চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার মৌলভীপাড়ায় ১০০ একরের তিন ফসলি জমিতে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এতে গ্রামের আবহাওয়া, পরিবেশ, জনজীবনের ওপর দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন পরিবেশবিদরা। সেই সঙ্গে হুমকির মুখের পড়বে এশিয়ার বৃহত্তম বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘পরিবেশ বাঁচাতে, পরিবেশ ধ্বংস করার’ উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অন্যদিকে এই প্রকল্পকে ঘিরে মৌলভীপাড়া গ্রামে কম দামে কৃষিজমি কিনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ব্যবসায়ীদের একটি দল। তারা ইতোমধ্যে গ্রামটির এক-তৃতীয়াংশ কৃষিজমি কিনে নিয়েছে। তিন গুণ মুনাফা লাভের আশায় চক্রটি এখন টিএসডিএফ (ট্রিটমেন্ট স্টোরেজ অ্যান্ড ডিসপোজাল ফ্যাসিলিটি) প্রকল্পের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আন্তর্জাতিক হংকং কনভেনশন অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডকে সবুজায়ন করার বাধ্যবাধকতা আছে। তাই পরিবেশসম্মতভাবে জাহাজভাঙা শিল্প ও এই শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বর্জ্য সংরক্ষণ ও ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সীতাকুণ্ড উপজেলার মৌলভীপাড়ায় একটি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। আনুমানিক ১০০ একর কৃষিজমিতে এটি নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যশনাল কো-অপারেশন্স এজেন্সি (জাইকা)। তবে এর ব্যয় ধরা হবে কারিগরি, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক ফিজিবিলিটি স্টাডির ওপর ভিত্তি করে। যদিও ইতোমধ্যেই ওই গ্রামে ভূমি জরিপ চালাচ্ছে জাইকা। কয়েক দফায় গ্রামটি পরিদর্শনও করেছে তারা। জমি কিনতে তারা মালিকদের সঙ্গে উঠান বৈঠকও করেছে। নির্ধারণ করেছে যাতায়াতের সড়ক। কয়েক স্থানে স্থাপন করা হয়েছে সীমানা খুঁটিও।
সরেজমিনে মৌলভীপাড়ায় দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিমে রেললাইন, তারও পশ্চিমে যত দূর চোখ যায় চারদিকে সবুজ গাছগাছালি, বিস্তৃত ফসলের মাঠ, এরই মাঝে ছোট ছোট ঘরবাড়ি, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি ছড়াটি সোজা গিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। ছবির মতো গ্রামটির প্রতিটি বাড়িই এক একটি খামার। সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের এই গ্রামটির ৯০ শতাংশ মানুষ পাহাড়ি ঢালু ও সমতলে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এদিকে প্রকল্পের বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন সীতাকুণ্ড পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম। ১ সপ্তাহ আগে লেখা ওই চিঠিতে পৌর মেয়র উল্লেখ করেন, তিন ফসলি কৃষিজমি ধ্বংস করে শিল্প বর্জ্য শোধনাগার করা হলে গোটা পৌর এলাকার অপূরণীয় ক্ষতি হবে। শব্দদূষণের পাশাপাশি এলাকায় স্থায়ী যানজট তৈরি হবে। যার প্রভাব পড়বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। বিষাক্ত কেমিক্যাল আর শব্দদূষণে বিষিয়ে উঠবে স্থানীয়দের জীবন। বিলুপ্ত হবে কৃষি, হুমকির মুখে পড়বে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। একই সঙ্গে ওই এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠবে গ্রামটি।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ইকোপার্কের পর্যটন রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন ও পুনর্বাসন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাসুম কবীর বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের পরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বরাবরে এ বিষয়ে চিঠি লিখেছেন। এতে বলা হয়, জাইকা কর্মকর্তারা গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ও এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তাদের কার্যালয়ে যান। ওই সময় জাইকার কর্মকর্তারা জানান, তারা টিএসডিএফ স্থাপনের জন্য ইকোপার্কের প্রবেশ সড়ক ব্যবহার করবে। এটি (টিএসডিএফ) স্থাপিত হলে প্রতিদিন ওই সড়কেই বিষাক্ত বর্জ্যবাহী ৭০-৮০টি ৩২ চাকার লং লরি চলাচল করবে। এখানে জাহাজভাঙা শিল্পসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্প-কারখানার বর্জ্য আনা হবে। এ ছাড়া এই এলাকায় বর্জ্যবাহী লরি চলাচল করলে পর্যটকদের গাড়ি চলাচলে অসুবিধা হবে, তৈরি হবে ঝুঁকি-যানজট। অন্যদিকে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের পরিবেশ ধ্বংস হবে। ফলে ইকোপার্কের গাছপালা ও বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হবে। কেননা, প্রকল্পটি পার্কের পাশেই করা হচ্ছে।
দুই রেঞ্জ কর্মকর্তার ওই অনুরোধের পর ইকোপার্কের পরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষকের কাছে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি পার্কের অর্থনৈতিক, জাতীয়, ধর্মীয়, সামাজিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব তুলে ধরে প্রকল্পটি সেখানে করা সমীচীন হবে না উল্লেখ করে বলেন, ১৯৯৬ একরের এই পার্কে বিপন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণ, সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এখানে ৮২৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, বৃক্ষরাজি, গুল্ম, ভেষজ ও লতা এবং ৩১০ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। গত বছর থেকে সরকার এই পার্কের প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ শীর্ষ প্রকল্প শুরু করেছে। প্রতিবছর ৩ লাখ পর্যটক এটি পরিদর্শন করে। এই পার্কের পথ ধরেই প্রতিবছর ১০-১৫ লাখ সনাতন তীর্থযাত্রী চন্দ্রনাথ ধাম দর্শন করে থাকেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে এম রফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অংশীজনদের নিয়ে সভা করব। সেখানে সব জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সবাই থাকবেন। তাদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা প্রতিবেদন তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। তারপর মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।’
সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য এস এম আল মামুন খবরের কাগজকে বলেন, প্রকল্পটি জনবহুল এলাকায় না করে নদীর চরে করতে বলেছি। আগে মানুষকে বাঁচতে হবে। তারপর বর্জ্য শোধন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়া, বিরা, বেখা ও বিআইএম) মো. শামীমুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা সেখানে এখনো যাচাই-বাছাই করছি। যদি পরিবেশ, কৃষিজমি, প্রাণিজগৎ, মানুষের জীবনের প্রভাব পড়ে তাহলে প্রকল্পটি সেখানে করা হবে না।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা এটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায় কিনা ভেবে দেখছি।’