ঢাকা ২১ বৈশাখ ১৪৩২, রোববার, ০৪ মে ২০২৫

রক্তস্নাত নবযাত্রা এখন সময় সামনে তাকানোর

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫০ এএম
এখন সময় সামনে তাকানোর
ছাত্র-জনতার বিজয় উল্লাস

আগস্টের প্রথম সপ্তাহের দিনগুলো যেন আগের জুলাই মাসেরই অংশ ছিল। ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচিতে ব্যস্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারোরই যেন ক্যালেন্ডারের ওই পরিবর্তনের দিকে তাকানোর সময় বা মনোযোগ কোনোটাই ছিল না। তাদের শুধুই খেয়াল সরকারের অনড়, একরোখা, কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরুদ্ধে পাহাড়সম প্রতিবাদ গড়ে তোলার দিকে। এসময় খুব দ্রুতই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হতে থাকে। আগের দিন ডাক দেওয়া ‘অসহযোগ’ আন্দোলন ৩ আগস্ট রূপ নেয় সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি হিসেবে। 

সমন্বয়করা ওইদিন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করতে দেশবাসীকে আহ্বান জানান। পরদিন ৪ আগস্ট সারা দেশে শুধু লাশ আর লাশ। বয়ে যায় তাজা রক্তের বন্যা। ক্ষোভে ফেটে পড়া ছাত্র-জনতার একটাই দাবি- স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যাগ। কী হয়, কী না হয়! এ ভাবনা-দুশ্চিন্তায় দেশবাসীর একটি দীর্ঘ রাত অতিক্রম শেষে ৫ আগস্ট সকাল থেকেই শুরু হয় স্বস্তির বৃষ্টি, ভারী বৃষ্টি। রক্তে রঞ্জিত রাজপথ বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলেও দুপুরের পর রাজপথে মানুষের ঢল নামে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মাথায় পৌনে বেলা ৩টার দিকে ভয়ে সরকারপ্রধান তার রাষ্ট্রীয় বাসভবন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যান। 

রাজপথে অবস্থানরত ছাত্র-জনতা স্বজন হারানোর বেদনা-হাহাকার বুকে নিয়েও খুশি হয় এই ভেবে যে, গুলিতে আর কোনোও প্রাণ যাবে না। সেনাবাহিনী তখনকার ওই সরকারের তাঁবেদারি না করে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ায়। অতঃপর আন্দোলনকারীদের আহ্বান ও দাবি অনুযায়ী নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন। 

ড. ইউনূস দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেন, ‘এ অর্জন তরুণদের। নতুন প্রজন্মের। বাংলাদেশের তরুণরা বিশ্বে এক নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব আমাদের এ তরুণদের কাছ থেকে শিখবে। তরুণদের সঙ্গে নিয়ে আমি একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই। এখানে থাকবে না শোষণ, নিপীড়ন, দারিদ্র্য, অবিচার ও নির্যাতন।’  শুরু হয় এক নবযাত্রা। 

কয়েক শ নারী-শিশু, ছাত্র-জনতার রক্তে স্নাত এ নবযাত্রায় অন্তর্বর্তী সরকারকে বিগত সময়ের পুঞ্জীভূত সমস্যা, ক্ষোভ ও বঞ্চনার নজিরবিহীন বহিঃপ্রকাশ সইতে হয়েছে সুদীর্ঘ একটি মাস। পথে পথে বিক্ষোভ-সমাবেশ, শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, শিক্ষালয়সহ সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা, কূটনৈতিক পর্যায়ে বৈদেশিক সম্পর্কে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া এবং সবশেষ আনসার বাহিনীর একটি অংশের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস- এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকারের এগিয়ে চলার দৃপ্ত-বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে আশাবাদী অনেকেই। 

বিগত এক মাস পররাষ্ট্রনীতির সুস্পষ্ট বার্তা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরানোসহ রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও হত্যা-নির্যাতনের বিচারকাজ শুরু করতে আইনি ব্যবস্থাকে ইতিবাচক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন বিগত সরকারের তীর্যক সমালোচক, রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক বিশ্লেষকরা।

দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে গত ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ গঠনের ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিশ্লেষকরা বলেছেন, এ শ্বেতপত্রে ‘মেগা প্রকল্প’ নিয়ে পর্যালোচনা করাসহ আর্থিক খাত (ব্যাংক ও পুঁজিবাজার) এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হলে জাতির জন্য পরবর্তী কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সুবিধা হবে। এ বিষয়ক সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কমিটির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নব্বই দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেবেন।

খবরের কাগজের সঙ্গে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস’ সম্পর্কে ধারণা প্রকাশ করতে গিয়ে সমালোচক, রাজনীতিক ও আর্থসামাজিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, সামনের দিকে তাকাতে হবে, এগিয়ে চলার দিন এসেছে। মানুষের অভাব-দারিদ্র্য এখন স্পষ্ট। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ছে। শিল্প-কারখানার উদ্যোক্তারা আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। কর্মসংস্থানের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব কিছুতেই মনোযোগ দিতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, প্রথম ৫০ বা ১০০ দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজে হাত দেওয়া হলে তার সুফল পাওয়া যাবে সব ক্ষেত্রে। তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক কাজগুলো কার্যত সঠিক ধারায় রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চায় দেশবাসী। বিগত সরকারের শেষ দুই বছর দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এতে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ভাত-মাছ ও ডালপ্রিয় দেশবাসী যেন সাধ্যের মধ্যে নিজের ও পরিবারের খাবার গ্রহণ করতে পারে সেই দাবিটি পূরণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

সাবেক সচিব ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এটা তো স্বীকার করতে হবে যে- একটা ‘অভূতপূর্ব’, একটা ‘অশ্রুতপূর্ব’ বিপ্লব হয়েছে। বিগত সরকারের যে কর্মকাণ্ড- তা ছিল অবিচার, অত্যাচার, অনাচারে পরিপূর্ণ। সে কারণেই মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ-হতাশা কাজ করছিল তার একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এটা অনেকটাই অনিবার্য ছিল।’ 

তার মতে, এখন যারা বিপ্লবটা করল তারা তো ছাত্র। এদের সঙ্গে ছিল বিগত সরকারের সময়ে সুবিধাবঞ্চিত, অন্যায়-অবিচারের শিকার হওয়া লোকজন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিপ্লবী এসব মানুষের সঙ্গে যোগ হয়েছে সুযোগসন্ধানী কিছু লোক ও গোষ্ঠী। এরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। এই সুযোগসন্ধানীরা খুবই ভয়ংকর, রক্তস্নাত বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত (অন্তর্বর্তী) সরকারের জন্য হুমকি। এই সুযোগসন্ধানীদের দমন করতে হবে শক্ত হাতে। এদের যদি দমন করা না হয় কিংবা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব হয় তাহলে অরাজকতা বাড়বে। এজন্য সবার আগে দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর গণমানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। এ কাজটি সহজ নয়। 

সরকারের হুকুম মানতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দলীয় পরিচয় ধারণ করেছে, পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়ে একের পর এক বিতর্কিত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা ফেরানোর কাজটি কঠিন। তার পরও এসব বাহিনীকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব এটি করা জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথম ৫০ দিনের মধ্যে এটা করে দেখানো উচিত।

গোলাম রহমান বলেন, ‘এর পরই যে কাজে হাত দেওয়া দরকার সেটি হলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হওয়া। অর্থনীতি এমনিতেই একটি মন্দ সময় পার করছিল। এরই মধ্যে রাজনৈতিক এ পরিবর্তনটা ঘটে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারে যারা অছেন তাদের বেশির ভাগই অর্থনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ। তাদের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশাটাও তাই বেশি। এ আস্থা ও বিশ্বাসের প্রমাণ তারা দেবেন এ ভরসা করা যায়। মোটাদাগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আনা ও অর্থনীতিতে ছন্দ ফেরাতে পারলে গণমানুষের আস্থা অর্জনে অন্তর্বর্তী সরকার যেমন সব মহলের আনুকূল্য পাবে তেমনি অন্য সব সমস্যাও দূরীভূত করার ক্ষেত্রে গতি আনতে প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্মও দ্রুত তৈরি হয়ে যাবে।’

অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়নকর্মী এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘একাত্তরের যে চেতনা তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু নেই এবার। যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো জনগণের প্রত্যাখ্যাত সরকার আমাদের একটা নষ্ট সমাজ দিয়ে গেছে। আমাদের অনেকগুলো সমস্যা ছিল তখনো কিন্তু সমাজে নানারকম অপকর্ম, ধর্ষণ-গুম-খুন, এসব তো ছিল না। এ সবকিছুই আজকের তরুণদের জীবনবাজি রেখে পথে নামতে বাধ্য করেছে। পরিণতি যা হওয়ার তাই হলো।’

তিনি বলেন, ‘এখন সামনের দিকে তাকাতে হবে। সরকারকে তার কাজের একটি প্রায়োরিটি লিস্ট (অগ্রাধিকার তালিকা) করতে হবে। জরুরিভিত্তিতে যা করা দরকার তাই সবার আগে করতে হবে। পুলিশের তৃণমূল পর্যায়ে বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবা দিতে (সার্ভিস ডেলিভারি) জনগণের প্রতি আচরণগত পরিবর্তন হয়নি। এ অভিযোগও উঠে আসছে খুব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যা ঘটেছে তা নজিরবিহীন, অতীতে ব্যাপক অনিয়ম-অবিচার হয়েছে। প্রশাসনেও প্রায় একই অবস্থা। দলীয় নিয়োগ, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারের ঘটনা হয়েছে অহরহ। যেসব কাজ জরুরি নয়, সেগুলো চলতে থাকুক। এসব কিছুতে এখনই হাত দেওয়ার দরকার নেই।’

তিনি বলেন, একটা চরম দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। দুর্বৃত্তায়ন, মানুষের অধিকার হরণ, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া- এসব করে একটা চরম কর্তৃত্ববাদী, কেউ কেউ বলে ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে পুরো দেশটাকেই একটা কারাগারে পরিণত করেছিল ৫ আগস্টে প্রত্যাখাত সরকার।’

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি আবারও বলব, বিগত সরকারের সময়ে একটা নষ্ট সমাজ সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। নতুন প্রজন্ম এটি আর নিতে পারছিল না। এই নতুন প্রজন্মের জন্য সরকার আশাব্যঞ্জক বিকল্প কিছু দিতে পারেনি। তাই একাধারে ছাত্র-জনতা তথা নাগরিকরা জেগে উঠে একটা দুষ্ট সরকারকে উৎখাত করেছে। এখন যেখানে অন্যায় সেখানেই নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে, এক হয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের মালিক হলো সোজা কথায় জনগণ। কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়।’

গোলাম রহমান ও বদিউল আলম মজুমদার- দুজনই বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং এরপরই অর্থনীতিকে মেরামত করার কাজে হাত দেওয়া। তবে, এর সঙ্গে যারা অপরাধী, তাদের আইনগত প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনতে হবে। অপরাধী ও দুষ্কৃতকারীদের কোনো ছাড় নয়। এ ছাড়া, যাদের আত্মত্যাগে আজকের এই পরিবর্তন, এই অর্জন, তাদের পরিবারকে সহায়তা করা, যারা বেঁচে আছেন কিন্তু চিকিৎসার প্রয়োজন তাদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সে ব্যবস্থা করা দরকার। সরকার এটি রাষ্ট্রের কোষাগারের শক্তি বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারে। এর পর, যে এজেন্ডা নিয়ে সরকার এগোতে চায় সেটি হলো সার্বিক সংস্কার। আর তা তড়িঘড়ি করে নয় বরং সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ অনুসন্ধান ও প্রতিবেদন নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

লোকসানে হতাশ লবণজলের শ্রমিক

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ০২:৩৩ পিএম
লোকসানে হতাশ লবণজলের শ্রমিক
কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডী এলাকায় লবণের স্তূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেখানে শ্রমিকরা কাজ করছেন। ছবি: খবরের কাগজ

কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদন্ডী গ্রাম। রোদে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া জমিতে কাজ করছিলেন লবণচাষি আবদুর রহিম। ১২ বছর ধরে লবণ চাষ করে সংসার চালান তিনি। তবে বাজারে এই গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপণ্যের দাম কম হওয়ায় তিনি হতাশ।

শ্রম আর মজুরি কোনোটাই ঠিকঠাক যাচ্ছে না জানিয়ে রহিম বলেন, ‘গতবার অনুকূল আবহাওয়ায় দেশে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছিল। তবে আগের মৌসুমের অপরিশোধিত লবণ অবিক্রীত থাকায় এ বছর বাজারে এর দাম কমে গেছে। যার ফল আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।’

আবদুর রহিম জানান, তিনি এক পাইকারের কাছে লবণ বিক্রি করেছিলেন। আগামীতে দাম আরও বাড়বে এই আশায় গত মৌসুমে ১ হাজার মণ লবণ মজুদ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘তিন মাস আগে যে দাম পেয়েছিলাম এখন তাও পাচ্ছি না। তখন মণপ্রতি লবণের দাম ছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। এখন প্রতি মণ লবণ ৩১০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে প্রায় ১ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’

লবণশ্রমিক বাহাদুর শাহ। বাড়ি কুতুবদিয়ায়। প্রতি মৌসুমে কাজ করতে সদরের চৌফলদন্ডীতে আসেন। লবণের দাম না থাকায় তিনি এখন মূল্যহীন। অন্য শ্রমিকদের অবস্থাও তার মতো। তাই ক্ষোভে তিনি কথাই বলতে পারছিলেন না। তার মতে, দেশের সব পণ্যের ন্যায্যমূল্য আছে, শুধু লবণের বেলায় নেই।

সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের চাষি নান্নু মিয়ার কণ্ঠেও একই সুর। তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়, তাতে দেশের চাহিদা মিটে যায়। তারপরও একটি চক্র লবণ আমদানি করে। আবার আরেকটি চক্র লবণ মজুদ করে কালোবাজারি করে। সব সংগ্রাম লোকসান লবণশ্রমিকের। কিন্তু তারাই বঞ্চিত।’

জানা গেছে, গত বছর দেশে ২৪ লাখ ৩৮ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়, যা গত ৬২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবারও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উপকূলীয় এই জেলার অনেকে লবণ চাষে আগ্রহী নন। বিশেষ করে অনেকের হাতে অবিক্রীত লবণ মজুদ আছে।

গত রবিবার চৌফলদন্ডী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কালো পলিথিনে ঢাকা লবণের স্তূপ মাঠজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চাষিরা জানিয়েছেন, নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত ছয় মাস লবণের মৌসুম। তাদের হাতে আগের মৌসুমের লবণ আটকে আছে।

কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের পাইকারি বিক্রেতা সরওয়ার কামাল বলেন, ‘চাষিদের কাছ থেকে প্রতি মণ লবণ ৩১০ টাকায় কিনেছি। এরপর লবণ কারখানায় সেগুলো মণপ্রতি ৪০০ টাকায় বিক্রি করেছি। পরিবহন ও শ্রমিকদের খরচ বিবেচনায় নিলে প্রতি মণে মুনাফা হয়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা।’

তিনি জানান, আগের মৌসুমের লবণ মজুদ থাকায় কারখানাগুলো এবার বেশি দামে কিনতে রাজি হয়নি। সরওয়ার কামাল মনে করেন, ‘বাজারের যে অবস্থা তাতে বোঝা যায় নতুন লবণের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম হবে।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি) সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের ৬৯ হাজার একর জমি থেকে ২৬ লাখ টন অপরিশোধিত লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ২৫ লাখ টন।

ন্যায্য বেতন মেলে না বেকারি শ্রমিকদের

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ০২:২৬ পিএম
ন্যায্য বেতন মেলে না বেকারি শ্রমিকদের
ছবি: খবরের কাগজ

ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের তেরোছিড়া গ্রামের বাসিন্দা আহমদ আলী। তার দুই ছেলে আশরাফুল ইসলাম (১৯) ও ইজাজুল ইসলাম (২১) চাকরি করেন ময়মনসিংহ শহরের হক বেকারিতে শ্রমিক হিসেবে। আশরাফুল সাত বছর ধরে ও ইজাজুল ১০ বছর ধরে এই কারখানায় কর্মরত আছেন।

সরেজমিনে কারখানাটিতে গিয়ে দেখা যায়, অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে দুই ভাই বিস্কুট ও বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরিসহ প্যাকেটিং করে থরে থরে সাজাচ্ছেন। ব্যস্ততার কারণে দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের। চেয়ারে বসে ম্যানেজার সবকিছু দেখভাল করছেন। এ সময় কথা হয় শ্রমিকদের সঙ্গে। তারা জানান, সারা বছর বিরামহীনভাবে কাজ করেন তারা। কাজের দক্ষতা, বয়সের পার্থক্য, কাজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে একেকজন একেক রকম বেতন পান।

শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কাজ শুরুর প্রথম এক মাসে মাত্র ৫০০ টাকা বেতন পেয়েছি। ধীরে ধীরে বেতন বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ৯ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। নিজের খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঘুমানোর সময় ছাড়া সারাক্ষণ কাজ করি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও ন্যায্য বেতন পাচ্ছি না। তবে এসব বলে চাকরি হারাতে চাই না।’

আশরাফুলের বড় ভাই একই কারখানার শ্রমিক ইজাজুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সময়ে যে টাকা বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চলে না। এই টাকা নিজেদের জন্য খরচ করতে হয়, পরিবারের খাবার-দাবারে খরচ হয়। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম চড়া, খরচও হয় বেশি। বাবা-মায়ের অসুখ-বিসুখেও খরচ করতে হয়। বেতন আরও বাড়লে আমাদের জন্য ভালো হতো। কিন্তু মালিককে এ নিয়ে কিছু বলি না। কারণ বললে চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।’

কারখানার ম্যানেজার আনারুল ইসলাম জানার, হক বেকারিতে অর্ধশতাধিক শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে রাতে ১৫ জন কাজ করেন। মালিকপক্ষ বেতন নির্ধারণ করেছেন। তাই এ নিয়ে তার কোনো বক্তব্য নেই। এ বিষয়ে কারখানার মালিক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কাজের ধরনসহ কে কতক্ষণ কাজ করে সেই অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে মাঝেমধ্যেই শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে। পরে আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।’ 

কলকারখানা অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপমহাপরিদর্শক আহমাদ মাসুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা বিভিন্ন ধরনের কারখানায় নিয়মিত পরিদর্শন করে আসছেন। শ্রমিকদের মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। 

সেজন্য আমরা কাজ করছি। কোনো কোনো কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেন না এবং শিশুদের দিয়ে বড়দের মতো কাজ করাতে চেষ্টা করছেন। সেসব কারখানার তালিকা করতেও কাজ চলছে। ন্যায্য মজুরি থেকে কোনো কারখানার মালিক শ্রমিকদের বঞ্চিত করছে, এমন প্রমাণ মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মজুরিতে বিস্তর ফারাক বিড়ি শ্রমিকদের

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ০২:০৯ পিএম
মজুরিতে বিস্তর ফারাক বিড়ি শ্রমিকদের
ছবি: খবরের কাগজ

বরিশালের অমৃত লাল দের কারিকর বিড়ি দেশে হাতে তৈরি বিড়ি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম একটি। কোম্পানির নগরীতে তিনটি, উজিরপুর উপজেলায় একটি এবং ঝালকাঠি জেলায় চারটি শাখা রয়েছে। এসব শাখায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু বৃহৎ এই শ্রমিক গোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নেই কোনো ব্যবস্থা। 

ফলে অধিকাংশ শ্রমিক নানা রোগে ভুগছেন। অন্যদিকে মজুরি নিয়েও বৈষম্য রয়েছে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শ্রমিকদের মধ্যে। শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে পরিচালিত কারখানায় প্রতি হাজার বিড়ি তৈরিতে ৫৫ টাকা মজুরি পার্থক্য রয়েছে এই দুই শ্রেণির শ্রমিকের মধ্যে। গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মজুরিবৈষম্য নিয়ে মালিকপক্ষের নেই কোনো নজরদারি। আবার এ নিয়ে মালিকপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে, এমন নজিরও দেখা যায় না।

জানা যায়, ১৯৪৮ সালে গড়া অমৃত লাল দের কারিকর বিড়ির কারখানার ৮টি শাখায় প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে নারীশ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি। মজুরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য দেখা না গেলেও নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শ্রমিকদের মধ্যে মজুরির বিস্তর ফারাক রয়েছে। কারখানাটির নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজার ৭০০ জন। অনিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছে ৫ হাজারের বেশি। নিবন্ধিত শ্রমিকরা প্রতি হাজার শলাকা বিড়ি তৈরিতে কোম্পানি থেকে ৯১ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। অনিবন্ধিত শ্রমিকরা প্রতি হাজারে মজুরি পান ৩৪ টাকা। এর মধ্যে প্রতি শলাকার জন্য রোল তৈরিতে ১৬ টাকা, রোলে তামাক ভরার জন্য ১৬ টাকা এবং প্যাকেজিংয়ের জন্য ৩ টাকা। সেই হিসেবে প্রতি শলাকার জন্য অনিবন্ধিত শ্রমিকদের মজুরি শূন্য দশমিক ৩৬ পয়সা। আর নিবন্ধিত শ্রমিকদের মজুরি শূন্য দশমিক শূন্য ৯১ পয়সা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর সাধুর বটতলা শাখার এক শ্রমিক জানান, অধিকাংশ নিবন্ধিত শ্রমিক নিজেরা বিড়ি তৈরির কাজ করেন না। তারা চুক্তিতে অনিবন্ধিত শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে প্রতি হাজার শলাকা দিয়ে ৫৫ টাকা আয় করেন। কারখানার শ্রমিক নেতা শেখ সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দৈনিক কিংবা মাসিক মজুরিতে এখানে কাজ হয় না। বিড়ির শলাকা তৈরির পরিমাণের ওপরে মজুরির টাকা পরিশোধ করা হয়। কর্ম দক্ষতার ওপর নির্ভর করে কেউ প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারেরও বেশি শলাকা তৈরি করেন। ৪ থেকে ৫ হাজারও তৈরি করেন। সেই হিসেবে প্রতিদিনের টাকা পরিশোধ করা হয়। অনিবন্ধিত শ্রমিকরা সরাসরি কোম্পানি থেকে উপকার নিতে পারেন না। তারা নিবন্ধিত শ্রমিকদের হয়ে কাজ করেন।’

অনিবন্ধিত শ্রমিক রিনা বেগম (৪২) বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ধরে এখানে অনিবন্ধিত শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার বিড়ির তৈরি করি। কোনো কোনো দিন বেশিও তৈরি করি। এতে মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় হয়।’ বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘বাজারে হাতে তৈরির বিড়ির চাহিদা অনেকাংশে কমে গেছে। ফলে কারখানায় উৎপাদনও কম। তাই মজুরি তেমন একটা বাড়ছে না।’ 

কারিকর বিড়ির পরিচালক রাহুল দে বলেন, ‘কারখানাগুলো স্থানীয় ইউনিয়ন শ্রমিকদের দিয়ে পরিচালিত হয়। কোম্পানি কেবল বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহ করে। তারপরও কোনো অভিযোগ পেলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করি।’

জাহাজভাঙা ২ শ্রমিকের দুঃখগাথা

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ১২:২৫ পিএম
আপডেট: ০১ মে ২০২৫, ০২:১০ পিএম
জাহাজভাঙা ২ শ্রমিকের দুঃখগাথা
জাহাজ কাটতে আহত হওয়া মিজান হোসেন তার দুই সন্তানকে নিয়ে বসে আছেন। ইনসেটে আহত আবু মুছা। ছবি: খবরের কাগজ

মাটির ঘরটি খসে খসে পড়ছে। বাঁশের বেড়াও নড়বড়ে। টিনগুলোতে মরিচা পড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেকোনো মুহূর্তে পুরো ঘরটি উড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ঘরে আসবাবপত্র বলতে পুরোনো একটি খাট, টেবিল আর কমদামি খাঁচা ফ্যান।

দুই সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘরের চৌকাঠে একজন বসে আছেন। মাঝে মধ্যে পিঠের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। তার নাম মিজান হোসেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামের এই তরুণ মাত্র ১৪ বছর বয়সে জীবনসংগ্রামে নামেন। বাড়ির পাশের শিপইয়ার্ড ম্যাক করপোরেশনে শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দেন। সেখানে একযুগ কাজ করার পর তাকে একই কোম্পানির এপিএস করপোরেশনে কাটারম্যান হিসেবে বদলি করা হয়। 

২০২৪ সালের ১২ মে বিকেল। গ্যাসের মাধ্যমে জাহাজ কাটতে গিয়ে তিনি প্রায় ২০ ফুট উপর থেকে সাগরের বালুচরে পড়ে যান। এরপর তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হলেও ভালো চিকিৎসা পাননি। পরে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। কর্মরত প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিপূরণ চেয়ে ব্যর্থ হন। শেষশেষ শ্রম আদালতে তাকে মামলা করতে হয়।

একপর্যায়ে গত বছরের ২৮ আগস্ট তাকে মাত্র এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। অথচ শ্রম আইন অনুযায়ী তাকে আড়াই লাখ টাকা দেওয়ার কথা। একই সঙ্গে এক বছরের বেতনসহ আরও দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ও ছুটি দেওয়ার কথা। সেই হিসেবে মিজান সাড়ে চার লাখ টাকা পাবেন। গত এক বছর ধরে তিনি ফুলটাইম কোনো কাজ করেন না। দুই সন্তান, স্ত্রী, ভাবি, মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যেদের নিয়ে পড়েছেন চরম বেকায়দায়। মিজান ভারী কিছু বহনে অক্ষম। ঘুমাতে হলে তাকে বেল্ট পরতে হয়। কবে নাগাদ সুস্থ হবে তাও তিনি জানেন না। 

মিজান বলেন, ‘শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ খুবই প্রভাবশালী। এ ছাড়া তারা হুমকি দিয়েছে। তাই দাবি আদায়ের যুদ্ধ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। বড় ভাই ছয় মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এতে পুরো সংসারের চাপ এসে আমার ওপড়ে পড়েছে। কিন্তু এখন আমিই পঙ্গু। চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ কিছুই পাইনি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে চাচার দোকানে সময় দিই। উনার দেওয়া সামান্য সহযোগিতায় পরিবার কোনোমতে চলছে।’ কথা বলতে বলতে মিজানের চোখ ভিজে যায়। বলেন, ‘আমি না মরে বেঁচে আছি। পরিবারকেও মারছি।’

মিজানের মতোই গল্প আবু মুছার। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়। তিনি পাইপ ফিটার বিভাগে কাজ করতেন। শিপইয়ার্ডে তার কাজের অভিজ্ঞতা ১২ বছরের। এই কাজের একপর্যায়ে তিনি বিদেশে পাড়ি জমান। দেশে এসে সীতাকুণ্ডের আকিলপুরে বিয়ে করেন। তিন বছর আগে ম্যাক করপোরেশনের মালিক মাস্টার আবুল কাশেমের ভাই হাশেমের শিপইয়ার্ডে কাজ নেন। হঠাৎ করেই জাহাজের ওপর থেকে পড়ে তিনি মারাত্মক আহত হন। তার ডান পা ভেঙে ও থেতলে যায়। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওইদিন মুছাকে মৃত ভেবে, বাড়ি দূরে বলে ইয়ার্ডে দীর্ঘসময় ধরে ফেরে রাখা হয়েছিল। পরে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে মেঝেতে বিনা চিকিৎসায় রেখে দেওয়া হয়। এরপর স্থানীয়রা শিপইয়ার্ড ঘেরাও করলে তাকে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার ডান পায়ে দুটি রড ও ১৪টি নাট লাগানো হয়। দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় আবু মুছাকে। সেই হিসাবে তিনিও আইন অনুসারে ক্ষতিপূরণ পাননি। দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বেকার। এক জোড়া রড ও ডজনের বেশি নাটবোল্ট শরীরে বহন করছেন। বর্তমানে পরিবার নিয়ে আছেন চরম বেকায়দায়। তবে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার স্বামী যখন পায়ে আঘাত পান তখন আমি অন্তঃসত্ত্বা। সীমাহীন কষ্টে পড়ে যাই। একদিকে নিজে অসুস্থ, অন্যদিকে স্বামী মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সেই দিনগুলো কোনো দিন ভুলব না। আমার স্বামী এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি।

সামনে তার পায়ের রডগুলো খুলতে হবে। মালিক বলেছেন খরচ দেবেন। হয়তো চক্ষু লজ্জায় আমার স্বামী আপনাদের সঙ্গে কথা বলছেন না। জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক তপন দত্ত বলেন, শিপইয়ার্ড মালিকরা আমাদের একাধিক বৈঠকে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করার কথা জানালেও বাস্তবে তা হয়নি।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক শিপন চৌধুরী বলেন, বর্তমানে ৩৫টি ইয়ার্ড থাকলেও ২৫টিতে জাহাজ আছে। সবকটি ইয়ার্ডে আনুমানিক সাড়ে দশ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মজুরি রোয়েদাদ বাস্তবায়ন, ক্ষতিপূরণ আদায়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা ঠিক রাখতে আমরা কাজ করছি।

নওগাঁয় কৃষিতে মজুরিবৈষম্য

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ১১:১১ এএম
আপডেট: ০১ মে ২০২৫, ০২:১২ পিএম
নওগাঁয় কৃষিতে মজুরিবৈষম্য
নওগাঁ বাইপাস সড়কের একটি চালকলে কয়েকজন নারী ধান নাড়ানোর কাজ করছেন। ছবি: খবরের কাগজ

কৃষিপ্রধান জেলা নওগাঁ। বিশেষ করে ধান-চাল উৎপাদনের জন্য এ জেলার খ্যাতি রয়েছে। মাঠে ধানের চাষাবাদ থেকে শুরু করে কাটা, মাড়াই কিংবা চাতালে চাল উৎপাদন- সবগুলো কাজের সঙ্গে ৩০ শতাংশ নারী শ্রমিক জড়িয়ে আছেন। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা কৃষি কাজ করেন। কিন্তু ন্যায্য মজুরি থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়। পুরুষের সমান কাজ করলেও তাদের অর্ধেক মজুরি দেওয়া হয়।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, নওগাঁ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০০ চালকল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নারী শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত সাড়ে তিন হাজার।

নওগাঁ বাইপাস সড়কের পাশে বেশ কয়েকটি বড় রাইস মিল রয়েছে। চালকলগুলোতে নিয়োজিত শ্রমিকের বেশির ভাগই নারী। তাদেরই একজন কোহিনূর বিবি। জানালেন, প্রতিদিন ভোর থেকে তীব্র আগুনের তাপ সহ্য করে ধানসিদ্ধ করার চুল্লির পাশে বসে তাকে কাজ করতে হয়। সূর্য উঠার পর সেই ধান চাতালে বিছিয়ে শুকানোর কাজ করেন। দিনভর প্রখর রোদের মধ্যেই চাতালে অন্তত ১৫ থেকে ২০ বার বিছানো ধানে পারা দিতে (পা দিয়ে নাড়িয়ে দেওয়া) হয়। এমন হারভাঙা খাটুনির পর তিনি পান মাত্র দুই থেকে আড়াই শ টাকা। অথচ একজন পুরুষ শ্রমিক দিন হাজিরা হিসেবে ৬০০ টাকা করে পাচ্ছেন। 

কথা হয় আরও কয়েকজন নারী শ্রমিকের সঙ্গে। তাদের অবস্থাও কোহিনূরের মতো। নিজেদের সঙ্গে হওয়া বৈষম্যের কথা ফুটে উঠে তাদের কণ্ঠে। তারা জানান, একেকটি মাঝাড়ি আকারের চাতালে ২০ জন নারী শ্রমিক প্রতিদিন প্রায় ২০০ মন ধান সেদ্ধ ও শুকানোর কাজ করেন। কিন্তু বৈষম্যের কথা মালিকপক্ষকে বলে লাভ হয় না। প্রতিবাদ করলে চাকরি থাকে না।

এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চাকদার বলেন, ‘চাতালে নারী শ্রমিকরা খণ্ডকালীন এবং তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে থাকেন। ধান শুকানোর কাজটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে হয় না। তাই চুক্তির ভিত্তিতেই কাজটি করানো হয়। ১৫ থেকে ২০ জনের একেকটি নারী শ্রমিকের দল চাতালে ধান শুকানোর কাজ করেন। ভালো রোদ থাকলে সেদ্ধ ধান এক দিনেই শুকানো যায়। এতে ২০০ মন ধান সেদ্ধ হলে দেখা যায় জনপ্রতি শ্রমিকরা সাড়ে তিন শ টাকার সমপরিমাণ খুদ ও নগদ ১০০ টাকা, সব মিলিয়ে সাড়ে ৪০০ টাকা পেয়ে থাকেন। কখনো এর বেশিও পান।’
 
অন্যদিকে চাষাবাদের মাঠগুলোতে কাজ করেও নারী শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নওগাঁ জেলার বেশির ভাগ মাঠেই নারীদের কৃষি কাজ করতে দেখা যায়। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা সারা বছর জমিতে ফসল উৎপাদন করেন। চারা রোপণ, নিড়ানি ও অন্যান্য পরিচর্যা এবং ধান কাটার কাজ করে থাকেন। দিন হাজিরা হিসেবে তাদের মজুরি দেওয়া হয় ৩৫০ টাকা।

মহাদেবপুর উপজেলার উত্তরগ্রামের নারী কৃষি শ্রমিক মিনারা হাসদা বলেন, ‘মাঠে পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি কম পাচ্ছি। বছরের পর বছর এভাবেই হয়ে আসছে।’ 

একই এলাকার কৃষক আনোয়ার হোসেনের কাছে নারী কৃষি শ্রমিকের মজুরিবৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নারীরা মাঠে ছয় ঘণ্টা কাজ করে। ফলে তারা পুরুষের তুলনায় মজুরি কম পান।’

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘নওগাঁ জেলায় ফসলের খেত ও রাইস মিলগুলোতে কর্মরত প্রায় শতভাগ শ্রমিকই মৌসুমভিত্তিক খণ্ডকালীন ও চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন। তাই তারা নির্ধারিত কাঠামোতে মজুরি পান না। তবুও তাদের মজুরির বিষয়ে বিশেষ করে মিলমালিকদের বিভিন্ন সময় তাগাদা দেওয়া হয়।