খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারের ভেতরে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আসামি, কয়েদির থাকার জায়গা থেকে শুরু করে খাবার বিতরণ, মোবাইল ফোনে কথা বলা, সব জায়গায় পদে পদে টাকা গুনতে হয়। টাকা দিলেই কারাবিধি না মেনেই একজন ব্যক্তি ইচ্ছেমতো মোবাইলে কথা বলতে পারেন। আর সবকিছুই চলে নগদ টাকার মাধ্যমে। কারাগার থেকে বের হওয়া একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হলে তারা খবর প্রকাশ না করার শর্তে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারে গড়ে প্রতিদিন ১৭০ থেকে ২০০ জন বন্দি থাকেন। তবে তিনি কয়েদি হোন কিংবা হাজতি, এই কারাগারের ভালো জায়গায় থাকতে হলে প্রত্যেককেই মাসিক ভাড়া দিতে হয়। ২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতি বন্দির কাছ থেকে মাসিক ভাড়া হিসেবে তিন হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা এবং ৩ নম্বর ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডে দেড় হাজার থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। মহিলা ওয়ার্ডেরও একই অবস্থা।
পুরুষ বা মহিলা, যেকোনো আসামিকে কারাগারে পাঠানো হলে ওইদিনই তাকে পুরো মাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়ে থাকার জায়গা নির্ধারণ করতে হয়। কেউ টাকা দিতে না পারলে তার জায়গা হয় ওয়ার্ডের টয়লেটের পাশের খালি মেঝেতে। কোনো আসামি যদি এক দিন বা এক সপ্তাহ পর জামিন পান, তারপরও তাকে পুরো মাসের ভাড়া দিয়ে আসতে হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে কারাগার থেকে জামিনে আসা মাটিরাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা মো. হোসেন বলেন, ‘জেলখানায় টাকা ছাড়া আসামির কোনো মূল্য নেই। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে কয়েদিকে ম্যানেজার (ওয়ার্ডের ম্যাড) বানিয়ে বন্দিদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয়। আমি ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ছিলাম। থাকার জায়গার ভাড়া হিসেবে ওয়ার্ডের ম্যাডকে দেড় হাজার টাকা দিতে হয়েছে।’
১০ শতাংশ কমিশনে নগদ টাকার লেনদেন
কোনো কারাগারেই নগদ টাকা লেনদেনের নিয়ম নেই। বন্দিদের প্রত্যেকেরই একটি করে প্রিজনার ক্যাশ (পিসি) বা ব্যক্তিগত তহবিল কার্ড রয়েছে। তবে খাগড়াছড়ি কারাগারে পিসি কার্ডের চেয়ে বেশি লেনদেন হয় নগদ টাকার। আর এসব নগদ টাকা প্রবেশ করানো হয় সাক্ষাৎ কক্ষের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পাইপের মাধ্যমে। ডিউটিরত কারারক্ষীরা এর জন্য বন্দিদের কাছ থেকে ‘জেলারের কমিশন বাবদ’ শতকরা ১০ টাকা অর্থাৎ প্রতি হাজারে ১০০ টাকা করে কেটে রাখেন। এ ছাড়া বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও আসামি বা তার স্বজনের কাছ থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়।
খাগড়াছড়ি জেলা সদরের বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, ‘আমার এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। সাক্ষাতের আগে বাইরের ক্যান্টিনে মোবাইল জমা রাখতে ৫০ টাকা দিতে হয়েছে। পরে সাক্ষাৎ করতে দিতে হয়েছে আরও ৫০০ টাকা। ভেতরে তিন হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম, কমিশন বাবদ ৩০০ টাকা কেটে রাখা হয়।’
ক্যান্টিনে রমরমা বাণিজ্য
এক কেজি ব্রয়লার মুরগি বাজার থেকে ১৮০ টাকায় কিনে সেটি কারাগারের বন্দিদের কাছে কাঁচা বিক্রি করা হয় ৫০০ টাকায়। এরপর যুক্ত করা হয় রান্নার খরচ। এভাবে ৭৫০ টাকার গরুর মাংস কেজি বিক্রি হয় ২৫০০ টাকায়।
যদিও বাড়তি টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে ক্যান্টিনে রান্না করা তরকারি বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করেছেন কারা অভ্যন্তরের ক্যান্টিন ম্যানেজার কারারক্ষী রিয়াদ। তিনি বলেন, ‘মাঝে মধ্যে তরকারি রান্না করে বিক্রি করা হয়। জেলার স্যার সব জানেন।’
ফোন কলের মিনিট ২০ টাকা
নিয়ম হলো কারা অভ্যন্তরের টেলিফোন থেকে বন্দিরা প্রতিমিনিট এক টাকা হারে সপ্তাহে এক দিন সর্বোচ্চ ৫ মিনিট কথা বলতে পারবেন। আর কথা বলার চার্জ কাটা হবে পিসি কার্ড থেকে। বর্তমানে খাগড়াছড়ি কারাগারের ভেতরে বন্দিদের টেলিফোনে কথা বলার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন কারারক্ষী তুষার। নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনি বন্দিদের কাছ থেকে প্রতি মিনিট নগদ ২০ টাকা করে চার্জ আদায় করেন। মিনিটে ২০ টাকা করে দিলে বন্দিরা যখন যত মিনিট ইচ্ছে কথা বলতে পারেন।
প্রতি মিনিট ২০ টাকা হারে কার নির্দেশে আদায় করছেন তা জানতে চাইলে দায়িত্বরত কারারক্ষী তুষার বলেন, ‘আমি ছোট চাকরি করি। বেশি কিছু বলতে পারব না। বেশি কিছু বললে শেষে আমাকেই বিপদে পড়তে হবে।’
খাবার পান না বন্দিরা
সদ্য জামিনপ্রাপ্ত আসামি পানছড়ি উপজেলার বাসিন্দা ইমন বলেন, ‘বন্দিদের যেসব খাবার দেওয়া হয় তার মান খুবই খারাপ। রান্না তরকারি এবং ডাল সবই খাবার অনুপযোগী। বাধ্য হয়ে তাই বেশির ভাগ আসামিকে ক্যান্টিন থেকে চড়া দামে তরকারি কিনে খেতে হয়।’
জেল কোড অনুযায়ী বন্দিদের জন্য সরকারিভাবে যে পরিমাণ খাবার বরাদ্দ থাকে তার অর্ধেকও পায় না খাগড়াছড়ি কারাগারের বন্দিরা। প্রতিদিনের বরাদ্দের ডাল, তেল, মসলা ও পেঁয়াজ অর্ধেকের বেশি লোপাট করা হয়। মাছ এবং মাংসও দেওয়া হয় বরাদ্দের চেয়ে অনেক কম। আর এই লোপাটের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সহকারী প্রধান কারারক্ষী ছবিরঞ্জন ত্রিপুরাকে। প্রতিদিন সকালে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব খাদ্যদ্রব্য নিয়ে কারা অভ্যন্তরের রান্না ঘরে যান। তবে ছবি তুলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানোর পর তা থেকে অর্ধেকের বেশি খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে রাখেন তিনি। পরে বেলা ১২টার দিকে তিনি পুনরায় কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং সরিয়ে রাখা খাদ্যদ্রব্যগুলো বাইরে নিয়ে আসেন। এরপর সেসব খাদ্যদ্রব্য কাশেম নামের একজন অটোরিকশা চালককে দিয়ে খাগড়াছড়ি বাজারের একটি মুদি দোকানে বিক্রি করান ছবিরঞ্জন ত্রিপুরা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী প্রধান কারারক্ষী ছবিরঞ্জন ত্রিপুরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান এবং উৎকোচ দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘জেলার স্যার চা খেতে দিয়েছেন।’ উৎকোচ দেওয়া প্রসঙ্গে জেলারের কাছে জানতে চাইলে জেলার আক্তার হোসেন শেখ বলেন, ‘আরে রাখেন এটা। মোটরসাইকেলে তেল ভরবেন।’
জেলারের নামে আরও অভিযোগ
এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির জেলার আক্তার হোসেন শেখ কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। উল্টো দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছেন বন্দিদের ম্যাড ও কারারক্ষীদের ঘাড়ে। তিনি বলেন, ‘যদি কারা অভ্যন্তরে এমন কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তবে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ম্যাড এবং দায়িত্বরত কারারক্ষীরা জড়িত থাকতে পারে। আমি বিষয়গুলো সিরিয়াসলি দেখব।’
এদিকে জেল সুপার মো. এনামুল কবিরও দিলেন দায়সাড়া জবাব। তিনি জানালেন কোনো অনিয়মই হয় না এই কারাগারে। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন- ‘খুব ছোট একটা জেল এটা। সাপ খাওয়া পাহাড়িরা কয় টাকা দিয়ে সিট কিনবে বলেন? এরা টাকা কোথায় পাবে বলেন?’
কারা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-মহাপরিদর্শক টিপু সুলতান বলেন, ‘অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখব। সত্যতা পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’