ভেবেছিলাম খবরটায় গুরুত্ব দেব না। কারণ রোজই আমরা বৈঠকখানায় বা চায়ের দোকানের আড্ডায় বাঙালিকে সাত দুগুণে চোদ্দটা নরকে ফেলে পিষতে থাকি। কিন্তু এই ‘আমরা’ তো ফালতু লোক, আমাদের কথায় একটা দুব্বোঘাসও গজায় না, একটা উচ্চিংড়েও মরে না। আর ইনি হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, না কী যেন! ফলে যাকে বলে রীতিমতো ঘ্যাম লোক। তিনি একটা কথা বলেছেন, মিডিয়ার বাপের সাধ্য কী যে সে কথা অবহেলা করে! কাজেই তারাও মহাস্ফূর্তিতে ওই ‘আপ্তবচন’ ছেপে দিয়েছে। সে কী কথা? না, বাঙালির খুব অধঃপতন হয়েছে। তা তুমি বলতেই পারতে যে কিছু লোকের অধঃপতন হয়েছে, বাঙালির কিছু খবর আমাদের পছন্দ হয়নি, কিন্তু একেবারে পুরো জাত তুলে কথা! তাতে অবশ্য বাংলাদেশের বাঙালিদের ধরেছেন কি না জানি না। বোধ হয় ধরেননি। কারণ ঢাকায় রকের আড্ডা খুব বিশ্ববিখ্যাত নয়, কলকাতায় যেমন। এই গেল এক নম্বর।
দুনম্বর, অধঃপতনের কারণও তিনি নির্দেশ করেছেন। সে কারণ শুনলেই ঢাকাই কুট্টি গাড়োয়ান বলতে পারত, ‘হুইন্যা গুরায় (ঘোড়ায়) বি অ্যালায় আসব!’ মানে, শুনে ঘোড়াতেও হাসবে। এর মধ্যে ‘অ্যালায়’ কথাটি আমি প্রমিত রূপ দিতে সাহস করছি না, সম্পাদক কেটে দিতে পারেন। তা এই মহাপুরুষের মতে বাঙালির অধঃপতনের তিনটি কারণ—এক (না, এক, দুই অলরেডি সার্ভিসে লাগিয়েছি), প্রথমত, বাঙালি রকে বসে আড্ডা দেয়; দ্বিতীয়ত, বাঙালি মদ্যপান করে; আর তৃতীয়ত, মৃণাল সেনের ছবি দেখে। এই তিনটি কারণে বাঙালি অধঃপতনে গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তো একজন জ্ঞানী গুণী লোক হওয়ার কথা। নাকি আপনারা বলবেন, দুর মহাশয়, যে রকম আপনার প্রধানমন্ত্রী তেমনই তার উপদেষ্টা—কিন্তু আমি কথাগুলো শুনে শুধু ‘থ’ নয়, একেবারে ‘দ, ধ, দন্ত্য ন’ হয়ে গেলাম। আপনারা জানেন, লাতিনের একটা কথার লজিকে খুব ব্যবহার হয়, তা হলো non-sequitur, মানে It does not follow from that. তারও মানে হলো, এ থেকে ওটা দাঁড়ায় না। যেমন- ‘তিন কেজি আলুর দাম নব্বই টাকা- কাজেই পাঁচ কেজি পটোলের দাম চার শ কুড়ি টাকা!’
প্রথমত বাঙালি চিরকালই আড্ডা দিয়ে এসেছে, আর সবাই না হোক (এখনো সবাই মদ্যপান করে না, মদ সুলভ হওয়া সত্ত্বেও আর মৃণাল সেনের ছবিও সব বাঙালি দেখে না।) যারা এসব করেছে তারা সবাই অধঃপাতে গেছে, এটা যেমন প্রমাণ করা মুশকিল, তেমনই যারা অধঃপাতে গেছে (কিছু বাঙালি তো গেছে), তারা সবাই আড্ডা দিয়ে, মদ খেয়ে আর মৃণাল সেনের ছবি দেখে গেছে- তাও প্রমাণ করা মুশকিল। ইনি যেসব বাঙালি অধঃপাতে গেছে, তাদের কাছে গিয়ে ধরে ধরে ইন্টারভিউ নিয়ে নিশ্চয়ই জেনেছেন, সামনে প্রশ্নমালা ধরে যে, এই দাদা (কেউ কেউ ‘দিদি’ ছিলেন কি না জানি না), আপনি রকে আড্ডা দিয়েছেন তো? মদ খেয়েছেন তো? মৃণাল সেনের ছবি নিয়মিত দেখেছেন তো? ইশ্, কী কেচ্ছা করেছেন। এসব না করলেই তো বেঁচে যেতেন, পৃথিবীতে অক্ষয় কীর্তি রেখে যেতে পারতেন! এই অধঃপাতে যাওয়া বাঙালিদের তিনি কোথায় পেলেন জানি না।
আমরা এমন দাবি করছি না যে বাঙালিরা কেউ অধঃপাতে যায়নি বা তাদের আদৌ অধঃপাতে যাওয়ার অধিকার, ইচ্ছে বা ক্ষমতা নেই। প্রচুর বাঙালি অধঃপাতে গেছে, এখনো অনেকে হেসেখেলেই অধঃপাতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা সবাই রকে আড্ডা দিয়ে, মদ খেয়ে বা মৃণাল সেনের ছবি দেখে গেছে, এটা প্রমাণ করা খুব ক্যাচালের ব্যাপার বলেই মনে হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা নতুন রাজ্যপালের হাতে এখন কী রকম জানি না, কিন্তু তার কোনো একটাতে একটা ইউজিসি-পৃষ্ঠপোষিত গবেষণা প্রকল্প হাতে নেওয়াই যায় যে, যেসব অধঃপতিত বাঙালি এখন পাওয়া যাবে, তাদের কতজন বা সবাই মাননীয় উপদেষ্টার ফরমুলা নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে অধঃপাতে গেছেন কি না।
সেভাবে না গেলে, কেন যাননি। তাদের উত্তর থেকে জানা যাবে, ওই উপদেষ্টার প্রজ্ঞা ছাড়াও অধঃপাতে যাওয়ার আরও কী কী উপায় বাঙালি নিজেদের প্রতিভায় আবিষ্কার করেছিল। অবশ্যই এমন অনেক অধঃপতিত বাঙালি এখন বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের জীবনী পাওয়া গেলে বা উত্তরপুরুষদের মৌখিক ইন্টারভিউ নিয়েও জানা যাবে যে, তাদের আড্ডাস্থল কোথায় ছিল, মদ্যপানের সঙ্গীরা কারা ছিল বা মৃণাল সেনের কী কী ছবি তারা দেখেছিলেন। যদি ছবিগুলোর নাম পাওয়া যায়, তা হলে সেই ছবিগুলোতে অধঃপাতে যাওয়ার অনুকূল কী কী উপাদান আছে- তা নিয়েও পৃথক গবেষণা প্রকল্প হতেই পারে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী বা ইডির সাহায্য কতটা পাওয়া যেতে পারে, তাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাননীয় আচার্য নিশ্চয়ই বলতে পারবেন।
ওই বাঙালি উপদেষ্টাকে আপনারা নিশ্চয়ই সেই গ্রামের গরিব ও মেধাবী ছেলের মতো ভাববেন না— যাকে শহরের বড়লোকের মেয়ে প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছিল, আর যে বড়লোক শ্বশুরের কাছে নিজের বাপ-মায়ের পরিচয় দিয়েছিল বাড়ির ‘কাজের লোক’ বলে— গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় যা পাওয়া যেত আগে। কিন্তু আমাদের ভদ্রলোকের (‘নিশ্চয়ই ভদ্রলোক তিনি?) জন্য করুণা হয় এই জন্য যে, তিনি বাঙালির অধঃপতনের ফরমুলা এত সহজে বাতলে দিলেন, কিন্তু উন্নয়নের ফরমুলা বেমালুম চেপে গেলেন। সে ফরমুলা কি প্রধানমন্ত্রীর দলকে ভোট দেওয়া? তা হলেই অধঃপতন অ্যারেস্টেড হবে আর উন্নয়ন শুরু হবে?
করুণার আরও জায়গা আছে। তিনি বাঙালি হয়ে বাঙালি সম্বন্ধে এমন নিষ্ঠুর রসিকতা করেন—সেটা একটা জায়গা নয়। বাঙালি আত্মসমালোচনা করবে না তা কেউ বলে না। কিন্তু তার একটা মাথামুণ্ডু থাকবে তো? এই ওপরচালাকের মতো অন্তঃসারহীন কথাবার্তা যদি বাইরের লোক শোনে তো তাদের বাঙালির মেধাগত অধঃপতন সম্বন্ধে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না, যে একজন উঁচু পদের বাঙালি (দিল্লির হোক আর যেখানকারই হোক) এ ধরনের নির্বোধ ও ফালতু কথাবার্তা বলতে পারে।
করুণার আর একটা জায়গা হলো, এসব কথাবার্তা সত্ত্বেও এখন দু-একজন বাঙালি হঠাৎ একটা নোবেল প্রাইজ পেয়ে যায় (খুব বেশি দিন হলো কি অভিজিৎ বিনায়কের নোবেল প্রাইজ পাওয়া?), কারও নাম এখনো নোবেল-সম্ভাবনার কাছাকাছি থাকে, আন্তর্জাতিক বিদ্যা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বাঙালির মেধা স্বীকৃতি ও সম্মান পায়। বাংলাদেশের বাঙালিদের কথা আমি এখানে ধরছি না, উপদেষ্টা মশাই বোধ হয় নিজেও ধরেননি।
এমনকি বাঙালি সায়নী দাস ইংলিশ চ্যানেল পার করে, পৃথিবীর অন্যান্য চ্যানেল জয় করার জেদ ছাড়ে না, নিউজিল্যান্ড থেকেও জয় ছিনিয়ে আনে। তখন উপদেষ্টা মশায়ের জন্য করুণায় আমাদের চোখে জল আসে।
লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়