
প্রবন্ধ রচনা
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য/ সৌন্দর্য
ভূমিকা: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেই প্রত্যেক দেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও রূপ ফুটে ওঠে। সব দেশের মানুষ তার প্রকৃতিকে আপন করে নেয়, নিবিড়ভাবে ভালোবাসে। বাংলাদেশের প্রকৃতিও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। আমরা দেশের রূপ-সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হই। প্রকৃতিপ্রেমী হনর ডি ব্যালজাক বলেছেন, ‘প্রকৃতির ভালোবাসাই একমাত্র ভালোবাসা, যা মানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রতারিত করে না।’ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি এ দেশকে যেন বিধাতা সব সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছেন। ফুলে-ফলে, শস্যে ভরা এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি বলেছেন-
“কোন বনেতে জানি নে ফুল,
গন্ধে এমন করে আকুল
কোন গগনে ওঠে রে চাঁদ এমনি হাসি হেসে
আঁখি মেলে তোমার আলো
প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,
ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে”
দেশকে ভালোবাসার এ আবেগ ও উচ্ছ্বাসপূর্ণ কবির বাণী সার্থক। এ দেশের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক কবি বিভিন্ন দেশাত্মবোধক সংগীত রচনা করেছেন।
এ দেশের ভূ-প্রকৃতি: পল্লী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি এ দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে রয়েছে পাহাড়িয়া বনভূমি। এ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে সমুদ্র-সমতলে অবস্থিত খুলনার সুন্দরবন সৌন্দর্যের এক মোহনীয় লীলাভূমি। ময়মনসিংহের পূর্ব প্রান্তে সুসং ও গারো পাহাড় যেন নীল দিগন্তের সঙ্গে মিতালি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন প্রান্তরে সবুজ পর্বতশ্রেণি উন্নত শির তুলে দাড়িয়ে আছে। ঢাকা ও ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে ঢেউ দোলানো মধুপুর আর ভাওয়াল গড়ের বন। সিলেটের টিলায় টিলায় চা গাছের সাজানো বাগান যেন সবুজের সিঁড়ি। বাংলাদেশের দক্ষিণে অনেকগুলো দ্বীপ আছে। নারকেল-সুপারি গাছের দীর্ঘ সারি সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে নতুন রূপ দান করেছে।
আরো পড়ুন : পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা, ৩য় পর্ব
আবহাওয়া ও জলবায়ু: জলবায়ু দেশের প্রকৃতি গঠনে বিশেষভাবে সাহায্য করে। বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। গ্রীষ্মের আবহাওয়ার নানা রূপ দেখা যায়। চৈত্র-বৈশাখে প্রচণ্ড গরম পড়ে। প্রকৃতি তখন রুক্ষ ও শুষ্ক থাকে। বর্ষায় গরম কিছুটা কমে যায়। বর্ষার আগমনে গাছের পাতায় পাতায়, তৃণ দলে ও ফসলে সবুজ খেলা করে। এ সময় প্রকৃতি স্নিগ্ধ রূপ ধারণ করে। শরতে সবুজের মেলা বসে মাঠের বুকে। শরতে কাশবন সাদা ফুলে ফুলে ভরে যায়; ধানখেতের শ্যামল রূপ আমাদের মনকে জুড়িয়ে দেয়। শরতের শেষে হেমন্ত আসে পাকা ধানের খবর নিয়ে। আমন ধান কাটায় কৃষকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন ধান পেয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্নের উৎসব। প্রকৃতিতে এরপর শীতের আগমনি বার্তা শুরু হয়। রাতে শিশির পড়া শুরু হয়। শীতের উপস্থিতিতে প্রকৃতির রংবদল হতে শুরু করে। এ সময় গাঁদা, সূর্যমুখী, রজনিগন্ধা, ডালিয়া প্রভৃতি ফুল ফোটার ফলে প্রকৃতি যেন তার জীর্ণতাকে ঢাকার প্রয়াস পায়। এরপর আসে ঋতুরাজ বসন্ত। তখন গাছে গাছে নতুন নতুন পাতা দেখা যায়। মাঠে মাঠে সবুজ ঘাস আর চারদিকে শিমুল, পলাশ, অশোক, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি ফুল প্রকৃতিতে যে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটায় তার কোনো তুলনা হয় না।
গ্রাম্য দৃশ্য: কুটির ঘেরা পল্লীগ্রাম যেন প্রকৃতির শোভামন্ডিত এক একটি নিকেতন। যে দিকেই তাকাই না কেন, দেখা যায় সবুজ মাঠ, ফুল-ফলময় বৃক্ষে-তৃণ গুল্মশোভিত গাছের মনোরম শোভা আর শস্য-শ্যামল ক্ষেত্র। এ অপূর্ব সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। আর চারদিকের শস্য-শ্যামল প্রান্তর দেখে আমাদের শরীর ও মন মুগ্ধ হয়ে যায়। মাঠে সবুজের সমারোহ আর দীঘির পানিতে হাঁসের বিচরণ, সত্যি এক অপরূপ দৃশ্য। গ্রামের রাস্তার পাশে সারি সারি তাল ও নারকেল গাছ মনকে অন্যরকম ভালো লাগায় ভরিয়ে দেয়। তাইতো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
‘অবারিত মাঠ, গগন-ললাট চুমে তব পদ-ধূলি,
ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ।
স্তব্ধ অতল দীঘি-কালোজল, নিশীথ-শীতল স্নেহ’
পল্লীগ্রামের গোধূলি লগ্নের দৃশ্য সবচেয়ে মনোহর। রাখালরা গরু নিয়ে মাঠ থেকে ফিরে আসে। দিনের কাজ শেষ করে মানুষ যেমন ঘরে ফেরে তেমনি পাখিরা নীড়ে ফিরে যায়। কুলবধূরা দলবেঁধে নদী থেকে পানি নিয়ে ফিরে যায়। চমৎকার এ দেশ আর এ দেশের মানুষ। তাইতো এ দেশের কৃষক লাঙল ঠেলতে ঠেলতে গান ধরে-
‘মন তুমি কৃষিকাজ জান না, মন মানব জনম রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।’
নদ-নদীর দৃশ্য: এ দেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বুক চিরে বয়ে যাওয়া অসংখ্য নদ-নদী এ দেশের প্রকৃতিকে সুন্দর করে তুলেছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা প্রভৃতি নদী বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় এ দেশের সমভূমি সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা হয়েছে। নদীর বুকে যখন সারি সারি ডিঙি নৌকা, মহাজনি নৌকা পাল তুলে এবং লঞ্চ স্টিমারগুলো ধোঁয়া উদগিরণ করতে করতে চলতে থাকে, তখন এরূপ অপূর্ব শোভা দেখে মন খুশিতে ভরে যায়। তাইতো এ দেশের মাঝিরা নদীর স্রোতে নৌকা ভাসিয়ে উদাস মনে গান করে-
‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না’
(বাকি অংশ আগামীকাল প্রকাশ করা হবে)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা
কবীর