ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-উত্তর বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার। সংস্কারের তালিকায় নগরায়ণ ও নগর উন্নয়ন প্রসঙ্গ এখনো বিবেচিত হচ্ছে না। নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, বিচার বিভাগ, পুলিশ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ের মতো জরুরি না হলেও নগরায়ণ ও নগর উন্নয়নের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া সমীচীন মনে করি।
জাতীয় উন্নয়নের নানা বিষয়ে সংস্কার অবশ্যই এক চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে উন্নয়নে পাঁচশালা পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি বিশশালা কৌশল পরিকল্পনা ও শতবর্ষী বদ্বীপ পরিকল্পনার কথাও জানা আছে।
বর্তমান সংস্কার আলোচনার মুখ্য বিষয় বৈষম্য দূর করা ও মানবিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা। নগরায়ণ ও নগর উন্নয়ন পর্যালোচনাতেও এই দুই মুখ্য বিষয় গুরুত্ব পাবে।
নগরায়ণ বলতে বোঝানো হয়, দেশের জনসংখ্যার গ্রামীণ থেকে নগরীয় বা শহুরে হওয়ার প্রক্রিয়া। নগরায়ণের মুখ্য বৈশিষ্ট্য কৃষিপ্রধান অর্থনীতি থেকে অকৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, অর্থাৎ শিল্পনির্ভর উৎপাদন, পেশা ও সেবা বা ব্যবসাবাণিজ্য, পরিষেবা ইত্যাদির প্রসার। অকৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ড শহর ও নগরে কেন্দ্রীভূত হয় ও ক্রমশঃ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির তুলনায় অকৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। যেমন- বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে নগরায়ণ মাত্রা (অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার নগরীয় অংশের মাত্রা) ছিল ৫ শতাংশের মতো, অর্থনীতির মোট আকার ছিল খুবই সীমিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই মাত্রা দাঁড়িয়েছিল ৮ শতাংশে (১৯৭৪), অর্থনীতি কিছুটা উন্নত হয়। বর্তমানে নগরায়ণের মাত্রা ৩৫ শতাংশের মতো, অর্থনীতির আকার অনেকটাই সমৃদ্ধ, জিডিপি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের ওপর। এর প্রায় ৬৫ ভাগই নগর অর্থনীতির অবদান। অর্থাৎ নগরায়ণের সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটা ইতিবাচক সম্পর্ক আছে, বিশ্লেষকরা এমন উপসংহার টানেন।
কিন্তু সমস্যা হলো এই সমৃদ্ধি দেশের মধ্যে আঞ্চলিকভাবে মোটেও সমতাভিত্তিক নয় বরং প্রচণ্ডভাবে বৈষম্যপূর্ণ। বিভাগওয়ারি বৈষম্য যেমন রয়েছে, তেমনি জেলাভিত্তিক বৈষম্য আরও বেশি দৃশ্যমান। জেলা জিডিপির সাম্প্রতিক তথ্য আমাদের হাতে নেই, কিন্তু কয়েক বছর আগের তথ্যে দেখা যায়, কোনো কোনো জেলা, যেমন- ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা জিডিপিতে অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে ঢাকার নগরায়ণের মাত্রা অতি উচ্চ, ৯০ শতাংশেরও বেশি। আর বেশকিছু জেলা, যেমন- গাইবান্ধা, বরগুনা খুব পিঁছিয়ে। জিডিপিতে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলো নগরায়ণ মাত্রাতেও খুব পিছিয়ে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অপর এক সূচকে মনে করা হয়, জেলাভিত্তিক দারিদ্র্যমাত্রার তথ্যকে। এখানে দেখা যায়, নগরায়ণ মাত্রায় পিছিয়ে থাকা জেলাগুলো, যেমন- কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, শরীয়তপুর ইত্যাদি দারিদ্র্য মাত্রায় এগিয়ে।
বৈষম্যবিরোধী ভবিষ্যৎ সংস্কার চিন্তায় এ ধরনের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া বা দারিদ্র্যপীড়িত জেলা বা অঞ্চলের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের চিন্তা বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই অবশ্য শুরু। এ বিষয়ে আমরা কালানুক্রমিক ধারা বিবেচনা করতে পারি। যেমন- বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছিল:
* বিকেন্দ্রীভূত নগরায়ণ চিন্তা ও
* পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া।
’৯০-এর গণ-আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তাতে উপদেষ্টা প্রফেসর রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে ২৯টি টাক্সফোর্স গঠিত হয়েছিল, তার একটি ছিল নগরায়ণ বিষয়ক (যার আহ্বায়ক ছিলেন বর্তমান লেখক)। তাতেও আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল গ্রাম-শহর বৈষম্য হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণের। বিকেন্দ্রীভূত নগরায়ণের ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
নগরায়ণ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে একটি জাতীয় নগরনীতি প্রণয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করে, ২০১১ সালে এর খসড়া প্রণয়ন সম্পন্ন হয় ও একটি জাতীয় সেমিনারের মাধ্যমে তা উপস্থাপিত হয়। নীতিগতভাবে তা অনুমোদিতও হয়। কিন্তু খসড়াটি আবার পুনর্বিবেচনা করা হয়, নানাবিধ সংস্কার সুপারিশ করা হয়। এবং ২০২৪ সালে চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা হয়, অবশ্য সেটি এখনো অনুমোদিত হয়নি। অর্থাৎ অতি দীর্ঘ সময় ধরে নীতিমালাটি খসড়াই থেকে যায়। নীতিমালার মুখ্য বিষয় ছিল বিকেন্দ্রীভূত নগরায়ণ বাস্তবায়ন করা এবং সে লক্ষ্যে মেগাসিটি ঢাকার ‘অতিবৃদ্ধি’র (‘ওভার গ্রোথ’) হ্রাস টেনে ধরা, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহর তথা উপজেলা শহরের সমৃদ্ধির প্রতি নজর দেওয়া।
নগরায়ণে সংস্কার চিন্তার পূর্বশর্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এদিকে নগরায়ণ তার আপন গতিতে অপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হয়। যার ফল আমাদের জানা। আঞ্চলিক বৈষম্য প্রকটতর হয়।
নগরায়ণ সংস্কারের দ্বিতীয় যে প্রসঙ্গটি সূচনাতেই উল্লেখ করেছি তা হলো- ‘নগর উন্নয়ন’ বা নগর বিশেষের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন পরিস্থিতির কথা। যে তিনটি দলিল ও কার্যক্রমের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোতে নগর উন্নয়ন প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, এমনকি উপজেলা শহরের পরিকল্পনা ও উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। তাছাড়া ঢাকা ও অন্যান্য মহানগরের জন্য আধুনিক মহাপরিকল্পনাও তৈরি করা হয়েছে। কক্সবাজার শহরের জন্যও সম্প্রতি একটি অত্যাধুনিক মহাপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে।
সাধারণের কাছে যে বিষয়টি মনে হয়, তা হলো ঢাকাসহ আসলে কোনো শহরই ঠিকঠাক মতো চলছে না। ঢাকা তো রীতিমতো ‘অসম্ভব’ একটি শহর। নানা সংস্কার চিন্তা এই শহরকে নিয়ে অতীতে হয়েছে, হয়তো এখনো চলমান আছে, কিন্তু শহরের সমস্যা কমছে না, বরং বাড়ছে। বিশেষ করে এর পরিবহন ব্যবস্থায়। আসলে শুধু সংস্কার চিন্তাই নয়, সংস্কারের পরামর্শ মতো করণীয়সমূহের বাস্তবায়নটাই জরুরি। এর জন্য দরকার আধুনিক ও কার্যকর নগরব্যবস্থাপনা, প্রয়োজন দক্ষ জনবল, বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ পরিকল্পনাবিদ। একটি সুসংবাদ এই যে, বাংলাদেশে বিগত পাঁচ দশকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রায় ২৫০০ নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিদ সৃষ্টি হয়েছে। এরা অধিকাংশই তরুণ। নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় এদের ব্যবহার করতে হবে। তবে পাশাপাশি নগরব্যবস্থাপক বা প্রশাসক ও সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে দক্ষ, সৎ ও চিন্তাশীল হতে হবে। দক্ষ নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগরব্যবস্থাপকের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া মনে রাখতে হবে আধুনিক নগর উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তরুণ নাগরিকদের অংশগ্রহণ। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউটের তরুণ নেতৃত্ব প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
আধুনিক নগর নির্মাণে বৈষম্যবিরোধী চিন্তা অগ্রাধিকার পাবে। অবশ্য বর্তমান বাস্তবতা হলো আমাদের শহরগুলো, বিশেষত রাজধানী ঢাকা, অতিমাত্রায় বৈষম্যপূর্ণ শহর। এই শহরে দারিদ্র্য উচ্চমাত্রায় বিদ্যমান, অসংখ্য বস্তি এক চরম বাস্তবতা। মেগাসিটি ঢাকায় আর্থ-সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য প্রকট। আধুনিক নগরায়ণ ও নগর সংস্কারে বৈষম্য হ্রাসকরণ হোক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এ ছাড়া নগরায়ণ বিষয়ক সার্বিক চিন্তায় বিবেচনা করা যায় কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার:
১) জাতীয় নগরনীতি ২০২৪ (খসড়া)-এর সুপারিশ মতে, ব্যাপক অংশগ্রহণভিত্তিক একটি সমন্বিত জাতীয় নগর উন্নয়ন কাউন্সিল গঠন করা হোক।
২) একজন প্রবীণ প্রকৌশলী/নগর পরিকল্পনাবিদ (মো. নুরুল্লাহ) অতি সম্প্রতি তার একটি প্রবন্ধে সুপারিশ করেছেন একটি জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা কমিশন (‘ন্যাশনাল ফিজিক্যাল প্ল্যানিং কমিশন’) গঠনের কথা।
৩) পাশাপাশি বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউট (২০২৩ সালে) সুপারিশ করেছে স্থানিক পরিকল্পনা (‘স্প্যাশিয়াল প্ল্যানিং’) চিন্তা বাস্তবায়ন করার কথা।
৪) অন্যদিকে আমরা দেখি দেশে কমপক্ষে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকল্পনা শিক্ষাক্রম পরিচালিত হচ্ছে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা ‘আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং’ ডিগ্রি প্রদানের উদ্দেশে। ফিজিক্যাল প্ল্যানিং কিংবা স্প্যাশিয়াল প্ল্যানিং ধারণা নয়।
বিদ্যমান এই নানামুখী চিন্তা ও কার্যক্রমকে একটি ধারা বা প্রক্রিয়ায় আনয়ন করা সমীচীন। বর্তমান সংস্কার ভাবনায় বিষয়টি গুরুত্ব পাবে, আশা করছি। শুধু তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে সংস্কার ভাবনা বাস্তবায়ন হোক এমনটাই বর্তমান সময়ের দাবি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নগরবিদ