তদারকির ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে । খবরের কাগজ
ঢাকা ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, শনিবার, ১১ মে ২০২৪

তদারকির ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:২৩ এএম
তদারকির ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

বাজারব্যবস্থায় এভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া এবং সেটির বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত কাঠামো না থাকলে দেখা যায় সিদ্ধান্তে সফল হওয়া যায় না। ইতিপূর্বে আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, যেসব পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন এলপিজি আর তেলের ক্ষেত্রে কিছুটা দেখা গেছে। কাঁচা পণ্যের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেসব পণ্য কম সময়ে বাজারে আসে এবং চাহিদা থাকে, সে ক্ষেত্রে নিয়মিত বাজার তদারকি এবং নির্ধারণ করা মূল্যে সেটি বিক্রি হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য কাঠামো দরকার। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে মনিটরিং কাঠামোটি শক্তিশালী না। সে কারণে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে যে প্রত্যাশা করা হয়, সেটি পূরণ হয় না। 

এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত যত মার্কেট এজেন্ট থাকবে তাদের প্রত্যেকের নিবন্ধন দরকার। শুধু নরমাল ট্রেড লাইসেন্স থাকলে চলবে না। আলু বিক্রি করতে গেলে আলুর ট্রেড লাইসেন্স, পেঁয়াজ বিক্রি করতে হলে পেঁয়াজের ট্রেড লাইসেন্স, মরিচ বিক্রি করতে হলে মরিচের ট্রেড লাইসেন্স থাকতে হবে। লাইসেন্সধারীরা বাজারে যে ব্যবসায়িক লেনদন করবেন, তা ডিজিটাল পদ্ধতিতে রিপোর্ট করবেন। 

তাদের প্রত্যেকের আইডি থাকবে এবং আইডি দিয়ে তার কাছে কী পরিমাণ পণ্য মজুত আছে, সেটি শনাক্ত করা যাবে। এগুলো জাতীয় পর্যায় থেকে মনিটরিং করলে হবে না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও মনিটরিং সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে হবে। সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের যে অফিসগুলো রয়েছে তাদের সক্রিয়ভাবে এখানে কাজ করা দরকার। একই সঙ্গে নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কি না, বাজার কমিটিগুলোকেও তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাদেরও একধরনের দায়িত্ব রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আইনগত কোনো দুর্বলতা আছে কি না, সেগুলো দেখে প্রয়োজন হলে সংশোধন করা দরকার। বাজারে বড় ধরনের কোনো অযাচিত প্রভাব আছে কি না, সেটিও দেখা দরকার। বেশি বিক্রেতা যেন একটি বাজারে থাকেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে এককভাবে কারও ওপর যেন নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে সেটি দেখতে হবে। আইনগতভাবে নীতিগুলো দেখা, যাতে বাজারে পর্যাপ্তসংখ্যক উৎপাদক থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিক্রির বা বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা দেওয়া দরকার। একজন ডিলার যেন একটি পণ্যের একমাত্র সরবরাহক হতে না পারেন, সেই বাধ্যবাধকতা তৈরিতে আইনগত সংশোধনের দরকার আছে। 

লেখক: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

আকস্মিক বন্যা, জলাবদ্ধতা ও জলশূন্যতা: প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১১:২৮ এএম
আকস্মিক বন্যা, জলাবদ্ধতা ও জলশূন্যতা: প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম
ড. তোফায়েল আহমেদ

এপ্রিল ২০২৪ ছিল বিশ্বব্যাপী উত্তপ্ত মাস। সারা দেশ এপ্রিলের কয়েক সপ্তাহ তীব্র দাবদাহে পুড়ছিল। চট্টগ্রামও তার ব্যতিক্রম ছিল না। চলতি মাসের ৬ তারিখ ঝুমবৃষ্টি নামে। মানুষ বৃষ্টিসিক্ত হয়েও আনন্দের হাসি হাসে, কিন্তু পরক্ষণে তা বিষাদে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের আবহাওয়া অধিদপ্তর ৫ তারিখ রবিবার বিকেল ৪টা থেকে সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। এর মধ্যে রবিবারে বিকেলের এক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে মহানগরীর একটা বড় অংশ ডুবে যায়। ওই এলাকাগুলোর মধ্যে পাঁচলাইশ, প্রবর্তক মোড়, ২ নন্বর গেট, মুরাদপুর, শুল্কবহর, কাতালগঞ্জ, মির্জাপুল, ডিসি রোড, ওয়াসা মোড়, তিন পোলের মাথা, আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ এলাকা, চকবাজার ও বহদ্দারহাট অন্যতম। পানি সরতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়।

২০০৭ সালের ১২ জুন দিনটিকে অতিবৃষ্টিজনিত পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ি ধসে শতাধিক আদম সন্তানের মৃত্যুর কারণে ঐতিহাসিক ‘চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি’ নামে অভিহিত করা হয়। এ দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রামের আকস্মিক বন্যা এবং জলাবদ্ধতা নিয়ে শুরু হয় নানামুখী চিন্তাভাবনা। ওই সময়ে আমি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করি, যার শিরোনাম ‘চট্টগ্রামের বিপর্যয় ও উন্নয়ন: একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার রূপরেখা’। এ প্রবন্ধ সে সময় দৈনিক পূর্বকোণ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করে। পরবর্তীতে ওই রচনার সঙ্গে পানি, জমি, বন্যা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে আরও চারটি রচনা ২০১১ সালে প্রকাশিত আমার ‘বৃত্ত ও বৃত্তান্ত’ বইটিতে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়।

সর্বশেষ গত ৪ মে (২০২৪) দৈনিক খবরের কাগজে ‘প্রচণ্ড দাবদাহ ও অত্যাসন্ন বন্যা: কার কী প্রস্তুতি’ শীর্ষক আর একটি রচনা প্রকাশ করি। এ ভূমিকাটুকু এ কারণে লিখলাম যাতে কোনো অনুসন্ধানী পাঠক এবং নীতিনির্ধারক-প্রশাসক ইচ্ছা করলে এ বিষয়ের নানা লেখা ও বলা কথাগুলোর একটি ধারাবাহিকতা দেখতে পারেন। চট্টগ্রামের পানি, পরিবেশ ও সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চট্টগ্রাম শহর তার আশপাশের নদনদী খাল-ছড়া, পাহাড়, কৃষি, আবাসন, হালদা-কর্ণফুলীর নাব্য, পানির স্তর ও পানির প্রবাহ এসবকে পাশ কাটিয়ে করলে তা মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হওয়ার নয়। তাই একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়েছিলাম। যেখানে চট্টগ্রাম মহানগরী, উত্তর-দক্ষিণের বিস্তৃত পাহাড় (যা পুবে পাঁচলাইশ, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি এবং পাহড়ের পশ্চিমে সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলা এবং পূর্ব ও দক্ষিণের বিশেষত রাঙ্গুনিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর পাহাড়) পাহাড়ি ছড়া-ঝরনা, নগরীর সীমার মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ খাল-নালা এবং এসব খাল নালার আউট পল হালদা কর্ণফুলীকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

তা ছাড়া কর্ণফুলী ও হালদার জোয়ার-ভাটা পানির প্রবাহ, নদীর বেড বা তলা, পলি স্তর স্টাডি করে মহানগরী ও অন্যান্য খালে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে স্লুইসগেট-রেগুলেটরগুলোর ডিজাইন সাযুজ্য রাখতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক প্রেক্ষিত পরিকল্পনা দূরে থাকুক, মহানগরীর হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগুলো সাধারণ সম্ভাব্যতা যাচাই (Feasibility study) ছাড়াই করে ফেলা হয়েছে বলে একটি প্রকল্প সভায় আলোচনা হয়। এটি একটি বিস্ময়ের ব্যাপার।

এখন গত ১৫ বছরে হালদা-কর্ণফুলী দিয়ে বলা যাচ্ছে না, ‘অনেক জল গড়িয়েছে’ বলতে হয় ‘জল গড়ানো হ্রাস পেয়েছে’। পাহাড়ি ছড়া-ঝরনাগুলো শীর্ণকায় বা সম্পূর্ণ শুকিয়েছে। বর্ষায় কাটা পাহাড়ের বালির স্রোত নগরীর খালগুলো দিয়েই পুনঃ পুনঃ প্রবাহিত হবে। শহরকেন্দ্রিক খাল খননের হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নানা যৌক্তিক-অযৌক্তিক কারণে বিলম্বিত হলেও গড়পড়তা প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রাজউক, সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড- এ চার সংস্থা একক ও যৌথভাবে চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে মহানগরীর ৩৬টি খাল খনন, প্রশস্তকরণ, পার্শ্ব সুরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ, খালের পাশে সড়ক, খালের ওপর সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ করছে।’

চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক দিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫৬১৬.৪৯ কোটি টাকা। ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৩৫৪৩.৪৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৭-২০২৩। কাজের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। এ প্রকল্প করার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। দ্বিতীয় প্রকল্পটি সিটি করপোরেশনের, বহদ্দারহাট-বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন। সময়কাল ২০১৭-২০২৪, প্রাক্কলিত ব্যয় ১৩৬২.৬২ টাকা, জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত ছাড় হয়েছে প্রায় ১৭২ কেটি টাকা এবং কাজের অগ্রগতি প্রায় ৫৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্ণফুলীর তীর বরাবর কালুরঘাট ব্রিজ থেকে চাক্তাই পর্যন্ত সড়ক প্রকল্পের সময়কাল ২০১৭-২০২৪। প্রক্কলিত ব্যয় ২৭৭৯.৩৯ কোটি টাকা এবং ছাড় হয়েছে ১২৯১.২৮ কোটি টাকা, আর কাজের অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। চতুর্থ প্রকল্প সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা, জলমগ্নতা ও পানি নিষ্কাশন, প্রাক্কলিত অর্থ ১৬২০.৭৩ কোটি টাকা, মেয়াদকাল ২০১৮-২০২৪।

২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ২৩৬ কোটি টাকা। অগ্রগতি ২৫ শতাংশ। এসব বর্ণনা একটি গতানুগতিক প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন। প্রশ্ন এখানে অনেক আসতে পারে। যেমন সব প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪-এর জুনে শেষ। তাহলে এখানে অর্থ ব্যয় ও ভৌত কাজের অগ্রগতি কী বার্তা দেয়, বরাদ্দ ও ছাড়কৃত অথের্র সঙ্গে কাজের ভৌত অগ্রগতির সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। কম বরাদ্দ পেয়েও ভৌত কাজের অগ্রগতি অনেক বেশি। তাতে দুটো বিষয় থাকতে পারে। এক. প্রাক্কলন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ছিল। দুই. কাজের মানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) চ্যানেলের নাব্যতার স্বার্থে কর্ণফুলী ও মোহনায় নিয়মিত হাইড্রোলজিক্যাল জরিপ এবং নিয়মিত ড্রেজিং করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড পানিপ্রবাহ, উচ্চ ও নিম্ন প্রবাহের তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণ করে। চবক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যের সঙ্গে মহানগরীর ৩৬টি খালের বর্ষাকলীন ও শুষ্ক মৌসুমের পানির প্রবাহের পরিমাপ করে পানির নানা কাঠামো অবকাঠামো নির্মাণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। যদি না হয় তাহলে সাধারণ জোয়ার-ভাটা, ভরা বর্ষার বাড়ন্ত জোয়ার এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জলস্তরের উচ্চায়ন প্রভৃতির সঙ্গে এ খাল খনন, ব্রিজ-কালভার্ট ও রেগুলেটর কীভাবে সম্পর্কিত হবে।

মহানগরীর বাইরের জল সম্পদ বা জলপ্রবাহকে একটি ‘আপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে সব প্রকল্প রচনা হয়েছে। বৃষ্টির পানি আকস্মিক বন্যা বইয়ে দেয়, জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। সুতরাং এটি একটি আপদ। এটি একটি মহাভ্রান্ত ধারণা। প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ একটি মূল্যবান সম্পদ, যা আপনি বিনামূল্যে পান। সে কথিত ‘আপদ’ থেকে রক্ষা পাওয়ার যে বহুমূল্যের প্রকল্প সেগুলো শেষ পর্যন্ত গলার ফাঁস হতে পারে। কংক্রিট সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট আমাদের নেতাদের-প্রকৌশলীদের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। জলপ্রবাহের স্বাভাবিক খাল যে রাজপথে রূপান্তর করা যায় সে ধারণা কি আমাদের আছে?

আমি আমার আগের লেখায় এক জায়গায় নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরের খালজাল (canal network)-এর উল্লেখ করেছিলাম। চট্টগ্রামের খালজালকে সড়কের পরিবর্তে সুদৃশ্য জলপথ, বিনোদন ও পরিবেশ অনুকূল ব্যয়সাশ্রয়ী কাঠামোতে রূপান্তর করা যেত। সময় চলে যায়নি, এখনো করা যায়। সেটি করতে হলে নগর সুরক্ষার সঙ্গে নগরীর বাইরের জলাধার তথা সাগর, নদী, খাল সবগুলোর জল সম্পদের সুষম ব্যবহার পরিকল্পনা দরকার হবে। চট্টগ্রাম শহরের নাগরিকরা বিশেষত বণিক-ধনিক শ্রেণি ও রাজনৈতিক নেতারা নগরীর দেখভালের দুটি প্রধান প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন ও সিডিএ সে রকম কোনো স্বপ্ন কি দেখতে বা দেখাতে পারেন?

চট্টগ্রামের উত্তরের প্রায় ৩৫ কিমি দৈর্ঘ্য ও গড়পড়তা ৪-৫ কিমি প্রস্থ পাহাড়, তার বন, তার অভ্যন্তরে সঞ্চিত জল, পাহাড় থেকে উৎপন্ন ছড়া যার মিষ্টি জলের একটি বড় অংশ হালদা ও কর্ণফুলীতে পড়ে। তার কথা আপনাদের পরিকল্পনায় ভুলে গেলে চলবে না। তার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল পর্বতমালা যেখান থেকে কর্ণফুলী, শঙ্খপ্রবাহ বয়ে আসে সে পার্বত্য অঞ্চলকেও হিসেবে নিতে হবে। বিবেচনায় নিতে হবে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর পাহাড় ও পাহাড়ি জলপ্রবাহকেও। আমরা বাছবিচারহীনভাবে পাহাড়ের মাটি কেটে প্লট বানাব, গাছ কেটে সাবার করব আর হাজার কোটি টাকার খাল খনন প্রকল্প করে তার সুফল পাব, সে ভরসা মিছে।

তাই প্রয়োজন পুরো অঞ্চলের তথ্যনির্ভর বাস্তবসম্মত একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। সে পরিকল্পনাকে দৃষ্টিতে রেখে রচিত ও বাস্তবায়িত হোক ছোট ছোট প্রকল্প। যা শুধু সিটি করপোরেশন, সিডিএ, সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড নয়, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোও বাস্তবায়ন করবে। সমস্যাগুলোকে প্রকল্পায়নের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখার চেষ্টা করা হোক। চট্টগ্রামে ২৩ জুলাই, ২০২৩-এ নগরের প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ফজলুল হক (কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ) এবং কমিশনের এ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম। চট্টগ্রামের জন্য একটি ‘আঞ্চলিক প্রেক্ষিত পরিকল্পন’ করার প্রস্তাব ও উদ্যোগ আপনাদের পক্ষ থেকে আসুক এবং চট্টগ্রামে সর্বস্তরে তা আলোচিত হোক, সেটি কামনা করি।

লেখক: গবেষক ও শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected] 

নির্বাচনে জিততে মরিয়া মোদি

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১১:২৪ এএম
নির্বাচনে জিততে মরিয়া মোদি
ড. পবিত্র সরকার

আমি জানি না, প্রধানমন্ত্রী বা তার দল নির্বাচনে জেতার জন্য নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে উঠেছেন, সে তো সবাইকেই মরিয়া হতেই হয়। তবে মরিয়া হলে কী হবে, তাতে জিতও হয়, হারও হয়। অর্থাৎ মরিয়া হওয়াটা জেতার অব্যর্থ গ্যারান্টি নয়। কিন্তু মরিয়া হওয়ার কিছু লক্ষণ আছে। এক হচ্ছে আবেগের মাথায় কিছু বলে ফ্যালা, তার পরিণাম ভালো না মন্দ হবে তা বিবেচনা না করেই। অজস্র জুমলা বা ভুয়ো গ্যারান্টি তো দিচ্ছেনই, সেও সবাইকেই দিতে হবে- আমাদের বিদেশের কালো টাকা উদ্ধার করে প্রতি ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে পনেরো লাখ টাকা আর দু-কোটি চাকরির কথা মনে আছে, কিন্তু এবারেও এদিক-ওদিক এমন মুখ ছোটাচ্ছেন যে তাতে একটা সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য তৈরি হচ্ছে। তাতেই মনে হচ্ছে, এই যাঃ, ভোটাররা এতে খুশি হবে তো? সত্যি সত্যি উনি বিশেষ শ্রেণির ভোটারদের ভোট চান তো? কিছু কিছু মন-কী-বাত এই ভোটের মরশুমে লুকিয়ে রাখতে হয়, বলে ফেলতে নেই। ওর মতো জ্ঞানী (আমি ডিগ্রিটিগ্রি নিয়ে মাথা ঘামাই না) লোক কি তা জানেন না?

ধরুন, এই খাদ্য নিয়ে সেই এক ঘ্যানঘ্যান। ভারতের এক বিশাল জনগোষ্ঠী নিরামিষ খান এটা সত্য, তা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাদের মধ্যেও তথাকথিত উঁচু জাতের লোকই খায় নিরামিষ। তথাকথিত নীচু জাতের লোক যা পায় তাই খায়, তাতে আমিষও থাকে। দক্ষিণ ভারতেও আমরা যখন গেছি, তখন শহরগুলোতে ‘মিলিটারি হোটেলগুলোয়’ দিব্যি মাছ-মাংস পেয়েছি। আবার আন্নামালাইয়ের গ্রামে জেলেদের ঘরে চিংড়ির ঝোল দিব্যি খেয়েছি। অর্থাৎ শুধু সংখ্যালঘুরা মাছ-মাংস খায় এবং অন্যেরা মাছ-মাংস ধরেছে মোগল রাজশক্তির প্রভাবে এ কথা সম্পূর্ণ হাস্যকর ভুল। নদী আর সমুদ্রের আবহে যারা থাকে তাদের একটা অংশ মাছ-মাংস থেকে দূরে থাকতে পারে না।

আর পৃথিবীর প্রায় সব জাতিই যখন মাছ-মাংস খায়, তখন আমি কোন দর্শন থেকে বলব যে মাছ-মাংস খাওয়া ভুল! সব জায়গায় তো মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি! আমরা খাব বা খাব না, গোষ্ঠী এ সিদ্ধান্ত নিতেই পারে, কিন্তু অন্যরা খাবে না- এই হুকুমজারি কি আমরা করতে পারি? প্রধানমন্ত্রী মাঝে মাঝে তার এই ‘মন কী বাত’ উগরে দিচ্ছেন, তার পরিণাম কী হবে হয়তো না বুঝেই? বাঙালি-ওডিয়া-অসমিযা, উত্তরপুবের সব উপজাতি, পুর আর দক্ষিণের সাঁওতাল, মুন্ডারি থেকে টুলু কুরুখ, উত্তরে সিকিমি, পশ্চিমে পাঞ্জাবি, মারাঠি, কেরলি হিন্দুরা এতে খুশি হয়ে তাকে ভোট দেবে বলে তিনি মনে করছেন? সংখ্যালঘুদের কথা ছেড়েই দিই, কিন্তু এসব আঞ্চলিকের ভোটও কি তিনি চান না? নাকি তাদের ভারতের নাগরিক হিসেবেই তিনি মনে করেন না?

যারা নিরামিষ খায় তারা হিংস্র হয় না? বাবরি মসজিদ ভাঙল যারা তাদের মধ্যে নিরামিষ খাওয়া লোক ছিল না? গুজরাটে দাঙ্গা হলো কী করে? শুধু আমিষাশী লোকেরা সেসব করেছে? ভারতে এ পর্যন্ত যত অপরাধ আর নিষ্ঠুরতা ঘটে এসেছে, সবই করেছে আমিষাশীরা? এই মিথ্যা ইতিহাস কে বিশ্বাস করবে?

আমি প্রধানমন্ত্রী আর তার দলবলের এই মনোবেদনার কারণ বুঝি না। তার ওপর তিনি বা তার এক স্নেহপাত্রী এর মধ্যে সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে একটি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য চাউর করলেন। বাঙালির কাছে সিরাজ যে স্বাধীনতার শেষ প্রতীক, এই মানসিক ইতিহাসমূর্তি সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী কী অবহিত ছিলেন না? আজ এতদিন পরে, গৃহীত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস ও আবেগের বিরুদ্ধে গিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পরিবারের এক কন্যা সিরাজদ্দৌলা সম্বন্ধে বিষোদ্গারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্ত কর্ণকেই বেছে নিলেন। এতেও সংখ্যালঘুদের কথা বাদই দিই, বাঙালি হিন্দুর কাছেও তার দল কি রাতারাতি প্রিয় হয়ে উঠল? কে কখন কী বুঝে এই ঘটনাগুলো ঘটায়, তা বুঝি না। নির্বাচন বুঝি মানুষকে এমন উতলা করে দেয়। তা হবে। যার নির্বাচনি বন্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা পড়ে, তা মানুষের মাথা ঘুলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

তারপর আর এক হাস্যকর কথা শোনা গেল কাল না কবে। অযোধ্যার রামমন্দির হয়েছে তো হয়েছে। তাকে মোদিজি নির্বাচন-নদী পার হওয়ার এক নৌকো ধরে নিয়েছেন, তা ঠিক আছে। কোনো সাধুসন্নিসি নয়, মহাপুরুষ (যদি কেউ তেমন বেঁচে থাকে এখন) নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার নাকি ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেছেন। সেও এক মহা আজব ব্যাপার। প্রাণ পাওয়ার পর রাম ধেইধেই করে নাচছেন না কী করছেন জানি না। কিন্তু প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেই মোদিজি খুশি হননি, তিনি রামের চক্ষে একটা ভেলকি-আলোর ছটা ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। দিনের একটি সময়ে তার চক্ষু নাকি সূর্যের আলোয় জ্বলে উঠবে।

ব্যাপারটা যে বৈজ্ঞানিক আর প্রযুক্তিবিদরা করেছেন, সেটা চেপে যাওয়ার সর্বাঙ্গীণ চেষ্টা হচ্ছে। এ রকম ভেলকি আমরা পন্ডিচেরির এক মন্দিরে দেখেছি, সেখানে একটা কাচের বলের ওপর বেলা ঠিক বারোটায় এই রকম চোখ-ঝলসানো আলো ঠিকরে পড়ে। এটা কিছু নয়, মন্দিরের ছাদে কয়েকটা আয়না বা মিরর বসানো হয় তাক করে, সূর্যের আলো সেই আয়নায় ঠিকরে ওই বলের ওপর পড়ে। জানি না মেঘের দিনে, বর্ষাকালজুড়ে কী হয়। তারও ব্যবস্থা করা যেতে পারে বড় বিদ্যুতের আলোর কারিগরিতে। এ নেহাতই মামুলি আলোর খেলা। তাই নিয়ে এই অলৌকিকতার মহিমা প্রচার এমন হাস্যকর ছেলেমানুষি যে, ভাবি, একটা ইলেকশন জেতার জন্য লোকে কী না করতে পারে।

আরও ভাবি, এরা জনগণকে কী হাবাই না ভাবেন। তা আমাদের দেশে জনগণকে হাবা করে রাখার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, তার জন্য শাসকরা সব যুগেই আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছেন। মোদিজিরা এসে যেন একটু বেশি যত্ন নিচ্ছেন জনসাধারণকে শিক্ষা না দেওয়ার। কিংবা ভুল শিক্ষা দেওয়ার। ইতিহাসকে ধুয়ে-মুছে, বিজ্ঞানকে ভুলিয়ে, এমন এক উন্মাদের পাঠক্রম তৈরি করা হচ্ছে, আর সেটাও শিক্ষার আসল গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনো উদ্যমই চোখে পড়ছে না। শিক্ষার বাজেট কমছে, বরাদ্দ কমছে।

আর এই বিষয়টা নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না কেন যে গত ১৯৪১-এর পর থেকে প্রতি দশকে ভারতের জনগণনায় সাক্ষরতার হার যেখানে ৮ থেকে ৯ শতাংশ হারে বাড়ছে, সেখানে ২০১১ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে সরকারি হিসাবেই মাত্র ৩ শতাংশের মতো সাক্ষরতা বাড়ে কেন? এখনো ভারতের প্রায় এক-চতুর্থাংশের মতো মানুষ নিরক্ষর কেন? পেটে ভাত আগে চাই? লেখাপড়া আগে চাই, না আগে রামমন্দিরটাই ভীষণ জরুরি হয়ে উঠল? এসব নিয়ে বড় ধন্দে আছি। নির্বাচন কি এর উত্তর নিয়ে আসবে?

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

ফিলিস্তিন যুদ্ধ: ইসরায়েলকে বিচারের আওতায় আনতে পারে আইসিসি

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ১১:২৩ এএম
ফিলিস্তিন যুদ্ধ: ইসরায়েলকে বিচারের আওতায় আনতে পারে আইসিসি
রিচার্ড ফক

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বৈধতার পথ খুঁজে পেতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার ক্ষত্রে এই প্রতিষ্ঠান গঠন ছিল গ্লোবাল সাউথের জন্য একটি বড় বিজয়। যদিও শুরু থেকেই কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া (বিগ থ্রি) জাতিসংঘে যোগ দেওয়ার পর থেকেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না আইসিসি। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বর হামলায় মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিসিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলেও নেতানিয়াহু সরকার আদালতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে।

১২৪ সদস্যরাষ্ট্রবিশিষ্ট ব্যাপক প্রতিনিধিত্ব থাকা সত্ত্বেও আইসিসি তার স্বীকৃতি, প্রভাব এবং বৈধতার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আইসিসি গঠনের শুরুর দিকে আফ্রিকান নেতাদের কথিত অন্যায় কার্যকলাপের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। তাতে বর্ণবাদে পক্ষপাতিত্বের জন্য আইসিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অপরাধের প্রমাণাদি উপস্থান করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করছে সংস্থাটি। এ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে আইসিসি কিছুই করতে পারছে না।

ধারণা করা হয়েছিল, আইসিসি পশ্চিমা চাপ প্রতিরোধে দুর্বল। ট্রাম্পের অতি জাতীয়তাবাদের কারণে সে সময় আইসিসি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের অপরাধ তদন্ত রোধে সংস্থাটির প্রসিকিউটরের ওপর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

২০২২ সালে যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করেছিল, তখন ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে আইসিসিকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে আহ্বান করেছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা উচিত কি না, সে বিষয়ে জোরালো ভূমিকা নিতে আইসিসির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। পশ্চিমাদের স্বার্থে পুতিনের বিরুদ্ধে দ্রুত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।

গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের জন্য চিলি এবং মেক্সিকো যে পদক্ষেপ নিতে বলেছিল, সে ক্ষেত্রে আইসিসির তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দুই দেশের সরকার গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল। এখন পর্যন্ত আইসিসি এই জরুরি উদ্যোগে কোনো সাড়া দেয়নি। যদিও ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান হওয়ার পথে রয়েছে বলে মনে করা হয়। আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান পশ্চিমা চাপের কারণে গাজায় মানবিক বিপর্যয় উত্তরণে কাজ করতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। আইসিসির প্রতিক্রিয়ায় এমন দুই ধরনের পার্থক্য থাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগের বিচারে ট্রাইব্যুনালের দ্বৈত চরিত্রকেই প্রতিফলিত করছে।

শুরু থেকেই প্রধান রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা না থাকায় আইসিসি একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এ বিষয়ে এটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) বিপরীতে তুলনা করা হয়েছে, যেখানে জাতিসংঘের সদস্যদের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যায়।

বিচার ও আইনি বিরোধের যোগ্যতা মূল্যায়নে উচ্চমানের পেশাদারত্ব বজায় রাখার জন্য আইসিজে ব্যাপকভাবে সম্মানিত। এই ইতিবাচক খ্যাতিটি জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে তার সর্বসম্মত অন্তর্বর্তী আদেশের কারণে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। গাজায় ইসরায়েলের ‘বর্বর গণহত্যা’ বাধা দেওয়ার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা অনুরোধ করায় বেশ কয়েকটি অস্থায়ী ব্যবস্থা মঞ্জুর করেছিল আইসিজে।

ইসরায়েলকে আইনত নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য; যতক্ষণ না আইসিজে গণহত্যার বিষয়ে একটি চূড়ান্ত রায়ে না পৌঁছায়। এই প্রক্রিয়ায় কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। গাজায় এ ধরনের মানবিক সহায়তা আইসিজের কার্যকারিতার প্রমাণ বহন করে।

আইসিজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা করতে পারে। ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্টার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ সম্প্রতি ‘গণহত্যার আলামত’ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।

ইসরায়েলকে গণহত্যামূলক আচরণ বন্ধ করার আইনি আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলের নেতারা প্রতিদিনই রক্তাক্ত অবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যাচ্ছে। তারপরও ইসরায়েল রাফায় আক্রমণের নির্দেশ দেয় এবং মানবতার নৈতিক সংবেদনশীলতার বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাটা হুমকির মুখে পড়ে।

যদি এক সপ্তাহ আগেও জিজ্ঞেস করা হতো, আমি বলতাম যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুই হবেন শেষ ব্যক্তি, যিনি আইসিসির প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ধারে উজ্জ্বল প্রমাণ হয়ে আসবেন। কিন্তু গুজব ফাঁস হওয়ার পর তিনি প্রতিক্রিয়া জানাতে লাফিয়ে উঠেছিলেন যে, আইসিসি নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং সেনাপ্রধান হারজি হালেভির নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে চায়।

নেতানিয়াহু আক্রমণাত্মক হয়েছিলেন। আইসিসির বিরুদ্ধে তার চার মিনিটের ভিডিও দেখার মতো, যদি আদালত তার মতো করে কার্যকর করতে চায়, তাহলে তা কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে সেটা সহজেই বোধগম্য।

এই ব্যবস্থাপনার মধ্যে আইসিসির নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করার এবং মেরুদণ্ডহীনতার জন্য তার খ্যাতি উদ্ধার করার সুযোগ রয়েছে। ইসরায়েল এবং হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে আইসিসির পদক্ষেপকে তাদের কথিত ৭ অক্টোবরের আগের অপরাধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করাটা হাস্যকর।

ইসরায়েলের ওপর যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ বাড়াতে হবে। আইসিসির এ ধরনের ফাঁকি দ্বিগুণ হতাশার কারণ হবে, যার পরে জবাবদিহি, ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্গঠনের নির্দেশনা রয়েছে।

আমাদের কাছে এই ধাঁধা আছে যে, কেন আইসিসি তার নিম্নমানের প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান নিয়ে ইসরায়েলকে অনেক বেশি হুমকি হিসেবে দেখছে। তারা স্পষ্টতই অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত আইসিজের নির্দেশনার দিকে গুরুত্ব দিতে পারে।

নেতানিয়াহু বলেছেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইরানকে একক করে তুলবে এবং গণতন্ত্রের অধিকারের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু আমাদের সবার এখনই জানা উচিত যে, ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার কোনো ইচ্ছা নেই। কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে যেই হোক না কেন, তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না।

এই মুহূর্তে আইসিজে এবং আইসিসির গুরুত্ব হলো বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনি অধিকার ও সমর্থনের জন্য ধারাবাহিক জোয়ারকে আরও শক্তিশালী করা। সেই সঙ্গে উদীয়মান ঐকমত্য গড়ে তোলা দরকার, যেমনভাবে ভিয়েতনামে আমেরিকান পরাজয়ের জন্য অবদান রেখেছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে ধ্বংস করেছিল। যদি ফিলিস্তিনি জনগণ শেষ পর্যন্ত তাদের মৌলিক অধিকারগুলো উপলব্ধি করে, তাহলে নিরুপায় মানুষের প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাদের ঘন ঘন বিতর্কিত দমন-পীড়ন বন্ধ ও যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। ইসরায়েলের পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে সুশীল সমাজের মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ফিলিস্তিনে গণহত্যার জন্য আইসিসির অবশ্যই ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং সুষ্ঠু বিচার হতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ।
মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল 

এ যাত্রায় তো বেঁচে গেলাম!

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ১১:২১ এএম
এ যাত্রায় তো বেঁচে গেলাম!
রেজানুর রহমান

একটি সরল জিজ্ঞাসা। আইপিএলের মাঝখান থেকে মোস্তাফিজকে সরিয়ে আনা কি সঠিক কাজ হয়েছে? আইপিএলে ছেলেটি তো ভালোই খেলছিল। ওর সাফল্যে বারবার বাংলাদেশের নামই উচ্চারিত হচ্ছিল। ফিজ ফ্রম বাংলাদেশ। তাকে মাঝপথে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো। যুক্তি একটাই- আসন্ন টি-২০ বিশ্বকাপের আগে মোস্তাফিজের বিশ্রাম দরকার। যুক্তি ফেলে দেওয়া যায় না। তবু প্রশ্নটা থেকেই যায়, আইপিএলের পুরোটা সময় মোস্তাফিজ খেললে খুব কি ক্ষতি হতো? এ কথা সবাই স্বীকার করবেন- বিশ্বকাপ বাদ দিলে ভারতের আইপিএল টুর্নামেন্টই ক্রিকেটের অন্যতম বিশ্ব আসর।

আইপিএল যারা খেলছেন তাদের মধ্যে সিংহভাগ খেলোয়াড়কেই বিশ্ব ক্রিকেটের আসরে দেখা যাবে। কাজেই বিশ্বকাপের আগে একজন ক্রিকেটারের আইপিএল অভিজ্ঞতা তার জন্য সাহসও বটে। অথচ মাঝপথে ফিরিয়ে আনা হলো মোস্তাফিজকে। দেশে ফেরার পর মোস্তাফিজ এখন পর্যন্ত প্রচারমাধ্যমে কথা বলেননি। ফেসবুকে দেখলাম ছোট্ট ট্রলি ব্যাগ ঠেলে সামনের দিকে হাঁটছেন সবার প্রিয় ক্রিকেটার মোস্তাফিজ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তার মন ভালো নেই। কয়েকজন সংবাদকর্মী তার তাৎক্ষণিক অনুভূতি জানার চেষ্টা করছিলেন- মোস্তাফিজ, ছোট করে হলেও আইপিএলের অভিজ্ঞতা বলুন। কেমন হলো?

মোস্তাফিজের মুখ ভার। শুধু বললেন ‘ভালো’। এতে বোঝা গেল মোস্তাফিজ হয়তো মাঝপথে আইপিএল ছেড়ে আসতে চাননি। আমরা প্রকাশ্যে যা দেখি সেটাকেই সত্য ভাবি। আইপিএলের মাঝপথে মোস্তাফিজকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই পজিটিভ কোনো কারণ আছে। এখানে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বার্থ জড়িত। তবু একটা ছোট্ট প্রশ্ন করতে চাই। মোস্তাফিজের জায়গায় নামটি যদি সাকিব আল হাসানের হতো। তাকে কি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এভাবে ফিরিয়ে আনতে পারত?

সহজ কথা যায় না বলা সহজে। যেমন হঠাৎ করে মিল্টন সমাদ্দার নামে বিস্ময়কর এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটল। তাকে কেউ কেউ বললেন, মানবতার ফেরিওয়ালা। অথচ এই মানুষটিই কী ভয়ংকর, নিষ্ঠুর, নির্দয়! রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা অসহায় মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার নাম করে তথাকথিত চিকিৎসাকেন্দ্রে তুলে আনতেন। নিজেই রোগীদের চিকিৎসা করতেন। রোগীর শরীরের অঙ্গ কেটে ফেলতেন। কিডনি বের করে নিয়ে তা পাচার করতেন। এটাই ছিল তার মূল ব্যবসা। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো, মিল্টন সমাদ্দার নিজেই মৃত ব্যক্তির ডেথ সার্টিফিকেটে সই করতেন এবং রাতের অন্ধকারে দাফন-কাফনের কাজ সেরে ফেলতেন। মৃত ব্যক্তির কোনো জানাজা হতো না।

আশার কথা, মিল্টন সমাদ্দারের পাষাণ রহস্য ফাঁস হয়েছে। তিনি এখন কারাগারবাসী। তবু কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায়। একজন প্রায় অশিক্ষিত মিল্টন সমাদ্দার কীভাবে এত নির্দয়, নিষ্ঠুর, কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেন? জমি কিনলেন, বাড়ি বানালেন, দামি গাড়ি কিনলেন। চিকিৎসাকেন্দ্র অথবা পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলার আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দপ্তরে নানা ধরনের কাগজ জমা দিতে হয়। মিল্টন নিশ্চয়ই কাগজপত্র জমা দিয়ে তার অপকর্ম শুরু করেছিলেন? যদি তাই হয়, যারা কাগজপত্র জমা নিয়েছেন তাদের দায়িত্ব কি শুধু অনুমতি দেওয়া নাকি অনুমতি দেওয়ার পর নিয়মিত মনিটর করা?

যদি এমন হয় যে, মিল্টন সঠিক প্রক্রিয়ায় কোনো কাগজপত্র জমা না দিয়েই তার অপকর্ম শুরু করেছিলেন। এ ক্ষেত্রেও তো একটি প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, একজন অসৎ নির্দয়, নিষ্ঠুর ব্যক্তি দিনের পর দিন অপকর্ম চালিয়েই যাচ্ছেন। এক অর্থে প্রতিনিয়ত মানুষকে হত্যা করছেন। জমি কিনছেন, বাড়ি বানাচ্ছেন, দামি গাড়ি কিনছেন। কীভাবে সম্ভব? প্রচারমাধ্যম মিল্টনের অপকর্ম তুলে না ধরলে তিনি হয়তো তথাকথিত মানবতার ফেরিওয়ালা পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে অপকর্ম চালিয়ে যেতেন। প্রচারমাধ্যম ঘটনাটা টের পেল। কিন্তু সবার আগে তো টের পাওয়ার কথা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এই প্রশ্নের উত্তর কার কাছে খুঁজব?

প্রচারমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু করতে যাচ্ছে। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু রয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পঞ্চম শ্রেণির পর মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। ছেলেকে কোনো একটা পেশায় লাগিয়ে দেন। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র খুঁজতে থাকেন।

এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভালো উদ্যোগ। যথার্থ প্রক্রিয়ায় উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা গেলে সুফল মিলবে। প্রসঙ্গক্রমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটু বলতে চাই। দেশে নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। একই পরিবারে হয়তো দেখা যায় তিন সন্তানের একজনকে ভর্তি করা হয়েছে কিন্ডারগার্টেনে। অন্যজনকে সরকারি স্কুলে। আরেকজনকে মাদ্রাসায়। তারা বড় হয়ে একই মানসিকতাকে গুরুত্ব দেবে না। তাদের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে মতভেদ সৃষ্টি হবে। কাজেই দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্ক সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। শোনা যাচ্ছে, আগামীতে ৫ ঘণ্টার পরীক্ষা গ্রহণ কর্মসূচি চালু হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় এই যে হঠাৎ হঠাৎ নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে, এর ভবিষ্যৎ কী? সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখবেন আশা করছি।

সুন্দরবন নিয়ে একটু কথা বলি। সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের ফুসফুস। সুন্দরবন আছে বলেই বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়। সুন্দরবনে হঠাৎ করে আগুন লাগল। বনরক্ষী ও স্থানীয় লোকজন হাঁড়ি, কলস, বালতি করে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়। আগুন লাগে সকাল ১০টায়। অথচ ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসে সন্ধ্যার আগে। অন্ধকার নেমে যাওয়ায় ফায়ার সার্ভিস কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে। যাতে বন পুড়তেই থাকে।

সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা এটাই নতুন নয়। এর আগে বহুবার আগুন লেগেছে। অনেকের মন্তব্য, সুন্দরবনে আগুন লাগে না, আগুন লাগানো হয়। কী ভয়ংকর তথ্য। এবারও কি কেউ আগুন লাগিয়েছে? তাদের উদ্দেশ্য কী? সুন্দরবনে আগুন লাগার দৃশ্য টেলিভিশনে দেখার পর অস্থিরতা দমন করতে পারছিলাম না। কষ্টে বুকের ভেতরটা বারবার মোচড় দিচ্ছিল। সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল নিশ্চয়ই নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। তবে সেটা যেন লোক দেখানো নয়। বিপদ হলে আমরা অনেকেই মনে মনে বলি, হে আল্লাহ এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। ভবিষ্যতে আর ভুল হবে না। বিপদ কেটে গেলেই মনে মনে বলি- যাক বাবা, এ যাত্রায় তো বেঁচে গেলাম।

আমাদের ফেব্রুয়ারি মাসটাও অনেকটা এ রকমই। ফেব্রুয়ারি আসছে। কত জল্পনা-কল্পনা। মাসব্যাপী বইমেলার আয়োজন নিয়ে সীমাহীন ব্যস্ততা। মাতৃভাষা বাংলার জন্য কী যে মায়া শুরু হয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার দৃঢ়প্রত্যয় কাহিনি শুনি। মাননীয় আদালতে বাংলা ভাষায় রায় লেখা নিয়ে কত কথা যে শুরু হয়। অনেক আদর ও যত্নের মধ্যে বাংলা একাডেমিতে একুশে বইমেলা শুরু হয়। ফেব্রুয়ারি শেষ। বইমেলা শেষ। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কথা বলাও শেষ। যাক বাবা, এ যাত্রায় তো বেঁচে গেলাম। এখানেও একই মানসিকতা। কবে কোন দিন এই মানসিকতার বদল ঘটবে জানি না। তবে আশায় আছি। আশা আছে বলেই মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার
সম্পাদক, আনন্দ আলো 

ভারসাম্য রক্ষায় মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১০:২৯ এএম
ভারসাম্য রক্ষায় মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
ড. মোস্তাফিজুর রহমান

বেশ কয়েক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতা লক্ষণীয়। এটা যদি নিম্নমুখীও হয় মূল্যস্তর কিন্তু ওপরে উঠে গেছে- এ কথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত সবারই ক্রয়ক্ষমতার একটা অবনমন ঘটছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাহলে দারিদ্র্যসীমার সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনযাত্রার মানের একটা বৈপরীত্য রয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে ১৫ বছর আগে মূল্যস্তর আরও অনেক কম ছিল, কিন্তু জীবনযাত্রার মান নিম্ন ছিল না। কারণ আয় ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ মূল্যস্তর বা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় বাড়লে ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয় না।

সুতরাং এটা সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। আমাদের অর্থনীতি যে কিছুটা ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে সেটা স্পষ্ট। আমাদের অর্থনীতির যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং নিম্ন মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা ছিল তা এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নতুন ভারসাম্য আনতে হবে। এ জন্য প্রবৃদ্ধি কিছুটা নিচের স্তরে হলেও তা আমাদের মেনে নিতে হবে। এখানে সংকোচনমূলক যে মনিটরি পলিসি নেওয়া হয়েছে সেটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়েছে। সুদহার বাড়ানো হয়েছে, স্মার্ট রেট চালু করা হয়েছে, রিভার্স রেপো চেঞ্জ করা হয়েছে, পলিসি রেটকে বাড়ানো হয়েছে, যেন বাজারে মানি সাপ্লাই কমানো যায়।

খেয়াল রাখতে হবে যে এখানে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে হবে না, রাজস্বনীতির ব্যাপার আছে। শুল্ক কমানো হলে ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যে কিনতে পারে। সেখানে আমি যদি শুল্ক কমাই এবং ভোক্তারা যেন সে সুফলটা পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সাপ্লাই চেইনের যে অ্যাক্টররা (প্রভাবক) আছে তাদের ওপর তদারক করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের যে বৈদেশিক বিনিময় হার তা যদি স্থিতিশীল করতে পারি, তবে তা আমদানি করা মূল্যস্ফীতির ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। সুতরাং অনেক ফ্যাক্টর আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ,
আমাদের অর্থনীতিতে একটি নতুন ভারসাম্য নিয়ে আসার ওপর নির্ভর করবে যে, আমরা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারব কি না।

আমাদের বিনিয়োগ বাড়ানো, কস্ট অব ডুইং বিজনেস কমানো, উদ্যোক্তারা যাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে ইত্যাদি বিষয়ের দিকেও নজর দিতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে মূল্যস্তর অনেক বেড়ে গেছে। এখন যদি মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেও স্তরটা ওপরের দিকেই থেকে যাবে। সুতরাং সেখানে আয়বর্ধক বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে। গড় আয় যেটা বছরে বাড়ে, মূল্যস্ফীতি তার দ্বিগুণ, যেমন তৈরি পোশাক খাতের একজন কর্মীর কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখব, তার বেসিক স্যালারি ৫ শতাংশ করে বাড়ছে, কিন্তু তার খাদ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি।

ফলে আয় কিছুটা বাড়লেও তার ক্রয়ক্ষমতার কিন্তু অবনমন ঘটছে। অর্থাৎ আমাদের এসব ক্ষেত্রে যে আনুষঙ্গিক উদ্যোগগুলো রয়েছে- দক্ষতা বাড়ানো, প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো ইত্যাদির দিকে নজর দিতে হবে। বৈদেশিক ঋণের পরিষেবা নিয়ে আমাদের গুরুত্বসহকারে চিন্তা করা দরকার। কেননা এটা আরও বাড়বে। বিগত কয়েক বছরে যেসব ঋণ আমরা নিয়েছি সেগুলোর ম্যাচিউরিটি পিরিয়ড চলে এসেছে। গ্রেস পিরিয়ড, যখন আমাদের কোনো ঋণ পরিষেবার দরকার হবে না, সে পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা যে ঋণগুলো নিচ্ছি সেগুলোর অনেকগুলোরই গ্রেস পিরিয়ড কম, ম্যাচুরিটি পিরিয়ড কম, সুতরাং দায়ভারটা বেশি। আমরা মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্সের যেসব প্রাক্কলন পাচ্ছি তাতে দেখা যাচ্ছে, ১০ বছর আগে আমাদের যদি ২ বিলিয়ন ডলারের মতো পরিষেবা হতো (সুদাসলে) বৈদেশিক ঋণের, যা এখন ৪-৫ বিলিয়ন ডলারের দিকে চলে যাচ্ছে।

এমন একটা সময়ে যাচ্ছে যখন আমাদের রিজার্ভ কমের দিকে। যখন রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ছিল তখন ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিষেবা থাকলে এক কথা, কিন্তু এখন রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার এবং ঋণ পরিষেবা করতে হচ্ছে ৪-৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন! নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে কিছুটা রাশ টেনে ধরা। পুরোনো বিনিয়োগ যেগুলো পাইপলাইনে আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। এ ছাড়া ঋণ আলোচনাগুলো এমনভাবে করা, যাতে করে আমরা যে শর্তে ঋণ নিচ্ছি তা যেন আমাদের অনুকূলে হয়। ২০১৫ সালে আমাদের যখন মধ্যম আয়ের দেশে গ্র্যাজুয়েশন হলো, তখন কিন্তু কনসেশনাল লোন অনেক কমে গেল। আমাদের নন-কনসেশনাল লোনই এখন বেশি। আমাদের ঋণের দায়ভার আগের তুলনায় আগামীতে বাড়বে।

আমাদের বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যাতে করে আমাদের পরিষেবায় কোনো সমস্যা না হয়। জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ অত বেশি নয়, তুলনামূলকভাবে অনেক কম (আমাদের জিডিপির ১৮ বা ১৯ শতাংশ)। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের রেভিনিউ (রাজস্ব) কত হলো। কারণ এই রেভিনিউ দিয়েই ঋণ পরিষেবা করতে হবে। অথচ আমাদের রেভিনিউ-জিডিপি হার এখন ৯ শতাংশেরও কম! এর একটা বড় অংশ তো ঋণ পরিষেবাতেই তাহলে চলে যাবে। তখন যেন ঋণ এনে ঋণ পরিশোধ করা না লাগে- এমন অবস্থা এড়াতে আমাদের রেভিনিউ বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

আমাদের বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করতে হবে। যেহেতু অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, যার রিটার্ন আসবে টাকায় কিন্তু ফেরত দিতে হবে ডলারে। একসময় আমরা ৮৬ টাকায় ১ ডলার হিসাব করলেও এখন ১১০ টাকায় ১ ডলার হিসাব করা হচ্ছে। অর্থাৎ সেখানে একটা দায়ভার তুলনামূলকভাবে বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ প্রকল্পগুলো যেন সাশ্রয়ীভাবে, সময়মতো ও সুশাসনের সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়- এর প্রয়োজনীয়তা এখন তুলনামূলকভাবে অন্য অনেক কিছুর চেয়ে বেশি। এখন এটি যদি বাস্তবায়ন করতে পারি তবে আমরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। তবে যদি তা করতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। কেননা আমাদের রিজার্ভ অনেকটাই কমে এসেছে।

আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হতে পারে রাজস্ব, জিডিপি রেশিও; যা আমরা বাড়াতে পারি। এটা করা যাবে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে। বাংলাদেশে আমরা কিন্তু দেখছি যে, আয়বৈষম্য বা সম্পদবৈষম্য বাড়ছে, যেটা ইতিবাচক নয়। বাংলাদেশে আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চাই, কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়! বিবিএসের হিসাব বলছে, আয় কেন্দ্রীভূতকরণের যে সুযোগ তা ১৯৯০ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং তা শহরে ও গ্রামে বেড়ে চলেছে (৫ শতাংশ বেড়েছে)। এটা আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আমরা কিন্তু ইন্টারজেনারেশনাল গ্যাপ বা আন্ত-প্রজন্মের মধ্যকার পার্থক্য কমিয়ে আনতে পেরেছিলাম।

আমাদের পাঁচ দশক ধরে আর্থসামাজিক সূচকে যে উন্নয়ন হয়েছে (গত দুই দশকে আরও দ্রুত হারে হয়েছে), এ ইতিবাচক প্রবণতাও কিন্তু একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এ ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব কীভাবে রাজস্ব, জিডিপি প্রত্যক্ষ কর আহরণের মাধ্যমে বাড়াতে পারি। অনেকেই দুর্নীতি করে, ঋণখেলাপি করে দেশের টাকা বাইরে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। আগে এই পাচারকৃত টাকা দেশে বিনিয়োগ করা হলেও এখন তা দেশের মধ্যে থাকছে না। এ টাকা তারা বাইরের দেশে বিনিয়োগ করছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক সিস্টেমের মধ্যেই টাকাটা আর আসছে না। এ নেতিবাচক প্রবণতাগুলো আমাদের প্রশাসনকে শক্তিশালী করে মোকাবিলা করতে হবে।

এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের, পারচেজিং পাওয়ার হিসাব করলে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের একটা অর্থনীতি। এগুলো ম্যানেজ করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। এ ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সুশাসন, জবাবদিহি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সরকারি পরিষেবা যেসব প্রতিষ্ঠান করে তাদের জবাবদিহি ও সক্ষমতা বাড়িয়ে আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে।

লেখক: সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)