নতুন গণমাধ্যম পুরোনো সবকিছু নতুন করে দেখার সুযোগ করে দেয়। এমনটি হয় পাঠকের প্রতিক্রিয়া থেকে। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সিলেটের সব পুরোনো বিষয়কে নতুন করে দেখার চেষ্টায় সচেষ্ট ছিলাম। এর মধ্যে একটি বিষয় চোখে পড়ে, মন কাড়ে। খবরের কাগজের প্রিন্ট, অনলাইন ও ডিজিটাল মাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। বিপুল সাড়ায় বলা যায়, সবিস্ময়ে ওই বিষয়টি নিয়েই লেগে থাকি, লেগে আছি! বিষয়টি হচ্ছে, ভারতীয় চিনির চোরাচালান।
তৃণমূল সাংবাদিকতায় হাল না ছাড়া বা হার না মানার আরেক নাম লেগে থাকা। মনে পড়ে দুই যুগ আগের কথা। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘ওয়াটার লর্ড’ মুক্ত করে ভিন্ন একটি কর্মপন্থার দিকে কর্তৃপক্ষকে ধাবিত করতে নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাই হাওর-সাংবাদিকতা।
রাজনীতির গডফাদার জামানায় ‘ওয়াটার লর্ড’ শব্দটি ছিল নতুন। শব্দটির উদ্ভব অর্থাৎ প্রথম বলেছিলেন, রাজনীতির কবি খ্যাত প্রয়াত বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
‘ওয়াটার লর্ড’ বলার পরই লুফে নিয়ে উন্মোচনে লেগে থাকা!
হাওর গহিনের তিনটি উপজেলা বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনি এলাকাভুক্ত। সেখানকার সংসদ সদস্য ছিলেন প্রবাদ প্রতীম বাম রাজনীতিবিদ বরুণ রায়। তারপর নজির হোসেন ও সৈয়দ রফিকুল হক সুহেল। এ দুজনের পর সেখানকার সংসদ সদস্য হতে নির্বাচন করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু জিততে পারেননি। না পারার পেছনে ছিল হাওরের ইজারাদারদের ‘ওয়াটার লর্ড’ প্রভাব।
গবেষকদের দৃষ্টিতে সব হাওরের মা অথবা মাদার ফিশারিজ চিহ্নিত টাঙ্গুয়ার হাওর। এ হাওর ঘিরে জাগে নতুন সম্ভাবনা। তবে সম্ভাবনার পথের কাঁটা ইজারাপ্রথা। মা-হাওরটিকে ইজারামুক্ত করে ‘ওয়াটার লর্ড’ তথা ক্ষমতার দাপট ভেঙে ফেলতে কিছুকাল হাওর সাংবাদিকতায় লেগে থাকা। যদিও টাঙ্গুয়ার হাওরে সেই সুকর্মের সূত্রপাত এখনো হয়নি, তবে সূচিত হয়েছে নতুন ধারার। এক টাঙ্গুয়ার হাওরে চিরাচরিত ইজারাদারি শোষণ ও শাসনের অবসান হয়েছে। বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশে হাওর পর্যটন।
সাংবাদিকতায় সেই লেগে থাকার স্বভাবে চিনি চোরাচালানের দিকে চোখ রাখা। এ চোখ এতই প্রখরভাবে রাখতে হয়, যেন চোখ ফেরালেই নানা অপবাদে অপদস্ত হওয়ার পালা। শুরুটা খবরের কাগজের দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর। যেখানে সারা দেশ তথা সীমান্ত এলাকার চিনি চোরাচালান পরিস্থিতি ছিল। সিলেটের অবস্থা ছিল সবচেয়ে নাজুক। এক দিন ভোরবেলা সিলেট নগরীর জালালাবাদ থানা এলাকায় একসঙ্গে ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি ধরা পড়ে। ধরা পড়ার ঘটনা ধারাপাতের মতো করে সাড়া হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভিডিও স্টোরি করে শেষ।
কিন্তু এই শেষে যেন স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
লেগে থাকার সেই স্বভাবে মন অস্থির। সংঘটিত ঘটনার বাইরে কিছু একটা করা দরকার। স্পটে থাকা কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। দেখলাম, বাড়তি কিছু করা থেকে সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে। ঘটনা কী? একটু অনুসন্ধান করতেই অবাক। চোরাই চিনি রেখে যারা পালিয়েছেন, তারা ‘এমপির লোক’। ৭ জানুয়ারির নতুন এমপিরা বিব্রত হবেন বলে এ বিষয়টি সবার এড়িয়ে যাওয়া! ‘এমপির লোক’ বলে যারা পালায়, তারা ফেলে যায় একটি প্রাইভেট কার। প্রাইভেট কারটির নম্বর সংগ্রহ করে বিআরটিএর দপ্তরে পাঠালাম। নিবন্ধন সূত্র ধরে ঠিকানা মিলল। পালানো তিনজন ‘এমপির লোক’ নিশ্চিত। তিনজনের মধ্যে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানা গেল এমপির নামসহ বিস্তারিত তথ্য।
তবে তাদের নাম প্রকাশ না করে রিপোর্ট করি ‘অচেনা এমপির লোক কারা?’
এ যেন আত্মহারা এক অবস্থা! এক এক করে যোগাযোগ করলেন তৎকালীন তিন এমপি ও তাদের লোক। জানতে চাইলেন, কোন এমপি? তাদের হ্যাঁ-না কিছু না বলে সন্ধান-অনুসন্ধানে কড়া নাড়ি আসল জায়গায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উদ্দেশ করে রিপোর্ট ‘চোরাই চিনির পথে সব সাক্ষীগোপাল!’ এবার সাক্ষীগোপাল তকমা ঘোচাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নড়েচড়ে বসে। একই সঙ্গে চলে চোরাই চিনির গডফাদারের খোঁজ।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় একাধিকবার সরেজমিন ঘুরে কাকতালীয়ভাবে এক নামের দুজন ইউপি চেয়ারম্যানকে পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ার লোক। তাদের সঙ্গে সখ্য সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ থেকে শুরু করে রথিমহারথিদের। এ অবস্থায় সরাসরি ক্ষমতাধরদের ফোকাস না করে কান টানলে মাথা আসার কৌশলে রিপোর্ট করি ‘দিনে মিলন খান, রাতে চিনি খান! পাশাপাশি চোরাই চিনির লাইনে রাতারাতি নয়া ধনীদের খোঁজ করি। এতে অনেক ইন্টারেস্টিং তথ্য ও চরিত্র হাতে আসছিল। পাশাপাশি পাচ্ছিলাম চিনিকাণ্ডে জড়িতদের ফোনালাপ।
সিলেটের বিয়ানীবাজারে ছাত্রলীগের মাধ্যমে লুট হয় ২৪ লাখ টাকার চোরাই চিনি। এ নিয়ে মামলা হয়। কিন্তু আসামি অধরা। ফোনালাপ পেয়েই প্রকাশ করি ‘ছাত্রলীগের লুটের চিনি পিঁপড়ার মতো ভাগাভাগি!’ এ রিপোর্টে ছাত্রলীগের কমিটি কেন্দ্র বাতিল করে, দুই নেতা গ্রেপ্তারও হন। চোরাই চিনি নিয়ে সিলেট অঞ্চলের রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম। একটি পত্রিকা আর একজন মাত্র সাংবাদিক কেন লিখছে? এমন প্রশ্ন ছুড়েও চলে চাঞ্চল্য। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ সার্বিক পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে তুলে ধরলেন। সকাতরে বলেন, ‘ছাত্রলীগ নিয়ে অনেক কথা শুনি, সিলেট শহরে হাঁটতে পারি না!’
চোরাই চিনি নিয়ে লেগে থাকায় তথ্য মেলে ধামাচাপার। এ যাত্রায় খবরের কাগজের সিলেট ব্যুরোর নিজস্ব প্রতিবেদক শাকিলা ববি ও ফটোসাংবাদিক মামুন হোসেনকে যুক্ত করি। তথ্য-উপাত্তের ক্রস চেক চলে এক-দুই-তিন চোখে। সমন্বিতভাবে চলে লেগে থাকার কাজ। গোলাপগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের ধামাচাপার দুটি ঘটনা তুলে ধরি। ‘ধামাচাপার প্রথম কাহিনি গোলাপগঞ্জে’র পর চোখ যায় সুনামগঞ্জের দিকে।
সুনামগঞ্জের স্পট ছিল স্পর্শকাতর। চোরাই চিনির ভাগবাঁটোয়ার তথ্য ধামাচাপা দিতে বিচারকের খাসকামরার সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিআর মেশিন (নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) গায়েব করা হয়েছিল। রিপোর্ট করি, ‘বিচারকের খাসকামরায় চোরের হাত’! সর্বশেষ ফোনালাপ ও হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের সূত্র ধরে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করি। শিরোনাম ছিল, ‘ছাড়লে চোরাই চিনির গাড়ি, টাকা মেলে কাঁড়ি কাঁড়ি’।
মে থেকে এখন পর্যন্ত এভাবেই কেটেছে। আগেই বলেছিলাম, চোরাই চিনির পথে অন্য কিছুও আসতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে চিনির সঙ্গে অন্য অনেক কিছুও ধরা পড়ছে। উন্মোচন হয়েছে চোরাই চিনি বাজারজাত করার দেশবিরোধী কাজে সায় দেওয়া সিন্ডিকেট সাংবাদিকতাও।
আমার কাছে তৃণমূল সাংবাদিকতা হচ্ছে, যুদ্ধ-ঝুঁকি-ভালোবাসা। চোরাচালান রোধে লেগে থাকার সাংবাদিকতাকে অনেকে ‘চিনি যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। এ যুদ্ধের পর কতটা সুদ্ধ সাংবাদিকতা? এসব না ভেবে দেশের তরে ভালোবাসার কথা বলি। আমাদের চিনিকলগুলো সচল থাকার মধ্যে মস্ত এক দেশপ্রেম, এই অভিপ্রায়ে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রেরণা খবরের কাগজের দেশসেরা প্রতিবেদক পুরস্কার আমাকে ভালোবাসায় যারপরনাই আপ্লুত করেছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর ক্ষমতা ওলট-পালট এখন।
পালাবদলে আগের মতো না হলেও চলছে চোরাই চিনির কারবার। প্রতিরোধেও চলছে সাঁড়াশি অভিযান।
উন্মোচন-উন্মীলনের এ পথ চলাতে চোরাই চিনির পথে ‘যুদ্ধ’ শেষে শুদ্ধ হবে সাংবাদিকতা। অতঃপর অন্যদিকে ধাবিত হওয়া আর নতুন করে ভালোবাসার ঋণে আবদ্ধ হতে কলম চলবে।