পড়ালেখা শেষ করে সবাই ছুটছে সরকারি চাকরির পেছনে। আর এটা সবচেয়ে বেশি বোঝা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে গেলে। সকাল ৭টা থেকেই শুরু হয়ে যায় লাইনে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতা। প্রথমে শুধু ব্যাগ রেখে জায়গা রাখা হয়। ঠিক ৮টায় লাইব্রেরির গেট খুলে দেওয়া হয়…সারি বেঁধে সুশৃঙ্খলভাবে শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরির ভেতরে প্রবেশ করেন…তবে বিসিএস পরীক্ষার আগে এই লাইন শুরু হয় ভোর ৬টা থেকে, লাইনও থাকে অনেক দীর্ঘ।
সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে সকালের প্রতিদিনের দৃশ্য দেখে অনেকেই অবাক হতে পারেন, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশে সরকারি চাকরি সবার অতি কাঙ্ক্ষিত। এ জন্য কঠিন এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। কিন্তু চাকরিপ্রত্যাশীদের নিয়মিত পড়াশোনার জন্য নেই পর্যাপ্ত লাইব্রেরি। অন্যদিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে পড়ে আছে পাবলিক লাইব্রেরি, এমনকি বিজনেস ফ্যাকাল্টির একমাত্র লাইব্রেরিও বন্ধ করে রাখা হয়েছে, আর এসব চাপ এসে পড়েছে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির ওপর।
সাবেকদের কারণে লাইব্রেরিতে জায়গা পান না বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরা। চাইলেও পড়ালেখা করার জন্য লাইব্রেরিতে জায়গা হয় না, আর সব কিছু বিবেচনা করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে প্রবেশ করানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটি বাস্তাবায়ন হলে ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও যারা গ্রন্থাগারে পড়তে যান, বিশেষ করে বিভিন্ন চাকরি ও বিসিএস প্রস্তুতির জন্য পড়তে যাওয়ারা গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে পারবেন না। আগামী বছর থেকেই এই নিয়ম চালু হবে। ১০মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের দেওয়া এমন ঘোষণায় বেশ শঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনরা, যারা নিয়মিত লাইব্রেরিতে চাকরির পড়ালেখা করেন। অন্যদিকে পাঞ্চ কার্ডে বর্তমান শিক্ষার্থীরা সুবিধা পেলেও সাবেকরাও যাতে বিপদে না পড়েন সে ব্যবস্থা নেওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তারা।
শফিকুল ইসলাম, ঢাবির সমাজকল্যাণ গবেষণা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘পাঞ্চ কার্ড কার্যকর হলে ভালো হবে কিন্তু আসলেই হবে কি না সেটাই বড় কথা। কারণ আগেও এমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন ভিসি এসে বলেন, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। পাঞ্চ কার্ড চালু হলে প্রাক্তনরা লাইব্রেরিতে আসতে পারবেন না, সেক্ষেত্রে তাদের জন্য আলাদা একটা জায়গা নির্ধারণ করা উচিত। মাস্টার্স বা অনার্স শেষের দিকে সবাই চাকরির পড়া শুরু করেন। সেক্ষেত্রে তাদের কোথাও পড়ার সুযোগ না দিলে তারা পড়বেন কোথায়। সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।’
সাব্বির হোসেন স্বাধীন, ঢাবির বিজনেস ফ্যাকাল্টির একজন সাবেক ছাত্র। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে ডিসিশন জানিয়ে দিলে তো হবে না, সময় দিতে হবে। লাইব্রেরিতে সাবেক যারা আসেন তাদের সংখ্যাও অনেক। তাই সময় নিয়ে যদি প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্ত জানায় তাহলে ভালো হয়। যারা সরকারি চাকরির জন্য পড়ছেন, তাদের কারণে বর্তমান শিক্ষার্থীরা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখা করতেও আসতে পারেন না। বিজনেস ফ্যাকাল্টির লাইব্রেরি বন্ধ,পাবলিক লাইব্রেরি বন্ধ, সবাই সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতেই আসেন। এখানে চাপ পড়ে প্রচুর। প্রশাসন সিদ্ধান্ত যদি নিতেই চায় তাহলে অন্য লাইব্রেরিগুলো চালু করুক। সব জায়গা বন্ধ হয়ে গেলে চাকরিপ্রত্যাশীরা কোথায় পড়ালেখা করবে?’
তৌফিকুর রহমান ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পাঞ্চ কার্ডের ব্যবস্থা করলে অবশ্যই রানিং স্টুডেন্টদের জন্য ভালো হয়, তারা এসেই লাইব্রেরিতে বসতে পারবেন, পড়ালেখা করতে পারবেন। কিন্তু এর বিপরীতেও কথা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় একজন ছাত্রকে হলে সিট দেয় সেকেন্ড ইয়ার বা থার্ড ইয়ারে গিয়ে। আবার একাডেমিক পড়া শেষ হওয়ার পরেই হল ছেড়ে দিতে হবে, লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারবে না, এটা কেমন যুক্তি। তাহলে ফার্স্ট ইয়ার থেকেই হলে সিটের ব্যবস্থা করুক। সেটা তো করছে না। আগে চিন্তা করতে হবে দেশের সার্বিক কাঠামো কেমন। এখানে শিক্ষার্থীদের স্বপ্নই থাকে একটা সরকারি চাকরি, এর জন্য একাডেমিক পড়ালেখা কাজে আসে না। সেক্ষেত্রে লাইব্রেরিতে তো সবাই এসে চাকরির পড়াই পড়বে। উদ্যোগ ভালো, বর্তমান শিক্ষার্থীরা অনেকেই লাভবান হবেন, কিন্তু সাবেক ছাত্ররা যে সময় প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে পার করেছেন, সেই সময় বিবেচনা করেও তাদের জন্য মিনিমাম দুই বছরের জন্য একটা কার্ডের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত যাতে একাডেমিক পড়ালেখা শেষ হলেও তারা যেন লাইব্রেরিতে এসে পড়তে পারেন।’
ঢাবির দর্শন বিভাগের ছাত্র আব্দুল আলীম বলেন, ‘অনেকে আছেন যারা ঢাবিরও না, তারাও হলে থাকেন, লাইব্রেরিতে পড়েন। আবার যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারাও দীর্ঘসময় হলে থাকেন। সেক্ষেত্রে নতুনদের জন্য সমস্যা তৈরি হয়।’