আগস্টের প্রথম সপ্তাহের দিনগুলো যেন আগের জুলাই মাসেরই অংশ ছিল। ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচিতে ব্যস্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারোরই যেন ক্যালেন্ডারের ওই পরিবর্তনের দিকে তাকানোর সময় বা মনোযোগ কোনোটাই ছিল না। তাদের শুধুই খেয়াল সরকারের অনড়, একরোখা, কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরুদ্ধে পাহাড়সম প্রতিবাদ গড়ে তোলার দিকে। এসময় খুব দ্রুতই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হতে থাকে। আগের দিন ডাক দেওয়া ‘অসহযোগ’ আন্দোলন ৩ আগস্ট রূপ নেয় সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি হিসেবে।
সমন্বয়করা ওইদিন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করতে দেশবাসীকে আহ্বান জানান। পরদিন ৪ আগস্ট সারা দেশে শুধু লাশ আর লাশ। বয়ে যায় তাজা রক্তের বন্যা। ক্ষোভে ফেটে পড়া ছাত্র-জনতার একটাই দাবি- স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যাগ। কী হয়, কী না হয়! এ ভাবনা-দুশ্চিন্তায় দেশবাসীর একটি দীর্ঘ রাত অতিক্রম শেষে ৫ আগস্ট সকাল থেকেই শুরু হয় স্বস্তির বৃষ্টি, ভারী বৃষ্টি। রক্তে রঞ্জিত রাজপথ বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলেও দুপুরের পর রাজপথে মানুষের ঢল নামে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মাথায় পৌনে বেলা ৩টার দিকে ভয়ে সরকারপ্রধান তার রাষ্ট্রীয় বাসভবন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যান।
রাজপথে অবস্থানরত ছাত্র-জনতা স্বজন হারানোর বেদনা-হাহাকার বুকে নিয়েও খুশি হয় এই ভেবে যে, গুলিতে আর কোনোও প্রাণ যাবে না। সেনাবাহিনী তখনকার ওই সরকারের তাঁবেদারি না করে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ায়। অতঃপর আন্দোলনকারীদের আহ্বান ও দাবি অনুযায়ী নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন।
ড. ইউনূস দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেন, ‘এ অর্জন তরুণদের। নতুন প্রজন্মের। বাংলাদেশের তরুণরা বিশ্বে এক নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব আমাদের এ তরুণদের কাছ থেকে শিখবে। তরুণদের সঙ্গে নিয়ে আমি একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই। এখানে থাকবে না শোষণ, নিপীড়ন, দারিদ্র্য, অবিচার ও নির্যাতন।’ শুরু হয় এক নবযাত্রা।
কয়েক শ নারী-শিশু, ছাত্র-জনতার রক্তে স্নাত এ নবযাত্রায় অন্তর্বর্তী সরকারকে বিগত সময়ের পুঞ্জীভূত সমস্যা, ক্ষোভ ও বঞ্চনার নজিরবিহীন বহিঃপ্রকাশ সইতে হয়েছে সুদীর্ঘ একটি মাস। পথে পথে বিক্ষোভ-সমাবেশ, শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, শিক্ষালয়সহ সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা, কূটনৈতিক পর্যায়ে বৈদেশিক সম্পর্কে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া এবং সবশেষ আনসার বাহিনীর একটি অংশের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস- এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকারের এগিয়ে চলার দৃপ্ত-বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে আশাবাদী অনেকেই।
বিগত এক মাস পররাষ্ট্রনীতির সুস্পষ্ট বার্তা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরানোসহ রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও হত্যা-নির্যাতনের বিচারকাজ শুরু করতে আইনি ব্যবস্থাকে ইতিবাচক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন বিগত সরকারের তীর্যক সমালোচক, রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক বিশ্লেষকরা।
দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে গত ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ গঠনের ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিশ্লেষকরা বলেছেন, এ শ্বেতপত্রে ‘মেগা প্রকল্প’ নিয়ে পর্যালোচনা করাসহ আর্থিক খাত (ব্যাংক ও পুঁজিবাজার) এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হলে জাতির জন্য পরবর্তী কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সুবিধা হবে। এ বিষয়ক সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কমিটির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নব্বই দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেবেন।
খবরের কাগজের সঙ্গে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস’ সম্পর্কে ধারণা প্রকাশ করতে গিয়ে সমালোচক, রাজনীতিক ও আর্থসামাজিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, সামনের দিকে তাকাতে হবে, এগিয়ে চলার দিন এসেছে। মানুষের অভাব-দারিদ্র্য এখন স্পষ্ট। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ছে। শিল্প-কারখানার উদ্যোক্তারা আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। কর্মসংস্থানের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব কিছুতেই মনোযোগ দিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, প্রথম ৫০ বা ১০০ দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজে হাত দেওয়া হলে তার সুফল পাওয়া যাবে সব ক্ষেত্রে। তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক কাজগুলো কার্যত সঠিক ধারায় রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চায় দেশবাসী। বিগত সরকারের শেষ দুই বছর দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এতে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ভাত-মাছ ও ডালপ্রিয় দেশবাসী যেন সাধ্যের মধ্যে নিজের ও পরিবারের খাবার গ্রহণ করতে পারে সেই দাবিটি পূরণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
সাবেক সচিব ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এটা তো স্বীকার করতে হবে যে- একটা ‘অভূতপূর্ব’, একটা ‘অশ্রুতপূর্ব’ বিপ্লব হয়েছে। বিগত সরকারের যে কর্মকাণ্ড- তা ছিল অবিচার, অত্যাচার, অনাচারে পরিপূর্ণ। সে কারণেই মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ-হতাশা কাজ করছিল তার একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এটা অনেকটাই অনিবার্য ছিল।’
তার মতে, এখন যারা বিপ্লবটা করল তারা তো ছাত্র। এদের সঙ্গে ছিল বিগত সরকারের সময়ে সুবিধাবঞ্চিত, অন্যায়-অবিচারের শিকার হওয়া লোকজন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিপ্লবী এসব মানুষের সঙ্গে যোগ হয়েছে সুযোগসন্ধানী কিছু লোক ও গোষ্ঠী। এরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। এই সুযোগসন্ধানীরা খুবই ভয়ংকর, রক্তস্নাত বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত (অন্তর্বর্তী) সরকারের জন্য হুমকি। এই সুযোগসন্ধানীদের দমন করতে হবে শক্ত হাতে। এদের যদি দমন করা না হয় কিংবা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব হয় তাহলে অরাজকতা বাড়বে। এজন্য সবার আগে দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর গণমানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। এ কাজটি সহজ নয়।
সরকারের হুকুম মানতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দলীয় পরিচয় ধারণ করেছে, পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়ে একের পর এক বিতর্কিত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা ফেরানোর কাজটি কঠিন। তার পরও এসব বাহিনীকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব এটি করা জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথম ৫০ দিনের মধ্যে এটা করে দেখানো উচিত।
গোলাম রহমান বলেন, ‘এর পরই যে কাজে হাত দেওয়া দরকার সেটি হলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হওয়া। অর্থনীতি এমনিতেই একটি মন্দ সময় পার করছিল। এরই মধ্যে রাজনৈতিক এ পরিবর্তনটা ঘটে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারে যারা অছেন তাদের বেশির ভাগই অর্থনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ। তাদের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশাটাও তাই বেশি। এ আস্থা ও বিশ্বাসের প্রমাণ তারা দেবেন এ ভরসা করা যায়। মোটাদাগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আনা ও অর্থনীতিতে ছন্দ ফেরাতে পারলে গণমানুষের আস্থা অর্জনে অন্তর্বর্তী সরকার যেমন সব মহলের আনুকূল্য পাবে তেমনি অন্য সব সমস্যাও দূরীভূত করার ক্ষেত্রে গতি আনতে প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্মও দ্রুত তৈরি হয়ে যাবে।’
অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়নকর্মী এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘একাত্তরের যে চেতনা তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু নেই এবার। যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো জনগণের প্রত্যাখ্যাত সরকার আমাদের একটা নষ্ট সমাজ দিয়ে গেছে। আমাদের অনেকগুলো সমস্যা ছিল তখনো কিন্তু সমাজে নানারকম অপকর্ম, ধর্ষণ-গুম-খুন, এসব তো ছিল না। এ সবকিছুই আজকের তরুণদের জীবনবাজি রেখে পথে নামতে বাধ্য করেছে। পরিণতি যা হওয়ার তাই হলো।’
তিনি বলেন, ‘এখন সামনের দিকে তাকাতে হবে। সরকারকে তার কাজের একটি প্রায়োরিটি লিস্ট (অগ্রাধিকার তালিকা) করতে হবে। জরুরিভিত্তিতে যা করা দরকার তাই সবার আগে করতে হবে। পুলিশের তৃণমূল পর্যায়ে বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবা দিতে (সার্ভিস ডেলিভারি) জনগণের প্রতি আচরণগত পরিবর্তন হয়নি। এ অভিযোগও উঠে আসছে খুব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যা ঘটেছে তা নজিরবিহীন, অতীতে ব্যাপক অনিয়ম-অবিচার হয়েছে। প্রশাসনেও প্রায় একই অবস্থা। দলীয় নিয়োগ, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারের ঘটনা হয়েছে অহরহ। যেসব কাজ জরুরি নয়, সেগুলো চলতে থাকুক। এসব কিছুতে এখনই হাত দেওয়ার দরকার নেই।’
তিনি বলেন, একটা চরম দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। দুর্বৃত্তায়ন, মানুষের অধিকার হরণ, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া- এসব করে একটা চরম কর্তৃত্ববাদী, কেউ কেউ বলে ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে পুরো দেশটাকেই একটা কারাগারে পরিণত করেছিল ৫ আগস্টে প্রত্যাখাত সরকার।’
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি আবারও বলব, বিগত সরকারের সময়ে একটা নষ্ট সমাজ সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। নতুন প্রজন্ম এটি আর নিতে পারছিল না। এই নতুন প্রজন্মের জন্য সরকার আশাব্যঞ্জক বিকল্প কিছু দিতে পারেনি। তাই একাধারে ছাত্র-জনতা তথা নাগরিকরা জেগে উঠে একটা দুষ্ট সরকারকে উৎখাত করেছে। এখন যেখানে অন্যায় সেখানেই নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে, এক হয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের মালিক হলো সোজা কথায় জনগণ। কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়।’
গোলাম রহমান ও বদিউল আলম মজুমদার- দুজনই বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং এরপরই অর্থনীতিকে মেরামত করার কাজে হাত দেওয়া। তবে, এর সঙ্গে যারা অপরাধী, তাদের আইনগত প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনতে হবে। অপরাধী ও দুষ্কৃতকারীদের কোনো ছাড় নয়। এ ছাড়া, যাদের আত্মত্যাগে আজকের এই পরিবর্তন, এই অর্জন, তাদের পরিবারকে সহায়তা করা, যারা বেঁচে আছেন কিন্তু চিকিৎসার প্রয়োজন তাদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সে ব্যবস্থা করা দরকার। সরকার এটি রাষ্ট্রের কোষাগারের শক্তি বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারে। এর পর, যে এজেন্ডা নিয়ে সরকার এগোতে চায় সেটি হলো সার্বিক সংস্কার। আর তা তড়িঘড়ি করে নয় বরং সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ অনুসন্ধান ও প্রতিবেদন নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।