রোজার মাসে চাহিদা কমায় ক্রেতাসংকট থাকায় কমে এসেছিল ডিমের দাম। তখন প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয়েছিল ৮ টাকা ৬০ পয়সায়। রোজার পর চাহিদা বাড়তেই বর্তমানে প্রতি পিস ডিমের দাম ঠেকেছে ১০ টাকা ৪০ পয়সায়। গত ৩ দিনের ব্যবধানে প্রতি পিস ডিমে ২ টাকা দাম বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। বৃহৎ ডিমের আড়ত চট্টগ্রামে নগরের পাহাড়তলী ও রিয়াজুদ্দীন বাজারে। টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকে করে আনা হয় ডিম।
জানা গেছে, রোজার আগের কয়েক মাস প্রতি পিস ডিম ১০ টাকা ৫০ পয়সা করে পাইকারিতে বিক্রি হয়েছিল। গত মার্চ মাসের শুরুতে পাইকারিতে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয় ৯ টাকা ৩০ পয়সায়। গত ৩০ মার্চ পাইকারিতে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয়েছে ৯ টাকায়। গত ৭ এপ্রিল ক্রেতাসংকট থাকায় দাম কমে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয়েছে ৮ টাকা ৬০ পয়সায়। চাহিদা বাড়ায় ঈদের পর গত ১৫ এপ্রিল প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয় ৯ টাকা ৪০ পয়সায়। ১৮ এপ্রিল প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয়েছে ৯ টাকা ৫০ পয়সায়। গত ২ মে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয়েছিল ৯ টাকা ৫০ পয়সা। গত ৪ মে ৫০ পয়সা বেড়ে প্রতিপিস ডিম বিক্রি হয় ১০ টাকায়। গতকাল সোমবার প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয়েছে ১০ টাকা ৪০ পয়সায়।
ডিমের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, রোজায় ডিমের চাহিদা তুলনামূলক কম ছিল। তাই পণ্যটির চাহিদা কমে যাওয়ায় দামও ছিল নিম্নমুখী। কিন্তু এখন চাহিদা বাড়ায় বাড়তি দরে ডিম কিনে আনতে হচ্ছে। তাই আবারও পণ্যটির বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। তবে ডিমের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে সিন্ডেকেটকেই দায়ী করছেন চট্টগ্রামের অনেক ডিম ব্যবসায়ী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাহাড়তলীর এক ব্যবসায়ী খবরের কাগজকে বলেন, ‘চাহিদা বাড়াকে পুঁজি করে ডিমের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত ৩ দিনের ব্যবধানে প্রতি পিস ডিমে ২ টাকা বেড়েছে। মূলত সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দামটা বাড়ছে।
সূত্র জানায়, রোজার সময় ডিমের চাহিদা কমায় ওই সময় উৎপাদিত ডিমগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও কিশোরগঞ্জের ব্যবসায়ীরা কুমিল্লা ও ঢাকার কাঁচপুরে কোটি কোটি পিস ডিম কোল্ড স্টোরেজ করে রেখেছে। তার ওপর তীব্র তাপপ্রবাহে অনেক খামারির মুরগি মারা যাওয়ায় ডিমের উৎপাদন কমে গেছে। অপরদিকে বর্তমানে ডিমের চাহিদাও বেড়ে গেছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে ডিমের দাম। বৃষ্টির মাত্রা বাড়ার সঙ্গে কোল্ড স্টোরেজে রাখা ডিমগুলো পুরোদমে বাজারজাত করা হবে। কোরবান ঘনিয়ে এলে তখনই দাম কমাবেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল শুক্কুর খবরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। তার ওপর সামজিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাই চাহিদা বাড়ায় আমাদের ঢাকা, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাড়তি দরে ডিম কিনতে হচ্ছে। তাই পণ্যটির দাম বেড়েছে। আমরা এখন পাইকারিতে প্রতি পিস ডিম ১০ টাকা ৪০ পয়সায় বিক্রি করছি। তাই এর প্রভাব খুচরা বাজারেও পড়েছে।
রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওয়ের ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘রোজার মাসে ডিমের বাজার মন্দা ছিল। ঈদের পরও বাজার যেভাবে চাঙ্গা হওয়ার কথা, হয়নি। প্রচণ্ড গরমে অনেক মুরগি মারা গেছে। ফলে উৎপাদন কমে গেছে। তাই এখন ডিমের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামটাও বেড়ে গেছে।’
ডিমে সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ডিমে সিন্ডিকেটের প্রশ্নই আসে না। দেশে অনেক ফার্ম বেড়েছে, কিন্তু এসব ফার্মের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও নেই। আমাদের ডিমের চাহিদা কত, উৎপাদন কত এটা কেউ কখনো নিরূপণ করে নাই। এটা নিরূপণ করলেই বোঝা যেত, কেন ডিমের দাম বাড়ে।’
টাঙ্গাইলের খামারি মোহাম্মদ দুলাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অনেক মুরগি মারা গেছে। আমার কাছে ৪ হাজার ৬০০ পিস মুরগির বাচ্চা ছিল। প্রচণ্ড গরমে ১ হাজার ১০০ পিস মারা গেছে। ফলে আগে আমার খামারে দিনে ১০ হাজার ডিম উৎপাদন হলেও এখন সেটা ৬ হাজারে নেমে এসেছে। তবুও ডিমের দাম এত বাড়ার কথা না। কিন্তু বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ মুরগি ও ডিম ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। কোম্পানিগুলো এখন মুরগির বাচ্চা কিনতে গেলে খাদ্য কিনতে বাধ্য করে। তারা আবার মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে মুরগির খাবার বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১ হাজার ৮০০ টাকায় কিনতাম, এখন কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। তার ওপর কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেরাই ডিম উৎপাদন করছে। বিভিন্ন জায়গায় তাদের বিক্রয়কেন্দ্র আছে। ফলে ডিম, মুরগি সব কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। আর আমরা সাধারণ কৃষক প্রকৃত দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে খামারির সংখ্যা একেবারে কমে যাবে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘যেকোনো পণ্যের দাম বাড়ে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে। এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। খামারির উৎপাদন খরচ কত, আড়তদার থেকে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত সব স্তরে ক্রয়-বিক্রয় রশিদ যাচাই করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাই বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর বিকল্প নেই।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত বাজার তদারকি চলছে। ক্রয়-বিক্রয় রশিদ যাচাই করছি। অপরাধ প্রমাণ পেলে আইন মোতাবেক ব্যবস্থাও নিচ্ছি। তবে আমাদের ব্যবসায়ীদেরকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সঠিক পন্থায় ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের ক্রেতারা প্রতারণার শিকার হলে আমাদের অভিযোগ জানালে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’