ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রথম ঢাকা শহরে চালু হয় অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) আমলে, ২০০৯ সালের শেষের দিকে। তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এগুলোকে বৈধতা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সেই সময় ডিসিসি ও বিআরটিএর মধ্যে বিরোধ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। তখন পিছু হটে ডিসিসি।
তারপর থেকে অবৈধভাবেই বিকশিত হতে থাকে এই রিকশা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ যেটাকে ‘বাংলার টেসলা’ বলছেন সেটাকেই এখন অবৈধ তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করতে চাইছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনরা না চাইলে তো এটি বিকশিত হতে পারত না। শুরুতেই যদি সরকার কঠোর হতো তাহলে আজ এই পরিস্থিতি দেখতে হতো না। এখন লাখ লাখ পরিবারের জীবিকা এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর কঠোর সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
তখন অভিবক্ত ডিসিসি বৈধতা দিতে চাইলেও এখন বিভক্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি) চায় না এই রিকশা চলাচল করুক। কারণ হিসেবে সংস্থা দুটি নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলছে।
ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলছেন, সিদ্ধান্তে আসা দরকার যে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক চলবে না। এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
অন্যদিকে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলছেন, ভয়াবহ ব্যাপার, যখন ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা দুই পা ওপরে উঠিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালান। অনেক প্রতিবন্ধী চালক আছেন, যারা চোখে কিছুটা কম দেখেন, তারাও এই রিকশা নিয়ে নেমে পড়েন।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথম থেকেই এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হতো, তা যখন করা যায়নি তাহলে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তারপর কঠোর হওয়া দরকার।’
‘বাংলার টেসলা’ নিয়ে শুরুর মতবিরোধ চলছে এখনো
অবিভক্ত ডিসিসি ও বিআরটিএর সেই পুরোনো মতবিরোধ এখনো বিদ্যমান। সরকারের একটি অংশ মনে করছে এটি বিপজ্জনক। তাই চলতে দেওয়া যাবে না। আরেকটি অংশ বলছে, এটি কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রয়েছে ব্যাপক উপযোগিতা।
টেসলা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি। ব্যাটারিচালিত রিকশাকে তাই বাংলার টেসলা বলে অভিহিত করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা হলো ‘বাংলার টেসলা’। এসব যান যতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, তার চেয়ে রিটার্ন অনেক বেশি। অথচ যেসব কথা বলে এখন এসব রিকশা নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো এসব রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে বিপুল বিদ্যুৎ খরচ হয়।
রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান রিপন খবরের কাগজকে বলেন, সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশাকে বাংলার টেসলা বলেছেন। তিনি দ্রুত এসব রিকশার গতিসীমা ঠিক করে ও নীতিমালা প্রণয়ন করে লাইসেন্স দিতে বিআরটিএকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিদ্যুৎ অপচয় করছে। একটি বাসায় ৬ ঘণ্টা এসি চালাতে ১৬ ইউনিট বিদ্যুৎ লাগে; আর একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে সাড়ে ৩ থেকে ৪ ইউনিট বিদ্যুৎ লাগে। এ ছাড়া আবাসিকের চেয়ে বহুলাংশে বিল দিচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশামালিকরা। আমাদের দাবি হলো, মোটরযান গতিসীমা নীতিমালা সংশোধন করে দ্রুত লাইসেন্স দেওয়া হোক। ব্যাটারিচালিত রিকশা কিন্তু মূল সড়কে চলে না, চলে অলিগলিতে। হুট করে এসব রিকশা বন্ধ হয়ে গেলে নগরবাসী যে বিপাকে পড়বেন, তার দায় নিতে হবে বিআরটিএ ও সড়ক মন্ত্রণালয়কে।
সম্ভাব্য রাজস্ব যাচ্ছে চাঁদাবাজদের পেটে
নিবন্ধন দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে সরকারের ভেতরে মতবিরোধের মধ্যেই বেড়ে ওঠা এই খাত থেকে বিপুল রাজস্ব পেতে পারত সরকার। নিবন্ধন দিলে বছরে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ পুরোটা চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজদের পকেটে।
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক ব্যাটারি অ্যান্ড মোটরচালিত অটোরিকশা অটোবাইক সার্ভিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল কালাম বলেন, আমদানিকারকরা বিভিন্নভাবে ইজিবাইক আমদানি করে রাস্তায় নামিয়েছেন। এর মাধ্যমে লাখ লাখ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে অনেক শিক্ষিত বেকার রয়েছে। ২০১৬ সালে সারা দেশে ইজিবাইক ও অটোরিকশার সংখ্যা ছিল দুই থেকে আড়াই লাখ। বর্তমানে সেটি ৫০ লাখে উন্নীত হয়েছে। বিশাল সেক্টরের আয়ের সিংহভাগ চাঁদাবাজরা বিভিন্নভাবে আদায় করে নিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অটোরিকশার চাঁদার ভাগ পায় ট্রাফিক পুলিশ, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলররা। এ ছাড়া স্থানীয় অসাধু রাজনৈতিক নেতা ও পাড়ামহল্লার মাস্তানরাও চাঁদাবাজি করছে। বিনিময়ে এসব রিকশা চলতে দিচ্ছে তাদের এলাকায়। চাঁদা না দিলে অটোরিকশা চালকদের ধরে এনে নির্যাতন করে পুলিশ। এক হিসাবে রাজধানী ঢাকাতে টোকেনের নামে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দিতে হয় অটোরিকশা চালকদের।
সূত্র জানায়, রিকশাপ্রতি রেকার বিল গুনতে হয় ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা। আবার কোনো রিকশা ডাম্পিং স্টেশনে নেওয়া হলে দিতে হয় ২ হাজার থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত। মাসিক চাঁদার টাকা পরিশোধ করে রাস্তায় নামাতে হয় রিকশা। রাজধানী ঢাকায় অন্তত ৩ থেকে ৪ লাখের মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে। মাসে গড়ে রিকশাপ্রতি প্রায় ২ হাজার টাকা টোকেন নিতে হয়। এই হিসাবে মাসে অবৈধভাবে আদায় করা হয় ৬০ কোটি টাকা।
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটি। কমিটির সভাপতি জামসেদ আনোয়ার তপন ও সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এই দাবি জানিয়ে বলা হয়, অবিলম্বে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে লাইসেন্স দিতে হবে বিআরটিএকে। বিবৃতিতে বলা হয়, ব্যাটারিচালিত রিকশাকে নিরাপদ ও উন্নত করার একাধিক মডেলের প্রস্তাব দেশের অন্তত দুটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। এই লোকায়ত প্রযুক্তিটি বিপুলসংখ্যক মানুষের কষ্ট লাঘব ও কর্মের সংস্থান করেছে। একটি টেকসই ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে কর্তৃত্ববাদী ও আমলাতান্ত্রিক নির্দেশে বারবার এসব শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
তারা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের মদদে ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের যৌথ অংশগ্রহণে ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে যারা এত দিন অবৈধ রুট পারমিট প্রদানের মাধ্যমে চাঁদাবাজি চক্র পরিচালনা করেছে তারাই গত দুই দিন ধরে গ্যারেজে গ্যারেজে হামলা চালিয়ে ব্যাটারিসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ আটকের নামে লুটতরাজ পরিচালনা করছে। কয়েকটি স্থানে সড়কে রিকশাচালকদের পিটিয়ে গুরুতর আহত করার ঘটনা ঘটেছে।
অনড় অবস্থানে সরকার
গত বুধবার রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ ভবনে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভায় রাজধানীতে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত কোনো রিকশা চলতে না দেওয়ার নির্দেশ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই সভায় মন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকায় কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো যাবে না। এটা আগে কার্যকর করুন। এ ছাড়া ২২ মহাসড়কে রিকশা ও ইজিবাইক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন করুন। আর ঢাকা সিটিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা যাতে না চলে, সেই বিষয়ে শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ নয়, এগুলো চলতে যাতে না পারে, সেটার ব্যবস্থা করুন।’
এর পরপরই এসব রিকশা নিষিদ্ধে তোড়জোড় শুরু করে প্রশাসন। বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট বিভাগসংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব মহানগরীর সড়ক থেকে ও ২২টি মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে গতকাল থেকে তৎপরতা শুরু হয়েছে। মহানগর, জেলা ও হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন।
বিকল্প কর্মসংস্থান করে নিষিদ্ধের দাবি
যদি এসব রিকশা নিষিদ্ধই করতে হয় তাহলে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তারপর নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। না হলে লাখ লাখ মানুষের পথে বসার উপক্রম হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার অর্থ সম্পাদক রোকশানা আফরোজ আশা খবরের কাগজকে বলেন, ‘হাইকোর্ট যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা নেওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিল, এসব মানুষ যাবে কোথায়? বিকল্প ব্যবস্থা না করে গরিব মানুষের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থা না হলে এই রিকশাচালকদের কিছুই করা যাবে না।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো যখন সড়কে নামানো হয়েছিল, তখনই কিন্তু ওদের চলাচলের এলাকা আর গতিসীমা নির্ধারিত করে দেওয়ার দরকার ছিল। শুধু নিরাপত্তার ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দিলে সড়কের সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে অনেক শ্রমিকের রুটিরুজির ব্যাপার আছে। আর্থিক নিরাপত্তার দিক চিন্তা করে তাদের আগে পুনর্বাসন করা দরকার। ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়ক থেকে তুলে দিলে সেখানে বিকল্প পরিবহন কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
>ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি ১০ বছরেও