ্দের প্রস্তাবনার যৌক্তিকতা আছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চলমান চ্যালেঞ্জসমূহের বিবেচনায় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নগতির বর্তমান বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিলে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, বিশেষত যেসব বিনিয়োগে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা তুলনামূলকভাবে বেশি, সে ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হ্রাস টানার প্রয়োজন ছিল। তা করা হয়নি! 

সিপিডির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় বিনিয়োগ প্রকল্পসমূহের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পের মধ্যে একটি বড় অংশ  (৪৭৩টি বা  দুই-পঞ্চমাংশের বেশি প্রকল্প) আগেই সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। মেয়াদকাল বৃদ্ধি করা হয়েছে এমন প্রকল্পের সংখ্যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৬৯, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য দাঁড়িয়েছে ৪২৯-এ। এসব উদ্বর্ত (কেরিওভার) প্রকল্প ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার পর্যালোচিত হয়েছে; এগুলোর পেছনে ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে (কালক্ষেপণ মানেই ব্যয় বৃদ্ধি)। নীতিনির্ধারকরা বারবার এসব ব্যয় বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছেন। এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত বিনিয়োগ প্রকল্পসমূহের গড় বাস্তবায়নকাল ৪.৯ বছর। এক-চতুর্থাংশ প্রকল্পের (২৮৮টি)  বয়স ৬ থেকে ১০ বছর।  ৪৫০টি প্রকল্প এক থেকে চারবার সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে (৩৩৯টি একবার, ৮৪টি দুবার, ১৪টি তিনবার এবং ১টি চারবার)। ৮২০টি প্রকল্পের একটি আলাদা তালিকা রাখা হয়েছে, যেখানে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের শ্লথগতি ও বারবার সময় বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির ওপরে যে নেতিবাচক অভিঘাত পড়ে তা বহুমাত্রিক– প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায়; ঋণ পরিষেবার ব্যয় বাড়ে; প্রাক্কলিত ইতিবাচক ফল প্রাপ্তিতে বিলম্ব হয় এবং আর্থিক ও অর্থনৈতিক রিটার্নের হার হ্রাস পায়। 

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাজেট বাস্তবায়নের শ্লথ অগ্রগতিজনিত সমস্যাসমূহ সাম্প্রতিক সময়কালে প্রকটতর হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৯০.০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছিল। এর পরবর্তী সময়ে এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ হার ছিল ৮২.৬ শতাংশ; ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাজেট বরাদ্দের মাত্র ৫০.০ শতাংশ ব্যয়িত হয়েছে। ২০২৩-২৪-এর জন্য প্রস্তাবিত এডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় বাস্তবায়নের হার হতে হবে ৩০.০ শতাংশের বেশি। এই ব্যতিক্রমী ও উচ্চ বাস্তবায়ন হার অর্জন করার লক্ষ্যে কী কী সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হবে, তার কোনো পথরেখা অবশ্য বাজেটে উল্লেখ করা হয়নি।

এর আগে বলা হয়েছে যে, বাস্তবায়নের এই নিম্ন হারের ফলে পরবর্তী সময়ে ঋণ পরিশোধের দায়ভার বৃদ্ধি পায় এবং এই ক্রমবর্ধমান দায়ভার অর্থনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি করে। তখন আদায়কৃত রাজস্বের একটি বড় অংশই ব্যয় করতে হয় ঋণ পরিশোধে, যা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে তোলে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা ও সুশাসন আজ যেকোনো সময়ের তুলনায় তাই এত বেশি জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। 

পরিকল্পনা কমিশনের অধীনে যে সংস্থাটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেই আইএমইডি (ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুশন ডিভিশিন) তার বিভিন্ন পরিবীক্ষণ ও পর্যালোচনায় এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে। প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়ে চিহ্নিত মূল সমস্যাসমূহের মধ্যে আছে: প্রকল্প বাছাইকালে স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী ও উপকারভোগীদের মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়া; প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক ও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব; প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ক্ষেত্রে পেশাদারত্বের অভাব; প্রকল্প বাছাইয়ের পূর্বে জেলা প্রশাসন থেকে জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক অনুমতি না নেয়া; মধ্যমেয়াদি বাজেটারি কাঠামো কর্তৃক নির্ধারিত সর্বোচ্চ অনুমোদিত আর্থিক সিলিং না মেনে প্রকল্প প্রণয়ন; প্রকল্পের বেসলাইন তথ্য/উপাত্ত সংগ্রহ না করা; প্রকল্পের 'এক্সিট প্ল্যান' সঠিকভাবে প্রণয়ন না করা।

বাস্তবায়ন পর্যায়ে সমস্যার মধ্যে আছে: ডিপিপিতে উল্লিখিত কর্মপরিকল্পনা ও ক্রয় পরিকল্পনা অনুসরণ না করা; বাস্তবায়ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব; প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব; প্রকল্প বাস্তবায়নসংক্রান্ত কমিটির সভা নিয়মিত না হওয়া; সক্ষমতার অভাব আছে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কন্ট্রাক্ট দেয়া; সংশ্লিষ্ট  কন্ট্রাক্টর  কর্তৃক একাধিকবার বাস্তবায়ন সময়কাল দীর্ঘায়িত করার আবেদন; ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন;  একই প্রকল্প পরিচালককে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পণ। 

প্রকল্প বাস্তবায়ন-পরবর্তী পর্যায়ে চিহ্নিত সমস্যার মধ্যে আছে: আইএমইডি কাছে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর নির্ধারিত প্রতিবেদন দাখিল না করা; প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ না রাখা; প্রকল্প বাস্তবায়নের পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সংরক্ষণ ও যথাযথ তত্ত্বাবধান না করা; প্রয়োজনীয় দক্ষ স্থানীয় জনবলের অভাবে বিদেশি কোম্পানির কাছে মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে বাস্তবায়িত প্রকল্পের পরিচালনা হস্তান্তর।
 
এসব সমস্যা ধারাবাহিকভাবে অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে চার লেনের একটি সড়ক (আরবান আর্টারি রোড) নির্মাণে গড় ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি: যেমন- ভারত থেকে ৪.৪ গুণ, তুরস্ক থেকে ৩.৭ গুণ, চীন থেকে ১.৬ গুণ ও পাকিস্তান থেকে ২.১ গুণ। অনেক সময় যুক্তি দেখানো হয় যে, জমি অধিগ্রহণে বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশ থেকে বেশি ব্যয় এবং নদীমাতৃক বাংলাদেশে ব্রিজ-কালভার্টের সংখ্যা অনেক বেশি রাখতে হয়। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে এগুলো অন্যতম কারণ। এসব কিছুকে বিবেচনায় নিলেও বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে ব্যয় যে তুলনামূলকভাবে বেশি, বুয়েটের একটি গবেষণা থেকে তার সত্যতা মেলে। সাম্প্রতিক অতীতে বুয়েট কর্তৃক পরিচালিত এই গবেষণা কার্যক্রমে ব্যয় মূল্যের হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে একটি চার লেনের সড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় (তখনকার হিসাবে) হওয়া উচিত ১২.০ থেকে ১৫.০ কোটি টাকা (১.৪ থেকে ১.৮ মিলিয়ন ডলার)। এর বিপরীতে দেখা যায় যে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ২১.০ কোটি টাকা (২.৪৭ মিলিয়ন ডলার) এবং রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারের জন্য ব্যয় হয়েছে ৫৫.০ কোটি টাকা (৬.৪৭ মিলিয়ন ডলার)। নির্মাণাধীন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ক্ষেত্রে এ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০.০ কোটি টাকা (৭.০৬ মিলিয়ন ডলার)। 

অবশ্য বিষয়টি কেবল সড়কের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের জ্বালানি তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় বৈশ্বিক গড় ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি। যেমন, গ্যাস টারবাইন প্রযুক্তিতে চালিত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয়ের বৈশ্বিক গড় ৫৫১.০ ডলার, যেখানে বাংলাদেশের সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় ১১৭৭.০ ডলার আর বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ব্যয় ৮১৯.০ ডলার। 

যদিও এ কথা ঠিক, সাম্প্রতিক সময়ে ডিপিপি ফরমেটের উন্নত সংস্করণ প্রস্তুত করা হয়েছে; একই সরকারি কর্মকর্তা যাতে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে না থাকেন এবং প্রকল্প পরিচালক যাতে ঘন ঘন পরিবর্তন না হয়, সে জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ যাতে ডিপিপি প্রণয়নের সঙ্গে সমান্তরালভাবে পরিচালনা করা যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রকৃত তথ্য উদঘাটনকে প্রণোদিত করার লক্ষ্যে ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন প্রণীত হয়েছে। অর্থ ছাড়ের জটিলতা নিরসনে নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। আইএমইডি কর্তৃক বাইরের পরামর্শক নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত পরিস্থিতির অবনমন হয়েছে। 

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, উন্নত (ওইসিডিভুক্ত) দেশসমূহ অবকাঠামো বিনিয়োগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সরকারি বিনিয়োগের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কাঠামো প্রস্তুত করেছে এবং এই কাঠামো অনুসরণ করে সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ কাঠামোতে ১০টি স্তম্ভ আছে: যেমন- অবকাঠামো নির্মাণে কৌশলগত অভীষ্ট নির্ধারণ; অবকাঠামো নির্মাণের প্রাধিকার নির্ধারণ; সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায় ও বিভাগের মধ্যে কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয় বিধান; বিনিয়োগ কার্যক্রমে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; সম্ভাব্য বিভিন্ন উপকারভোগী গ্রুপের সঙ্গে মতবিনিময়ের ও তাদের বিনিয়োগ কর্মকাণ্ডের পরিবীক্ষণ কাজে সংশ্লিষ্ট করার কাঠামো; ‘গুড ভেল্যু ফর মানি’ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রকল্পসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ; বিনিয়োগকে টেকসই করার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রতিটি পিলারে তিনটি প্রশ্নসাপেক্ষে বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগের মান উন্নত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন তিনটি হলো- সংশ্লিষ্ট পিলারটি কেন অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ; পিলারের সঙ্গে সম্পর্কিত নীতিমান্যতার মূল বিষয়সমূহ কী; এবং সংশ্লিষ্ট পিলারের নিরিখে বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত সূচকসমূহ কী। এ সুশাসন কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক ৪৭টি সূচকের মাধ্যমে উল্লিখিত ১০টি পিলারের প্রেক্ষিতে বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন ও মানগত উৎকর্ষের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। এসব সূচক প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল্যায়নেও সহায়তা করে। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশেও এ ধরনের একটি ‘সুশাসন ফ্রেমওয়ার্ক’ বা ’সুশাসন কাঠামো’ প্রস্তুত করতে উদ্যোগ নিতে পারে এবং এ কাঠামোর নিরিখে সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। 

অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার একটি বড় কারণ বাস্তবায়নকালে আইনি জটিলতার সৃষ্টি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আইনি লড়াই পরিচালনার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই পরামর্শক আইনজীবীদের সহায়তা নেয়া হয়ে থাকে, যা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে এসব মামলা দীর্ঘায়িত হয়, ফলে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। এ সমস্যার প্রশমনে বৃহৎ আকারের সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়সমূহের নিজস্ব আইন ক্যাডার গড়ে তোলার কথা ভাবা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় প্রতিবছর যে ‘বার্ষিক পারফরমেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এপিএ) স্বাক্ষর করে থাকে, সে প্রক্রিয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ইস্যুকে কার্যকরভাবে সংশ্লিষ্ট করার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারি কর্মকর্তাদের প্রণোদনা ও পদোন্নয়নের সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতার বিষয়টিকে কার্যকরভাবে যুক্ত করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

আইএমইডি কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন পর্যালোচনার আলোকে যেসব পরামর্শ উঠে এসেছে, তা বিবেচনা ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। আইএমইডি কার্যক্রমকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার এখন সময় এসেছে বলে মনে হয়। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের জনবল ও দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন, প্রয়োজন নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং ল্যাবটেস্টিং সক্ষমতা বৃদ্ধি। আইএমইডির কর্মকাণ্ডে সচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তির ব্যবহার শক্তিশালী করতে পারলে প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা ও মান বৃদ্ধি পাবে এবং সাশ্রয়ীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। অন্যান্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, তার মধ্যে আছে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের তাদের স্ব-স্ব এলাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকরভাবে যুক্ত করা; বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা; স্থানীয় সরকারের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; প্রকল্পের উপকারভোগী জনগোষ্ঠীকে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যবেক্ষণ-প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান ও এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও নীতিমালা প্রণয়ন।

প্রারম্ভিক মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জসমূহের নিরিখে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মান উন্নীত করা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, এক টাকা বাড়তি আয় ও এক টাকা ব্যয় সাশ্রয় শেষ বিচারে একই কথা। এটা ব্যক্তির জন্য যেমন সত্য, সরকারের জন্যও। আগামীতে বাংলাদেশের উন্নয়ন-চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে; জনগণের করের টাকায় বাস্তবায়ন করা সরকারি বিনিয়োগও সমান্তরালভাবে বাড়বে। বিনিয়োগ কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, প্রকল্পের মানসম্মন্ন বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সকল পর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিত করার ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে দ্বৈত উত্তরণকালীন (মধ্য আয় ও এলডিসি গ্রাজুয়েশন) বাংলাদেশের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষার টেকসই বাস্তবায়ন, ঋণের ফাঁদ এড়িয়ে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে অব্যাহত যাত্রা, এসডিজির অভীষ্ট ও লক্ষ্যসমূহের বাস্তবায়ন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।

লেখক: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো

সীমান্তের কাঁটাতার ও মৃত্যুর মিছিল

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৪, ১১:২৬ এএম
সীমান্তের কাঁটাতার ও মৃত্যুর মিছিল
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

‘উন্নতি’ যে আমাদের বিপদে ফেলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই উন্নতিতে অনেকটা গাড়ির নিচে পড়ার দশা। আর আমাদের নদীগুলোর পক্ষে বেঁচে থাকাটা ক্রমাগত কঠিন হয়ে পড়ছে। জলাশয়ের সংখ্যা কমছে প্রতিদিন। জরিপ বলছে, গত ২৮ বছরে ঢাকা শহরে জলাশয় কমেছে ৮৫ শতাংশ; সবুজ এলাকা সঙ্কুচিত ৪৫ শতাংশ। এদের বিপরীতে নির্মাণ এলাকা বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। আর দেশের মানুষ? নতুন দরিদ্রের সংখ্যা তো ক্রমবর্ধমান।

ধরা যাক ফেলানীর কথা। ফেলানীকে ভুলে যাওয়া সহজ, কিন্তু ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। ফেলানী কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নয়, অতিসামান্য একজন কিশোরী। কিন্তু ফেলানী একজন নয়, অনেকজন- যাদের বসবাস বাংলাদেশের সীমান্তে। ফেলানী মারা গেছে ওই সীমান্তেই, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে, অমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে এবং ঘটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফেলানীর মৃত্যুকে ভুলে যাওয়াটা আবার সহজও নয় এবং ঠিকও নয়। কেননা তার মৃত্যু একটি প্রতীকী ঘটনা বটে। ঘটনাটা সেভাবেই দেখা হয়েছিল যখন তার মৃত্যু ঘটে, কয়েক বছর আগে ২০১১ সালে। ফেলানী প্রতীক- স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবনে স্বাধীনতার অভাবের এবং একই সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের ভেতরে তৈরি হওয়া ফারাকেরও। ঘটনার পরে গণমাধ্যমে যখন হতভাগী ফেলানীর ছবি বের হয়েছে সীমান্তবর্তী কাঁটাতারের বেড়াতে ঝুলন্ত অবস্থায়, আমরা তখন চমকে উঠেছিলাম এবং ঘটনাটি নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। ফেলানীর মৃত্যুর প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে কবিতাও রচিত হয়েছে। 

কিন্তু তাকে তো আমরা আবার মনেও রাখিনি। না রাখার অনেক কারণ। একটা হচ্ছে অমন ঘটনা বিরল নয়, ব্যতিক্রমও নয়। তা ছাড়া আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে উদয়াস্ত ভীষণ ব্যস্ত থাকি। এত ব্যস্ত যে, অন্য কিছু নিয়ে ভাবার ফুরসতই পাই না। 

ফেলানীকে ভুলে যাওয়ার আরও একটি কারণ অবশ্য রয়েছে। সেটা হলো- কিশোরী মেয়েটি একেবারেই প্রান্তিক অবস্থানে ছিল। পারিবারিকভাবে ফেলানীরা দারিদ্র্যসীমার প্রান্তবর্তী মানুষ। আবার ভৌগোলিক দিক থেকেও ফেলানীরা থাকে বাংলাদেশের একেবারে শেষ প্রান্তে; উত্তর দিকের সীমান্তে। এলাকাটি দুর্গম। নিতান্ত বাধ্য না হলে বাইরের মানুষ ওদিকে পা বাড়ায় না। ফেলানীরাও বাইরের জগতের খবর রাখে না। তাদের বসবাসের জায়গাটিতে রাস্তাঘাট নেই, বিদ্যুৎও পৌঁছায়নি। ছেলেরা তবু কেউ কেউ বাইরে ছুটে যায় জীবিকার সন্ধানে; মেয়েরা সেটাও পারে না, ব্যতিক্রম ছাড়া। 

ফেলানীরা আদতে এপারেরই মানুষ। বংশানুক্রমে এপারেই ছিল বসবাস। কাজের খোঁজে ফেলানীর মা ওপারে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল ফেলানী। ফেলানী নিজে এপারে আসতে চেয়েছিল- কাজের খোঁজে নয়, পাত্রের খোঁজে। তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পাত্র আর কোথায় পাওয়া যাবে? আপন খালাতো ভাই-ই পাত্র। এপারে থাকে। ফেলানী সীমান্ত পার হবে কী করে? কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন যে রাষ্ট্র, বৃহৎ ভারত, তার কর্তারা। ওই বেড়া ডিঙানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাতের অন্ধকারে বেআইনিভাবে ফেলানী মই বেয়ে উঠছিল, এপারে আসবে বলে। ওপারের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী সেটা দেখতে পায় এবং গুলি করে। পায়ে নয়, বুকে। ফেলানীর বুক ঝাঁজরা হয়ে গেছে। সে আর্তনাদ করেছে; পানি পানি বলে আওয়াজ দিয়েছে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বেঁচে ছিল তিন ঘণ্টা; তারপরে মৃত্যু। কারা যেন তার মৃতদেহটি ঝুলিয়ে রেখেছিল কাঁটাতারের বেড়াতে। অত্যন্ত দৃশ্যমান করে। 

কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় সীমান্ত এলাকার এই পাঁচটি জেলায় ফেলানীদের বসবাস। এরা একেবারেই প্রান্তিক মানুষ। ভৌগোলিকভাবে যেমন, তেমনি অর্থনৈতিক বন্দোবস্তে। দরিদ্র এবং উপেক্ষিত। স্বাধীনতা এদের জন্য মুক্তি তো দূরের কথা, চলাফেরার স্বাধীনতাটুকুও আনেনি। জীবনযাপন, শিক্ষা, চিকিৎসা- কোনো ক্ষেত্রে ওরা স্বাধীন নয়। প্রান্তিক এলাকা সব সময়ই পশ্চাৎপদ থাকে। এই জেলাগুলোও আগে থেকে পিছিয়ে পড়া অবস্থাতেই ছিল। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা আকস্মিক বজ্রপাতের মতোই এসে পড়েছে একেবারে ঘাড়ের ওপরে। 

খড়গের কোপের সঙ্গে তুলনা করাটাও বোধ হয় অন্যায় হবে না। ওই স্বাধীনতা অসংখ্য মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে; এপারের ঘরবাড়ি, জায়গাজমি, ব্যবসা-পেশা, আত্মীয়স্বজন- সবকিছু ফেলে তারা ওপারে চলে গেছে। একইভাবে ওপার থেকেও এপারে এসেছে মানুষ, নিঃস্ব হয়ে। প্রথম দিকে তাও চলাফেরার স্বাধীনতা কিছুটা ছিল; পাসপোর্ট-ভিসা লাগত না। জীবিকার খোঁজে মানুষ দূর-দূরান্তে চলে যেতে পারত। দিল্লি, কেরালা, বোম্বাইতে যেত, যেত আসামেও। সেসব জায়গায় গিয়ে মেহনত করত অমানুষিক; কিন্তু তবু যেত। কারণ উপার্জন হতো এবং উপার্জনের টাকা দেশে পাঠাতে পারত। পরে সেই যাতায়াত ক্রমাগত কঠিন হয়ে পড়ল। সীমান্তে প্রথমে পোঁতা হয়েছিল খুঁটি, পরে এল পাহারা-চৌকি, তারপরে বেড়া। এখন এসেছে কাঁটাতারের বেষ্টনী, যেটা পার হতে গেলে ফেলানীর মতো মানুষদের প্রাণ দিতে হয়। 

ওই এলাকাতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তরেখা এমনই অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তবিক যে, কারও শোবার ঘর যদি পড়েছে পাকিস্তানে, তবে রান্নাঘর হয়তো রয়ে গেছে ভারতে। এলাকাতে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে পারেনি, বিদ্যুতের খুঁটি পুঁততে গেলে ভারতের সীমান্তরক্ষীরা আপত্তি করে, বলে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। রাতের বেলা প্রাকৃতিক প্রয়োজনে কেউ যদি ঘরের বাইরে যায় এবং সে জন্য টর্চলাইট কিংবা হারিকেন জ্বালায়, তাহলে ওপার থেকে হুংকার তো আসবেই, গুলি আসারও শঙ্কা থাকে। এলাকার ভেতরে যে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করবে মানুষজন, তারও সুযোগ সীমিত। রাস্তাঘাট নেই। 

পাকা সড়ক তৈরি করা যায় না, ওপারের সীমান্তরক্ষীরা বাধা দেয়। বলে বিশ্বাস নেই, খোঁড়াখুঁড়ির সুযোগ নিয়ে হয়তো বাংকারই বানিয়ে ফেলবে। সেটা তো হবে ভারতের নিরাপত্তার জন্য মস্ত বড় হুমকি। চলাফেরা তাই প্রাগৈতিহাসিক কাঁচা পথেই। ভয়ানক বিপদ ঘটে বর্ষা এলে। পায়ে হাঁটার কাঁচা পথ পানিতে ডুবে যায়। কোথাও কোথাও তিন মাস ধরে পানির তলাতেই পড়ে থাকে এবং তারপর পানি যখন সরে যায় তখন এমন কাদা তৈরি করে রেখে যায় যে, হাঁটতে গেলে পা দেবে যাওয়াটা হয় অবধারিত। অনেক এলাকাতেই ডাক্তার বলে কেউ নেই। গুরুতর অসুস্থ মানুষকে দূরবর্তী হাসপাতালে যে নিয়ে যাওয়া হবে, তেমন কোনো যানবাহনও পাওয়া যায় না। খুঁজতে হয় ভ্যানগাড়ি, যা পেতে অনেকটা সময় লাগে এবং নিতে শুধু কষ্টই হয় না, রোগীর প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটে যায়। 

আটকে পড়া এই অসহায় মানুষেরা তাদের জীবনের সমস্যাগুলো ঠিকই জানেন। কর্মসংস্থান যে প্রধান সমস্যা, সেটা খুব ভালোভাবেই জানেন। এবং এটাও জানেন যে তাদের দেখার কেউ নেই। তারা সুখ আশা করেন না, স্বস্তি পেলেই সন্তুষ্ট থাকবেন; কিন্তু সেটা তারা পান না। তাদের তো নয়ই, তাদের গৃহপালিত গরু-ছাগলগুলোও নিরাপদে নেই। মানুষ তো তবু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চেনে, গরু-ছাগল তো সেটা চেনে না। তারা ওপারে চলে যায় এবং গেলে মানুষের তুলনায় তারা কম বিপদে পড়ে না। 

নেপালের বর্ডারে বিএসএফের গুলিতে একটা মানুষ মারা গেলে ইন্ডিয়া তার জন্য ক্ষমা চায়, পাকিস্তানের বর্ডারেও পারে না। আর বাংলাদেশের বর্ডারে পাখির মতো মানুষ মারছে। তার জন্য কিছু হয় না। সরকারের এমন দুর্বল অবস্থান দেখে সীমান্তের মানুষ অসহায় ফিল করে।

ভারত বাংলাদেশের নিকটতম ও ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী। বাংলাদেশ যে তার স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয় লাভ করেছে, তার পেছনে ভারতের যে সাহায্য ও সহযোগিতা, সেটি অতুলনীয়। দুই দেশ একসময়ে এক ছিল, অখণ্ড ছিল; স্বাধীন হতে গিয়ে ভাগ হয়েছে। সেসব তো ঘটেই গেছে। এখন যা প্রত্যাশিত সেটা হলো, দুই দেশের মধ্যে যথার্থ বন্ধুত্ব। সীমান্তের মানুষদের জন্য এটা সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক পরিমাণে প্রয়োজন। আর বন্ধুত্বের জন্য আবশ্যক হচ্ছে সমতা। 

ছোটর সঙ্গে বড়র যে বন্ধুত্ব- সেটাতে ফাঁক থেকে যায়; বিশেষ করে বড় যদি নিজেকে সব সময়ই বড় মনে করে। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই বড়-ছোটর বোধটা দূর করা চাই। ভারত সব দিক দিয়েই বাংলাদেশের তুলনায় বড়, এমনকি ভৌগোলিক অবস্থানেও রয়েছে সে উঁচুতে। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভারত তার সীমান্ত খুলে দিয়েছিল। সেটা সম্ভব হয়েছিল এই জন্য যে রাজনৈতিকভাবে ভারত তখন নিজেকে উঁচুতে তুলে রাখেনি, মানবিক সহমর্মিতায় বাংলাদেশের মানুষের অত্যন্ত কাছে চলে এসেছিল। তখনকার সম্পর্কটা যে এখন আর নেই, তার সবচেয়ে পরিষ্কার প্রমাণ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া এবং ফেলানীর ঝুলন্ত মৃত্যু। 

ওই বেড়া তুলে ফেলার এবং সীমান্তে মৃত্যুর যে আয়োজন, তার অবসান ঘটানো দরকার। দুই দেশের সীমান্ত সম্পর্ক হওয়া প্রয়োজন ঠিক তেমন- যেমনটা রয়েছে ইউরোপের অনেক দেশের মধ্যে, আছে উত্তর আমেরিকা ও কানাডার মধ্যেও। এটা ঘটলে দুই পক্ষেরই উপকার। চোরাচালান, হুন্ডিতে টাকা পাচার, সেনা পাহারায় খরচ, সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা এবং বন্ধুত্বের ভেতরকার বিদ্যমান ফাঁক- সবই দূর হবে। অপচয় কমবে, বাড়বে স্বস্তি ও শান্তি। উৎপাদন ও বিনিময় উভয় ক্ষেত্রেই উত্তরণ ঘটবে অসামান্য। 

দুর্ভোগটা মানবিক, কিন্তু সমস্যাটা পুরোপুরি রাজনৈতিক। আর এই রাজনীতিতে কর্তৃত্ব চলছে পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদ বন্ধুত্ব চায় না, মানবিকতার ধার ধারে না; পুঁজিবাদের চোখ একটা জিনিসের ওপরই- যার নাম মুনাফা। ভারতের বর্তমান শাসকরা যে পুঁজিবাদে অসংশোধনীয় রূপে দীক্ষিত, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাদের আচরণ নিজেদের দেশের ভেতরে যেমন, আন্তর্জাতিক সীমান্তেও তেমনি। পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক এবং মানবিক বিবেচনা থেকে বিচ্যুত। ভারতের সাধারণ মানুষ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মেনে নিতে প্রস্তুত নন। তারা এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। তাদের সেই সংগ্রামে জয়যুক্তির ওপর বহু কিছু নির্ভর করছে- নির্ভর করছে ফেলানীদের ভবিষ্যৎও।

সীমান্তবাসী আটকে পড়া মানুষদের কথা কেউ ভাবে না। ভাবার কথা প্রথমত রাষ্ট্রেরই। রাষ্ট্র উদ্যোগ না নিলে মানুষের ভাগ্য বদলাবে না, স্বাধীন দেশে বসবাস করেও মানুষ মুক্তি পাবে না এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথার্থ বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

ফাইব্রোমায়ালজিয়া: একটি অবহেলিত রোগের ইতিবৃত্ত

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৪, ১১:২০ এএম
ফাইব্রোমায়ালজিয়া: একটি অবহেলিত রোগের ইতিবৃত্ত
এ কে এম আখতারুজ্জামান

আজ মে মাসের ১২ তারিখ। প্রতিবছর এই দিনটি ফাইব্রোমায়ালজিয়া সচেতনতা দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে থাকে। ফাইব্রোমায়ালজিয়া শব্দটি শুনলে অনেকের কাছে নতুন একটি রোগের নাম মনে হতে পারে। কিন্তু এই রোগটির উপসর্গের সঙ্গে অনেক মানুষই পরিচিত। যেমন- শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা হওয়া, দুর্বলতা, ঘুমহীনতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়াসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা। তাই সহজেই অনুমেয়, ফাইব্রোমায়ালজিয়া কোনো নতুন রোগ নয়। আর বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এই রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালমুখী হচ্ছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফাইব্রোমায়ালজিয়া একটি মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচিত হতো। পরে ১৯০৪ সালে গাওয়ার নামের একজন চিকিৎসক সর্বপ্রথম ফাইব্রোসাইটিস শব্দটি ব্যবহার করেন, যা ১৯৭৬ সালে ফাইব্রোমায়ালজিয়া নামে পরিচিতি পায়।  

ফাইব্রোমায়ালজিয়া একটি জটিল, দীর্ঘস্থায়ী এবং যন্ত্রণাদায়ক রোগ। ফাইব্রোমায়ালজিয়ার কারণে শরীরের সব পেশি আক্রান্ত হয়। ফলে শরীরের পেশি, টেন্ডন এবং লিগামেন্টে টান সৃষ্টি করে, যা আমাদের ব্রেনের স্নায়ুকে উত্তেজিত করে এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা অনুভব করায়। ফাইব্রোমায়ালজিয়ার ব্যথাটি শরীরে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে যায় এবং এই রোগী সাধারণত যন্ত্রণার প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয়।

ফাইব্রোমায়ালজিয়া কাদের হয়ে থাকে

সাধারণত দেখা যায়, ফাইব্রোমায়ালজিয়াতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই রোগটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ৬.৪ শতাংশ লোকের হয়ে থাকে এবং নারীদের মধ্যে তার পরিমাণ ৭.৭ শতাংশ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গড়ে শতকরা ৩.৬ জনের ফাইব্রোমায়ালজিয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে নারীদের ৬.২ শতাংশ আর পুরুষের হার ০.৯ শতাংশ।

কী কী লক্ষণ হলে ফাইব্রোমায়ালজিয়া বোঝা যাবে?

সাধারণত ফাইব্রোমায়ালজিয়ার লক্ষণ হলো-

(১) শরীরজুড়ে ব্যথা, বিশেষ করে মাংসপেশি ও হাড়ে ব্যথা

(২) ক্লান্তি বা দুর্বলতা 

(৩) ঘুমের ব্যাঘাত বা ঘুমহীনতা 

(৪) শারীরিক পরিশ্রম বা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে অনাগ্রহ

(৫) স্মরণশক্তি কমে যাওয়া

(৬) ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভোগা

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার উপসর্গ কী কী?

ফাইব্রোমায়ালজিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের প্রধান উপসর্গগুলো হলো-

১. দীর্ঘস্থায়ী ও পুরো শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা হওয়া।

২. শরীরে জ্বালাপোড়া বা কাঁপুনি অনুভব করা।

৩. তীব্র ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা।

৪. ঘুমে ব্যাঘাত ঘটা বা ঘুমহীনতা।

এ ছাড়া আরও কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন-

১. মাংসপেশি এবং জয়েন্টগুলোয় টান লাগা।

২. শরীরে স্পর্শ করলেই টান লাগা বা ব্যথা অনুভব করা।

৩. হাতে ও পায়ে অবশ অনুভব হওয়া।

৪. মনোযোগ, চিন্তাশক্তিতে ব্যাঘাত ঘটে। এমনকি স্মৃতিশক্তিতেও প্রভাব ফেলে এবং রোগীর মধ্যে স্মরণশক্তি কমে যাওয়া ও ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।

৫. আলো, শব্দ, গন্ধ তাপমাত্রার প্রতি অতিরিক্ত মাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে যাওয়া।

৬. হজম ক্রিয়ায় সমস্যা হয়। যেমন- পেট ফুলে থাকা  বা কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া।

৭. ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভোগা।

ফাইব্রোমায়ালজিয়া কেন হয়?

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব আর্থ্রাইটিস অ্যান্ড মাস্কুলোস্কেলেটাল অ্যান্ড স্কিন ডিজিজের গবেষকদের মতে, ফাইব্রোমায়ালজিয়া হওয়ার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে কোনো ট্রমা বা দুর্ঘটনা, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া, মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং অন্য কোনো রোগ বা অসুস্থতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

কিছু গবেষকের মতে, এতে বংশগতির প্রভাবও থাকতে পারে। শরীরের কোনো জিনের জন্য যেগুলো সেরেটোনিন, ডোপামিন এবং ক্যাটাকোলামিন নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত বা জিন মিউটেশনের কারণে হতে পারে। তবে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার ব্যথা কখন বেশি হয়?

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার ব্যথাটি সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায় বেশি অনুভব হয়। তবে অনেকের ক্ষেত্রে সারা দিনও ব্যথা অনুভব হয়ে থাকতে পারে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা গরমে, অস্থিরতা, বিষণ্নতা বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করলেও ব্যথা অনুভব হতে পারে।

ফাইব্রোমায়ালজিয়া কীভাবে নির্ণয় করা হয়?

ফাইব্রোমায়ালজিয়া নির্ণয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। সাধারণত এ ধরনের রোগীর ব্যথার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেস্টগুলো স্বাভাবিক হয়ে থাকে। মূলত রোগটি রোগীর শারীরিক উপসর্গ, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা এবং কিছু ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা নির্ণয় করা হয়।

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?

ফাইব্রোমায়ালজিয়া রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা, উপসর্গ কী কী আছে এবং উপসর্গের তীব্রতার ওপর। যদিও এটি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়, কিন্তু উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। উপসর্গের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের জন্য মূলত একজন ব্যথা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। 

চিকিৎসার জন্য যা যা করা যেতে পারে-

#ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া। যেমন- ব্যথা হলে ব্যথানাশক ওষুধ সময়মতো খাওয়া। উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্ণয় করা হয়। 

#ইন্ট্রাভেনাস ড্রাগ চ্যালেঞ্জেস- এ রোগের একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি।

# ব্যায়াম ও ফিজিক্যাল থেরাপি।

# বিষণ্নতা ও অস্থিরতার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা।

# রিলাক্সেশন বা শিথিলায়ন পদ্ধতি খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে।

# প্রয়োজন অনুযায়ী ঠাণ্ডা বা গরম সেক।

# শরীরে ম্যাসাজ করা। 

সাইকো থেরাপি, যেমন- কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি এবং বিহেভিয়ার মেডিসিন থেরাপি খুব কার্যকর এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য।

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার রোগীদের করণীয়-

একজন ফাইব্রোমায়ালজিয়ায় আক্রান্ত রোগীর জন্য নিম্নলিখিত অভ্যাস বা নিয়মকানুন মেনে চলা প্রয়োজন-

১. প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ লবণ, মিনারেল, স্নেহসমৃদ্ধ খাবার রাখা।

২. ফাস্টফুড বা কোমল পানীয় যথাসম্ভব পরিহার করা।

৩. অধিক চিনি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার না খাওয়া।

৪. পরিমিত পরিমাণ আমিষজাতীয় খাবার খেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে প্রাণিজ আমিষের ক্ষেত্রে মাংসের তুলনায় মাছকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

৫. ওমেগা-৩ অ্যাসিডসমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে, যা শরীরের জন্য খুব উপকারী।

৬. ম্যাগনেশিয়াম-সমৃদ্ধ শাকসবজি যেমন- পালংশাক, লেটুস পাতা খেতে হবে। কারণ এটি ফাইব্রোমায়ালজিয়া নিরাময়ে ভূমিকা রাখে।

৭. পেঁয়াজ, রসুন, বাঁধাকপি, শসা, কমলালেবু এবং আপেল, যাতে রয়েছে সেলেনিয়াম- যা এই রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।

৮. ঘন ঘন পানি পান করতে হবে। দৈনিক কমপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করা অত্যাবশ্যক।

৯. চা-কফি এবং অ্যালকোহল-জাতীয় পানীয় পরিহার করা। কারণ এগুলো রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে।

১০. পরিমিত পরিমাণে লবণ খাওয়া। পাশাপাশি সোডিয়ামসমৃদ্ধ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য না খাওয়া।

লেখক: অধ্যাপক, পেইন মেডিসিন ইউনিট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও চিফ কনসালট্যান্ট, ঢাকা পেইন ম্যানেজমেন্ট সেন্টার 
[email protected] 

আকস্মিক বন্যা, জলাবদ্ধতা ও জলশূন্যতা: প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১১:২৮ এএম
আকস্মিক বন্যা, জলাবদ্ধতা ও জলশূন্যতা: প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম
ড. তোফায়েল আহমেদ

এপ্রিল ২০২৪ ছিল বিশ্বব্যাপী উত্তপ্ত মাস। সারা দেশ এপ্রিলের কয়েক সপ্তাহ তীব্র দাবদাহে পুড়ছিল। চট্টগ্রামও তার ব্যতিক্রম ছিল না। চলতি মাসের ৬ তারিখ ঝুমবৃষ্টি নামে। মানুষ বৃষ্টিসিক্ত হয়েও আনন্দের হাসি হাসে, কিন্তু পরক্ষণে তা বিষাদে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের আবহাওয়া অধিদপ্তর ৫ তারিখ রবিবার বিকেল ৪টা থেকে সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। এর মধ্যে রবিবারে বিকেলের এক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে মহানগরীর একটা বড় অংশ ডুবে যায়। ওই এলাকাগুলোর মধ্যে পাঁচলাইশ, প্রবর্তক মোড়, ২ নন্বর গেট, মুরাদপুর, শুল্কবহর, কাতালগঞ্জ, মির্জাপুল, ডিসি রোড, ওয়াসা মোড়, তিন পোলের মাথা, আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ এলাকা, চকবাজার ও বহদ্দারহাট অন্যতম। পানি সরতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়।

২০০৭ সালের ১২ জুন দিনটিকে অতিবৃষ্টিজনিত পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ি ধসে শতাধিক আদম সন্তানের মৃত্যুর কারণে ঐতিহাসিক ‘চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি’ নামে অভিহিত করা হয়। এ দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রামের আকস্মিক বন্যা এবং জলাবদ্ধতা নিয়ে শুরু হয় নানামুখী চিন্তাভাবনা। ওই সময়ে আমি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করি, যার শিরোনাম ‘চট্টগ্রামের বিপর্যয় ও উন্নয়ন: একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার রূপরেখা’। এ প্রবন্ধ সে সময় দৈনিক পূর্বকোণ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করে। পরবর্তীতে ওই রচনার সঙ্গে পানি, জমি, বন্যা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে আরও চারটি রচনা ২০১১ সালে প্রকাশিত আমার ‘বৃত্ত ও বৃত্তান্ত’ বইটিতে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়।

সর্বশেষ গত ৪ মে (২০২৪) দৈনিক খবরের কাগজে ‘প্রচণ্ড দাবদাহ ও অত্যাসন্ন বন্যা: কার কী প্রস্তুতি’ শীর্ষক আর একটি রচনা প্রকাশ করি। এ ভূমিকাটুকু এ কারণে লিখলাম যাতে কোনো অনুসন্ধানী পাঠক এবং নীতিনির্ধারক-প্রশাসক ইচ্ছা করলে এ বিষয়ের নানা লেখা ও বলা কথাগুলোর একটি ধারাবাহিকতা দেখতে পারেন। চট্টগ্রামের পানি, পরিবেশ ও সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চট্টগ্রাম শহর তার আশপাশের নদনদী খাল-ছড়া, পাহাড়, কৃষি, আবাসন, হালদা-কর্ণফুলীর নাব্য, পানির স্তর ও পানির প্রবাহ এসবকে পাশ কাটিয়ে করলে তা মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হওয়ার নয়। তাই একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়েছিলাম। যেখানে চট্টগ্রাম মহানগরী, উত্তর-দক্ষিণের বিস্তৃত পাহাড় (যা পুবে পাঁচলাইশ, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি এবং পাহড়ের পশ্চিমে সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলা এবং পূর্ব ও দক্ষিণের বিশেষত রাঙ্গুনিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর পাহাড়) পাহাড়ি ছড়া-ঝরনা, নগরীর সীমার মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ খাল-নালা এবং এসব খাল নালার আউট পল হালদা কর্ণফুলীকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

তা ছাড়া কর্ণফুলী ও হালদার জোয়ার-ভাটা পানির প্রবাহ, নদীর বেড বা তলা, পলি স্তর স্টাডি করে মহানগরী ও অন্যান্য খালে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে স্লুইসগেট-রেগুলেটরগুলোর ডিজাইন সাযুজ্য রাখতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক প্রেক্ষিত পরিকল্পনা দূরে থাকুক, মহানগরীর হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগুলো সাধারণ সম্ভাব্যতা যাচাই (Feasibility study) ছাড়াই করে ফেলা হয়েছে বলে একটি প্রকল্প সভায় আলোচনা হয়। এটি একটি বিস্ময়ের ব্যাপার।

এখন গত ১৫ বছরে হালদা-কর্ণফুলী দিয়ে বলা যাচ্ছে না, ‘অনেক জল গড়িয়েছে’ বলতে হয় ‘জল গড়ানো হ্রাস পেয়েছে’। পাহাড়ি ছড়া-ঝরনাগুলো শীর্ণকায় বা সম্পূর্ণ শুকিয়েছে। বর্ষায় কাটা পাহাড়ের বালির স্রোত নগরীর খালগুলো দিয়েই পুনঃ পুনঃ প্রবাহিত হবে। শহরকেন্দ্রিক খাল খননের হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নানা যৌক্তিক-অযৌক্তিক কারণে বিলম্বিত হলেও গড়পড়তা প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রাজউক, সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড- এ চার সংস্থা একক ও যৌথভাবে চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে মহানগরীর ৩৬টি খাল খনন, প্রশস্তকরণ, পার্শ্ব সুরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ, খালের পাশে সড়ক, খালের ওপর সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ করছে।’

চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক দিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫৬১৬.৪৯ কোটি টাকা। ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৩৫৪৩.৪৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৭-২০২৩। কাজের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। এ প্রকল্প করার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। দ্বিতীয় প্রকল্পটি সিটি করপোরেশনের, বহদ্দারহাট-বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন। সময়কাল ২০১৭-২০২৪, প্রাক্কলিত ব্যয় ১৩৬২.৬২ টাকা, জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত ছাড় হয়েছে প্রায় ১৭২ কেটি টাকা এবং কাজের অগ্রগতি প্রায় ৫৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্ণফুলীর তীর বরাবর কালুরঘাট ব্রিজ থেকে চাক্তাই পর্যন্ত সড়ক প্রকল্পের সময়কাল ২০১৭-২০২৪। প্রক্কলিত ব্যয় ২৭৭৯.৩৯ কোটি টাকা এবং ছাড় হয়েছে ১২৯১.২৮ কোটি টাকা, আর কাজের অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। চতুর্থ প্রকল্প সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা, জলমগ্নতা ও পানি নিষ্কাশন, প্রাক্কলিত অর্থ ১৬২০.৭৩ কোটি টাকা, মেয়াদকাল ২০১৮-২০২৪।

২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ২৩৬ কোটি টাকা। অগ্রগতি ২৫ শতাংশ। এসব বর্ণনা একটি গতানুগতিক প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন। প্রশ্ন এখানে অনেক আসতে পারে। যেমন সব প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪-এর জুনে শেষ। তাহলে এখানে অর্থ ব্যয় ও ভৌত কাজের অগ্রগতি কী বার্তা দেয়, বরাদ্দ ও ছাড়কৃত অথের্র সঙ্গে কাজের ভৌত অগ্রগতির সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। কম বরাদ্দ পেয়েও ভৌত কাজের অগ্রগতি অনেক বেশি। তাতে দুটো বিষয় থাকতে পারে। এক. প্রাক্কলন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ছিল। দুই. কাজের মানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) চ্যানেলের নাব্যতার স্বার্থে কর্ণফুলী ও মোহনায় নিয়মিত হাইড্রোলজিক্যাল জরিপ এবং নিয়মিত ড্রেজিং করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড পানিপ্রবাহ, উচ্চ ও নিম্ন প্রবাহের তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণ করে। চবক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যের সঙ্গে মহানগরীর ৩৬টি খালের বর্ষাকলীন ও শুষ্ক মৌসুমের পানির প্রবাহের পরিমাপ করে পানির নানা কাঠামো অবকাঠামো নির্মাণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। যদি না হয় তাহলে সাধারণ জোয়ার-ভাটা, ভরা বর্ষার বাড়ন্ত জোয়ার এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জলস্তরের উচ্চায়ন প্রভৃতির সঙ্গে এ খাল খনন, ব্রিজ-কালভার্ট ও রেগুলেটর কীভাবে সম্পর্কিত হবে।

মহানগরীর বাইরের জল সম্পদ বা জলপ্রবাহকে একটি ‘আপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে সব প্রকল্প রচনা হয়েছে। বৃষ্টির পানি আকস্মিক বন্যা বইয়ে দেয়, জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। সুতরাং এটি একটি আপদ। এটি একটি মহাভ্রান্ত ধারণা। প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ একটি মূল্যবান সম্পদ, যা আপনি বিনামূল্যে পান। সে কথিত ‘আপদ’ থেকে রক্ষা পাওয়ার যে বহুমূল্যের প্রকল্প সেগুলো শেষ পর্যন্ত গলার ফাঁস হতে পারে। কংক্রিট সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট আমাদের নেতাদের-প্রকৌশলীদের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। জলপ্রবাহের স্বাভাবিক খাল যে রাজপথে রূপান্তর করা যায় সে ধারণা কি আমাদের আছে?

আমি আমার আগের লেখায় এক জায়গায় নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরের খালজাল (canal network)-এর উল্লেখ করেছিলাম। চট্টগ্রামের খালজালকে সড়কের পরিবর্তে সুদৃশ্য জলপথ, বিনোদন ও পরিবেশ অনুকূল ব্যয়সাশ্রয়ী কাঠামোতে রূপান্তর করা যেত। সময় চলে যায়নি, এখনো করা যায়। সেটি করতে হলে নগর সুরক্ষার সঙ্গে নগরীর বাইরের জলাধার তথা সাগর, নদী, খাল সবগুলোর জল সম্পদের সুষম ব্যবহার পরিকল্পনা দরকার হবে। চট্টগ্রাম শহরের নাগরিকরা বিশেষত বণিক-ধনিক শ্রেণি ও রাজনৈতিক নেতারা নগরীর দেখভালের দুটি প্রধান প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন ও সিডিএ সে রকম কোনো স্বপ্ন কি দেখতে বা দেখাতে পারেন?

চট্টগ্রামের উত্তরের প্রায় ৩৫ কিমি দৈর্ঘ্য ও গড়পড়তা ৪-৫ কিমি প্রস্থ পাহাড়, তার বন, তার অভ্যন্তরে সঞ্চিত জল, পাহাড় থেকে উৎপন্ন ছড়া যার মিষ্টি জলের একটি বড় অংশ হালদা ও কর্ণফুলীতে পড়ে। তার কথা আপনাদের পরিকল্পনায় ভুলে গেলে চলবে না। তার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল পর্বতমালা যেখান থেকে কর্ণফুলী, শঙ্খপ্রবাহ বয়ে আসে সে পার্বত্য অঞ্চলকেও হিসেবে নিতে হবে। বিবেচনায় নিতে হবে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর পাহাড় ও পাহাড়ি জলপ্রবাহকেও। আমরা বাছবিচারহীনভাবে পাহাড়ের মাটি কেটে প্লট বানাব, গাছ কেটে সাবার করব আর হাজার কোটি টাকার খাল খনন প্রকল্প করে তার সুফল পাব, সে ভরসা মিছে।

তাই প্রয়োজন পুরো অঞ্চলের তথ্যনির্ভর বাস্তবসম্মত একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। সে পরিকল্পনাকে দৃষ্টিতে রেখে রচিত ও বাস্তবায়িত হোক ছোট ছোট প্রকল্প। যা শুধু সিটি করপোরেশন, সিডিএ, সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড নয়, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোও বাস্তবায়ন করবে। সমস্যাগুলোকে প্রকল্পায়নের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখার চেষ্টা করা হোক। চট্টগ্রামে ২৩ জুলাই, ২০২৩-এ নগরের প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ফজলুল হক (কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ) এবং কমিশনের এ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম। চট্টগ্রামের জন্য একটি ‘আঞ্চলিক প্রেক্ষিত পরিকল্পন’ করার প্রস্তাব ও উদ্যোগ আপনাদের পক্ষ থেকে আসুক এবং চট্টগ্রামে সর্বস্তরে তা আলোচিত হোক, সেটি কামনা করি।

লেখক: গবেষক ও শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected] 

নির্বাচনে জিততে মরিয়া মোদি

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১১:২৪ এএম
নির্বাচনে জিততে মরিয়া মোদি
ড. পবিত্র সরকার

আমি জানি না, প্রধানমন্ত্রী বা তার দল নির্বাচনে জেতার জন্য নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে উঠেছেন, সে তো সবাইকেই মরিয়া হতেই হয়। তবে মরিয়া হলে কী হবে, তাতে জিতও হয়, হারও হয়। অর্থাৎ মরিয়া হওয়াটা জেতার অব্যর্থ গ্যারান্টি নয়। কিন্তু মরিয়া হওয়ার কিছু লক্ষণ আছে। এক হচ্ছে আবেগের মাথায় কিছু বলে ফ্যালা, তার পরিণাম ভালো না মন্দ হবে তা বিবেচনা না করেই। অজস্র জুমলা বা ভুয়ো গ্যারান্টি তো দিচ্ছেনই, সেও সবাইকেই দিতে হবে- আমাদের বিদেশের কালো টাকা উদ্ধার করে প্রতি ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে পনেরো লাখ টাকা আর দু-কোটি চাকরির কথা মনে আছে, কিন্তু এবারেও এদিক-ওদিক এমন মুখ ছোটাচ্ছেন যে তাতে একটা সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য তৈরি হচ্ছে। তাতেই মনে হচ্ছে, এই যাঃ, ভোটাররা এতে খুশি হবে তো? সত্যি সত্যি উনি বিশেষ শ্রেণির ভোটারদের ভোট চান তো? কিছু কিছু মন-কী-বাত এই ভোটের মরশুমে লুকিয়ে রাখতে হয়, বলে ফেলতে নেই। ওর মতো জ্ঞানী (আমি ডিগ্রিটিগ্রি নিয়ে মাথা ঘামাই না) লোক কি তা জানেন না?

ধরুন, এই খাদ্য নিয়ে সেই এক ঘ্যানঘ্যান। ভারতের এক বিশাল জনগোষ্ঠী নিরামিষ খান এটা সত্য, তা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাদের মধ্যেও তথাকথিত উঁচু জাতের লোকই খায় নিরামিষ। তথাকথিত নীচু জাতের লোক যা পায় তাই খায়, তাতে আমিষও থাকে। দক্ষিণ ভারতেও আমরা যখন গেছি, তখন শহরগুলোতে ‘মিলিটারি হোটেলগুলোয়’ দিব্যি মাছ-মাংস পেয়েছি। আবার আন্নামালাইয়ের গ্রামে জেলেদের ঘরে চিংড়ির ঝোল দিব্যি খেয়েছি। অর্থাৎ শুধু সংখ্যালঘুরা মাছ-মাংস খায় এবং অন্যেরা মাছ-মাংস ধরেছে মোগল রাজশক্তির প্রভাবে এ কথা সম্পূর্ণ হাস্যকর ভুল। নদী আর সমুদ্রের আবহে যারা থাকে তাদের একটা অংশ মাছ-মাংস থেকে দূরে থাকতে পারে না।

আর পৃথিবীর প্রায় সব জাতিই যখন মাছ-মাংস খায়, তখন আমি কোন দর্শন থেকে বলব যে মাছ-মাংস খাওয়া ভুল! সব জায়গায় তো মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি! আমরা খাব বা খাব না, গোষ্ঠী এ সিদ্ধান্ত নিতেই পারে, কিন্তু অন্যরা খাবে না- এই হুকুমজারি কি আমরা করতে পারি? প্রধানমন্ত্রী মাঝে মাঝে তার এই ‘মন কী বাত’ উগরে দিচ্ছেন, তার পরিণাম কী হবে হয়তো না বুঝেই? বাঙালি-ওডিয়া-অসমিযা, উত্তরপুবের সব উপজাতি, পুর আর দক্ষিণের সাঁওতাল, মুন্ডারি থেকে টুলু কুরুখ, উত্তরে সিকিমি, পশ্চিমে পাঞ্জাবি, মারাঠি, কেরলি হিন্দুরা এতে খুশি হয়ে তাকে ভোট দেবে বলে তিনি মনে করছেন? সংখ্যালঘুদের কথা ছেড়েই দিই, কিন্তু এসব আঞ্চলিকের ভোটও কি তিনি চান না? নাকি তাদের ভারতের নাগরিক হিসেবেই তিনি মনে করেন না?

যারা নিরামিষ খায় তারা হিংস্র হয় না? বাবরি মসজিদ ভাঙল যারা তাদের মধ্যে নিরামিষ খাওয়া লোক ছিল না? গুজরাটে দাঙ্গা হলো কী করে? শুধু আমিষাশী লোকেরা সেসব করেছে? ভারতে এ পর্যন্ত যত অপরাধ আর নিষ্ঠুরতা ঘটে এসেছে, সবই করেছে আমিষাশীরা? এই মিথ্যা ইতিহাস কে বিশ্বাস করবে?

আমি প্রধানমন্ত্রী আর তার দলবলের এই মনোবেদনার কারণ বুঝি না। তার ওপর তিনি বা তার এক স্নেহপাত্রী এর মধ্যে সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে একটি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য চাউর করলেন। বাঙালির কাছে সিরাজ যে স্বাধীনতার শেষ প্রতীক, এই মানসিক ইতিহাসমূর্তি সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী কী অবহিত ছিলেন না? আজ এতদিন পরে, গৃহীত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস ও আবেগের বিরুদ্ধে গিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পরিবারের এক কন্যা সিরাজদ্দৌলা সম্বন্ধে বিষোদ্গারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্ত কর্ণকেই বেছে নিলেন। এতেও সংখ্যালঘুদের কথা বাদই দিই, বাঙালি হিন্দুর কাছেও তার দল কি রাতারাতি প্রিয় হয়ে উঠল? কে কখন কী বুঝে এই ঘটনাগুলো ঘটায়, তা বুঝি না। নির্বাচন বুঝি মানুষকে এমন উতলা করে দেয়। তা হবে। যার নির্বাচনি বন্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা পড়ে, তা মানুষের মাথা ঘুলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

তারপর আর এক হাস্যকর কথা শোনা গেল কাল না কবে। অযোধ্যার রামমন্দির হয়েছে তো হয়েছে। তাকে মোদিজি নির্বাচন-নদী পার হওয়ার এক নৌকো ধরে নিয়েছেন, তা ঠিক আছে। কোনো সাধুসন্নিসি নয়, মহাপুরুষ (যদি কেউ তেমন বেঁচে থাকে এখন) নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার নাকি ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেছেন। সেও এক মহা আজব ব্যাপার। প্রাণ পাওয়ার পর রাম ধেইধেই করে নাচছেন না কী করছেন জানি না। কিন্তু প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেই মোদিজি খুশি হননি, তিনি রামের চক্ষে একটা ভেলকি-আলোর ছটা ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। দিনের একটি সময়ে তার চক্ষু নাকি সূর্যের আলোয় জ্বলে উঠবে।

ব্যাপারটা যে বৈজ্ঞানিক আর প্রযুক্তিবিদরা করেছেন, সেটা চেপে যাওয়ার সর্বাঙ্গীণ চেষ্টা হচ্ছে। এ রকম ভেলকি আমরা পন্ডিচেরির এক মন্দিরে দেখেছি, সেখানে একটা কাচের বলের ওপর বেলা ঠিক বারোটায় এই রকম চোখ-ঝলসানো আলো ঠিকরে পড়ে। এটা কিছু নয়, মন্দিরের ছাদে কয়েকটা আয়না বা মিরর বসানো হয় তাক করে, সূর্যের আলো সেই আয়নায় ঠিকরে ওই বলের ওপর পড়ে। জানি না মেঘের দিনে, বর্ষাকালজুড়ে কী হয়। তারও ব্যবস্থা করা যেতে পারে বড় বিদ্যুতের আলোর কারিগরিতে। এ নেহাতই মামুলি আলোর খেলা। তাই নিয়ে এই অলৌকিকতার মহিমা প্রচার এমন হাস্যকর ছেলেমানুষি যে, ভাবি, একটা ইলেকশন জেতার জন্য লোকে কী না করতে পারে।

আরও ভাবি, এরা জনগণকে কী হাবাই না ভাবেন। তা আমাদের দেশে জনগণকে হাবা করে রাখার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, তার জন্য শাসকরা সব যুগেই আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছেন। মোদিজিরা এসে যেন একটু বেশি যত্ন নিচ্ছেন জনসাধারণকে শিক্ষা না দেওয়ার। কিংবা ভুল শিক্ষা দেওয়ার। ইতিহাসকে ধুয়ে-মুছে, বিজ্ঞানকে ভুলিয়ে, এমন এক উন্মাদের পাঠক্রম তৈরি করা হচ্ছে, আর সেটাও শিক্ষার আসল গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনো উদ্যমই চোখে পড়ছে না। শিক্ষার বাজেট কমছে, বরাদ্দ কমছে।

আর এই বিষয়টা নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না কেন যে গত ১৯৪১-এর পর থেকে প্রতি দশকে ভারতের জনগণনায় সাক্ষরতার হার যেখানে ৮ থেকে ৯ শতাংশ হারে বাড়ছে, সেখানে ২০১১ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে সরকারি হিসাবেই মাত্র ৩ শতাংশের মতো সাক্ষরতা বাড়ে কেন? এখনো ভারতের প্রায় এক-চতুর্থাংশের মতো মানুষ নিরক্ষর কেন? পেটে ভাত আগে চাই? লেখাপড়া আগে চাই, না আগে রামমন্দিরটাই ভীষণ জরুরি হয়ে উঠল? এসব নিয়ে বড় ধন্দে আছি। নির্বাচন কি এর উত্তর নিয়ে আসবে?

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

ফিলিস্তিন যুদ্ধ: ইসরায়েলকে বিচারের আওতায় আনতে পারে আইসিসি

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ১১:২৩ এএম
ফিলিস্তিন যুদ্ধ: ইসরায়েলকে বিচারের আওতায় আনতে পারে আইসিসি
রিচার্ড ফক

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বৈধতার পথ খুঁজে পেতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার ক্ষত্রে এই প্রতিষ্ঠান গঠন ছিল গ্লোবাল সাউথের জন্য একটি বড় বিজয়। যদিও শুরু থেকেই কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া (বিগ থ্রি) জাতিসংঘে যোগ দেওয়ার পর থেকেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না আইসিসি। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বর হামলায় মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিসিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলেও নেতানিয়াহু সরকার আদালতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে।

১২৪ সদস্যরাষ্ট্রবিশিষ্ট ব্যাপক প্রতিনিধিত্ব থাকা সত্ত্বেও আইসিসি তার স্বীকৃতি, প্রভাব এবং বৈধতার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আইসিসি গঠনের শুরুর দিকে আফ্রিকান নেতাদের কথিত অন্যায় কার্যকলাপের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। তাতে বর্ণবাদে পক্ষপাতিত্বের জন্য আইসিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অপরাধের প্রমাণাদি উপস্থান করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করছে সংস্থাটি। এ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে আইসিসি কিছুই করতে পারছে না।

ধারণা করা হয়েছিল, আইসিসি পশ্চিমা চাপ প্রতিরোধে দুর্বল। ট্রাম্পের অতি জাতীয়তাবাদের কারণে সে সময় আইসিসি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের অপরাধ তদন্ত রোধে সংস্থাটির প্রসিকিউটরের ওপর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

২০২২ সালে যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করেছিল, তখন ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে আইসিসিকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে আহ্বান করেছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা উচিত কি না, সে বিষয়ে জোরালো ভূমিকা নিতে আইসিসির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। পশ্চিমাদের স্বার্থে পুতিনের বিরুদ্ধে দ্রুত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।

গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের জন্য চিলি এবং মেক্সিকো যে পদক্ষেপ নিতে বলেছিল, সে ক্ষেত্রে আইসিসির তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দুই দেশের সরকার গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল। এখন পর্যন্ত আইসিসি এই জরুরি উদ্যোগে কোনো সাড়া দেয়নি। যদিও ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান হওয়ার পথে রয়েছে বলে মনে করা হয়। আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান পশ্চিমা চাপের কারণে গাজায় মানবিক বিপর্যয় উত্তরণে কাজ করতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। আইসিসির প্রতিক্রিয়ায় এমন দুই ধরনের পার্থক্য থাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগের বিচারে ট্রাইব্যুনালের দ্বৈত চরিত্রকেই প্রতিফলিত করছে।

শুরু থেকেই প্রধান রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা না থাকায় আইসিসি একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এ বিষয়ে এটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) বিপরীতে তুলনা করা হয়েছে, যেখানে জাতিসংঘের সদস্যদের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যায়।

বিচার ও আইনি বিরোধের যোগ্যতা মূল্যায়নে উচ্চমানের পেশাদারত্ব বজায় রাখার জন্য আইসিজে ব্যাপকভাবে সম্মানিত। এই ইতিবাচক খ্যাতিটি জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে তার সর্বসম্মত অন্তর্বর্তী আদেশের কারণে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। গাজায় ইসরায়েলের ‘বর্বর গণহত্যা’ বাধা দেওয়ার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা অনুরোধ করায় বেশ কয়েকটি অস্থায়ী ব্যবস্থা মঞ্জুর করেছিল আইসিজে।

ইসরায়েলকে আইনত নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য; যতক্ষণ না আইসিজে গণহত্যার বিষয়ে একটি চূড়ান্ত রায়ে না পৌঁছায়। এই প্রক্রিয়ায় কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। গাজায় এ ধরনের মানবিক সহায়তা আইসিজের কার্যকারিতার প্রমাণ বহন করে।

আইসিজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা করতে পারে। ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্টার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ সম্প্রতি ‘গণহত্যার আলামত’ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।

ইসরায়েলকে গণহত্যামূলক আচরণ বন্ধ করার আইনি আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলের নেতারা প্রতিদিনই রক্তাক্ত অবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যাচ্ছে। তারপরও ইসরায়েল রাফায় আক্রমণের নির্দেশ দেয় এবং মানবতার নৈতিক সংবেদনশীলতার বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাটা হুমকির মুখে পড়ে।

যদি এক সপ্তাহ আগেও জিজ্ঞেস করা হতো, আমি বলতাম যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুই হবেন শেষ ব্যক্তি, যিনি আইসিসির প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ধারে উজ্জ্বল প্রমাণ হয়ে আসবেন। কিন্তু গুজব ফাঁস হওয়ার পর তিনি প্রতিক্রিয়া জানাতে লাফিয়ে উঠেছিলেন যে, আইসিসি নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং সেনাপ্রধান হারজি হালেভির নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে চায়।

নেতানিয়াহু আক্রমণাত্মক হয়েছিলেন। আইসিসির বিরুদ্ধে তার চার মিনিটের ভিডিও দেখার মতো, যদি আদালত তার মতো করে কার্যকর করতে চায়, তাহলে তা কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে সেটা সহজেই বোধগম্য।

এই ব্যবস্থাপনার মধ্যে আইসিসির নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করার এবং মেরুদণ্ডহীনতার জন্য তার খ্যাতি উদ্ধার করার সুযোগ রয়েছে। ইসরায়েল এবং হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে আইসিসির পদক্ষেপকে তাদের কথিত ৭ অক্টোবরের আগের অপরাধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করাটা হাস্যকর।

ইসরায়েলের ওপর যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ বাড়াতে হবে। আইসিসির এ ধরনের ফাঁকি দ্বিগুণ হতাশার কারণ হবে, যার পরে জবাবদিহি, ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্গঠনের নির্দেশনা রয়েছে।

আমাদের কাছে এই ধাঁধা আছে যে, কেন আইসিসি তার নিম্নমানের প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান নিয়ে ইসরায়েলকে অনেক বেশি হুমকি হিসেবে দেখছে। তারা স্পষ্টতই অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত আইসিজের নির্দেশনার দিকে গুরুত্ব দিতে পারে।

নেতানিয়াহু বলেছেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইরানকে একক করে তুলবে এবং গণতন্ত্রের অধিকারের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু আমাদের সবার এখনই জানা উচিত যে, ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার কোনো ইচ্ছা নেই। কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে যেই হোক না কেন, তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না।

এই মুহূর্তে আইসিজে এবং আইসিসির গুরুত্ব হলো বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনি অধিকার ও সমর্থনের জন্য ধারাবাহিক জোয়ারকে আরও শক্তিশালী করা। সেই সঙ্গে উদীয়মান ঐকমত্য গড়ে তোলা দরকার, যেমনভাবে ভিয়েতনামে আমেরিকান পরাজয়ের জন্য অবদান রেখেছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে ধ্বংস করেছিল। যদি ফিলিস্তিনি জনগণ শেষ পর্যন্ত তাদের মৌলিক অধিকারগুলো উপলব্ধি করে, তাহলে নিরুপায় মানুষের প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাদের ঘন ঘন বিতর্কিত দমন-পীড়ন বন্ধ ও যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। ইসরায়েলের পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে সুশীল সমাজের মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ফিলিস্তিনে গণহত্যার জন্য আইসিসির অবশ্যই ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং সুষ্ঠু বিচার হতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ।
মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল