ভাগ্য বদলাতে প্রতিদিনই দেশ ছাড়ছে হাজারো বাংলাদেশি। তবে বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করা নিয়ে বিদেশগামীদের ভোগান্তির কথা সবার জানা। অসহনীয় এই ভোগান্তি কমিয়ে আনতে বিদেশে যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশনে কাজ করে যাচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। ২০২১ সালের শেষের দিকে বিদেশগামীদের সেবা দিতে তৈরি করা হয় ‘আমি প্রবাসী’ নামের একটি অ্যাপ। এটি ব্যবহার করে সহজেই যে কেউ বিদেশে কর্মসংস্থান খুঁজে বের করাসহ বিদেশ যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া ঘরে বসে সম্পন্ন করতে পারেন।
বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের বিএমইটি নিবন্ধন থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, ছাড়পত্র ও স্মার্ট কার্ডসহ সবই এখন মিলছে অনলাইনে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের সব সেবাই ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে এই অনলাইন প্রক্রিয়া পুরোপুরি চালু হলে নিরাপদ অভিবাসনে যোগ হবে নতুন মাত্রা।
মাত্র তিন বছরেই এই অ্যাপের ব্যবহারকারী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮ লাখেরও বেশি। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করে ঘরে বসেই এখন বিএমইটির ডাটাবেইজে রেজিস্ট্রেশন করা যায়। আর এখন পর্যন্ত এই সেবা নিয়েছেন ৩০ লাখেরও বেশি বিদেশগামী ব্যক্তি। আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এই সেবা নিতে যেকোনো জনশক্তি কার্যালয়ে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এখন ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ ব্যবহার করে, ঘরে বসেই সে সেবা নিতে পারছেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা।
সৌদি আরব ফেরত প্রবাসী আবু রায়হান করোনার সময় অ্যাপটি ব্যবহার শুরু করেন। তিনি এটি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে বলেন, ‘প্রথমবার বিদেশ যেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও রেজিস্ট্রেশন, ট্রেনিংয়ের শিডিউল নেওয়া, সার্টিফিকেট উত্তোলন, স্মার্ট কার্ডসহ বিদেশ যাওয়ার প্রতিটা ধাপ ম্যানুয়াল থাকায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। ব্যয়ও হয়েছে অতিরিক্ত। তবে এখন এসব প্রক্রিয়া ডিজিটাল হওয়ায় এসব ঝামেলা অনেকটাই করেছে। সবকিছু নিজে নিজেই করা যাচ্ছে। তবে বাকি কার্যক্রমগুলো অনলাইনে সম্পন্ন করা গেলে আরও ভালো হতো।’
করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যখন স্থবির হয়ে পড়ে। বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিও থমকে যায়। আর এই সময় ভরসা হয়ে ওঠে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। এ অবস্থায় প্রবাসী আয় বাড়াতে তৎপর হয় সরকার। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ও সুশৃঙ্খলভাবে করোনার টিকা পেতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এই অ্যাপ।
১৭ লাখেরও বেশি বিদেশগামী করোনা টিকার রেজিস্ট্রেশন করেন ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ ব্যবহার করে। ফলে কোনো রকম ভোগান্তি ছাড়াই বিদেশগামীরা টিকা নিয়েছেন।
করোনা-পরবর্তী সময়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের হয়রানি ও ভোগান্তি কমাতে বিদেশ যাত্রার সব সরকারি প্রক্রিয়াগুলো ডিজিটালাইজেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপে প্রাথমিকভাবে বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন, প্রি-ডিপার্চার ওরিয়েন্টেশন (পিডিও), ট্রেনিং এবং বিএমইটি কিউআর কোড সংবলিত স্মার্ট কার্ডসহ চারটি সেবা ডিজিটালাইজেশন করা হয়। বিএমইটির তথ্যমতে, এ পর্যন্ত প্রায় ২২ লাখ পিডিও অন্তর্ভুক্তি হয়েছে এই অ্যাপের মাধ্যমে।
অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পিডিওতে অংশ নেওয়ার জন্যও নানা ঝামেলা হতো। এই সেবাটি নিতে বিদেশ গমনেচ্ছুদের এক দিন পিডিও শিডিউল চেক করতে আসতে হতো, আরেক দিন ভর্তি, তারপর কোর্সে অংশগ্রহণ ও সর্বশেষ সার্টিফিকেট উত্তোলন করতে হতো। এসব প্রক্রিয়াতেই নষ্ট হতো অন্তত সাত থেকে দশ কর্মদিবস ও অর্থ। আর এখন পিডিওর ডিজিটালাইজেশনের ফলে অনলাইনেই সেবাগ্রহীতা শিডিউল দেখে অনলাইনে পেমেন্ট করে, সরাসরি পিডিও সেশনে ভর্তি হতে পারছেন। আবার কোর্স শেষে সার্টিফিকেটও মিলছে অনলাইনেই। ফলে বিদেশগামীদের একদিকে বাঁচছে টাকা, অন্য দিকে পোহাতে হচ্ছে না ভোগান্তি।
কর্মকর্তাদের ফাইল জট কমাতে ও রিক্রুটিং এজেন্সিদের সেবাগুলোও নিরবচ্ছিন্ন করতে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিদের সেবাগুলো। শুরুতে এজেন্সিগুলোর ডিজিটালাইজেশনে কিছুটা অনীহা থাকলেও সময়ের ব্যবধানে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি রিক্রুটিং এজেন্সি যুক্ত হয়েছে স্মার্ট সেবায়।
অ্যাপে গিয়ে যাবতীয় কাগজপত্রাদিসহ একজন বিদেশগামীকে অনলাইন ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন করতে হয়। এরপর কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গেই অভিবাসনপ্রত্যাশীরা তাদের মোবাইলে স্মার্ট কার্ডটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে পারবেন বা প্রিন্টও করতে পারবেন। সেই সঙ্গে কিউআর কোডের মাধ্যমে স্মার্ট কার্ডটি দেখাতে পারবেন ইমিগ্রেশনসহ বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে। ফলে স্মার্ট কার্ডটি হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোনো ভয়ও নেই।
অ্যাপটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সাইফ উল আলম জানান, এটি ব্যবহারে অভিবাসীপ্রত্যাশীদের থেকে বেশি সুবিধা পাবেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। কারণ আমাদের সিস্টেমে রিক্রুটিং এজিন্সিগুলো বিএমইটিতে না এসেও অনলাইনে তাদের ক্লায়েন্টদের ফাইল পুট-আপের সুযোগ রয়েছে। এ কারণে ফাইল নিয়ে তাদের আর কোনো দপ্তরে ঘুরতে হবে না। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে না।
তিনি আরও বলেন, আগে শুধু ম্যানুয়ালি যখন বিএমইটি ক্লিয়ারেন্সের জন্য ফাইল জমা পড়ত, সেখানে লোকবলের ঘাটতি থাকায় সময়মতো অনেকেরই ক্লিয়ারেন্স পেতে সমস্যা হতো। এখন অনলাইনে কিউআর কোডের মাধ্যমে মিলছে বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স।
বিএমইটির সাবেক মহাপরিচালক শহিদুল আলম অ্যাপটিকে সেইফ মাইগ্রেশন বা স্মার্ট মাইগ্রেশন নাম দিয়ে ডিজিটাল কিউআর কোডভিত্তিক স্মার্ট কার্ড প্রবর্তনকে যুগান্তকারী সংযোজন হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে একদিকে কার্ড প্রিন্টিংয়ের অতিরিক্তি ঝামেলা কমেছে। শুধু কার্ড প্রিন্টিং এড়ানোর কারণে সরকারে এখান থেকে বছরে বড় অঙ্কের খরচ কমেছে। এ ছাড়া ভুয়া স্মার্ট কার্ড বা জালিয়াতির মাধ্যমে ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়েছে। কাজে এসেছে স্বচ্ছতা।
গত বছরের জুনে অনলাইনে বিএমইটি ক্লিয়ারেন্সের ফিচারটি চালু করা হয়। এতে গ্রাহকদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। বিএমইটির তথ্যমতে, ইতোমধ্যে ৮ লাখেরও বেশি কিউআর কোডভিত্তিক ইমিগ্রেশন স্মার্ট কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। গত মাসে রেকর্ড সংখ্যক বিএমএইটি ছাড়পত্র ইস্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া ট্রেনিংয়ে অংশ না নিয়ে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়েছে। ফলে এক দিকে বিদেশে গিয়ে শ্রমিকদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে, অন্যদিকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের হারানো আস্থা ফিরছে। ইতোমধ্যে আড়াই লাখেরও বেশি কর্মী বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারের বিভিন্ন কোর্সে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
বর্তমানে এই অ্যাপে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ নতুন চাকরির খোঁজ মিলেছে। যে কেউ চাইলেই নিজের চাকরি নিজেই খুঁজে অথবা নিজের সংগৃহীত ভিসার প্রসেসিং বা সিঙ্গেল ভিসার প্রসেসিং ওয়ানস্টপের মাধ্যমে করতে পারবেন। বিএমইটির ওয়ানস্টপ সেবাও অনলাইনে মিলছে। তাই যে কেউ চাইলেই এখন নিজের ভিসার যাবতীয় কার্যক্রম ঘরে বসে অনলাইনেই সম্পন্ন করতে পারবেন। সেই সঙ্গে একজন ব্যক্তি বিদেশ যাওয়ার আগে তার জব বা তার ভিসা সঠিক কি না অথবা তিনি যে কোম্পানিতে যাচ্ছেন সেটির তথ্য যাচাই করতে পারছেন।
‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের সিইও নামির আহমেদ বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্মার্ট মাইগ্রেশন বা স্মার্ট অভিবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এই খাতে শতভাগ ডিজিটাল সেবার আওতায় নিয়ে আনতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা ডিজিটাল সত্যায়ন চালু করছি। ফলে আর কোনো কর্মী বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। সেই সঙ্গে সরকারও ভিসা অ্যাটাস্টেশন বাবদ নির্ধারিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে না। অ্যাপটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে গুগল প্লে স্টোর ও আইওএস অ্যাপ স্টোর থেকে।
কলি