এপ্রিল ২০২৪ ছিল বিশ্বব্যাপী উত্তপ্ত মাস। সারা দেশ এপ্রিলের কয়েক সপ্তাহ তীব্র দাবদাহে পুড়ছিল। চট্টগ্রামও তার ব্যতিক্রম ছিল না। চলতি মাসের ৬ তারিখ ঝুমবৃষ্টি নামে। মানুষ বৃষ্টিসিক্ত হয়েও আনন্দের হাসি হাসে, কিন্তু পরক্ষণে তা বিষাদে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের আবহাওয়া অধিদপ্তর ৫ তারিখ রবিবার বিকেল ৪টা থেকে সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। এর মধ্যে রবিবারে বিকেলের এক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে মহানগরীর একটা বড় অংশ ডুবে যায়। ওই এলাকাগুলোর মধ্যে পাঁচলাইশ, প্রবর্তক মোড়, ২ নন্বর গেট, মুরাদপুর, শুল্কবহর, কাতালগঞ্জ, মির্জাপুল, ডিসি রোড, ওয়াসা মোড়, তিন পোলের মাথা, আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ এলাকা, চকবাজার ও বহদ্দারহাট অন্যতম। পানি সরতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়।
২০০৭ সালের ১২ জুন দিনটিকে অতিবৃষ্টিজনিত পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ি ধসে শতাধিক আদম সন্তানের মৃত্যুর কারণে ঐতিহাসিক ‘চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি’ নামে অভিহিত করা হয়। এ দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রামের আকস্মিক বন্যা এবং জলাবদ্ধতা নিয়ে শুরু হয় নানামুখী চিন্তাভাবনা। ওই সময়ে আমি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করি, যার শিরোনাম ‘চট্টগ্রামের বিপর্যয় ও উন্নয়ন: একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার রূপরেখা’। এ প্রবন্ধ সে সময় দৈনিক পূর্বকোণ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করে। পরবর্তীতে ওই রচনার সঙ্গে পানি, জমি, বন্যা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে আরও চারটি রচনা ২০১১ সালে প্রকাশিত আমার ‘বৃত্ত ও বৃত্তান্ত’ বইটিতে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়।
সর্বশেষ গত ৪ মে (২০২৪) দৈনিক খবরের কাগজে ‘প্রচণ্ড দাবদাহ ও অত্যাসন্ন বন্যা: কার কী প্রস্তুতি’ শীর্ষক আর একটি রচনা প্রকাশ করি। এ ভূমিকাটুকু এ কারণে লিখলাম যাতে কোনো অনুসন্ধানী পাঠক এবং নীতিনির্ধারক-প্রশাসক ইচ্ছা করলে এ বিষয়ের নানা লেখা ও বলা কথাগুলোর একটি ধারাবাহিকতা দেখতে পারেন। চট্টগ্রামের পানি, পরিবেশ ও সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চট্টগ্রাম শহর তার আশপাশের নদনদী খাল-ছড়া, পাহাড়, কৃষি, আবাসন, হালদা-কর্ণফুলীর নাব্য, পানির স্তর ও পানির প্রবাহ এসবকে পাশ কাটিয়ে করলে তা মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হওয়ার নয়। তাই একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়েছিলাম। যেখানে চট্টগ্রাম মহানগরী, উত্তর-দক্ষিণের বিস্তৃত পাহাড় (যা পুবে পাঁচলাইশ, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি এবং পাহড়ের পশ্চিমে সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলা এবং পূর্ব ও দক্ষিণের বিশেষত রাঙ্গুনিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর পাহাড়) পাহাড়ি ছড়া-ঝরনা, নগরীর সীমার মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ খাল-নালা এবং এসব খাল নালার আউট পল হালদা কর্ণফুলীকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
তা ছাড়া কর্ণফুলী ও হালদার জোয়ার-ভাটা পানির প্রবাহ, নদীর বেড বা তলা, পলি স্তর স্টাডি করে মহানগরী ও অন্যান্য খালে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে স্লুইসগেট-রেগুলেটরগুলোর ডিজাইন সাযুজ্য রাখতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক প্রেক্ষিত পরিকল্পনা দূরে থাকুক, মহানগরীর হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগুলো সাধারণ সম্ভাব্যতা যাচাই (Feasibility study) ছাড়াই করে ফেলা হয়েছে বলে একটি প্রকল্প সভায় আলোচনা হয়। এটি একটি বিস্ময়ের ব্যাপার।
এখন গত ১৫ বছরে হালদা-কর্ণফুলী দিয়ে বলা যাচ্ছে না, ‘অনেক জল গড়িয়েছে’ বলতে হয় ‘জল গড়ানো হ্রাস পেয়েছে’। পাহাড়ি ছড়া-ঝরনাগুলো শীর্ণকায় বা সম্পূর্ণ শুকিয়েছে। বর্ষায় কাটা পাহাড়ের বালির স্রোত নগরীর খালগুলো দিয়েই পুনঃ পুনঃ প্রবাহিত হবে। শহরকেন্দ্রিক খাল খননের হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নানা যৌক্তিক-অযৌক্তিক কারণে বিলম্বিত হলেও গড়পড়তা প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রাজউক, সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড- এ চার সংস্থা একক ও যৌথভাবে চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে মহানগরীর ৩৬টি খাল খনন, প্রশস্তকরণ, পার্শ্ব সুরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ, খালের পাশে সড়ক, খালের ওপর সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ করছে।’
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক দিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫৬১৬.৪৯ কোটি টাকা। ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৩৫৪৩.৪৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৭-২০২৩। কাজের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। এ প্রকল্প করার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। দ্বিতীয় প্রকল্পটি সিটি করপোরেশনের, বহদ্দারহাট-বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন। সময়কাল ২০১৭-২০২৪, প্রাক্কলিত ব্যয় ১৩৬২.৬২ টাকা, জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত ছাড় হয়েছে প্রায় ১৭২ কেটি টাকা এবং কাজের অগ্রগতি প্রায় ৫৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্ণফুলীর তীর বরাবর কালুরঘাট ব্রিজ থেকে চাক্তাই পর্যন্ত সড়ক প্রকল্পের সময়কাল ২০১৭-২০২৪। প্রক্কলিত ব্যয় ২৭৭৯.৩৯ কোটি টাকা এবং ছাড় হয়েছে ১২৯১.২৮ কোটি টাকা, আর কাজের অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। চতুর্থ প্রকল্প সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা, জলমগ্নতা ও পানি নিষ্কাশন, প্রাক্কলিত অর্থ ১৬২০.৭৩ কোটি টাকা, মেয়াদকাল ২০১৮-২০২৪।
২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ২৩৬ কোটি টাকা। অগ্রগতি ২৫ শতাংশ। এসব বর্ণনা একটি গতানুগতিক প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন। প্রশ্ন এখানে অনেক আসতে পারে। যেমন সব প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪-এর জুনে শেষ। তাহলে এখানে অর্থ ব্যয় ও ভৌত কাজের অগ্রগতি কী বার্তা দেয়, বরাদ্দ ও ছাড়কৃত অথের্র সঙ্গে কাজের ভৌত অগ্রগতির সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। কম বরাদ্দ পেয়েও ভৌত কাজের অগ্রগতি অনেক বেশি। তাতে দুটো বিষয় থাকতে পারে। এক. প্রাক্কলন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ছিল। দুই. কাজের মানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) চ্যানেলের নাব্যতার স্বার্থে কর্ণফুলী ও মোহনায় নিয়মিত হাইড্রোলজিক্যাল জরিপ এবং নিয়মিত ড্রেজিং করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড পানিপ্রবাহ, উচ্চ ও নিম্ন প্রবাহের তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণ করে। চবক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যের সঙ্গে মহানগরীর ৩৬টি খালের বর্ষাকলীন ও শুষ্ক মৌসুমের পানির প্রবাহের পরিমাপ করে পানির নানা কাঠামো অবকাঠামো নির্মাণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। যদি না হয় তাহলে সাধারণ জোয়ার-ভাটা, ভরা বর্ষার বাড়ন্ত জোয়ার এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জলস্তরের উচ্চায়ন প্রভৃতির সঙ্গে এ খাল খনন, ব্রিজ-কালভার্ট ও রেগুলেটর কীভাবে সম্পর্কিত হবে।
মহানগরীর বাইরের জল সম্পদ বা জলপ্রবাহকে একটি ‘আপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে সব প্রকল্প রচনা হয়েছে। বৃষ্টির পানি আকস্মিক বন্যা বইয়ে দেয়, জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। সুতরাং এটি একটি আপদ। এটি একটি মহাভ্রান্ত ধারণা। প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ একটি মূল্যবান সম্পদ, যা আপনি বিনামূল্যে পান। সে কথিত ‘আপদ’ থেকে রক্ষা পাওয়ার যে বহুমূল্যের প্রকল্প সেগুলো শেষ পর্যন্ত গলার ফাঁস হতে পারে। কংক্রিট সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট আমাদের নেতাদের-প্রকৌশলীদের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। জলপ্রবাহের স্বাভাবিক খাল যে রাজপথে রূপান্তর করা যায় সে ধারণা কি আমাদের আছে?
আমি আমার আগের লেখায় এক জায়গায় নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরের খালজাল (canal network)-এর উল্লেখ করেছিলাম। চট্টগ্রামের খালজালকে সড়কের পরিবর্তে সুদৃশ্য জলপথ, বিনোদন ও পরিবেশ অনুকূল ব্যয়সাশ্রয়ী কাঠামোতে রূপান্তর করা যেত। সময় চলে যায়নি, এখনো করা যায়। সেটি করতে হলে নগর সুরক্ষার সঙ্গে নগরীর বাইরের জলাধার তথা সাগর, নদী, খাল সবগুলোর জল সম্পদের সুষম ব্যবহার পরিকল্পনা দরকার হবে। চট্টগ্রাম শহরের নাগরিকরা বিশেষত বণিক-ধনিক শ্রেণি ও রাজনৈতিক নেতারা নগরীর দেখভালের দুটি প্রধান প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন ও সিডিএ সে রকম কোনো স্বপ্ন কি দেখতে বা দেখাতে পারেন?
চট্টগ্রামের উত্তরের প্রায় ৩৫ কিমি দৈর্ঘ্য ও গড়পড়তা ৪-৫ কিমি প্রস্থ পাহাড়, তার বন, তার অভ্যন্তরে সঞ্চিত জল, পাহাড় থেকে উৎপন্ন ছড়া যার মিষ্টি জলের একটি বড় অংশ হালদা ও কর্ণফুলীতে পড়ে। তার কথা আপনাদের পরিকল্পনায় ভুলে গেলে চলবে না। তার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল পর্বতমালা যেখান থেকে কর্ণফুলী, শঙ্খপ্রবাহ বয়ে আসে সে পার্বত্য অঞ্চলকেও হিসেবে নিতে হবে। বিবেচনায় নিতে হবে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর পাহাড় ও পাহাড়ি জলপ্রবাহকেও। আমরা বাছবিচারহীনভাবে পাহাড়ের মাটি কেটে প্লট বানাব, গাছ কেটে সাবার করব আর হাজার কোটি টাকার খাল খনন প্রকল্প করে তার সুফল পাব, সে ভরসা মিছে।
তাই প্রয়োজন পুরো অঞ্চলের তথ্যনির্ভর বাস্তবসম্মত একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। সে পরিকল্পনাকে দৃষ্টিতে রেখে রচিত ও বাস্তবায়িত হোক ছোট ছোট প্রকল্প। যা শুধু সিটি করপোরেশন, সিডিএ, সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড নয়, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোও বাস্তবায়ন করবে। সমস্যাগুলোকে প্রকল্পায়নের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখার চেষ্টা করা হোক। চট্টগ্রামে ২৩ জুলাই, ২০২৩-এ নগরের প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ফজলুল হক (কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ) এবং কমিশনের এ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম। চট্টগ্রামের জন্য একটি ‘আঞ্চলিক প্রেক্ষিত পরিকল্পন’ করার প্রস্তাব ও উদ্যোগ আপনাদের পক্ষ থেকে আসুক এবং চট্টগ্রামে সর্বস্তরে তা আলোচিত হোক, সেটি কামনা করি।
লেখক: গবেষক ও শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected]