ঢাকা ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫
English
শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গল্পজাদুকর উপেন্দ্রকিশোর

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ০২:৫০ পিএম
গল্পজাদুকর উপেন্দ্রকিশোর
বেহালা বাজাতে খুব ভালোবাসতেন উপন্দ্রেকিশোর

এ কেমন আজব ছেলেরে বাবা! ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের সব শিক্ষক ভীষণ অবাক। ছেলেটিকে সবাই খুব পছন্দ করেন। ছেলেটা প্রতিদিন ক্লাসে পড়া পারে। পরীক্ষায় কখনো সেকেন্ড হয় না। সবসময় প্রথম। দুরন্ত মেধা আর বিপুল প্রতিভা। কিন্তু এ কেমন আজব ছেলে! স্কুলের পাঠ্যবিষয়ে তার একেবারেই আগ্রহ নেই। পড়াশোনাও করে না ঠিকমতো। রাতে তো এক অক্ষরও পড়ে না। তবু প্রথম হয়। কেমন করে?

শিক্ষকরা ধরে বসলেন ছেলেটিকে। ‘ঘটনা কী উপেন্দ্র? রাতে একটুও পড়াশোনা কর না। তবু প্রথম হও কী করে? ক্লাসে পড়াই বা দাও কেমন করে?’
ছেলেটি জবাব দিল, ‘শরৎকাকা আমার পাশের ঘরেই থাকে। রোজ সন্ধ্যায় সে চিৎকার করে করে পড়া মুখস্ত করে। ওতেই আমার পড়া হয়ে যায় যে!’
নাহ। এরপর কি আর কিছু বলা যায়?
এভাবেই চলতে থাকল বছরের পর বছর। চলতে চলতে একসময় চলে এল সেই কঠিন সময়। প্রবেশিকা পরীক্ষা।
নাকের ডগায় পরীক্ষা। ক্লাসের সবাই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। দম ফেলবারও ফুরসৎ নেই কারও। পড়তে পড়তে সবাই যেখানে হাঁপিয়ে যাচ্ছে, সেখানে উপেন্দ্র কি না বেহালা আর রংতুলি নিয়ে মজে আছে! স্কুলের প্রধান শিক্ষক রতনমণি গুপ্ত ডেকে পাঠালেন ছেলেটিকে। বললেন, ‘তোমার ওপর আমাদের অনেক আশা। তুমি আমাদের হতাশ কোরো না।’
ভীষণ অনুতপ্ত হলেন উপেন্দ্র। বাড়ি ফিরে সাধের বেহালাটি ভেঙে ফেললেন নিজে।
কেবল বাজনাই নয়, ভালো ছবিও আঁকতে পারতেন উপেন্দ্রকিশোর।
একবার ময়মনসিংহ জেলা স্কুল পরিদর্শনের জন্য এলেন স্যার অ্যাশলি ইডেন। এই অ্যাশলি ইডেন ছিলেন তৎকালীন ভারতের গভর্নর। তার নামেই ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ। যাই হোক, ছাত্ররা ক্লাসে মন দিয়ে ইডেন সাহেবের কথা শুনছে, নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। হঠাৎ ইডেন দেখলেন পেছনের বেঞ্চিতে বসা একটি ছেলে তার কোনো কথাই শুনছে না। মাথা নিচু করে কিছু একটা করছে। ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষকদেরও নজরে পড়েছে এটা। শঙ্কিত হয়ে উঠলেন শিক্ষকরা। না জানি সাহেব কী মনে করেন।
ওদিকে চুপি চুপি ছেলেটির কাছে এলেন ইডেন। এসে দেখলেন ছেলেটি একমনে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা প্রতিকৃতি আঁকছে। আর সেটা স্বয়ং অ্যাশলি ইডেনের প্রতিকৃতি।
নিজের প্রতিকৃতি দেখে ভীষণ খুশি হলেন ইডেন সাহেব। জানতে চাইলেন, ‘কী নাম তোমার?’
চমকে উঠে জবাব দিল ছেলেটি, ‘উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী’।
এবার উপেন্দ্রর পিঠ চাপড়ে দিয়ে অ্যাশলি বললেন, ‘কখনো আঁকা ছেড়ো না। এটাই চালিয়ে যেও।’ এমনই ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। কে এই উপেন্দ্রকিশোর?
তিনি সুকুমার রায়ের বাবা। এবং সত্যজিৎ রায়ের দাদা। আর?
অনেক বছর আগের কথা।
বিহার থেকে এক কায়স্থ পরিবার এল নদীয়ার চাকদহ গ্রামে। কয়েক পুরুষ বাদে ওই পরিবার পাকাপাকিভাবে চলে এল ব্রহ্মপুত্রের ধারে ‘খুকুরপাড়া।’ পরে গ্রামের নাম বদলে হয় ‘মসুয়া’। ততদিনে মুঘল রাজসরকারে কাজ করার সুবাদে পাওয়া ‘রায়’ উপাধিকেই পদবি করে নিয়েছেন তারা। গড়ে তুলেছেন জমিদারি। মসুয়ার সেই অভিজাত পরিবারের মানুষদের অনেক গুণ। বহুভাষাবিদ হিসেবে তাদের বেশ সুনাম। তেমনি এক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত কালীনাথ রায়। কালীনাথের পাঁচ ছেলে। সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন।
পাঁচ বছর বয়সে পণ্ডিত কালীনাথের দ্বিতীয় পুত্র কামদারঞ্জনকে ১৮৬৮ সালে দত্তক নেন নামি উকিল ও জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী। যাগযজ্ঞ করে কামদারঞ্জনের নাম বদলে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। নিজের সন্তান না থাকায় জ্ঞাতী ভাই কালীনাথের মেজো ছেলেকে দত্তক হিসেবে নেন হরিকিশোর। যদিও এর কয়েক বছর পরে হরিকিশোরের নিজের একটি ছেলে হয়। তার নাম নরেন্দ্রকিশোর।
১৮৭৯ সালে বৃত্তিসহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন উপেন্দ্রকিশোর। প্রবেশিকা পাসের পর তাকে আর পায় কে! ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুদিন পড়াশোনা করলেন। এরপর ১৮৮৪ সালে স্নাতক হলেন মেট্রোপলিটন কলেজ (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে।
হরিকিশোর কখনো উপেন্দ্রকিশোরের ওপর প্রচলিত রীতিনীতি চাপিয়ে দিতেন না। ফলে উপেন্দ্রকিশোর বেড়ে উঠেছিলেন তার খেয়ালি স্বভাব নিয়ে। যদিও উপেন্দ্রকিশোর চলাফেরা করতেন রাজা রামমোহন রায়ের ভক্ত-অনুসারীদের সঙ্গে। এরা সবাই ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের মানুষ। ওদিকে এমন খবর জেনে হরিকিশোর বেশ শঙ্কিত ছিলেন, তার ছেলেটা না আবার ব্রাহ্ম হয়ে যায়। বিচলিত পিতা চরমপত্র দিলেন পুত্রকে- ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে উপেন্দ্রকিশোর তার সম্পত্তির কানাকড়িও পাবেন না।
ব্রাহ্মধর্মের প্রতি উপেন্দ্রকিশোরের আগ্রহ আরও বাড়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সান্নিধ্যে এসে। তার চেয়ে দুই বছরের বড় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে উপেন্দ্রকিশোরের। ব্রাহ্মরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না, বর্ণপ্রথা মানতেন না। তাদের বাড়ির মেয়েদের স্কুলে যাওয়ায় বাধা ছিল না। পর্দাপ্রথারও ধার ধারতেন না।
পিতার সম্পত্তির থোড়াই কেয়ার করেন খামখেয়ালি উপেন্দ্রকিশোর। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন। খবর শুনে ভীষণ রেগে গেলেন হরিকিশোর। তার সম্পত্তির মাত্র এক-চতুর্থাংশ দিলেন দত্তকপুত্রকে। ফলে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন উপেন্দ্রকিশোর।
তবে হরিকিশোরের মৃত্যুর পর এ উইল ছিঁড়ে ফেলেন হরিকিশোরের স্ত্রী ও নরেন্দ্রকিশোরের মা রাজলক্ষ্মী দেবী। পুত্রদের মধ্যে সম্পত্তি সমান ভাগ করে দেন তিনি।
১৮৮৩ সালে শিক্ষক প্রমদাচরণ সেনের ‘সখা’ পত্রিকায় ‘মাছি’

ছোটদের প্রিয় সন্দেশের কয়েকটি প্রচ্ছদ

নামে একটা লেখা লিখলেন উপেন্দ্রকিশোর। ছোটদের সাহিত্যে প্রথম চলিত ভাষায় লিখলেন অনুবাদ প্রবন্ধ ‘নিয়ম ও অনিয়ম’। উপেন্দ্রকিশোরের চিন্তাভাবনা সবই ছিল শিশু-কিশোরদের নিয়ে। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হলো তার প্রথম বই, ‘শিক্ষক ব্যাতিরেকে হারমোনিয়াম শিক্ষা।’ সংগীতবিষয়ে তার দ্বিতীয় বইটি ওই একই জায়গা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। এটি ছিল বেহালা শিক্ষার বই।
১৮৯৭ সালে সিটি বুক সোসাইটি থেকে ‘ছেলেদের রামায়ণ’ নামে উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ও অলংকরণ করা সচিত্র বই প্রকাশিত হলো। কিন্তু ছাপার মানে সন্তুষ্ট ছিলেন না লেখক। পৈতৃক জমি অনেকখানি বেচে দিয়ে সেই টাকায় বিলেতের পেনরোজ কোম্পানি থেকে বইপত্র, রাসায়নিক, ক্যামেরা, যন্ত্রপাতি আনিয়ে নিয়ে শুরু করলেন ছাপার উন্নতিসাধনের চেষ্টা। যাত্রা শুরু করল মুদ্রণসংস্থা ইউ রে আর্টিস্ট।


১৯০৩ সালে প্রাচীন পৃথিবী ও প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুদের নিয়ে ছোটদের জন্য ‘সেকালের কথা’ প্রকাশিত হলো। ‘ছেলেদের রামায়ণ’ নতুন করে প্রকাশিত হলো ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে বের হলো ‘ছেলেদের মহাভারত’। ১৯০৯ সালে ‘মহাভারতের গল্প’। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় গ্রামবাংলার মা ঠাকুমাদের মুখে মুখে প্রচলিত বেশ কিছু গল্প একত্রে সংগ্রহ করে লেখা হলো ‘টুনটুনির বই।’ ১৯১০ সালে ছেলে সুকুমারকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে রাখলেন ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। ১৯১১ সালে এই ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে বের হলো কবিতা আকারে ‘ছোট্ট রামায়ণ’।
১৯১৩ সালের গ্রীষ্মকালে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হলো ছোটদের জন্য ঝকঝকে পত্রিকা ‘সন্দেশ।’ যা নিজস্ব মহিমায় আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে বাংলা শিশু সাহিত্যের আসরে। ১৯১৫ সালে গিরিডিতে ডায়াবেটিস রোগভোগে ওপারে পাড়ি জমানোর আগ পর্যন্ত সন্দেশের বত্রিশটা সংখ্যা সম্পাদনা করতে পেরেছিলেন। এই সন্দেশেই ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় উপেন্দ্রকিশোরের শেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ‘গুপিগাইন বাঘা বাইন’।
১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭ বৈশাখ বা ১৮৬৩ সালের ১২ মে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে তার জন্ম। সে হিসেবে জন্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশি। আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে।
ছোটদের কথা ভেবেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী লিখেছেন। তার লেখার বিষয় নির্বাচন, রচনারীতি, পরিবেশনা, ভাষার ব্যবহার- এসব লক্ষ্য করলেই সহজেই সেটা বোঝা যায়। যদিও তার বেশির ভাগ লেখাই মৌলিক হিসেবে বলা যায় না, তবু তার পরিবেশনার মৌলিকত্ব তাকে দিয়েছে অমরত্ব। আর এই অমরত্বের কারণেই ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বাংলার শিশুদের কাছেই শুধু নয়, বাঙালির কাছে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি অতি পরিচিত।

 

দুরন্ত ছড়া: ধানের ঘ্রাণ

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ০৪:৩৮ পিএম
আপডেট: ২২ মে ২০২৫, ০৪:৩৯ পিএম
দুরন্ত ছড়া: ধানের ঘ্রাণ
এঁকেছে তুবা

ধানের ঘ্রাণ

হাফিজুর রহমান

শিষ হেলেছে ধান পেকে
সোনালি রং গায় মেখে
দুলছে মৃদু হাওয়ায়, 
হাসছে কৃষান খুশি মনে 
গাইছে পাখিরা গান বনে
দারুণ ঘ্রাণ পাওয়ায়।

ফসল উঠবে গোলা-ঘরে
স্তূপ করানো ধানের খড়ে
সূর্যের ছড়ানো রোদে,
ক্লান্তি আসে না কৃষকের
ঘাম ঝরান তা বৈশাখের 
অন্যরকম সুখ বোধে।

 

 

গ্রীষ্মকালের ফল

জহিরুল হক বিদ্যুৎ

গ্রীষ্মকালে নানান রকম
ফলের বাহার দেখি,
বৃক্ষ ডালে আম ও জামে
মুগ্ধ করে আঁখি।
কাঁঠাল, লিচু, বেল ও কলা
ঝুলে আছে গাছে,
তরমুজ, বাঙ্গি, আনারসেও
খেত যে ভরা আছে।
লাল ও সাদা জামরুল খেলে
মুখ ভরে যায় রসে,
পেয়ারাও বেশ দারুণ স্বাদের
রস ভরা টসটসে।
আরো দেখি বনবাদাড়ে
লেবু, বৈঁচি, চুকুর,
পেকে আছে গোছা গোছা
হলুদ রঙের ডুমুর।
পাকা পেঁপে তালের শাসও
খেতে দারুণ লাগে,
গ্রীষ্মকালে ফল খেলে তাই
শরীর ভালো থাকে।

 


মজার দেশ

শারমিন নাহার ঝর্ণা

এক যে ছিল মজার দেশ
জাদুর বাতি জ্বলে,
গাছের পাতা হেসে হেসে
মিষ্টি কথা বলে।

ফুলে ফুলে প্রজাপতি
খলখলিয়ে হাসে,
জলের উপর পাখির বাসা
কী যে সুখে ভাসে।

কুমির ছানা ডাঙ্গায় বসে
খেলে জাদুর খেলা,
মাছেরা সব ডাঙ্গায় বসে
সাজায় মজার মেলা।

মজার দেশে জাদুর খেলা
দিনে রাতে চলে,
মজার দেশে জাদুর রাজা
মজার কথা বলে।

 

মাছে মজা

হাফিয রেদওয়ান

মাথা বড় কাতলা
ঝোল মজা, পাতলা।

পেটি বড় চিতল  
খেয়ে মন শীতল।

ইলিশ ভাজা সরষে
মুখে পুরি হরষে।

শিং টেংরা কৈ
আহা! স্বাদ, হই হই।

 

 

মায়ের মতো

কাব্য কবির

মাগো তোমার আঁচল তলে
শান্তি খুঁজে পাই,
এমন পরশ স্বর্গ ছাড়া
আর কোথাও নাই।

কোথায় আছি, কেমন আছি
নাও যে তুমি খোঁজ,
দুধ, কলা, ভাত আদর করে
মেখে খাওয়াও রোজ।

কাঁদো তুমি রবের কাছে
আমার অসুখ হলে,
কেঁদে কেঁদে ভাসো তুমি
দুই নয়নের জলে।

 

মুক্ত পাখি 

আব্দুস সাত্তার সুমন 

মুক্ত পাখি মুক্ত হয়ে
দূর আকাশের বুকে,
সাদা সাদা মেঘের ভেলায় 
থাকবে মহাসুখে।

প্রাণ পাখিটি বলবে গিয়ে 
মুক্ত হতে চাই,
সবুজ ঘেরা ওই বনেতে 
দেবে আমায় ঠাঁই?

স্বাধীন পাখি স্বাধীন হয়ে 
সুখী হবে নীড়ে,
সুখে-দুঃখে থেকো তুমি
শত পাখির ভিড়ে।

উড়ে উড়ে রঙিন ডানায়
যাবে গহিন বনে,
যেথায় থেকো সুস্থ থেকো 
রাখবে আমায় মনে?

সাক্ষী শিয়াল

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ০১:৫৪ পিএম
সাক্ষী শিয়াল
এঁকেছেন মাসুম

একজন সওদাগর একটি ঘোড়া নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে তার বড্ড ঘুম পেল। তখন তিনি ঘোড়াটিকে এক গাছে বেঁধে, সেই গাছের তলায় ঘুমিয়ে রইলেন।
এমন সময় এক চোর এসে সওদাগরের ঘোড়াটিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সওদাগর ঘোড়ার পায়ের শব্দে জেগে উঠে বললেন, ‘কী ভাই, তুমি আমার ঘোড়াটিকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?’
চোর তাতে ভারি রাগ করে বলে, ‘তোমার ঘোড়া আবার কোনটা হলো?’
শুনে সওদাগর আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘সে কী কথা! তুমি আমার ঘোড়া নিয়ে চলে যাচ্ছ, আবার বলছ কোনটা আমার ঘোড়া?’
দুষ্টু চোর তখন মুখ ভার করে বলে, ‘খবরদার! তুমি আমার ঘোড়াকে তোমার ঘোড়া বলবে না!’
সওদাগর বললেন, কী? আমি আমার ঘর থেকে ঘোড়াটাকে নিয়ে এলুম, আর তুমি বলছ সেটা তোমার?’
চোর বলে, ‘বটে। এটা তো আমার ওই গাছের ছানা। এক্ষুনি হলো। তুমি বুঝে শুনে কথা কও, নইলে বড় মুশকিল হবে।’
তখন সওদাগর গিয়ে রাজার কাছে নালিশ করলেন, ‘মহারাজ, আমি গাছে আমার ঘোড়াটি বেঁধে ঘুমুচ্ছিলুম, আর ওই বেটা এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে।’
রাজামশাই চোরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হে, তুমি ওর ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছ কেন?’
চোর হাত জোড় করে বলে, ‘দোহাই মহারাজ। এটি কখনোই ওর ঘোড়া নয়। এটি আমার গাছের ছানা। ছানাটি হতেই আমি তাকে নিয়ে যাচ্ছিলুম, আর ওই বেটা উঠে বলছে কিনা ওটা ওর ঘোড়া, সব মিথ্যে কথা!’
তখন রাজামশাই বললেন, ‘এ তো ভারি অন্যায়। গাছের ছানা হলো, আর তুমি বলছ সেটা তোমার ঘোড়া। তুমি দেখছি বড় দুষ্টু লোক। পালাও এখান থেকে!’ বলে তিনি ঘোড়াটা চোরকেই দিয়ে দিলেন।
সওদাগর বেচারা তখন মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে চললেন। খানিক দূরে গিয়ে এক শিয়ালের সঙ্গে তার দেখা হলো।
শিয়াল তাকে কাঁদতে দেখে বললেন, ‘কী ভাই? তোমার মুখ এমন ভার দেখছি যে! কী হয়েছে?’
সওদাগর বললেন, ‘আর ভাই, সে কথা বলে কী হবে? আমার ঘোড়াটি চোরে নিয়ে গেছে। রাজার কাছে নালিশ করতে গেলুম, সেখানে চোর বললে কিনা ওটা তার গাছের ছানা! রাজামশাই তাই শুনে ঘোড়াটি চোরকেই দিয়ে দিয়েছেন।’
এ কথা শুনে শিয়াল বললেন, ‘আচ্ছা, এক কাজ করতে পারো?’
সওদাগর বললেন, ‘কী কাজ?’
শিয়াল বললেন, ‘তুমি আবার রাজামশাইয়ের কাছে গিয়ে বলবে, মহারাজ, আমার একটি সাক্ষী আছে। আপনার বাড়িতে কুকুরদের ভয়ে সে আসতে পারছে না। অনুগ্রহ করে যদি কুকুর তাড়িয়ে দেওয়ার হুকুম দেন, তবে আমার সাক্ষীকে নিয়ে আসতে পারি।’
তা শুনে রাজামশাই তক্ষুনি সব কুকুর তাড়িয়ে দেওয়ার হুকুম দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, এখন তোমার সাক্ষী আসুক।’
এসব কথা সওদাগর শিয়ালকে এসে বলতেই শিয়াল চোখ বুজে টলতে-টলতে রাজার সভায় এল। সেখানে এসেই সে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমুতে লাগল। রাজামশাই তো দেখে হাসতে হাসতে বললেন, ‘কী শিয়াল পণ্ডিত? ঘুমচ্ছ যে?’
শিয়াল আধ চোখে মিট মিট করে তাকিয়ে বললে, ‘মহারাজ, কাল সারা রাত জেগে মাছ খেয়েছিলুম, তাই আজ বড্ড ঘুম পাচ্ছে।’
রাজা বললেন, ‘এত মাছ কোথায় পেলে?’
শিয়াল বলল, ‘কাল নদীর জলে আগুন লেগে সব মাছ এসে ডাঙায় উঠল। আমরা সবাই মিলে সারা রাত খেলুম, খেয়ে কি শেষ করতে পারি!’
এ শুনে রাজামশাই এমনি ভয়ানক হাসলেন যে, আর একটু হলেই তিনি ফেটে যেতেন। শেষে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, ‘এমন কথা তো কখনো শুনিনি! জলে আগুন লাগে, এও কি কখনো হয়। এ সব পাগলের কথা!’
তখন শিয়াল বললেন, ‘মহারাজ ঘোড়া গাছের ছানা হয় এমন কথাও কি কখনো শুনেছেন? সে কথা যদি পাগলের কথা না হয়, তবে আমার এই কথাটার কি দোষ হলো?’
শিয়ালের কথায় রাজামশাই ভারি ভাবনায় পড়লেন। ভেবে-চিন্তে শেষে তিনি বললেন, ‘তাই তো! ঠিক বলেছ। গাছের আবার কী করে ছানা হবে? সে বেটা তবে নিশ্চয় চোর।’
তখনই হুকুম হলো, ‘আন তো রে সেই চোর বেটাকে বেঁধে!’
অমনি দশ পেয়াদা গিয়ে চোরকে বেঁধে আনলেন। আনতেই রাজামশাই বললেন, ‘মার বেটাকে পঞ্চাশ জুতো।’
বলতে বলতেই পেয়াদারা তাদের নাগরা জুতো খুলে চটাস-চটাস চোরের পিঠে মারতে লাগলেন। সে বেটা পঁচিশ জুতো খেয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘গেলুম গেলুম। আমি ঘোড়া এনে দিচ্ছি। আর এমন কাজ কখনো করব না।’
কিন্তু তার কথা আর তখন কে শোনে। পঞ্চাশ জুতো মারা হলে রাজা বললেন, ‘শিগগির ঘোড়া এনে দে, নইলে আরও পঞ্চাশ জুতো!’
চোর তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ঘোড়া এনে দিল। তারপর তার নিজ হাতে তার নাক-কান মলিয়ে মাথা চেঁছে, তাতে ঘোল ঢেলে হতভাগাকে দেশ থেকে দূর করে দেওয়া হলো। সওদাগর তার ঘোড়া পেয়ে শিয়ালকে আশীর্বাদ করতে লাগল।

ট্রেন চলে ঝিক ঝিক ঝিক

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ০১:৪৯ পিএম
ট্রেন চলে ঝিক ঝিক ঝিক

অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন মানুষ ঘোড়া, গরু আর হেঁটে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত। তখন তো গাড়ি, বাস, ট্রেন কিছুই ছিল না। কিন্তু মানুষ ভেবেছিল—‘ইশ! যদি এমন কিছু থাকত, যেটা অনেক লোক একসঙ্গে বসে অনেক দূরে যেতে পারত।’
এই ভাবনা থেকেই একদিন তৈরি হলো ট্রেন।
প্রথম দিকে, খনি থেকে কয়লা টানার জন্য কাঠের রেলপথ বানানো হয়। মানুষ বা গরু সেই গাড়ি টানত। কিন্তু এতে সময় লাগত অনেক। তখন এক বুদ্ধিমান লোক এলেন, নাম রিচার্ড ট্রেভিথিক। তিনি ভাবলেন, ‘গরু নয়, ইঞ্জিনই টানবে গাড়ি।’
সেই ভাবনা থেকেই তিনি ১৮০৪ সালে তৈরি করলেন এক আজব ইঞ্জিন- যা ধোঁয়া ছাড়ে আর শোঁ শোঁ করে চলে। এটিই ছিল প্রথম বাষ্পচালিত ট্রেন! ভাবো তো, ট্রেন ধোঁয়া ছাড়ছে আর সবাই হাঁ করে দেখছে- ‘উফ! কী আজব জিনিস!’
তারপর এলেন আরেক বুদ্ধিমান চাচ্চু- জর্জ স্টিফেনসন। তিনি বানালেন আরও ভালো ট্রেন, নাম দিলেন লোকোমোশন নং ১। ১৮২৫ সালে ইংল্যান্ডে এই ট্রেন প্রথম যাত্রী নিয়ে চলল। মানুষের খুশি আর দেখে কে। একদল মানুষ চেঁচাচ্ছে, ‘হুররে!’ আরেক দল তো বলেই বসল, ‘এ তো জাদু!’
ধীরে ধীরে ট্রেন ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে। ভারতেও এল ট্রেন। ১৮৫৩ সালে, মুম্বাই থেকে থানে চলে প্রথম ভারতীয় ট্রেন। সব যাত্রী নতুন যাত্রায় অনেক খুশি, কিছুটা ভয়ও- এই বুঝি ট্রেন উড়ে যাবে!
আর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে? হ্যাঁ, আমাদের এখানেও এসেছে ট্রেন- ১৮৬২ সালে, প্রথম ট্রেন চলল কুষ্টিয়ার দর্শনা থেকে খুলনা পর্যন্ত। সেই ট্রেনের গতি ছিল কম, ‘ঝিক ঝিক ঝিক... ঝিক ঝিক ঝিক...’ শুনলেই ঘুম পায়, তাই না?
ট্রেন তখন কাঠের চেয়ারে বসা, জানালায় মাথা বের করা, বাতাসে চুল ওড়া আর পাশে চলা গরুর গাড়ি দেখা- একেবারে রোমাঞ্চকর ব্যাপার!
আজকাল কিন্তু ট্রেন আরও আধুনিক। এখন আছে ডিজেল ও বৈদ্যুতিক ট্রেন, আছে বুলেট ট্রেন- যা ঘণ্টায় ৩০০ কিমিরও বেশি গতিতে ছুটে চলে! এমনকি চুম্বকের মতো ভাসা ম্যাগলেভ ট্রেনও আছে!
ট্রেন এখন শুধু চলার মাধ্যম নয়- এটা একটা রোমাঞ্চ, এক গল্পের নাম।
তোমরা ট্রেনে উঠেছ? জানালায় বসে সূর্য দেখেছ? যদি না দেখে থাকো, তবে বাবাকে বলো, ‘আমরা ট্রেনে চড়তে চাই!’
কারণ ট্রেন শুধু গন্তব্যে নিয়ে যায় না, এটা নিয়ে যায় এক রোমাঞ্চকর যাত্রায়। যেখানে গল্প, খুশি আর নতুন নতুন জায়গার দেখা মেলে।
তো, তৈরি হও। ট্রেনের বাঁশি বাজছে ‘টু টু!’ চলো, আমরা একসঙ্গে ট্রেনে চড়ে যাই।

সুন্দর পাখি টোকো টোকান

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৪ পিএম
সুন্দর পাখি টোকো টোকান
টোকো টোকান অত্যন্ত সামাজিক পাখি। ছবি সংগৃহীত

টোকো টোকান অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর পাখি। এদের মূলত দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এদের চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য হলো তাদের বিশাল ও রঙিন ঠোঁট। এটি শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।

শারীরিক গঠন
টোকো টোকান হলো টোকান প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় পাখি। একটি পূর্ণবয়স্ক টোকো টোকানের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওজন হয় প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম। এদের ঠোঁট প্রায় ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে, যা পুরো দেহের এক-তৃতীয়াংশের বেশি। ঠোঁটটি দেখতে ভারী মনে হলেও এটি আসলে খুব হালকা। কারণ এটি কেরাটিন নামক এক ধরনের প্রোটিন দিয়ে তৈরি, যার ভেতরটা ফাঁপা।
এই ঠোঁটটি কমলা, হলুদ ও লাল রঙের সংমিশ্রণে তৈরি এবং তার প্রান্ত সাধারণত কালো রঙের হয়। এদের চোখের চারপাশে উজ্জ্বল নীল বা কমলা রঙের বৃত্ত থাকে, যা তাদের আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এদের শরীর সাধারণত কালো রঙের হলেও বুক এবং গলা সাদা বা হালকা রঙের হয়।

আবাসস্থল
টোকো টোকান সাধারণত দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যেমন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার উষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গলে বাস করে। তবে তারা শুধু গভীর অরণ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তাদের কখনো কখনো খোলা সাভানা, ফলবাগান এবং গ্রামীণ বনের আশপাশেও দেখা যায়। এরা সাধারণত গাছে বসবাস করে এবং গাছের ফাঁকফোকর, পুরোনো কাঠঠোকরার গর্তে বাসা বানায়।

খাদ্যাভ্যাস
টোকো টোকান সর্বভূক পাখি। এরা মূলত ফল খেতে পছন্দ করে, বিশেষ করে পাকা, নরম ফল তাদের প্রধান খাদ্য। তবে শুধু ফলে সীমাবদ্ধ না থেকে তারা পোকামাকড়, ছোট ছোট সরীসৃপ, পাখির ডিম এবং বাচ্চাও খেতে পারে। এদের ঠোঁটটি ফল ছেঁটে খাওয়া এবং দূরের শাখা থেকে ফল পেড়ে আনার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।

ছানাপোনা
টোকো টোকান জোড়া হিসেবে থাকে। এরা সাধারণত গাছের উঁচুতে বাসা তৈরি করে এবং স্ত্রী পাখি প্রতি মৌসুমে দুই থেকে চারটি ডিম পাড়ে। বাবা-মা উভয়ই ডিমে তা দেয় এবং বাচ্চাদের যত্ন নেয়। বাচ্চারা সাধারণত প্রায় দুই মাস পরে উড়তে শেখে এবং ততদিন তারা বাসাতেই থাকে।

আচরণ
টোকো টোকান অত্যন্ত সামাজিক পাখি। তারা প্রায়ই ছোট দলে ঘুরে বেড়ায় এবং একে অপরের সঙ্গে ঠোঁট ঠোকরানোর মাধ্যমে মজা করে। তারা উচ্চৈঃস্বরে ডাকাডাকি করে, যেটি অনেক দূর থেকে শোনা যায়। এই ডাকের মাধ্যমে তারা তাদের এলাকা চিহ্নিত করে এবং বিপদে সতর্কতা সংকেত দেয়।
উড়তে একেবারেই ভালোবাসে না টোকো টোকান। যতটা না ওড়ে, তার চেয়ে অনেক বেশি লাফিয়ে চলে। পুরো গাছই লাফাতে লাফাতে পার হয়। জীবনের বেশির ভাগ সময় মগডালে কাটায়। বৃষ্টিময় আমাজন বনমালার আলো-ছায়ায় ওরা রঙিন শরীর লুকিয়ে শিকারিদের ফাঁকি দেয়।

 

পাতালপুরী অভিযান

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩০ পিএম
পাতালপুরী অভিযান
এঁকেছেন মাসুম

হাবলুর বয়স ১০ বছর। তবে তার মাথার ভেতর ২৫টা প্ল্যান আর ৮০ ধরনের সন্দেহ সারাক্ষণ ঘুরপাক খায়। সে ভাবে—স্কুলের হেডস্যার আসলে এলিয়েন, গ্রামের মোড়ের পাঁপড়ি বিক্রেতা জ্যোতিষী, আর সবচেয়ে বড় কথা—তার বাড়ির পেছনের কুয়োটা পাতালপুরীর গোপন গেট!
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ! হাবলু তিন মাস ধরে সেই কুয়োর দিকে সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। কারণ? একদিন দুপুর বেলা, সে কুয়োর ধারে বসে খেজুর খাচ্ছিল। হঠাৎ কুয়োর ভেতর থেকে একটা ফিসফিসে আওয়াজ ভেসে এল— চিকেনপুরী নাকি ডিমপুরী?
হাবলু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার হাত থেকে খেজুর পড়ে গেল কুয়োয়। আর তারপর আবার সেই আওয়াজ— ডিমপুরী শেষ! এখন কেবল পাতালপুরী!
সেই দিন থেকে হাবলুর মাথায় পেঁচিয়ে গেছে পাতালপুরীর ধাঁধা। পরের দিনই হাবলু তার দুই সেরা বন্ধুকে ডেকে পাঠায়—মুনিয়া আর টোকনকে। মুনিয়া হলো একদম গম্ভীর, চশমা পরা মেয়ে। সে নাকি তিনবার হেডস্যারকে চোখের ইশারায় ভীত করেছে। আর টোকন—সে নিজেকে গুগল বলে দাবি করে। মানে, সব জানে। যদিও সে দিনকে ‘উল্টা রাত’ আর গরুকে ‘আলগা গরিল্লা’ বলেই ডাকে।
তো এই তিনজন মিলে কুয়োর পাশে বসে একটা প্ল্যান তৈরি করে। প্ল্যানের নাম দেয়—‘অপারেশন পাতালপুরী’।
হাবলুর কাজ—গার্ডকে পাহারা দেওয়া।
মুনিয়ার কাজ—লিপিবদ্ধ করা।
টোকনের কাজ—পাতালপুরীর সোর্স খোঁজা।
তিন দিন পর্যবেক্ষণের পর একদম ভর দুপুরে তারা দেখে, কুয়োর নিচ থেকে ধোঁয়া উঠছে! আর ধোঁয়ার মধ্যে কেমন যেন ঘিয়ের গন্ধ!
টোকন তখন চিৎকার করে বলে, বন্ধুরা! এটা পাতালপুরীর ধোঁয়া না হলে আমার নাম টোকন গুগল না!
হাবলু ঘোষণা দেয়, কাল ভোরে কুয়োয় নামব!
মুনিয়া চোখ সরু করে বলে, সাবধান। কুয়োর নিচে যদি কুমির থাকে!
টোকন হেসে বলে, তাহলে পাতালপুরী তো কুমিরেই বানায়!
পরদিন ভোরে তারা একে একে রশি বেঁধে হাবলুকে নামিয়ে দেয় কুয়োয়। হাবলু এক হাতে টর্চ, আরেক হাতে ছাতু দিয়ে বানানো হেলমেট পরে কুয়োর নিচে নামে। নামতে নামতে সে হঠাৎ কেমন যেন হাওয়ায় ভাসে। চোখ খুলে দেখে সে পড়েছে এক বিশাল পাতালপুরীতে! চারপাশে ছোট ছোট দোকান, দোকানের নাম ‘পেঁয়াজপুরী প্যালেস’, ‘চিকেন চাট চেম্বার’, ‘ঝালঝোলে জমিদারপুরী’। আর মাঝখানে এক বিশাল রঙ্গিলা চেয়ার, তাতে বসে এক মোটা লোক, যার মাথায় টমেটো রঙের টুপি আর গলায় ঝোলানো—‘পণিপতি’ লেখা ব্যাজ!
পণিপতি বলল, তুমি কি পৃথিবী থেকে এসেছ?
হাবলু বলল, আমি হাবলু। তোমার পাতালপুরীর গন্ধে এসেছি!
পণিপতি গম্ভীরভাবে বলল, হুঁ... তুমি নির্বাচিত হয়েছ। তুমি পাতালপুরীর ‘তরকারি তত্ত্ব’ জানো না তো?
হাবলু মাথা নাড়ল। পণিপতি ব্যাখ্যা দিল, পৃথিবীর মানুষ এখন আর মনের সঙ্গে কথা বলে না। তারা শুধু মোবাইলে গল্প করে। কিন্তু যে শিশু সত্যি সত্যি খাওয়ার গন্ধ শুঁকে সঠিক পুরী চিনতে পারে, তার মন এখনো জীবিত। তাই তাকে আমরা বেছে নিই পাতালপুরীর রক্ষক হিসেবে!
তারপর হাবলুকে দেওয়া হয় একটি ‘ঝাল ঝাঁঝাল ঝুড়ি’, যাতে থাকে বিশেষ মসলা। বলা হয়— যখন কারও মন খারাপ হবে, একটু ঝুড়ি খুলে ছিটিয়ে দিলেই তারা হাসবে।
হাবলু ফিরে আসে সেই ঝুড়ি হাতে। কুয়ো থেকে উঠে দেখে, মুনিয়া আর টোকন এক এক করে ওকে জড়িয়ে ধরে। তারা কেউ বিশ্বাস করে না এই গল্প। কিন্তু তার পর দিন মুনিয়ার দাদি যখন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যান, হাবলু তার চারপাশে হালকা করে মসলা ছিটায়। দাদি হঠাৎ নাচতে শুরু করেন! টোকনের ভাই যখন জিদ করে পড়তে চায় না, হাবলু মসলা ছিটায়, সে গাইতে শুরু করে, আয় খুকু আয়!
সেই থেকে পাড়ার সবাই জানে—হাবলু আসলে পাতালপুরীর বাহক। আর কুয়োর পাশে ছোট একটা গাছ এখন বাড়ছে, যার পাতায় টক-ঝাল গন্ধ ছড়ায়। কেউ জানে না—ওটাই একদিন হবে ‘ঝালরং পাতাল গাছ’—যার পাতায় লাগলে মন হাসে।