বাঙালির অধঃপতন! । খবরের কাগজ
ঢাকা ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪

বাঙালির অধঃপতন!

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১২ এএম
বাঙালির অধঃপতন!
ড. পবিত্র সরকার

ভেবেছিলাম খবরটায় গুরুত্ব দেব না। কারণ রোজই আমরা বৈঠকখানায় বা চায়ের দোকানের আড্ডায় বাঙালিকে সাত দুগুণে চোদ্দটা নরকে ফেলে পিষতে থাকি। কিন্তু এই ‘আমরা’ তো ফালতু লোক, আমাদের কথায় একটা দুব্বোঘাসও গজায় না, একটা উচ্চিংড়েও মরে না। আর ইনি হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, না কী যেন! ফলে যাকে বলে রীতিমতো ঘ্যাম লোক। তিনি একটা কথা বলেছেন, মিডিয়ার বাপের সাধ্য কী যে সে কথা অবহেলা করে! কাজেই তারাও মহাস্ফূর্তিতে ওই ‘আপ্তবচন’ ছেপে দিয়েছে। সে কী কথা? না, বাঙালির খুব অধঃপতন হয়েছে। তা তুমি বলতেই পারতে যে কিছু লোকের অধঃপতন হয়েছে, বাঙালির কিছু খবর আমাদের পছন্দ হয়নি, কিন্তু একেবারে পুরো জাত তুলে কথা! তাতে অবশ্য বাংলাদেশের বাঙালিদের ধরেছেন কি না জানি না। বোধ হয় ধরেননি। কারণ ঢাকায় রকের আড্ডা খুব বিশ্ববিখ্যাত নয়, কলকাতায় যেমন। এই গেল এক নম্বর।

দুনম্বর, অধঃপতনের কারণও তিনি নির্দেশ করেছেন। সে কারণ শুনলেই ঢাকাই কুট্টি গাড়োয়ান বলতে পারত, ‘হুইন্যা গুরায় (ঘোড়ায়) বি অ্যালায় আসব!’ মানে, শুনে ঘোড়াতেও হাসবে। এর মধ্যে ‘অ্যালায়’ কথাটি আমি প্রমিত রূপ দিতে সাহস করছি না, সম্পাদক কেটে দিতে পারেন। তা এই মহাপুরুষের মতে বাঙালির অধঃপতনের তিনটি কারণ—এক (না, এক, দুই অলরেডি সার্ভিসে লাগিয়েছি), প্রথমত, বাঙালি রকে বসে আড্ডা দেয়; দ্বিতীয়ত, বাঙালি মদ্যপান করে; আর তৃতীয়ত, মৃণাল সেনের ছবি দেখে। এই তিনটি কারণে বাঙালি অধঃপতনে গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তো একজন জ্ঞানী গুণী লোক হওয়ার কথা। নাকি আপনারা বলবেন, দুর মহাশয়, যে রকম আপনার প্রধানমন্ত্রী তেমনই তার উপদেষ্টা—কিন্তু আমি কথাগুলো শুনে শুধু ‘থ’ নয়, একেবারে ‘দ, ধ, দন্ত্য ন’ হয়ে গেলাম। আপনারা জানেন, লাতিনের একটা কথার লজিকে খুব ব্যবহার হয়, তা হলো non-sequitur, মানে It does not follow from that. তারও মানে হলো, এ থেকে ওটা দাঁড়ায় না। যেমন- ‘তিন কেজি আলুর দাম নব্বই টাকা- কাজেই পাঁচ কেজি পটোলের দাম চার শ কুড়ি টাকা!’

প্রথমত বাঙালি চিরকালই আড্ডা দিয়ে এসেছে, আর সবাই না হোক (এখনো সবাই মদ্যপান করে না, মদ সুলভ হওয়া সত্ত্বেও আর মৃণাল সেনের ছবিও সব বাঙালি দেখে না।) যারা এসব করেছে তারা সবাই অধঃপাতে গেছে, এটা যেমন প্রমাণ করা মুশকিল, তেমনই যারা অধঃপাতে গেছে (কিছু বাঙালি তো গেছে), তারা সবাই আড্ডা দিয়ে, মদ খেয়ে আর মৃণাল সেনের ছবি দেখে গেছে- তাও প্রমাণ করা মুশকিল। ইনি যেসব বাঙালি অধঃপাতে গেছে, তাদের কাছে গিয়ে ধরে ধরে ইন্টারভিউ নিয়ে নিশ্চয়ই জেনেছেন, সামনে প্রশ্নমালা ধরে যে, এই দাদা (কেউ কেউ ‘দিদি’ ছিলেন কি না জানি না), আপনি রকে আড্ডা দিয়েছেন তো? মদ খেয়েছেন তো? মৃণাল সেনের ছবি নিয়মিত দেখেছেন তো? ইশ্, কী কেচ্ছা করেছেন। এসব না করলেই তো বেঁচে যেতেন, পৃথিবীতে অক্ষয় কীর্তি রেখে যেতে পারতেন! এই অধঃপাতে যাওয়া বাঙালিদের তিনি কোথায় পেলেন জানি না।

আমরা এমন দাবি করছি না যে বাঙালিরা কেউ অধঃপাতে যায়নি বা তাদের আদৌ অধঃপাতে যাওয়ার অধিকার, ইচ্ছে বা ক্ষমতা নেই। প্রচুর বাঙালি অধঃপাতে গেছে, এখনো অনেকে হেসেখেলেই অধঃপাতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা সবাই রকে আড্ডা দিয়ে, মদ খেয়ে বা মৃণাল সেনের ছবি দেখে গেছে, এটা প্রমাণ করা খুব ক্যাচালের ব্যাপার বলেই মনে হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা নতুন রাজ্যপালের হাতে এখন কী রকম জানি না, কিন্তু তার কোনো একটাতে একটা ইউজিসি-পৃষ্ঠপোষিত গবেষণা প্রকল্প হাতে নেওয়াই যায় যে, যেসব অধঃপতিত বাঙালি এখন পাওয়া যাবে, তাদের কতজন বা সবাই মাননীয় উপদেষ্টার ফরমুলা নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে অধঃপাতে গেছেন কি না।

সেভাবে না গেলে, কেন যাননি। তাদের উত্তর থেকে জানা যাবে, ওই উপদেষ্টার প্রজ্ঞা ছাড়াও অধঃপাতে যাওয়ার আরও কী কী উপায় বাঙালি নিজেদের প্রতিভায় আবিষ্কার করেছিল। অবশ্যই এমন অনেক অধঃপতিত বাঙালি এখন বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের জীবনী পাওয়া গেলে বা উত্তরপুরুষদের মৌখিক ইন্টারভিউ নিয়েও জানা যাবে যে, তাদের আড্ডাস্থল কোথায় ছিল, মদ্যপানের সঙ্গীরা কারা ছিল বা মৃণাল সেনের কী কী ছবি তারা দেখেছিলেন। যদি ছবিগুলোর নাম পাওয়া যায়, তা হলে সেই ছবিগুলোতে অধঃপাতে যাওয়ার অনুকূল কী কী উপাদান আছে- তা নিয়েও পৃথক গবেষণা প্রকল্প হতেই পারে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী বা ইডির সাহায্য কতটা পাওয়া যেতে পারে, তাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাননীয় আচার্য নিশ্চয়ই বলতে পারবেন।

ওই বাঙালি উপদেষ্টাকে আপনারা নিশ্চয়ই সেই গ্রামের গরিব ও মেধাবী ছেলের মতো ভাববেন না— যাকে শহরের বড়লোকের মেয়ে প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছিল, আর যে বড়লোক শ্বশুরের কাছে নিজের বাপ-মায়ের পরিচয় দিয়েছিল বাড়ির ‘কাজের লোক’ বলে— গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় যা পাওয়া যেত আগে। কিন্তু আমাদের ভদ্রলোকের (‘নিশ্চয়ই ভদ্রলোক তিনি?) জন্য করুণা হয় এই জন্য যে, তিনি বাঙালির অধঃপতনের ফরমুলা এত সহজে বাতলে দিলেন, কিন্তু উন্নয়নের ফরমুলা বেমালুম চেপে গেলেন। সে ফরমুলা কি প্রধানমন্ত্রীর দলকে ভোট দেওয়া? তা হলেই অধঃপতন অ্যারেস্টেড হবে আর উন্নয়ন শুরু হবে?

করুণার আরও জায়গা আছে। তিনি বাঙালি হয়ে বাঙালি সম্বন্ধে এমন নিষ্ঠুর রসিকতা করেন—সেটা একটা জায়গা নয়। বাঙালি আত্মসমালোচনা করবে না তা কেউ বলে না। কিন্তু তার একটা মাথামুণ্ডু থাকবে তো? এই ওপরচালাকের মতো অন্তঃসারহীন কথাবার্তা যদি বাইরের লোক শোনে তো তাদের বাঙালির মেধাগত অধঃপতন সম্বন্ধে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না, যে একজন উঁচু পদের বাঙালি (দিল্লির হোক আর যেখানকারই হোক) এ ধরনের নির্বোধ ও ফালতু কথাবার্তা বলতে পারে।

করুণার আর একটা জায়গা হলো, এসব কথাবার্তা সত্ত্বেও এখন দু-একজন বাঙালি হঠাৎ একটা নোবেল প্রাইজ পেয়ে যায় (খুব বেশি দিন হলো কি অভিজিৎ বিনায়কের নোবেল প্রাইজ পাওয়া?), কারও নাম এখনো নোবেল-সম্ভাবনার কাছাকাছি থাকে, আন্তর্জাতিক বিদ্যা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বাঙালির মেধা স্বীকৃতি ও সম্মান পায়। বাংলাদেশের বাঙালিদের কথা আমি এখানে ধরছি না, উপদেষ্টা মশাই বোধ হয় নিজেও ধরেননি।
এমনকি বাঙালি সায়নী দাস ইংলিশ চ্যানেল পার করে, পৃথিবীর অন্যান্য চ্যানেল জয় করার জেদ ছাড়ে না, নিউজিল্যান্ড থেকেও জয় ছিনিয়ে আনে। তখন উপদেষ্টা মশায়ের জন্য করুণায় আমাদের চোখে জল আসে।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হবে বাংলাদেশ

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪, ১১:৩৮ এএম
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হবে বাংলাদেশ
এম. হুমায়ুন কবির

ডোনাল্ড লু যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবেন ডোনাল্ট লু। ডোনাল্ড লু প্রথমে ভারত ও শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় পৌঁছবেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ডোনাল্ড লু যে দায়িত্বে আছে বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে, সেই দায়িত্বের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তার সফল বাস্তবায়ন করবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তার একটা প্রাধান্য রয়েছে। তাদের অগ্রাধিকারের বিষয়ের আলোকেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবেন। সেদিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবেই দেখছি। বাংলাদেশে আমরা দুটি প্রবণতা দেখছি। বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কেমন ছিল, তা আমরা জানি। বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের অবস্থান রয়েছে। আমাদের দেশের যে সাম্প্রতিক রিপোর্ট হিউমান রাইটসের কাছে আছে, সে ক্ষেত্রে দেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, নাগরিক অধিকার, স্বাধীনতা, সামগ্রিক অর্থনৈতিক গভর্ন্যান্স হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অবস্থান রয়েছে।

ডোনাল্ট লু বাংলাদেশে এসে দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কথাবার্তা ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবেন। সেখানে তিনি তার অবস্থান তুলে ধরবেন এবং আমাদের অবস্থান জানতে চাইবেন। আমরা মনে করি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক টেকসই হওয়ার ক্ষেত্রে যে উপাদানগুলো দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা রাখতে পারবে সেই বিষয়গুলোই আলোকপাত করা হবে। তার মধ্যে অন্যতম আলোচনার বিষয় হবে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু দুই দিক থেকেই সম্পর্কটি উপাদেয়, সেহেতু দুই দিক থেকেই সম্পর্কটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের নির্বাচনের পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী একটি দল বাংলাদেশে এসেছিল। সে আগমনটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের নেতৃত্বাধীন হয়েছিল। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। তখন কিন্তু তারা দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বড় বাজার মনে করছে। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি সম্ভাব্য দেশ হিসেবে চিন্তা করেছে। সেই কথা মাথায় রেখেই কিন্তু তারা বাংলাদেশে কাজ করতে আগ্রহী। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিবেচনায় দুই দেশের অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও নৈতিক বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সবাই সহনশীল ও সহমত পোষণ করবে। পারস্পরিকভাবে দুই দেশেরই ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। বৈদেশিক সম্পর্কটা সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দুই দেশেরই সহমত আছে। 

কিছু আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি অনেক মনোযোগ দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কীভাবে ইতিবাচক অবস্থান ধরে রাখতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত আমাদের আগ্রহ নৈতিক বিষয়ের অগ্রগতি এবং অপ্রচলিত নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে। আমরা নন ট্রাডিশনাল সিকিউরিটি বিষয় যেমন; জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-চীন, বাংলাদেশ-ইউরোপ, বাংলাদেশ-মধ্যপ্রাচ্যর চলমান বিষয়গুলো নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা হবে বলে মনে হয়। সে ক্ষেত্রে দুই পক্ষই তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে। সে ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো কোনো বিষয়ে হয়তো আমাদের মতভেদ আছে। যেমন: ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ও রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। অন্যান্য বিষয় যেমন: অপ্রচলিত নিরাপত্তা, মুক্ত অঞ্চল ও বাণিজ্য অঞ্চল এসব বিষয়ে আমরা সহমত আছি। 

আরেকটি বিষয় হলো বাংলাদেশের জলবায়ুসংক্রান্ত বিষয়। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন বড় ধরনের একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ যেহেতু ভুক্তভোগীর শিকার, সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে সেই ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করতে হবে।

বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে ব্যাপারেও দুই পক্ষের মধ্যে ইতিবাচক আলাপ-আলোচনা হবে। বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করছে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কীভাবে আমরা সহযোগিতা পেতে পারি, তা আলোচনায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের অবস্থানটা তাদের কাছে তুলে ধরতে পারি যে, আমরা তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেতে পারি। জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়টি জলবায়ুর সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। 

সেই আলোকেও আমরা আলাপ-আলোচনা করতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনে যত আলোচনা করুক না কেন, বাংলাদেশের জ্বালানি জলবায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে, সে ক্ষেত্রে আমেরিকার যে বৈশ্বিক জলবায়ু বিষয়ে পরিকল্পনা আছে, তার মধ্যে আমরা কীভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি তা দেখতে হবে। বাংলাদেশ সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সামনে এগিয়ে যাবে বলে আশা করি। দুই দেশের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য থাকলেও এখন ইতিবাচকভাবেই সামনে এগিয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সম্পর্ক ও অবস্থান এবং আগামী দিনের ইতিবাচক অবস্থানগুলো আলোচনা করে একে অপরকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে সে ব্যাপারে বিশদ আলোচনা হবে বলে আশা করি।

লেখক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

দ্বৈত নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪, ১১:৩৫ এএম
দ্বৈত নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট
নোমান জাকির

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পৃথিবীর মোট ১০১টি দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন। অর্থাৎ, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের পাসপোর্ট রাখার পাশাপাশি আরও ১০১টি দেশের মধ্য থেকে যেকোনো দেশের পাসপোর্ট বহন করতে পারবেন। 

বাংলাদেশের নাগরিকরা বিশ্বায়নের এই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা বেশির ভাগই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন কাজের সন্ধানে। তারা যদি সেই উন্নত দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তবে তারা সেখানে তুলনামূলক সহজভাবে কর্মসংস্থান খুঁজে নিতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যও চালু করতে পারবেন। এই ব্যবসার পরিসর বাংলাদেশেও আসার সম্ভাবনা অস্বাভাবিক প্রত্যাশা নয়। বরং এই প্রত্যাশা এখন  বাস্তবতা।  

তাই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার এই  উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। একটি জাতীয় দৈনিকে দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) মো. হাবিবুর রহমানের বক্তব্য এই প্রবন্ধে পুনরায় প্রকাশ করার লোভ সামলাতে পারছি না। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে তিনি বলেন, দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারী প্রবাসীরা সেসব দেশে ভালোভাবে আয়-রোজগার করার সুযোগ-সুবিধা পাবেন এবং দেশে অর্থ পাঠাবেন, তাতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
দ্বিতিয়ত, বিশ্ব নাগরিক বিবেচনায় গ্লোবাল ভিলেজে কেউ দ্বৈত নাগরিক হতে চাইলে দেশের স্বার্থ ঠিক রেখে সে সুযোগ দেওয়া উচিত, যা বাংলাদেশ ‘নাগরিকত্ব আইন-২০১৬’ বিলের মাধ্যমেও অনুমোদিত।  

আর তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের আদান-প্রদান। দ্বৈত নাগরিকরা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার দেশে প্রয়োগ করতে পারবেন এবং দেশের বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর খাতে প্রযুক্তির ব্যবহারে দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ করার লক্ষ্যেও আকৃষ্ট হবেন। সেই সঙ্গে দেশের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক পারে দেশকে প্রযুক্তি ও জ্ঞানে আরও সমৃদ্ধ করতে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বেশির ভাগ নাগরিকই কীভাবে একই সঙ্গে নতুন নাগরিকত্ব পাওয়া দেশের পাসপোর্ট ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট অব্যাহত রাখবেন কিংবা কীভাবে বাংলাদেশে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, সে বিষয়ে অসচেতন। 
অথচ খুব সহজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের জন্য আবেদন করা যায়। আবার অফলাইনেও আবেদন করার প্রক্রিয়া রয়েছে। অনলাইনে আবেদন করলে কীভাবে আবেদন করতে হবে, কী কী ডকুমেন্টস দিতে হবে সব নির্দেশনা ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। 

তাছাড়া, বর্তমানে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে বিদেশের যেকোনো জায়গা থেকে দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদের আবেদন করা যায়, যা বিগত দিনগুলোতে সংশ্লিষ্ট দেশের মিশনের মাধ্যমে করা হতো। এতে করে প্রবাসী সেবাপ্রত্যাশীদের দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা টিকিয়ে রাখতে অনেক ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হতো এবং প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় হতো। 

বর্তমানে সোনালি ব্যাংকের ‘সোনালি পেমেন্ট গেটওয়ে’ অ্যাপের সঙ্গে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও পুলিশের বিশেষ শাখার সংযোগ থাকায় পেমেন্ট সংক্রান্ত ভোগান্তি থেকে রেহাই পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকরা খুব সহজেই দেশ-বিদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারবেন এবং সনদ প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও প্রয়োজনীয় কাজগুলো  অতিদ্রুত সম্পন্ন করতে পারেন। এতে করে প্রবাসীরা দ্বৈত নাগরিকত্ব টিকিয়ে রাখতে আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী হবেন।

বাংলাদেশের  দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ দিয়ে একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্যও আবেদন করতে পারবেন কিংবা তার ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকলে, সেই পাসপোর্ট খুব সহজেই নবায়ন করতে পারবেন। সুতরাং, পাসপোর্ট সংক্রান্ত ভোগান্তি থেকেও খুব সহজেই দ্বৈত নাগরিকরা মুক্তি পাবেন।

আবার অনেক দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারীর বাংলাদেশের পাসপোর্ট গ্রহণের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ গ্রহণেরও প্রয়োজন হয় না। এসআরও নম্বর ২৭০-আইন/২০০৮ অনুযায়ী বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তথা জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, চেকপ্রজাতন্ত্র, গ্রিস, পর্তুগাল, সুইডেন, হাঙ্গেরি, বেলারুশ, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, মোলদোভা, বসনিয়া, আলবেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, আইসল্যান্ড, অ্যান্ডোরা, মোনাকো, লিচেনস্টাইন, সান মারিনো, কসোভো, ইংল্যান্ড, এনডোরা, সাইপ্রাস, আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তখন পাসপোর্টের আবেদনের জন্য তাদের আর নতুন করে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ প্রদান করতে হবে না। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এসআরও নম্বর ২৭-আইন/২০১২ অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিক যারা এশিয়ার আরও সাতটি দেশ তথা হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করবেন, তাদের ক্ষেত্রেও পাসপোর্টের আবেদন করার সময় দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে না মর্মে গেজেট প্রকাশ করে। 

আবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নির্বাচন সহায়তা-২ শাখার ১২ এপ্রিল ২০২২ তারিখের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পাসপোর্ট গ্রহণের সময় দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে না। উপরিউক্ত সব দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের শপথ গ্রহণে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বিষয়ে কোনো বক্তব্য থাকতে পারবে না, মর্মে সব গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি তারা এমন শপথ গ্রহণ করে থাকেন, তখন বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে তাদের ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে।

দ্বৈত নাগরিকত্ব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, তাই এর সঠিক ব্যবহার এবং সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে দ্বৈত নাগরিকদের অবহিত করা অত্যন্ত জরুরি। ঠিক তেমনি দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদপ্রাপ্তিও যেন ভোগান্তির কারণ না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে। 

তবে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন, যেন কোনো অসাধু ব্যক্তি এর সুযোগ না নিতে পারে। আর এই জন্য ‘নাগরিকত্ব আইন ২০১৬’ অতি দ্রুত বলবৎ করা উচিত। এতে করে নাগরিকত্ব এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব দুটি বিষয়ই সার্বিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এগুলোর  সুব্যস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে এবং নাগরিকরাও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারবেন। একই সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত ভোগান্তিও অনেকাংশে কমবে।

লেখক: উপ-পরিচালক 
বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, বরিশাল
[email protected]

মোদির হিন্দুত্ববাদের অস্ত্র এবং দুশ্চিন্তার ভাঁজ

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৪, ১০:৫৫ এএম
মোদির হিন্দুত্ববাদের অস্ত্র এবং দুশ্চিন্তার ভাঁজ
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তৃতীয় দফার নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও সরকারপক্ষ, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি এবং আরএসএস নিশ্চিত হতে পারছে না, তারা ৪০০ আসন পাবে কি না। নির্বাচন শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রচারে নেমেছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত।

তাদের কোনো বক্তৃতায় উন্নয়ন, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা নেই। শুধু গান্ধী পরিবারকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি রয়েছে। যেসব শব্দ তারা ব্যবহার করছেন টিভির পর্দায় সরাসরি দেখালেও ছাপার অক্ষরে তা লেখা যায় না।

সাত দফার মধ্যে তিন দফা ভোট গ্রহণ হয়ে গেলেও মোদি এখনো ৪০০ আসন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। গোড়া থেকেই ৪০০ আসন পেয়ে সংবিধান সংশোধনের যে ডাক তিনি দিয়েছেন, তা কতটা কার্যকর হবে, নিজেও জানেন না।

সংবিধান সংশোধন করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধ করতে চাইছে মোদি সরকার। তৃতীয় দফার নির্বাচনের পর মোদি এখন উন্নয়ন-সংক্রান্ত সব কথাবার্তা বাদ দিয়ে গান্ধী পরিবার এবং সংখ্যালঘু দমন নিয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। কিন্তু মোদি সে অভিযোগের এখনো কোনো জবাব দেননি।

বিজেপি-আরএসএসের কটূক্তির জবাব দিয়েছেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, তথা ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। প্রিয়াঙ্কা মোদিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গান্ধী পরিবার শহিদ পরিবার। শহিদ পরিবারকে অপমান করা ভারতবর্ষের মানুষ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, আমার ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে বিজেপি আরএসএসের কোনো ক্ষোভ, দুঃখ কিছুই নেই। আর ৯১ সালে নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে দক্ষিণ ভারতে তিরুঅনন্তপুরমে মানববোমার হানায় আমার বাবার দেহটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই দৃশ্য দেখেও আরএসএস উল্লসিত হয়েছিল। কেন হয়েছিল তা জানি না। তবে এই আরএসএসেরই অপর এক ব্যক্তি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা মোদিজির মনে পড়ে না। আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, এ ধরনের প্রচার আপনি বন্ধ করুন। আমার দাদা রাহুল গান্ধী দুই বছর ধরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরেছেন। দেখেছেন মানুষের দুর্দশা, হতাশা। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় আনার জন্যই কংগ্রেসের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় করার কথা ঘোষণা করেছেন।

শুধু কংগ্রেস নয়, গত তিন-চার দিন ধরে INDIA জোটের সব শরিকই পৃথকভাবে বিবৃতি দিয়ে রাহুলের দাবি সমর্থন করেছেন। প্রিয়াঙ্কার বক্তব্যের পরও বিজেপি-আরএসএস মুখে কুলুপ এঁটে আছে। বুধবারও বিভিন্ন জনসভায় মোদির বক্তব্য- সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। বিজেপি দেবে না।

ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিম লিগ প্রধান আসাফউদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, আমি কংগ্রেসবিরোধী। কিন্তু রাহুলের সংখ্যালঘু সংরক্ষণের প্রস্তাব পূর্ণ সমর্থন করি। চিরদিনের কংগ্রেসবিরোধী আসামের রাজনীতিবিদ বদরুদ্দিন বুধবার একাধিক জনসভায় বলেছেন, মুসলিমদের সংরক্ষণ নিয়ে রাহুলের চিন্তার সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত।

শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, দিল্লির একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি চ্যানেল এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। সেই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৬ শতাংশ মানুষই রাহুলের এই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন।

INDIA জোটের সংসদীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান, তথা সাবেক কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী মঙ্গলবার মধ্যপ্রদেশে নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক ফায়দার জন্যই ঘৃণাভাষণ দিয়ে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি আরও বলেন, হঠাৎই উন্নয়নের প্রচার বাদ দিয়ে সুস্পষ্ট মেরূকরণের পথে হাঁটছেন মোদি। ‍তৃতীয় দফার ভোটপর্বে মোদি অস্ত্র করেছেন ‘ভোট জিহাদ’কে। তীব্র ঘৃণাভাষণ ছড়িয়ে মোদিকে এ কথাও বলতে শোনা গেছে যে, বিজেপিকে ৪০০ আসন পাইয়ে দিতেই হবে। তা না হলে রামমন্দিরে তালা দিয়ে দিতে পারে কংগ্রেস।

এ প্রসঙ্গে মোদি সরাসরি কংগ্রেসকেই দায়ী করছেন। অর্থাৎ মোদির অভিযোগ ভোট জিহাদের নামে একটা নির্দিষ্ট ধর্মের লোকদের একজোট হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলছেন রাহুল গান্ধী। এদিকে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা বলছে, প্রচারে আসলে মোদির হাতে কোনো ইতিবাচক অস্ত্র নেই। তাই ফের কড়ামাত্রার হিন্দুত্বের দিকেই ঝোঁক মোদি এবং অমিত শাহর। আর মোদির এই অস্ত্রকে ভোঁতা করতে কংগ্রেস মূলত তাদের আর্থসামাজিক প্রচারকেই তুলে ধরছে। সোনিয়া গান্ধীও এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, দেশের যুব সম্প্রদায় চরম বেকারত্বের সম্মুখীন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলছেন- এবার ভারতের নির্বাচনে ‘রাম’ আর মানুষ খাচ্ছে না।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ কী দেখাল?

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৪, ১০:৫২ এএম
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ কী দেখাল?
রাজেকুজ্জামান রতন

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ফলাফল পাওয়া গেছে। ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন সরকারের পরিকল্পনা এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হলেও কিছু নতুন সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা আর দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের নানা দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে এই নির্বাচনে। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের, তেমনি এবারে প্রতীকবিহীন নির্বাচনের সিদ্ধান্তও আওয়ামী লীগের। এই সিদ্ধান্তকে নির্বাচনের গুণগত মান বৃদ্ধির চাইতেও নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করে নিয়ে আসা এবং ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধির কৌশল বলেই মনে করা হয়েছে। এত কৌশলের পরও নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কম কেন, বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার। দেখা যাচ্ছে, এযাবৎকালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের মধ্যে সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতি হয়েছে এই নির্বাচনে।
 
দেশে ষষ্ঠবার এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এ নিয়ে চতুর্থবার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার প্রথম ধাপে নির্বাচন হলো ৮ মে, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন ২৩ মে, তৃতীয় ধাপ ২৯ মে এবং চতুর্থ ও শেষ ধাপের নির্বাচন হবে ৫ জুন। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের জন্য গত ২১ মার্চ তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে মামলাসহ অন্যান্য কারণে আটটি উপজেলার নির্বাচন স্থগিত হয়। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান- এই তিনটি পদের সব প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচ উপজেলায়। ফলে ৮ মে ১৩৯টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 

ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ১৩৯ উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে গড়ে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে ৯ মে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানান। নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বুধবারের (৮ মে) প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে ইভিএমে প্রদত্ত ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ, ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ।

গত ৮ মে ভোট শেষ হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন ভবনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, অনেক ভোটার ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় ভোটকেন্দ্রে আসেননি। ভোটার বেশি এলে নির্বাচন আরও ভালো হতো। নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হতে পারে জানিয়ে সিইসি বলেছিলেন, সকালে বৃষ্টি হয়। আবার ধান কাটার মৌসুম বিধায় ভোট পড়ার হার কম হতে পারে। ভোটাররা ধান কাটতে থাকায় ভোটকেন্দ্রে আসেননি, এটা জানতে পেরেছি। এ ছাড়া কিছু কিছু জায়গায় ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। ভোটার বেশি এলে আরও বেশি ভালো হতো। 

এর আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে গড়ে ৪১ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। ওই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। আর ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা ভোটে ৬১ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ভোট গণনা করা হয়েছিল। এর আগে ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় উপজেলা নির্বাচন এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা নির্বাচনে কত ভোট পড়েছিল সে বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য জানা যায়নি। ফলে যতটুকু ধারণা করা যায় তাতে উপজেলা নির্বাচনগুলোর মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতি ঘটেছে। 

অথচ প্রার্থী বাড়ানোর মাধ্যমে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে এবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি নির্বাচন যাতে নিজ দলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন না হয় বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যাপক প্রার্থী নির্বাচিত না হয়, সে কারণে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে মন্ত্রী-এমপির স্বজনকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে কেউই ওই নির্দেশনা কানে তোলেননি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য বলা হয়, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের বাইরে বাকিরা নির্বাচন করতে পারবেন। ২০১৯ সালের উপজেলা ভোটে চেয়ারম্যান পদে ১১৫ জন বিনা ভোটে জয়ী হলেও এবার প্রথম ধাপে মাত্র পাঁচটি উপজেলায় সব প্রার্থী বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। ফলে সেই বিবেচনায়ও ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। নির্বাচন কমিশন ভোটার উপস্থিতি নিয়ে তথ্য দিলেও সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, দিনভর কেন্দ্রগুলো প্রায় ভোটারশূন্য ছিল। অবশ্য নির্বাচনের দিন ইসি সচিব জাহাংগীর আলম জানিয়েছিলেন, প্রথম চার ঘণ্টায় ভোটার উপস্থিতির হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।

স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন হবে কিন্তু ভোটার উপস্থিতি থাকবে না বা কম হবে, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু ভোটারদের আগ্রহ কমতে শুরু হয়েছিল প্রধানত পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনের সময় থেকে। সেবারই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল উপজেলা নির্বাচন। ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচন বিরোধী দলগুলো বর্জন করায় তখন ভোটের হারে ধস নামে। ফলে ধান কাটা, বৃষ্টি, গরম এসবের কিছু প্রভাব থাকলেও মূলত বিরোধী দলের অনুপস্থিতি বা ভোট বর্জন এবারের নিম্নহারের ভোটের প্রধান কারণ। মূল কারণ দূর না করলে অজুহাত যতই দেওয়া হোক না কেন, ভোটাররা নির্বাচনে আগ্রহী হবে না, এই সত্য মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। 

পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার ও অনিয়মের ঘটনায় এক-চতুর্থাংশ উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল, তা নিয়ে সরকারি দলের শরিক দলের নেতারা জাতীয় সংসদে সোচ্চার হয়েছিলেন। সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা এই প্রতিবাদ, অভিযোগ বা অনুযোগ যে কানেই তোলেননি, সেটা পরবর্তী সময়ে তাদের সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। সংবিধানের কথা মেনে চলবেন বলে যে অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে করা হয় সেই সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান’ করার নির্দেশনা আছে। কিন্তু ভোটারদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় শাসনের ভার যাদের ওপর প্রদান করা হয়, তাতে সংবিধানের মর্যাদা এবং নির্বাচনের সংস্কৃতি কোনোটাই তো রক্ষা হয় না। 

নির্বাচনকে ভোটারবিহীন করে আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব বিষয়ে পরিণত করার ফল কি ভালো হবে? স্থানীয় শাসন থেকে জাতীয় সংসদ সর্বত্র কি মানুষ একই চিত্র দেখবে? ভোটাররা যদি ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ঘোষিত জনপ্রতিনিধিরা জবাবদিহিহীন হয়ে পড়ে আর প্রশাসন দায়হীন আচরণ করতে থাকে, তাহলে গণতন্ত্র একটি চর্চাহীন শব্দগুচ্ছে পরিণত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে। এটা শুধু গণতন্ত্রহীন পরিবেশ তৈরি করে তাই নয়, ওপর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দেয়। ক্ষমতাসীনদের দাপট সমাজে গণতন্ত্রহীন পরিবেশ তৈরি করে। পাশাপাশি জন্ম দেয় প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতার। যার বিষময় ফল ভোগ করতে হয় পরবর্তী প্রজন্মকে। উপজেলা শুধু দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক স্তর নয়, গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম জায়গা। সেই নির্বাচনে যদি গণতন্ত্র ও জবাবদিহির চর্চা না হয়, তাহলে দেশের জনগণের আস্থা অর্জিত হবে কীভাবে? উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ সেই প্রশ্ন ও আশঙ্কা আবার তুলে ধরল। 

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]

ভারতে ভোটের হার কম, আতঙ্ক মোদি শিবিরে

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৪, ১০:৫১ এএম
ভারতে ভোটের হার কম, আতঙ্ক মোদি শিবিরে
দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

লোকসভা নির্বাচনের প্রথম তিন দফাতেই ভোটের হার কম থাকায় ‘অশনিসংকেত’ দেখছে বিজেপি। বিজেপি শিবিরের আশঙ্কার কারণ, সাম্প্রতিক অতীতে একমাত্র ১৯৯৯ সালের নির্বাচন ছাড়া যতবারই কম ভোট পড়েছে, প্রতিবার সরকার বদল হয়েছে। এবার যে ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের মতো ‘মোদি হাওয়া’ নেই, তা বিজেপি নেতৃত্ব আগেই টের পেয়েছিল। তার ওপরে প্রথম তিন দফায় মোট ২৮৩টি লোকসভা কেন্দ্রেই ভোটের কম হার বিজেপি শিবিরের চিন্তা বাড়িয়েছে। বিজেপি সূত্র বলছে, লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট গ্রহণ হয়ে গেছে। এই ২৮৩টি আসনের মধ্যে এনডিএ খুব বেশি হলে শ দেড়েক আসনে জিততে পারে। ফলে ‘৪০০ পারের’ সম্ভাবনা এখনো দূর অস্ত। উল্টো দিকে কংগ্রেস দাবি করেছে, প্রথম দুই দফার ভোটের মতো তৃতীয় দফায় ভোট হওয়া ৯৩টি আসনের সিংহভাগ আসন ইন্ডিয়া জোটই পেতে চলেছে। তেলেঙ্গানায় নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছেন, তিন দফায় ভোটের পরে ইন্ডিয়া জোটের ‘ফিউজ উড়ে গেছে’। বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জয়ের দিকে এগোচ্ছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। কিন্তু বিজেপি সূত্র বলছে, তৃতীয় দফায় যে ৯৩টি লোকসভা কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হয়েছে, তার মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে ভোটের হার কিছুটা বাড়লেও বিহারে ভোটের হার কমেছে। 

কংগ্রেসের সাংগঠনিক সম্পাদক কে সি বেণুগোপাল বলেছেন, তৃতীয় দফায় ভোট গ্রহণের পর সব আসন থেকে যে রিপোর্ট আসছে, তাতে স্পষ্ট, বিজেপি ঐতিহাসিক হারের মুখে পড়তে চলেছে। প্রথম দুই দফায় ভোটের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির ভুয়া জিনিসপত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। হিন্দুত্বের ধুয়া তোলা থেকে কংগ্রেস মঙ্গলসূত্র, মোষ ছিনিয়ে নেবে বলে আতঙ্ক তৈরি করছিলেন। বেণুগোপাল বলেন, “এসব মোদির মরিয়াভাবের প্রমাণ। উনি দেখতে পাচ্ছেন, পায়ের তলা থেকে জমি সরে যাচ্ছে। এর পরে উনি আরও মিথ্যে বলবেন। বিদ্বেষ ছড়াবেন। ‘ইন্ডিয়া’র তরফে ঢেউ উঠেছে।” বিজেপি অবশ্য আশা করছে, এখনো চার দফার ভোট বাকি। মোদির পক্ষে হাওয়া ওঠার সময় এখনো রয়েছে।

ভারতের ভোট নিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ রাশিয়ার 
ভারতে লোকসভা ভোট চলছে। সেই সময়ে অভিযোগের আঙুল তুলল রাশিয়া। তাও আবার খোদ আমেরিকার দিকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের লোকসভা নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘ভারসাম্যহীন’ করার চেষ্টা করছে।

ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে। জাখারোভা বলেন, ভারতের জাতীয় মানসিকতা, ইতিহাস সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের বোঝার অভাব রয়েছে। আমেরিকা ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে ‘ভিত্তিহীন অভিযোগ’ করে চলেছে। এটি ভারতের কাছে অসম্মানজনক, এই কথাও বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর মার্কিন কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের লঙ্ঘনের অভিযোগে ভারতের সমালোচনা করেছে। এটি ‘ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারের, বিশেষ করে গুরুতর লঙ্ঘনে জড়িত।’ এ জন্য ভারত এবং অন্যান্য ১৬টি দেশকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে মনোনীত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

মহাসংকটে এয়ার ইন্ডিয়া 
টাটা গোষ্ঠীর বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস পড়েছে মহাসংকটে। গণছুটিতে চলে গেছেন কেবিন ক্রুরা। যার জেরে বুধবার একাধিক ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। এবার এই ঘটনায় এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষের থেকে রিপোর্ট চাইল ভারত সরকার। অন্যদিকে এয়ার ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অধিকারসংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে শ্রমিক কমিশন।

গত মঙ্গলবার রাত থেকেই কর্মীসংকটে ভুগছে এয়ার ইন্ডিয়া। বাতিল হচ্ছে একের পর এক এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের ফ্লাইট। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে প্রায় ৩০০ জন কেবিন ক্রু আচমকাই ছুটি নিয়েছেন। এমনকি তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ। কোনোভাবেই কেবিন ক্রুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাই অগত্যা অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা বাতিল করতে বাধ্য হয় এয়ার ইন্ডিয়া। একের পর এক বিমান বাতিল হতে শুরু করে। কাল থেকে আজ অবধি ৮০-এর বেশি বিমান বাতিল হয়েছে।

এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটা অধিগ্রহণ করার পর থেকেই নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে বলে দাবি তুলেছিলেন কর্মীরা। তাদের অভিযোগ ছিল, ইন্টারভিউতে যে পোস্টের কথা বলা হচ্ছে, আদৌ সেই পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অনেক কর্মীকেই নিচু পদে নিয়োগ করছে সংস্থা। তা ছাড়া কোম্পানির অন্দরে তলে তলে কর্মী ছাঁটাইও চলছিল। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মীরা অসন্তোষ দেখাচ্ছেন। গণছুটিতে যাওয়া প্রতিবাদের অংশ বলেও মনে করছেন অনেকে।

এই পরিস্থিতিতে এয়ার ইন্ডিয়ার মুখপাত্র সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং জানিয়েছেন, এভাবে এতজন কর্মী অনুপস্থিত হয়ে পড়ায় আর পরিস্থিতি সামলানো যায়নি। শেষ মুহূর্তে ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে এয়ার ইন্ডিয়াকে। 

লেখক: কলকাতা প্রতিনিধি, খবরের কাগজ