মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় সন্তান শেখ জামাল ছিলেন কিশোর বয়সী। কিন্তু তার ছিল ভীষণ দুঃসাহস। ২৮ এপ্রিল শেখ জামালের জন্মদিন। তার সম্পর্কে জানাচ্ছেন আহমেদ রিয়াজ
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচেয়ে কম আলোচিত যে নাম, সে নাম হচ্ছে শেখ জামাল। ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম। জন্মের ঠিক ১২ দিন পর ১৯৫৪ সালের ১০ মে বাবা শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বাবা মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে পুরো পরিবার তখন মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে এসে ওঠে। কিন্তু সৌভাগ্যের অপর পিঠেই লুকিয়ে ছিল দুর্ভাগ্য। ওই বছরই ৩১ মে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পরপরই গ্রেফতার হয়ে যান শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় তিনি সাত মাস জেলে বন্দি ছিলেন।
একেবারে মায়ের কোলের বয়স থেকেই অন্য ভাইবোনদের মতো বাবার জেলজীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন জামাল। মায়ের কোলে চড়ে মাঝে মাঝে বাবাকে জেলখানায় দেখতেও যেতেন। জেলবন্দি বাবার কাছ থেকে খুব একটা আদর-স্নেহও পাননি। তবে বাবাকে নিয়ে তার ছিল ভীষণ রকম গর্ব। কারণ তার বাবাই তো নেতৃত্ব দিয়ে পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর এই স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেও অংশ নিলেন সরাসরি।
পাকিস্তানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বন্দি করে রাখল ধানমন্ডির ২৬ নম্বর সড়কের ১৮ নম্বর (বর্তমানে ৯এ) বাড়িতে। ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট কিশোর শেখ জামাল সেই বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এলেন। তার বয়স তখন ১৭ বছর তিন মাস। তার পরিবারের কেউ, কিংবা পাহারাদার শসস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্য- কেউই আগে থেকে তার পালিয়ে যাওয়াটা টের পায়নি। বেশ কিছুদিন থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। আর সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারকাঁটার বেড়া দেওয়া বাড়ি থেকে কিশোর শেখ জামাল পালিয়ে গেলেন।
ওই বাড়িতে তখনো বন্দি মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বড় বুবু শেখ হাসিনা, ছোট বোন শেখ রেহানা, ছোটভাই শেখ রাসেল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাবা শেখ মুজিবকে বন্দি করে নিয়ে যায়। তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়ি আক্রমণ করার ঠিক আগে আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান বড় ভাই শেখ কামাল। তারপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ কামাল ছিলেন মুক্তিবাহিনির কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি।
বড় ভাই শেখ কামালের বয়স তখন ২২ বছর। আর শেখ জামালের আঠারোও হয়নি। তাতে কী! মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অদম্য এক সংকল্প করে রেখেছেন শেখ জামাল। মাকে বলে যাননি। কারণ বলতে গেলে যদি বয়স কম হওয়ার যুক্তিতে অনুমতি না মেলে!
ভাইবোনদের মধ্যে বেশ চাপা স্বভাবের ছিলেন শেখ জামাল। সহজে মনের কথা প্রকাশ করতেন না। সবসময় বই নিয়ে পড়ে থাকতেন। প্রচণ্ড বইপড়ুয়া ছিলেন।
নিরুদ্দেশের পরই শুরু হয়ে গেল তার খোঁজাখুঁজি। খোঁজ না পেয়ে মায়ের সন্দেহ হলো পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর। কদিন ধরে ওদের হাবভাবও ভালো ঠেকছিল না। ওরা শেখ জামালকে গুম করে দেয়নি তো! পাকিস্তানিদের বিশ্বাস নেই। নিরীহ মানুষদের ওপর যারা রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে গুলি চালায়, তাদের কে বিশ্বাস করবে? পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ছেলে শেখ জামালকে অপহরণের অভিযোগ তুললেন মা। পুরো বিশ্বে সে খবর প্রচার হলো। বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো শেখ জামালের নিখোঁজ হওয়ার খবর।
ততদিনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ পথ পেরিয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছে গেছেন কিশোর শেখ জামাল। তারপর আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে পৌঁছে গেলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে। যোগ দিলেন মুজিব বাহিনীতে। ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ নিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে চলে গেলেন রণাঙ্গনের ৯ নম্বর সেক্টরে।
শেখ জামালের খবরটা তখন কৌশলগত কারণে চেপে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। এই ইস্যুতে প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকারের তীব্র চাপে আন্তর্জতিক অঙ্গনে বেশ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। কিন্তু ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় কিছু মুক্তিযুদ্ধের ছবি ছাপা হয়। তেমনি একটি ছবিতে সীমান্তের দশ মাইল ভিতরে একটি রণাঙ্গনে সাবমেশিনগানধারী এক কিশোরকে দেখা যায়। সেই কিশোরই ছিলেন শেখ জামাল। সেই ছবিতে কোনো কিশোরের মুখায়ব নয়, ফুটে উঠেছিল সংকল্পবদ্ধ দুঃসাহসী এক মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি।
স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফিরলেন ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। তাকে পেয়ে সেদিন মা আর ভাইবোনদের কী যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস!
শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। খুব ইচ্ছের কারণে গিটার শিখতে ভর্তি হলেন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া ক্রিকেটও খেলতেন নিয়মিত। হয়তো গিটারিস্ট বা ক্রিকেটার হতেন। কিন্তু ছায়ার মতো তার সঙ্গী ছিল দুঃসাহস। সেই দুঃসাহসের পালে হাওয়া দিলেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো। ১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন মার্শাল টিটো। আলাপচারিতায় শেখ জামাল জানালেন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান। সঙ্গে সঙ্গে মার্শাল টিটো তাকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। দুই মাস পরই ১৯৭৪ সালে বসন্তে যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন শেখ জামাল। কিন্তু ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া আর ভাষাগত সমস্যার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। মার্শাল টিটো তাকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণের পরামর্শ দেন। ১৯৭৪ সালের শরতে লন্ডনে এলেন শেখ জামাল। কিন্তু সরাসরি স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলেন না। তার আগে ব্রিটেনের আর্মি স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ, বেকসফিল্ড থেকে কিছু পূর্ব প্রশিক্ষণ নিতে হলো। তারপর স্যান্ডহার্স্টের শর্ট সার্ভিস কমিশনে ছয় মাসের সুকঠিন গ্রাজুয়েট কোর্স করেন।
১ আগস্ট থেকে স্যান্ডহার্স্টে নিয়মিত ক্যারিয়ার কোর্সের সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাননি শেখ জামাল। কারণ তার প্রিয় দুই বন্ধু দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তাছাড়া অনেকদিন মায়ের সান্নিধ্য থেকেও বঞ্চিত। মাকে না দেখে কতদিন থাকা যায়! মা যে তার খুব প্রিয়।
ফিরে এলেন ঢাকায়। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পোস্টিং হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। কোম্পানি অফিসার হিসেবে শুরু হলো রেজিমেন্টজীবন।
প্রায় দেড় মাসের পেশাদার সৈনিক জীবন পেয়েছিলেন শেখ জামাল। তবু এই সামান্য সময়েও পেশাগত দক্ষতা ও কাজের প্রতি ভীষণ রকম আন্তরিক ছিলেন। ইউনিট মাঠে সৈনিকদের সঙ্গে বাস্কেটবল খেলেন, বক্সিং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। সন্ধ্যায় সৈনিকদের সঙ্গে মেসে রাতের খাবার খান। রাষ্ট্রপতির সন্তান হিসেবে আলাদা কোনো সুযোগ কখনো নেননি। বরং নিজের টাকায় কোম্পানির সৈনিকদের জন্য উন্নতমানের প্লেটের ব্যবস্থা করেন। মায়ের নির্দেশে, গাড়িতে করে নয়, অন্য তরুণ অফিসারদের মতো মোটরসাইকেলে করে ক্যান্টমেন্টে যাতায়াত করতেন।
১৪ আগস্ট ১৯৭৫। ক্যান্টমেন্টে না গিয়ে, মায়ের অনুরোধে রাতে বাসায় থেকে গিয়েছিলেন শেখ জামাল।
১৫ আগস্ট ভোররাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সে বাড়িতে উপস্থিত পরিবারের সবাই বিশ্ব ইতিহাসের এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। মাত্র ২১ বছর তিন মাস ১৮ দিন বয়সী শেখ জামালও।
শেখ জামালের দুঃসাহস ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে-পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। তার দুঃসাহস তারুণ্যের গর্ব।
জাহ্নবী